হিসাবরক্ষকের দৃষ্টিভঙ্গির বাজেট আর কতদিন
Published: 6th, July 2025 GMT
অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ ২০২৫-২৬ অর্থবছরের জাতীয় বাজেট উপস্থাপন করেন এমন এক সময়ে, যখন শেখ হাসিনার স্বৈরাচারী শাসনের পতনের পর দেশ এক গুরুত্বপূর্ণ সন্ধিক্ষণ অতিক্রম করছে। এ অবস্থায় যখন বহু প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কার প্রক্রিয়াধীন এবং সালেহউদ্দিন আহমেদ একজন অর্থনীতিবিদ, সাবেক আমলা ও বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর, তখন তাঁর উপস্থাপিত বাজেটে কোনো দূরদর্শী সংস্কারের ইঙ্গিত না থাকা অত্যন্ত বিস্ময়কর বটে। এই বাজেট বরং অতীতের ধারাবাহিকতা ধরে রাখা এক হতাশাজনক দলিল। অর্থাৎ যথা পূর্বং তথা পরং।
এতে নেই ভবিষ্যতের দিকনির্দেশনা, নেই কোনো সংস্কার পরিকল্পনার প্রতিফলন। উন্নত দেশের অর্থমন্ত্রীরা সবাই পেশায় অর্থনীতিবিদ না হলেও তাঁরা অর্থনীতিতে গভীর জ্ঞানের অধিকারী। তাঁরা কোনো অর্থনৈতিক তত্ত্বের আলোকে বাজেট প্রণয়ন করেন এবং নতুন কোনো উন্নয়ন কৌশলের প্রস্তাব করেন।
উদাহরণস্বরূপ, হার্ভার্ডের অধ্যাপক, জোসেফ শমপিটার তাঁর কর্মজীবনের প্রথম দিকে ১৯১৯ সালে অস্ট্রিয়ান সরকারের অর্থমন্ত্রী হন। তখন তিনি আরেক অস্ট্রিয়ান সমাজবিজ্ঞানী রুডলফ গোল্ডশাইডের একটি বিখ্যাত তত্ত্ব, রাজস্ব সমাজবিজ্ঞানের ধারণাটি প্রয়োগ করে বাজেট প্রণয়ন করেন। ২০২৫-২৬ বাজেটে এসবের অস্তিত্ব নেই। এটি একটি নিছক রক্ষণশীল রাজস্ব ব্যবস্থাপনা, যেখানে প্রকৃত আর্থসামাজিক পরিবর্তনের কোনো ধারণারও স্থান নেই।
আমরা আশা করেছিলাম, এই বছরের বাজেট একটি স্পষ্ট ও সুসমন্বিত অর্থনৈতিক তত্ত্বের ভিত্তিতে প্রণীত হবে। কিন্তু এটি না কেইনসীয় দৃষ্টিভঙ্গির প্রতিফলন, না কাঠামোগত রূপান্তরের প্রতি কোনো ডেভেলপমেন্টালিস্ট অঙ্গীকার। আবার এটি নিওক্ল্যাসিক্যাল সাপ্লাই-সাইড নীতির পথও অনুসরণ করেনি, যা বেসরকারি খাতকে উদ্দীপিত করতে পারত। বরং বাজেটটি একটি সংখ্যাগত হিসাব–নিকাশ ছাড়া আর কিছু নয়—এর মধ্যে ভবিষ্যতের কোনো দিশাও নেই।
সাবেক অর্থমন্ত্রী এ এস এম কিবরিয়া একবার জাতীয় সংসদে মন্তব্য করেছিলেন, ‘মাননীয় স্পিকার, বিরোধী দলের অর্থমন্ত্রী বাজেটকে হিসাবরক্ষকের দৃষ্টিভঙ্গি থেকে দেখেন, আর আমি দেখি একজন অর্থনীতিবিদের দৃষ্টিকোণ থেকে।’ দুঃখজনকভাবে এবারের বাজেটও প্রস্তুত হয়েছে একজন হিসাবরক্ষকের দৃষ্টিভঙ্গি থেকে—কোনোক্রমেই একজন অর্থনীতিবিদের নয়।
বাংলাদেশের জন্য একটি দূরদর্শিতাসম্পন্ন বাজেটের ভীষণ প্রয়োজন। কিন্তু উপস্থাপিত বাজেট একটি গতানুগতিক আমলাতান্ত্রিক অনুশীলন, যা হয়তো জাতীয় হিসাব-নিকাশের ভারসাম্য বজায় রাখতে পারবে, কিন্তু সামাজিক অবিচার ও বৈষম্য দূর করতে পারবে না।৫ দশমিক ৬৪ ট্রিলিয়ন টাকার রাজস্বের লক্ষ্যমাত্রা অর্জনযোগ্য বলে মনে হতে পারে, কিন্তু দুর্বল কর আদায়ের ব্যবস্থা, কর প্রশাসনে দীর্ঘস্থায়ী অদক্ষতা, পরোক্ষ করের ওপর অব্যাহত নির্ভরতা, ভ্যাট অব্যাহতি সংস্কারে রাজনৈতিক অনীহা এবং উচ্চপর্যায়ের দুর্নীতির কারণে এই বাজেটকে অত্যন্ত উচ্চাভিলাষীই বলতে হবে। কাঠামোগত কর সংস্কার ছাড়া বাস্তবে এ সংখ্যা অর্জন করা অসম্ভব। এটি বাস্তবায়ন করতে হলে কর আদায়ের প্রক্রিয়ায় গভীর ও পদ্ধতিগত সংস্কার করতে হবে। জরুরি আরও কিছু পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে, যেমন করভিত্তি সম্প্রসারণ করা, অর্থাৎ আরও বেশি মানুষ এবং ব্যবসাকে করের জালে আনা, কর ফাঁকি রোধ এবং দুর্নীতি হ্রাস করা।
ডিজিটাইজেশন শক্তিশালী করা। পরোক্ষ করের ওপর অতিরিক্ত নির্ভরতা ছেড়ে আয় এবং করপোরেট করের মতো আরও ন্যায়সংগত প্রত্যক্ষ করের দিকে স্থানান্তর করা। এ ধরনের পদক্ষেপ ছাড়া, উচ্চাভিলাষী রাজস্ব লক্ষ্যমাত্রা কেবল কাগজে–কলমে একটি সংখ্যা হয়েই থাকবে।
দ্বিতীয়ত, বর্তমান বাজেটে প্রস্তাবিত ঋণের পরিমাণ অনেক সফল অর্থনীতির ঋণের মাত্রা বিবেচনায় নিলে যথেষ্ট যুক্তিসংগত বটে। যেসব দেশে সরকারের ঋণ-জিডিপি অনুপাত অনেক বেশি, এমন কিছু উদাহরণ দিই। জাপানের মোট সরকারি ঋণ তার জিডিপির ২৬০ শতাংশের বেশি, যা উন্নত দেশগুলোর মধ্যে সর্বোচ্চ। এটি উদ্বেগজনক মনে হতে পারে, কিন্তু বাংলাদেশের বা পাকিস্তানের মতো দেশের বিপরীতে জাপানের বেশির ভাগ ঋণই দেশীয় উৎস থেকে নেওয়া। তাদের সরকারি বন্ডগুলো মূলত তাদের নিজস্ব নাগরিকের ও প্রতিষ্ঠানের হাতে। ফলে জাপানের ঋণের সুদের হার তুলনামূলকভাবে কম।
যুক্তরাষ্ট্র, ফ্রান্স, জার্মানি, ইতালি, যুক্তরাজ্য ও কানাডার ঋণ-জিডিপি অনুপাত যথাক্রমে ১২৩-১২৪ শতাংশ, ১১০ শতাংশ, ৬৩ শতাংশ, ১৩৫ শতাংশ, ১০১ শতাংশ ও ১০৭ শতাংশ। এসব দেশে ঋণ-জিডিপি অনুপাত তুলনামূলকভাবে বেশি হলেও তাদের অর্থনীতি ভালো করছে—সম্ভবত এ জন্য যে তাদের বড় দেশীয় বাজার থাকায় তারা তাদের ঋণের জোগান ও সুদ স্থিতিশীল রাখতে পারে।
বাংলাদেশের বাজেটে প্রস্তাবিত ঋণের মাত্রা যুক্তিসংগত বলে উল্লেখ করার পর একটি সতর্কবার্তাও জারি করা দরকার। চলতি ব্যয়ের পরিবর্তে উৎপাদনশীল বিনিয়োগ নিশ্চিত করতে হবে। উচ্চ প্রবৃদ্ধি বজায় রাখা, রাজস্ব সংগ্রহ জোরদার করা (একটি বিস্তৃত করভিত্তিসহ কার্যকর রাজস্ব সংগ্রহের ব্যবস্থা, কর্মকর্তাদের দুর্নীতি ও কর ফাঁকি রোধ ইত্যাদি) এবং প্রাতিষ্ঠানিক স্থিতিশীলতা (রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা, আইনের শাসন, দক্ষ আমলা এবং একটি বিশ্বাসযোগ্য, স্বাধীন কেন্দ্রীয় ব্যাংক ইত্যাদি) —দীর্ঘমেয়াদি আর্থিক স্বাস্থ্যের জন্যও অপরিহার্য। যদি অভ্যন্তরীণ সুদের হার বৃদ্ধি পায় বা কোনো আন্তর্জাতিক ধাক্কা (এক্সটারনাল শক) লাগে, তাহলে ঋণ অতিরিক্ত চাপ তৈরি করবে। অতএব এ ক্ষেত্রে সতর্কতামূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করতেই হবে।
বিশেষজ্ঞ ও উন্নয়ন সংস্থাগুলোর বারবার সতর্কীকরণ সত্ত্বেও শিক্ষা ব্যয় জিডিপির মাত্র ২ দশমিক ১ শতাংশ, যেখানে স্বাস্থ্য খাতে ১ শতাংশের কম। এই সংখ্যাগুলো সব আন্তর্জাতিক মানের চেয়ে কম—ইউনেসকোর সুপারিশকৃত ৪ থেকে ৬ শতাংশ, নিম্ন আয়ের দেশগুলোর গড় এবং দক্ষিণ এশিয়ার গড়ের চেয়ে অনেক কম। বাংলাদেশের ২ দশমিক ১ শতাংশের বিপরীতে নেপাল, ভুটান ও মালদ্বীপে শিক্ষা খাতে বরাদ্দ যথাক্রমে ৪ দশমিক ৩ শতাংশ, ৮ শতাংশ ও ৪ দশমিক ৭ শতাংশ। অথচ নেপালের মাথাপিছু আয় বাংলাদেশের তুলনায় অর্ধেক।
২০১৮ সালে জিডিপির অংশ হিসেবে বাংলাদেশের স্বাস্থ্য ব্যয় দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে সর্বনিম্ন ছিল এবং ২০১১ সালে শিক্ষা ব্যয় ছিল সর্বনিম্নের চেয়ে সামান্য বেশি। ২০১২ সাল থেকে, বাংলাদেশ ধীরে ধীরে শিক্ষা বাজেট কমিয়ে আনছে অথচ স্বাস্থ্য ও শিক্ষাই হিউম্যান ক্যাপিটালের তথা মানবপুঁজির ভিত্তি।
এ ধরনের মনোভাব নীতিনির্ধারকদের নৈতিক দেউলিয়াত্বকে প্রতিফলিত করে, যেখানে লাখ লাখ মানুষ শিক্ষাগত বৈষম্য এবং স্বাস্থ্যসেবার অপর্যাপ্ত সুযোগের মুখোমুখি হয় প্রতিদিন। আর একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, বাংলাদেশে স্বাধীনতার পর থেকেই দেখা যাচ্ছে, এই সীমিত বরাদ্দের একটি উল্লেখযোগ্য অংশও অব্যবহৃত থেকে যায়। এটি আমলাতান্ত্রিক অদক্ষতা এবং দুর্বল প্রাতিষ্ঠানিক সক্ষমতাকে নির্দেশ করে।
বাজেটে বেসরকারি খাতের প্রবৃদ্ধিকে সমর্থন করার দাবি করা হয়েছে, কিন্তু বাগাড়ম্বরের পেছনে বাস্তব প্রচেষ্টা খুব কম। এফবিসিসিআই, বিজিএমইএর মতো ব্যবসায়িক গোষ্ঠীগুলো ইতিমধ্যেই উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। উদাহরণস্বরূপ, টার্নওভার এবং ডিজিটাল পেমেন্টের ওপর নতুন কর ছোট ব্যবসা ও স্টার্টআপগুলোকে ক্ষতি করতে পারে বলে তারা জানিয়েছে। আমলাতান্ত্রিক জটিলতা দূর করার, রপ্তানি বৃদ্ধি করার বা বিদেশি বিনিয়োগ আকর্ষণ করার জন্য কোনো রোডম্যাপ নেই এই বাজেটে। সংক্ষেপে সরকার বেসরকারি খাতের কথা উল্লেখ করে, কিন্তু বাস্তব কর্মকৌশল প্রয়োগ করার নাম নেই।
শিক্ষিত যুব বেকারত্ব মোকাবিলায় বাংলাদেশকে তার পদ্ধতি পুনর্বিবেচনা করতে হবে। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষাকে বাজারের চাহিদার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ করতে হবে; প্রযুক্তি, স্বাস্থ্যসেবা ও পরিবেশবান্ধব শিল্পে দক্ষতার ওপর জোর দিতে হবে। তরুণদের ব্যবহারিক দক্ষতায় সজ্জিত করার জন্য বৃত্তিমূলক ও প্রযুক্তিগত প্রশিক্ষণ সম্প্রসারণ করতে হবে। সরকারের উচিত তহবিল ও পরামর্শদানের মাধ্যমে উদ্যোক্তাদের উৎসাহিত করা এবং অবকাঠামোগত উন্নয়নের মাধ্যমে ডিজিটাল চাকরি ও ফ্রিল্যান্সিংকে সমর্থন করা।
সরকারি-বেসরকারি অংশীদারত্ব ইন্টার্নশিপ ও শিক্ষানবিশ তৈরি করতে পারে, অন্যদিকে বড় শহরগুলোর বাইরে সুযোগ বিকেন্দ্রীকরণ তরুণদের পূর্ণ সম্ভাবনা কাজে লাগাতে সাহায্য করবে। সঠিক নীতিমালার মাধ্যমে এই বিশাল যুব জনগোষ্ঠী উদ্ভাবন ও প্রবৃদ্ধির একটি শক্তিশালী ইঞ্জিন হয়ে উঠতে পারে।
২০২৫-২৬ সালের বাজেট সাহসী সংস্কার নয়, বরং আর্থিক ব্যয় সংকোচনের মানসিকতার ধারাবাহিকতার প্রতিফলন। এটি একটি সুসংগত অর্থনৈতিক কর্মকৌশল গ্রহণ করতে বা দেশের পরিবর্তিত উন্নয়ন চাহিদা পূরণে সাড়া দিতে ব্যর্থ হয়েছে।
বাংলাদেশের জন্য একটি দূরদর্শিতাসম্পন্ন বাজেটের ভীষণ প্রয়োজন। কিন্তু উপস্থাপিত বাজেট একটি গতানুগতিক আমলাতান্ত্রিক অনুশীলন, যা হয়তো জাতীয় হিসাব-নিকাশের ভারসাম্য বজায় রাখতে পারবে, কিন্তু সামাজিক অবিচার ও বৈষম্য দূর করতে পারবে না।
গতানুগতিক এই ধারা থেকে বেরিয়ে আসার জন্য সরকারকে কেইনসীয় ও কাঠামোগত নীতির ওপর ভিত্তি করে একটি উন্নয়ন কৌশল গ্রহণ করতে হবে; প্রত্যক্ষ কর আদায় বৃদ্ধির জন্য কর প্রশাসন সংস্কার করতে হবে; শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও ডিজিটাল অবকাঠামোয় বিনিয়োগ করতে হবে; প্রতিযোগিতা ও কর্মসংস্থান উন্নত করার জন্য একটি শিল্পনীতি তৈরি করতে হবে এবং বাজেট বাস্তবায়নে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি নিশ্চিত করতে হবে। না হলে একটি উন্নত দেশে উন্নীত হওয়ার স্বপ্ন স্বপ্নই থেকে যাবে।
এন এন তরুণ অর্থনীতির অধ্যাপক, ইনডিপেনডেন্ট ইউনিভার্সিটি বাংলাদেশ। সাউথ এশিয়া জার্নালের এডিটর অ্যাট লার্জ। [email protected]
.উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: আমল ত ন ত র ক গ রহণ করত ক ঠ ম গত ব সরক র ব যবস থ উপস থ প সরক র র দ র কর প রস ত কর র জ ক ষ কর র জন য দশম ক র করত ণ করত র ওপর র একট
এছাড়াও পড়ুন:
ট্রাম্প কীভাবে ‘ম্যাডম্যান তত্ত্ব’ ব্যবহার করে বিশ্ব বদলে দেওয়ার চেষ্টা করছেন
যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের কাছে গত মাসে জানতে চাওয়া হয়েছিল, ইরানে হামলায় তিনি ইসরায়েলের সঙ্গে অংশ নেওয়ার পরিকল্পনা করছেন কি না। জবাবে তিনি বলেছিলেন, ‘আমি এটা করতে পারি। আবার আমি না-ও করতে পারি। আমি কী করতে যাচ্ছি, তা কেউই জানে না।’
ট্রাম্প বিশ্বকে এমনটা বিশ্বাস করতে দিয়েছিলেন যে ইরানকে আলোচনা শুরুর সুযোগ দিতে দুই সপ্তাহ হামলা স্থগিত রাখার বিষয়ে তিনি সম্মত হয়েছেন। কিন্তু পরে এ সময়ের মধ্যেই তিনি হামলা চালিয়ে বসেন।
এ ঘটনায় একটি প্রবণতা সামনে এসেছে, ট্রাম্পের সম্পর্কে সবচেয়ে অনুমেয় বিষয়টি হলো তাঁর অননুমেয় আচরণ। তিনি তাঁর চিন্তাভাবনা পরিবর্তন করেন। তিনি স্ববিরোধী কাজ করেন। তাঁর কথা আর কাজে মিল নেই।
লন্ডন স্কুল অব ইকোনমিকসের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক পিটার ট্রুবোউইৎজ বলেন, ‘(ট্রাম্প) একটি অত্যন্ত কেন্দ্রীভূত নীতিনির্ধারণী প্রক্রিয়া তৈরি করেছেন, অন্তত পররাষ্ট্রনীতির ক্ষেত্রে। সম্ভবত (প্রেসিডেন্ট) রিচার্ড নিক্সনের পর থেকে এটিই সবচেয়ে কেন্দ্রীভূত।’ তিনি বলেন, ‘এটি নীতিনির্ধারণী সিদ্ধান্তগুলোকে ট্রাম্পের আচরণ, তাঁর পছন্দ ও মেজাজ-মর্জির ওপর আরও বেশি নির্ভরশীল করে তুলেছে।’
ট্রাম্প তাঁর এই বৈশিষ্ট্যকে রাজনৈতিকভাবে ব্যবহার করে আসছেন। তিনি তাঁর নিজের অননুমেয় আচরণকে গুরুত্বপূর্ণ কৌশলগত ও রাজনৈতিক সম্পদে পরিণত করেছেন। তিনি এই অননুমেয় আচরণকে একটি মতবাদ বা নীতির পর্যায়ে নিয়ে গেছেন। আর এখন যে ব্যক্তিগত বৈশিষ্ট্য তিনি হোয়াইট হাউসে নিয়ে এসেছেন, সেটিই পররাষ্ট্র ও নিরাপত্তা নীতি নিয়ন্ত্রণ করছে। এটি বিশ্বব্যবস্থার বিদ্যমান কাঠামো পাল্টে দিচ্ছে।
রাষ্ট্রবিজ্ঞানীরা এটিকে ‘ম্যাডম্যান থিওরি’ বা ‘খ্যাপাটে তত্ত্ব’ বলে থাকেন। এই তত্ত্বে একজন বিশ্বনেতা তাঁর প্রতিপক্ষকে বোঝানোর চেষ্টা করেন, তিনি নিজের মেজাজ-মর্জিমতো যেকোনো কিছু করতে সক্ষম, যাতে প্রতিপক্ষের কাছ থেকে সুবিধা আদায় করা যায়। সফলভাবে ব্যবহার করা হলে এটি একধরনের জবরদস্তি বা চাপ প্রয়োগের কৌশল হতে পারে। ট্রাম্প বিশ্বাস করেন, এটি সুফল দিচ্ছে এবং এর মাধ্যমে তিনি যুক্তরাষ্ট্রের মিত্রদের তাঁর পছন্দমতো অবস্থানে নিয়ে আসতে পারছেন।
কিন্তু এটি কি এমন পদ্ধতি, যা শত্রুদের বিরুদ্ধেও কাজে দেবে? আর এর ত্রুটি কি এমনটি হতে পারে যে এটি প্রতিপক্ষকে বোকা বানানোর জন্য তৈরি করা একটি কৌশল না হয়ে বরং সুপ্রতিষ্ঠিত ও সুস্পষ্ট চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের ওপর ভিত্তি করে গঠিত, যার ফলে তাঁর আচরণ আরও সহজে অনুমানযোগ্য হয়ে ওঠে?
কথার আক্রমণ, অপমান ও কাছে টানা
রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনকে কাছে টেনে আর আমেরিকার মিত্রদের কথার আক্রমণের মধ্য দিয়ে প্রেসিডেন্ট হিসেবে ট্রাম্প তাঁর দ্বিতীয় মেয়াদ শুরু করেন। তিনি কানাডাকে অপমান করে বলেছিলেন, দেশটির যুক্তরাষ্ট্রের ৫১তম অঙ্গরাজ্য হয়ে যাওয়া উচিত।
ট্রাম্প বলেছিলেন, গ্রিনল্যান্ডকে (আমেরিকার মিত্র ডেনমার্কের একটি স্বায়ত্তশাসিত অঞ্চল) যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে একীভূত করার জন্য সামরিক শক্তি প্রয়োগের কথা বিবেচনা করতে তিনি প্রস্তুত। তিনি আরও বলেছিলেন, যুক্তরাষ্ট্রের উচিত পুনরায় পানামা খালের মালিকানা ও নিয়ন্ত্রণ নেওয়া।
সামরিক জোট ন্যাটো সনদের ৫ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী, প্রতিটি সদস্যদেশ অন্য দেশকে রক্ষায় এগিয়ে আসার জন্য প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। ট্রাম্প যুক্তরাষ্ট্রের এ অঙ্গীকারকে সংশয়ের মধ্যে ফেলে দেন। যুক্তরাজ্যের সাবেক প্রতিরক্ষামন্ত্রী বেন ওয়ালেস বলেন, ‘আমি মনে করি, (ন্যাটো সনদের) ৫ অনুচ্ছেদ লাইফ সাপোর্টে আছে।’
ন্যাটো সম্মেলনে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প (প্রথম সারিতে বাঁ থেকে চতুর্থ) ও বিশ্বনেতারা