মার্কিন-ইসরায়েলি ত্রাণকেন্দ্রে খাবার নিতে এসে প্রাণ গেছে ৭৪৩ ফিলিস্তিনির
Published: 6th, July 2025 GMT
যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক এবং ইসরায়েল–সমর্থিত সংস্থা গাজা হিউম্যানিটারিয়ান ফাউন্ডেশনের (জিএইচএফ) ত্রাণ বিতরণকেন্দ্রের আশপাশে ভিড় করা মানুষের ওপর নির্বিচার হামলার অভিযোগ বাড়ছে। সেখানে কয়েক সপ্তাহে ত্রাণ নিতে গিয়ে প্রায় সাড়ে ৭০০ ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন বলে জানিয়েছে গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়।
মে মাসের শেষ দিক থেকে গাজায় ত্রাণ বিতরণ শুরু করে জিএইচএফ। শনিবার গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় থেকে বলা হয়, জিএইচএফের কেন্দ্রগুলোতে হামলায় অন্তত ৭৪৩ ফিলিস্তিনি নিহত এবং ৪ হাজার ৮৯১ জন আহত হয়েছেন।
এদিকে মধ্যস্থতাকারী দেশ কাতার, যুক্তরাষ্ট্র ও মিসরের দেওয়া যুদ্ধবিরতি পরিকল্পনা নিয়ে আলোচনার জন্য কাতারে প্রতিনিধিদল পাঠাচ্ছেন ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু। তবে আলোচনা চললেও গাজায় ইসরায়েলের হামলা থামেনি। রোববার ভোরেও গাজাজুড়ে ইসরায়েলের হামলায় ২৭ ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন।
জিএইচএফ ইতিমধ্যে ব্যাপক সমালোচনার মুখে পড়েছে। একাধিক প্রতিবেদনে দাবি করা হয়েছে, সংস্থাটির কর্মীদের পাশাপাশি ইসরায়েলি বাহিনীও ত্রাণ নিতে আসা মানুষের ওপর গুলি চালিয়েছে।
এই সপ্তাহের শুরুতে অ্যাসোসিয়েটেড প্রেসের (এপি) এক প্রতিবেদনে কয়েকজন মার্কিন ভাড়াটে কর্মীর বরাত দিয়ে বলা হয়, জিএইচএফের ত্রাণ বিতরণকেন্দ্রগুলোতে সহায়তা নিতে আসা ফিলিস্তিনি বেসামরিক নাগরিকদের ওপর গুলি ও স্ট্যান গ্রেনেড ছোড়া হয়েছে। তাঁরা আরও বলেন, সেখানে অস্ত্রে সজ্জিত কর্মীরা যেন যা খুশি তাই করছেন। তাঁদের আচরণে তেমনটাই মনে হয়েছে।আল–জাজিরার সাংবাদিক হানি মাহমুদ গাজা স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের সর্বশেষ সংখ্যার বিষয়ে বলেন, মর্মান্তিক বিষয় হলো তাঁরা সবাই ত্রাণ নিতে ত্রাণ বিতরণকেন্দ্রে গিয়েছিলেন এবং খাবারের প্যাকেটের জন্য অপেক্ষায় করছিলেন।
হানি মাহমুদ গাজা নগরী থেকে সংবাদ সংগ্রহ করছেন। তিনি বলেন, ইসরায়েলের অবরোধে সৃষ্ট চরম সংকটের মধ্যে যখন ফিলিস্তিনিরা পরিবারের সদস্যদের জন্য একটু খাবার সংগ্রহ করতে মরিয়া, ঠিক তখনই ত্রাণ নিতে আসা মানুষের ওপর হামলা হয়েছে। তিনি বলেন, ‘মানুষ অনাহারে দিন কাটাচ্ছে। হিসাব করে খাবার খাচ্ছে। অনেক পরিবারই খাবার খেতে পারছে না। অনেক মা নিজে না খেয়ে সন্তানদের মুখে খাবার তুলে দিচ্ছেন।’
এই সপ্তাহের শুরুতে অ্যাসোসিয়েটেড প্রেসের (এপি) এক প্রতিবেদনে কয়েকজন মার্কিন ভাড়াটে কর্মীর বরাত দিয়ে বলা হয়, জিএইচএফের ত্রাণ বিতরণকেন্দ্রগুলোতে সহায়তা নিতে আসা ফিলিস্তিনি বেসামরিক নাগরিকদের ওপর গুলি ও স্ট্যান গ্রেনেড ছোড়া হয়েছে। তাঁরা আরও বলেন, সেখানে অস্ত্রে সজ্জিত কর্মীরা যেন যা খুশি তাই করছেন। তাঁদের আচরণে তেমনটাই মনে হয়েছে।
আমার সন্তানেরা টানা তিন দিন না খেয়ে ছিল। তাই আমি বাধ্য হয়ে ওই (জিএইচএফ) ত্রাণ বিতরণকেন্দ্রে গিয়েছিলাম।’মজিদ আবু লাবান, জিএইচএফ ত্রাণকেন্দ্রে ত্রাণ নিতে গিয়ে আহত ফিলিস্তিনিজিএইচএফ এপির প্রতিবেদনকে ‘সম্পূর্ণ মিথ্যা’ বলে উড়িয়ে দিয়েছে এবং বলেছে, তাদের কাছে নিজেদের কার্যক্রম স্থলগুলোর নিরাপত্তা এবং সুরক্ষা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
জুনের শেষ দিকে ট্রাম্প প্রশাসন জিএইচএফের জন্য ৩ কোটি ডলার অনুদানের প্রতিশ্রুতি দিয়েছে।
জিএইচএফের একটি ত্রাণ বিতরণকেন্দ্রে ত্রাণ নিতে গিয়ে আহত হওয়া মজিদ আবু লাবান বলেন, ‘আমার সন্তানেরা টানা তিন দিন না খেয়ে ছিল। তাই আমি বাধ্য হয়ে ওই (জিএইচএফ) ত্রাণ বিতরণকেন্দ্রে গিয়েছিলাম।’
আরও পড়ুনআগামী সপ্তাহেই গাজায় যুদ্ধবিরতি চুক্তি হতে পারে: ট্রাম্প০৫ জুলাই ২০২৫গাজায় নিহত ২৭গাজায় ২০ মাসের বেশি সময় ধরে যুদ্ধ চলছে। রোববার ভোরেও গাজাজুড়ে ইসরায়েলের হামলায় ২৭ ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন। গাজা নগরীর কাছের এলাকা তুফাতে হামলায় তিন ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন বলে জানিয়েছে আল-আহলি আরব হাসপাতাল। দক্ষিণের খান ইউনিসে একটি তাঁবুতে ইসরায়েলের ড্রোন হামলায় দুজন নিহত হন এবং আরও কয়েকজন আহত হয়েছেন। আগের দিন শনিবার ২৪ ঘণ্টায় অন্তত ৭৮ ফিলিস্তিনিকে হত্যা করে ইসরায়েল।
উত্তরে গাজা সিটির কাছের এলাকা শেখ রাদওয়ানে একটি বাড়িতে ইসরায়েলের হামলায় অন্তত ১২ জন নিহত এবং বহু মানুষ আহত হয়েছেন। বাস্তুহারা অনেক ফিলিস্তিনি ওই বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছিলেন।
আরও পড়ুনগাজায় যুদ্ধবিরতি আলোচনা শুরু করতে প্রস্তুত হামাস০৫ জুলাই ২০২৫.উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: ত র ণ ব তরণক ন দ র জ এইচএফ র র জন য কর ম র র ওপর
এছাড়াও পড়ুন:
গাজায় ক্ষুধার্ত মানুষের ওপর গুলি চালানোর দৃশ্য দেখেছেন নিরাপত্তা ঠিকাদার
‘মেশিনগান দিয়ে ক্ষুধার্ত ফিলিস্তিনিদের ওপর বেশ কয়েকবার গুলি চালাতে দেখেছি, যারা কোনো হুমকিই ছিল না’, গাজায় ইসরায়েল ও মার্কিন-সমর্থিত বিতর্কিত ত্রাণ বিতরণ কেন্দ্রের সাবেক নিরাপত্তা ঠিকাদার এ কথা বলেছেন। বিবিসিকে তিনি জানিয়েছেন, একবার একদল নারী, শিশু ও বয়স্ক ব্যক্তি ঘটনাস্থল থেকে একটু দূরে, শুধুমাত্র একটু ধীরে চলায় ওয়াচ টাওয়ার থেকে একজন প্রহরী মেশিনগান দিয়ে গুলি চালায়।
এ বিষয়ে গাজা হিউম্যানিটেরিয়ান ফাউন্ডেশন বা জিএইচএফের প্রতিক্রিয়া জানতে চাওয়া হলে অভিযোগগুলো সম্পূর্ণ মিথ্যা বলে দাবি করছে তারা। তারা বিবিসিকে একটি বিবৃতির উদ্ধৃতি দিয়ে উল্লেখ করেছে, জিএইচএফ সহায়তা কেন্দ্রের কাছে কোনো বেসামরিক নাগরিক কখনো গুলিবিদ্ধ হননি।
মে মাসের শেষের দিকে দক্ষিণ ও মধ্য গাজার বেশ কয়েকটি এলাকায় সীমিতভাবে ত্রাণ বিতরণের মাধ্যমে গাজায় নিজেদের কার্যক্রম শুরু করে জিএইচএফ। এরপর গাজার ওপর ১১ সপ্তাহের সম্পূর্ণ অবরোধ আরোপ করে ইসরায়েল, এরপর থেকে ওই এলাকায় আর কোনো খাবার প্রবেশ করেনি। শুরু থেকেই সহায়তা বিতরণের এই ব্যবস্থা ব্যাপকভাবে সমালোচিত হয়েছে। কারণ এর ফলে বিপুল সংখ্যক মানুষকে সক্রিয় যুদ্ধক্ষেত্রের মধ্য দিয়ে হেঁটে অল্প কয়েকটি জায়গায় যেতে বাধ্য করা হচ্ছিল।
জাতিসংঘ এবং স্থানীয় চিকিৎসকরা বলছেন, জিএইচএফ শুরু হওয়ার পর থেকে, ইসরায়েলি বাহিনী তাদের কাছ থেকে খাদ্য সহায়তা সংগ্রহের চেষ্টার সময় ৪০০ জনেরও বেশি ফিলিস্তিনিকে হত্যা করেছে। যদিও ইসরায়েল মনে করে, তাদের নতুন এই পদক্ষেপের ফলে হামাসের সাহায্য পাওয়ার পথ বন্ধ হয়েছে।
ফিলিস্তিনিদের একটি দলের ওপর প্রহরীদের গুলি চালানো ঘটনার বর্ণনা দিতে গিয়ে ওই ঠিকাদার বলেন, একজন ঠিকাদার একটি লম্বা জায়গার ওপর দাঁড়িয়ে বের হয়ে যাওয়ার রাস্তাটার দিকে তাকিয়ে জনতার ওপর বারবার ১৫ থেকে ২০টি করে গুলি চালাতে শুরু করে। একজন ফিলিস্তিনি নিশ্চল হয়ে মাটিতে পড়ে গেল। এরপর সেখানে দাঁড়িয়ে থাকা অন্য আরেকজন ঠিকাদার বলল, ‘ধুর, আমি ভাবলাম তুমি একজনকে মেরেছো’। আর তারপর তারা এটা নিয়ে হেসে উঠল।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে বিবিসির সাথে কথা বলা ওই ঠিকাদার বলেন, জিএইচএফের পরিচালকরা তার প্রতিবেদনটিকে কাকতালীয় ঘটনা বলে উড়িয়ে দেয় এবং ফিলিস্তিনি ব্যক্তিটি ‘হোঁচট খেয়ে পড়েছিলেন’ অথবা ‘ক্লান্ত ও অজ্ঞান’ হয়ে গিয়েছিলেন বলে দাবি করে। জিএইচএফ দাবি করেছে, এই অভিযোগকারী ব্যক্তি একজন ‘অসন্তুষ্ট সাবেক ঠিকাদার’ যাকে তারা অসদাচরণের জন্য বরখাস্ত করেছিল।
যদিও এই অভিযোগ অস্বীকার করেছেন ওই ঠিকাদার। বিবিসিকে তিনি বেতনের কয়েকটি স্লিপ দেখিয়েছেন যাতে বোঝা যাচ্ছে, ওই পদ ছাড়ার পরও তাকে দুই সপ্তাহ ধরে বেতন দেওয়া হয়েছে। জিএইচএফ পরিচালিত চারটি বিতরণ কেন্দ্রে কাজ করা ওই ব্যক্তি বিবিসিকে জানান, সহায়তা কেন্দ্রগুলোতে নিয়ম, নিয়ন্ত্রণ খুবই কম যা দায়মুক্তির সুযোগ করে দেয়।
ঠিকাদারদের কোনো স্পষ্ট নিয়ম বা স্ট্যান্ডার্ড অপারেটিং পদ্ধতি দেওয়া হয়নি বলেও জানান তিনি। একজন টিম লিডার তাদের বলেছিলেন, ‘যদি তুমি হুমকি মনে কর, গুলি কর- হত্যা করার জন্য গুলি কর এবং পরে প্রশ্ন জিজ্ঞাসা কর’। পরিস্থিতি দেখে মনে হচ্ছিল, আমরা গাজায় যাচ্ছি, তুমি যা ইচ্ছা কর। এখানে এটিই নিয়ম।
বিবিসিকে ওই ঠিকাদার বলেছিলেন, সিসিটিভি ক্যামেরার মাধ্যমে সমগ্র এলাকার কার্যকলাপ পর্যবেক্ষণ করা হচ্ছে এবং জিএইচএফের দাবি- সেখানে কেউ আহত বা গুলিবিদ্ধ হয়নি। ‘এগুলো সম্পূর্ণ মিথ্যা’।
সাবেক ওই ঠিকাদার বলেন, ইসরায়েলের সেনা দলের নেতারা গাজার বাসিন্দাদের ‘জম্বি’' বা ‘মৃত মানুষের দল’ হিসেবে উল্লেখ করেছেন, ‘যা এই মানুষগুলোর কোনো মূল্য নেই বলেই ইঙ্গিত দিয়ে।’
ওই ব্যক্তি আরও জানান, জিএইচএফ সাইটগুলোতে ফিলিস্তিনিরা অন্যভাবেও ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছেন। স্টান গ্রেনেডের ধ্বংসাবশেষের আঘাত কিংবা মানুষের ভিড়কে কাটাতারের মধ্যে ঠেলে দেয়া হচ্ছে উদাহরণ হিসেবে বলেন তিনি। ফিলিস্তিনিদের বেশ কয়েকবার গুরুতর আহত হতে দেখেছেন তিনি। একবার একজন পুরুষের মুখে পিপার স্প্রের পুরো ক্যানই ঢেলে দেওয়া হয়েছিল বা একজন নারী স্টান গ্রেনেডের ধাতব অংশে আঘাত পেলেন, যা ভুলভাবে ওই মানুষগুলোর দিকে ছোঁড়া হয়েছিল।
ওই সাবেক ঠিকাদার বলছিলেন, ‘এই ধাতব টুকরোটি সরাসরি তার মাথায় আঘাত করে এবং সে নড়তে না পেরে মাটিতে পড়ে যায়। আমি জানি না তিনি মারা গেছেন কিনা। আমি কেবল দেখলাম, অজ্ঞান ও সম্পূর্ণরূপে নিস্তেজ ছিলেন।’
এ সপ্তাহের শুরুতে জিএইচএফ বন্ধের আহ্বান জানিয়েছে ১৭০টিরও বেশি দাতব্য সংস্থা এবং অন্যান্য এনজিও। অক্সফাম এবং সেভ দ্য চিলড্রেনসহ সংস্থাগুলো বলেছে, ইসরায়েলি বাহিনী এবং সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলো ‘নিয়মিতভাবে’ সাহায্যপ্রার্থী ফিলিস্তিনিদের ওপর গুলি চালায়। সাহায্য নিতে আগতদের ওপর নিজের সৈন্যদের ইচ্ছাকৃতভাবে গুলি চালানোর বিষয়টি অস্বীকার করেছে ইসরায়েল। তারা বলছে, জিএইচএফ এর ব্যবস্থাপনা হামাসের হস্তক্ষেপ এড়িয়ে, সাহায্য প্রার্থীদের সরাসরি সহায়তা প্রদান করে।
জিএইচএফ বলছে, পাঁচ সপ্তাহে পাঁচ কোটি ২০ লাখেরও বেশি খাবার তারা সরবরাহ করেছে এবং অন্যান্য সংস্থাগুলো ‘অসহায়ভাবে তাদের সাহায্য লুট হওয়ার সময় পাশে দাঁড়িয়েছে’। ২০২৩ সালের ৭ই অক্টোবর ইসরায়েলে হামলা চালায় হামাস। যেখানে প্রায় এক হাজার ২০০ জন নিহত এবং ২৫১ জনকে জিম্মি করা হয়।
হামাসের এই হামলার জবাবে গাজায় একটি অভিযান শুরু করে ইসরায়েলি সেনাবাহিনী। গাজার হামাস-পরিচালিত স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, তখন থেকে গাজায় কমপক্ষে ৫৭ হাজার ১৩০ জন নিহত হয়েছেন।