মাটি, মূর্তি ও মানস: অতীত ঐতিহ্যের নান্দনিক ছবি
Published: 6th, July 2025 GMT
জৈন তীর্থংকর ঋষভ দেব পদ্মাসনে বসে চক্ষু মুদে গভীর ধ্যানে নিমগ্ন। তাঁর ধ্যানমগ্ন মূর্তির দুই পাশে ও ওপরে–নিচে সারিবদ্ধভাবে ছোট ছোট কুঠুরির আকৃতির ভেতরেও জৈন সাধকদের ধ্যানমগ্ন মূর্তি। এই মূর্তি আবিষ্কৃত হয়েছিল রাজশাহীতে। জৈন তীর্থংকরদের মধ্যে ঋষভ দেব হলেন প্রথম তীর্থংকর। তথাগত গৌতম বুদ্ধের জন্মের ও পূর্বকালে তাঁর আবির্ভাব। পাথরে খোদিত মূর্তি থেকে ঋষভ দেবকে চিত্রকলায় জনসাধারণের সামনে তুলে এনেছেন তরুণ শিল্পী জারীন তাসনিম।
গত শুক্রবার থেকে উত্তরা ৭ নম্বর সেক্টরের ৫৫ লেক ড্রাইভ রোডের অ্যালবিয়ান আর্ট গ্যালারিতে শুরু হয়েছে জারীন তাসনীমের ‘মাটি, মূর্তি ও মানস’ নামের প্রথম একক শিল্পকলা প্রদর্শনী। উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে অতিথি ছিলেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের অধ্যাপক সুফি মোস্তাফিজুর রহমান, এশিয়াটিক সোসাইটির সাধারণ সম্পাদক অধ্যাপক সিদ্দিকুর রহমান ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা বিভাগের অধ্যাপক মোহাম্মদ শামিম রেজা।
‘মাটি, মূর্তি, মানস’ প্রদর্শনীটি বেশ আলাদা। উপমহাদেশের প্রাচীন ধর্ম, দর্শনের প্রবর্তক ও প্রচারক যেসব মহাজন কালজয়ী হয়ে আছেন, তাঁদের অনেক মূর্তি সংরক্ষিত আছে দেশের বিভিন্ন জাদুঘর ও প্রত্নস্থলে। আরও সংরক্ষিত রয়েছে বৈদিক, পৌরাণিক, লৌকিক অনেক দেবদেবীর বহু রকমের মূর্তি। আধ্যাত্মিকতা ছাড়াও এসব মূর্তির যেমন বিপুল প্রত্নতাত্ত্বিক গুরুত্ব রয়েছে, তেমনি রয়েছে এর নান্দনিক সৌন্দর্য। একেক মূর্তির আছে একেক রকমের গড়ন, ভিন্ন ভিন্ন বৈশিষ্ট্যে অনন্য এসব ভাস্কর্য। ধর্মীয় অনুভূতি ব্যতিরেকেই এসব ভাস্কর্যের সৌন্দর্য উপভোগ করেন সাধারণ দর্শকেরা। জারীন তাসনিম সেই দৃষ্টিভঙ্গি থেকেই দেশের বিভিন্ন জাদুঘর ও প্রত্নস্থলের ঘুরে ঘুরে পাথরে খোদিত প্রাচীন ধর্মগুরু ও দেবদেবীদের মহাকালের অতীত থেকে চিত্রকলার মাধ্যমে তুলে এনেছেন বর্তমানের আলোয়। প্রদর্শনীতে চিত্রকলার পাশাপাশি রয়েছে টেরাকোটার কাজ।
মূল ভাস্কর্যের ব্যঞ্জনা দর্শদের কাছে পৌঁছে দিতে জারীন তাসনিম মাধ্যম হিসেবে ব্যবহার করেছেন চারকোল। কারণ, এই ভাস্কর্যগুলো মূলত কালো পাথর খোদাই করে তৈরি করা হয়েছিল কয়েক শ কিংবা সহস্র বছর আগে। চারকোলে কালো রঙের পাশাপাশি পাথরের কাঠিন্য বেশ চমৎকারভাবে উঠে এসেছে। ড্রয়িংগুলো অনুশীলন পর্যায়ের হলেও যথেষ্ট নৈপুণ্যের প্রকাশ আছে। আলো-আধাঁরের প্রক্ষেপণ ও পটভূমির সঙ্গে দেহাবয়বের অনুপাত—এসব মিলিয়ে কাজগুলোতে একরকম ত্রিমাত্রিক আবহ সৃষ্টি হয়েছে, যা দর্শকদের মনে অনেকটা মূর্তিগুলো দেখার অনুভব জাগায়।
ছবির পাশাপাশি টেরাকোটার কাজ আছে ছয়টি। টেরাকোটাগুলো অবশ্য পৌরাণিক বিষয়ের নয়। জারীন তাসনিম চারুকলার প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা গ্রহণ করেননি। নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্থাপত্যকলায় স্নাতক। তিনি প্রথম আলোকে বললেন, শিক্ষাসফরে বিভিন্ন প্রত্নস্থান ভ্রমণ করতে গিয়ে প্রাচীন মূর্তির প্রতি তিনি আগ্রহী হয়ে ওঠেন। একটা সময় বিভিন্ন জাদুঘর ও প্রত্নস্থানে গিয়ে ছবি আঁকতে শুরু করেন।
প্রদর্শনী চলবে ১১ জুলাই পর্যন্ত। প্রতিদিন দুপুর ১২টা থেকে রাত ৯টা অবধি খোলা থাকবে সবার জন্য। দেখতে এলে অতীত ঐতিহ্যের এই নান্দনিক ছবি শিল্পানুরাগীদের ভালো লাগবে।
.উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: ভ স কর য
এছাড়াও পড়ুন:
জুলাই শহীদদের সনদ সম্ভাব্য, যোদ্ধাদের সনদ একটু কঠিন: উপদেষ্টা শারমীন
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে গুলিতে শহীদ শিক্ষার্থী নাফিসা হোসেন মারওয়ার বাড়ি পরিদর্শনে গিয়ে মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা শারমীন এস মুরশিদ বলেছেন, জুলাই আন্দোলনে আমি নিজেও মাঠে ছিলাম। আমরা দায়িত্ব নিয়েছি এক বছর হলো। এতদিনের মধ্যে আমরা তাদের কাছে যেতে পারিনি। আমরা যতটুকু অনুদান দিতে পেরেছি শহীদ নাফিসার বাবা তা পেয়েছেন। এখানে আর একজন শহীদের বাবা আছেন তিনিও অনুদান পেয়েছেন।
তিনি আরও বলেন, আমাদের বিরুদ্ধে অনেক অভিযোগ থাকে, আমরা সময়মতো শহীদদের পারিবারের কাছে পৌঁছাতে পারছি না। অনেক দেরি হলেও আপ্রাণ চেষ্টা করছি সবার কাছে পৌঁছানোর। নাফিসার বাবা ও জুলাই কন্যাদের দাবি হচ্ছে জুলাই সনদ। এখানে শহীদদের সনদ সম্ভাব্য কিন্তু যোদ্ধাদের সনদ একটু কঠিন কারণ যোদ্ধাদের সংখ্যা অনেক।
শুক্রবার আড়াইটায় উপদেষ্টা গাজীপুরের টঙ্গীর এরশাদ নগর এলাকায় শহীদ নাফিসার বাড়িতে গিয়ে তিনি এসব কথা বলেন।
এর আগে সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলার সময় কান্নায় ভেঙে পড়েন শহীদ নাফিসার বাবা আবুল হোসেন। এসময় তিনি বলেন, বেঁচে থাকতে মেয়ে হত্যার ন্যায়বিচার দেখে যেতে চাই। খুনিদের যেন দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দেওয়া হয়।
নাফিসার অনাকাঙ্ক্ষিত মৃত্যু মেনে নিতে পারেনি তার পরিবার এবং স্থানীয়রা। মারা যাওয়ার এক বছর পরও তার স্মৃতি আঁকড়ে কাঁদছে তার পরিবার। এ সময় উপদেষ্টাকে পেয়ে সেখানে এক আবেগঘন পরিবেশের সৃষ্টি হয়।
উল্লেখ্য, ২০২২ সালে নাফিসার মা কুলসুম বেগম পারিবারিক সমস্যার কারণে দুই মেয়েকে নিয়ে সাভারের দক্ষিণ বক্তারপুরে কোর্টবাড়ি এলাকায় চলে আসেন। এরপর তিনি মেয়েদের ভবিষ্যতের কথা ভেবে বিদেশে পাড়ি জমান। নাফিসাকে ভর্তি করা হয় সাভারের বেসরকারি ল্যাবরেটরি কলেজে। পরে নাফিসার বাবা আবুল হোসেন নাফিসাকে টঙ্গীতে নিয়ে যান। তিনি নাফিসাকে সাহাজউদ্দিন সরকার উচ্চ বিদ্যালয়ে ভর্তি করিয়ে দেন। তবে নাফিসা অধিকাংশ সময়ে সাভারে মামা হযরত আলীর বাসায় থাকতেন। গত ২৮ জুলাই ধামরাইয়ে বড় মামার বাসায় আসেন। পরে ৩০ জুলাই ছোট মামা হযরত আলীর বাসায় যান। এরপর থেকে বন্ধুদের সঙ্গে সাভারে আন্দোলনে অংশ নিতেন।
আগস্টের ৩ তারিখ থেকে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সমন্বয়কদের সঙ্গে আন্দোলনে সক্রিয় ছিলেন নাফিসা। ৫ আগস্ট সকালে মামাকে জানিয়েছিলেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আন্দোলনকারীদের সঙ্গে গাবতলীতে যাবেন।
বিষয়টি ভেবে মামা হযরত আলী আন্দোলনে যেতে নিষেধ করছিলেন। কিন্তু নাফিস নিষেধ শোনেননি। কাউকে কিছু না বলেই বেরিয়ে যান। কিছুক্ষণ পর মামা নাফিসার মুঠোফোনে কল দিলে জানান, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে তিনি আছেন। তখন মামা তাকে রেডিও কলোনি হয়ে বাসায় ফিরতে বলেন। বেলা ১১টার দিকে আবার কল দিলে আর ফোন ধরেননি নাফিসা।
বেলা আড়াইটার দিকে নাফিসার ছোট বোন সাফা হোসেন কল দিলে অপরিচিত একজন কল ধরে ‘নাফিসা গুলিবিদ্ধ হয়েছেন’ জানিয়ে ল্যাবজোন হাসপাতালে যেতে বলেন। বিষয়টি জানতে পেরে হযরত আলী ল্যাবজোন হাসপাতালে যান। সেখানে গিয়ে নাফিসাকে চিকিৎসাধীন অবস্থায় দেখতে পান। কিছুক্ষণ পর চিকিৎসকেরা নাফিসাকে মৃত ঘোষণা করেন। পরে আন্দোলনকারীরাসহ লাশ বাসায় নেওয়ার পথে মুক্তির মোড় এলাকায় পৌঁছালে পুলিশ ছররা গুলি ছোড়ে। এতে হযরত আলীসহ বেশ কয়েকজন আহত হন। পরে স্থানীয় বাসিন্দাদের সহায়তার ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি অ্যাম্বুলেন্সে বিকেল চারটার দিকে লাশ তার মামার বাসায় নেওয়া হয়।
রাত নয়টার দিকে সাভারে জানাজা শেষে নাফিসার মায়ের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী নানির বাসায় নাফিসার ছোট ভাইয়ের কবরের পাশে তাকে দাফনের সিদ্ধান্ত হয়। তবে নাফিসার বাবা টঙ্গীর এরশাদনগরে লাশ নিয়ে নিজ বাড়ির একটি কবরস্থানে দাফন করেন।