তারুণ্য মানেই উদ্যম, উদ্বেলিত মানসিক শক্তি। কবি নজরুলের ভাষায়—‘আমি অনিয়ম, উচ্ছৃঙ্খল,/আমি দ’লে যাই যত বন্ধন, যত নিয়ম কানুন শৃঙ্খল!/আমি মানি নাকো কোনো আইন,/আমি ভরা-তরী করি ভরা-ডুবি, আমি টর্পেডো, আমি ভীম ভাসমান মাইন!’

তারুণ্য মানেই একেকটা ভাসমান মাইন। তারুণ্য মানে নিয়ম-কানুন-শৃঙ্খল ভাঙার গতি। তবে সে গতি হতে হবে অবশ্যই মানুষের জন্য প্রয়োজনীয়, উপকারী আর কাঙ্ক্ষিত। জুলাই আন্দোলনের গতি এবং তার ফলাফল শেষ পর্যন্ত কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে, সেটা হয়তো রাজনৈতিক বিবেচনার বিষয়। কিন্তু মনোরোগবিদ হিসেবে আমাদের উদ্বেগ হলো, এই তারুণ্যের জয়গান গেয়ে আমাদের দেশের লাখ লাখ তরুণ যেভাবে রাস্তায় নেমেছে, আন্দোলন করেছে, নিজের জীবনের কথা বিন্দুমাত্র না ভেবে বুক চিতিয়ে দাঁড়িয়ে পড়েছে বন্দুকের সামনে—সেসব ঘটনা, কাঙ্ক্ষিত-অনাকাঙ্ক্ষিত ফলাফল তরুণ আর তারুণ্যের মনে কতটুকু প্রভাব ফেলেছে?

তরুণেরা বন্ধুবান্ধব নিয়ে থাকতে এবং তাদের চাহিদা পূরণের দিকে বেশি মনোযোগ দেয়.

উৎস: Prothomalo

এছাড়াও পড়ুন:

সমন্বয়ের অভাবে চামড়া শিল্পে বড় ক্ষতি

ঈদুল আজহার পর দেশের চামড়ার বাজারে চলছে অস্থিরতা। মাঠপর্যায়ে চাহিদা থাকলেও সরকার নির্ধারিত চামড়ার দরের সঙ্গে বাস্তবতার মিল না থাকায় মৌসুমি চামড়া ব্যবসায়ীরা পড়েছেন বিপাকে। 

চট্টগ্রাম, বরিশাল, খুলনা, যশোর ও নাটোরসহ দেশের বিভিন্ন জেলায় দেখা গেছে, সংগ্রহ করা চামড়ার বড় একটি অংশ ব্যবস্থাপনার অভাবে নষ্ট হয়ে গেছে। রাজধানী ঢাকাতেও দেখা গেছে একই চিত্র। গরুর কাঁচা চামড়া বিক্রি হয়েছে ৭০০ থেকে ৯০০ টাকায়—যা সরকার নির্ধারিত দামের প্রায় অর্ধেক।

সরকারি দাম কাগজে, বাস্তবে অর্ধেক

বাণিজ্য মন্ত্রণালয় ২৬ মে ঢাকায় লবণযুক্ত গরুর চামড়ার দাম নির্ধারণ করে প্রতি বর্গফুট ৬০–৬৫ টাকা এবং ঢাকার বাইরে ৫৫–৬০ টাকা। এর ভিত্তিতে একটি মাঝারি আকারের গরুর চামড়ার মূল্য ঢাকায় ১,৩৫০ টাকা, ঢাকার বাইরে ১,১৫০ টাকা হওয়ার কথা। কিন্তু বাস্তবে অনেক জায়গায় ৭০০–৯০০ টাকার বেশি চামড়ার দর ওঠেনি।

৭ জুন ঢাকার সায়েন্সল্যাব এলাকায় মৌসুমি চামড়া ব্যবসায়ী কাউছার আহমেদ ২৩টি চামড়া আনেন। প্রতিটি চামড়া তিনি  কিনেছিলেন ৬০০–৭০০ টাকায়। কিন্তু বিক্রি করতে হয়েছে গড় মূল্য ৭৫০ টাকায়। কাউছার বলেন, ‘‘৮৫০–৯০০ টাকা আশা করেছিলাম, কিন্তু বাজারে কেউ সে দাম দেয়নি। লোকসান গুনেই বিক্রি করেছি।’’

যশোর, নাটোর ও চট্টগ্রামের শত শত মৌসুমি ব্যবসায়ী অভিযোগ করেছেন, ঈদের দিন ও পরদিন তারা চড়া দামে চামড়া কিনলেও এখন তা বিক্রি হচ্ছে সরকার নির্ধারিত মূল্যের অনেক কমে। নাটোরের কয়েকজন ব্যবসায়ী জানিয়েছেন, ট্যানারি মালিকদের অনাগ্রহ ও স্থানীয় দালালদের কারণে তারা চামড়া বিক্রি করতে পারছেন না।

বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সচিব মাহবুবুর রহমান বলেছেন, চামড়া নিয়ে অপপ্রচার চলছে, একটি মহল কৃত্রিম সংকট তৈরি করছে। তবে মাঠপর্যায়ে ব্যবসায়ীরা বলছেন, এই সমস্যা কোনো অপপ্রচারে নয়, বরং বাস্তবতারই অংশ। 

বাংলাদেশ ট্যানার্স অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক মিজানুর রহমান বলেন, ‘‘সরকারি হস্তক্ষেপে বাজারে একটি মানসিক জড়তা তৈরি হয়। মৌসুমি ব্যবসায়ীরা আত্মবিশ্বাস হারান, ফলে অনেকেই বড় ধরনের লোকসানে পড়েন।’’

৯১ লাখ কোরবানির পশু, সম্ভাবনার অপচয়

প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তর জানিয়েছে, এবারের ঈদুল আজহায় ৯১ লাখ ৩৬ হাজার পশু কোরবানি হয়েছে—যার মধ্যে ৪৭ লাখ গরু-মহিষ এবং ৪৪ লাখ ছাগল-ভেড়া। সবচেয়ে বেশি কোরবানি হয়েছে রাজশাহী বিভাগে (২৩ লাখ ২৪ হাজার), এরপর ঢাকা ও চট্টগ্রামে।

অর্থনীতিবিদ ড. এম মুইদ রহমান বলেন, ‘‘কোরবানির চামড়া আমাদের গার্মেন্টসের পর দ্বিতীয় বৃহত্তম সম্ভাবনাময় রপ্তানি খাত হতে পারতো। কিন্তু মূল্য নির্ধারণ, সরবরাহ ব্যবস্থাপনা ও স্বচ্ছতার অভাবে প্রতিবছর হাজার কোটি টাকার অপচয় হচ্ছে।’’

তিনি আরও বলেন, ‘‘প্রতি বছর যদি গড়ে ৮০ লাখ গরু কোরবানি হয় এবং প্রতি চামড়া গড়ে ১ হাজার টাকা ধরে হিসাব করি, তাহলে প্রায় ৮০০ কোটি টাকার বাজার তৈরি হয়। সঠিক ব্যবস্থাপনায় এই খাতে বৈপ্লবিক পরিবর্তন আসতে পারতো।’’

ট্যানারি পল্লীর কাঠামোগত দুর্বলতা

সাভারে স্থাপিত আধুনিক ট্যানারি পল্লী এখনও পুরোপুরি কার্যকর হয়নি। ফলে চামড়া প্রক্রিয়াজাতকরণে বড় সংকট দেখা দিয়েছে। বাংলাদেশ ট্যানার্স অ্যাসোসিয়েশনের সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান সাখাওয়াত উল্লাহ বলেন, ‘‘ছোট গরুর চামড়া বেশি এসেছে, সরবরাহ ভালো ছিল। কিন্তু কাঠামোগত দুর্বলতায় কেউ চামড়ার প্রকৃত মূল্য পাচ্ছেন না।’’

সকালাম ব্রাদার্স ট্যানারির পরিচালক সাজেদুল খায়ের বলেন, ‘‘প্রতিটি চামড়ায় লবণ, শ্রমিক ও পরিবহন খরচ মিলিয়ে পড়ে যাচ্ছে ৩৫০–৪০০ টাকা। বাজার ভালো না হওয়ায় আমরা কম দামেই কিনতে বাধ্য হচ্ছি।’’

একটি মাঝারি আকারের চামড়া নষ্ট হওয়ায় শুধু ৫০০–৭০০ টাকার সম্পদই নয়, পরিবেশও ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। পচা চামড়া থেকে দুর্গন্ধ ছড়িয়ে পড়ছে, যা জনস্বাস্থ্যর জন্য ঝুঁকির কারণ। বিভিন্ন এলাকায় এসব চামড়া নালায়, খালে ও উন্মুক্ত স্থানে ফেলে দেওয়া হচ্ছে।

সমাধান কী?

শিল্প মন্ত্রণালয়ের এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ‘‘চামড়া শিল্পে সরকার, ট্যানারি মালিক, স্থানীয় ব্যবসায়ী ও মধ্যস্বত্বভোগীদের মধ্যে কোনো কার্যকর সমন্বয় নেই। একটি জাতীয় সমন্বয় কমিটি ছাড়া এই খাতকে সুষ্ঠু পথে আনা সম্ভব নয়।’’

তিনি আরও বলেন, ‘‘চামড়া শিল্পের সংকট সমাধানে প্রয়োজন দীর্ঘমেয়াদি নীতিনির্ভর পদক্ষেপ। মৌসুমি ব্যবসায়ীদের প্রশিক্ষণ, লবণ সংরক্ষণ কেন্দ্র, স্বচ্ছ মূল্য কাঠামো এবং দ্রুত ট্যানারি পল্লীর পূর্ণ কার্যকারিতা ছাড়া প্রতিবছর একই চিত্রের পুনরাবৃত্তি হবে।’’

এক সময় দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম রপ্তানি খাত ছিল চামড়া শিল্প। আজ তা অব্যবস্থাপনা, কাগুজে সিদ্ধান্ত এবং দুর্বল সমন্বয়ের কারণে ধ্বংসের পথে। বাস্তবভিত্তিক নীতিমালা ও মাঠপর্যায়ে কার্যকর বাস্তবায়ন ছাড়া এই খাত পুনরুদ্ধার সম্ভব নয় বলে মনে করেন শিল্প মন্ত্রণালয়ের ওই কর্মকর্তা। 

এএএম//

সম্পর্কিত নিবন্ধ