ইরানের সঙ্গে পাল্টাপাল্টি হামলার মধ্যেও গাজায় ইসরায়েলের হত্যাযজ্ঞ থেমে নেই। গতকাল শুক্রবার ইসরায়েলি বাহিনীর হামলায় ফিলিস্তিনের অবরুদ্ধ উপত্যকাটিতে অন্তত ৮২ জন নিহত হয়েছেন। এর মধ্যে ত্রাণ নিতে যাওয়া ৩৪ ফিলিস্তিনিকে গুলি চালিয়ে হত্যা করেছে ইসরায়েলি সেনারা।

গাজার স্বাস্থ্য কর্তৃপক্ষ জানায়, গতকালও গাজার বিভিন্ন স্থানে বিমান হামলার পাশাপাশি ট্যাংক থেকে গোলাবর্ষণ করে ইসরায়েলি বাহিনী। মধ্য গাজার নেতজারিম করিডরে ত্রাণ নিতে যাওয়া ফিলিস্তিনিদের লক্ষ্য করে ইসরায়েলি সেনারা গুলি করলে ৩৪ জন নিহত ও শতাধিক আহত হন। এ ছাড়া দেইর আল–বালায় ইসরায়েলের বোমা হামলায় নিহত হয়েছেন অন্তত আটজন।

ত্রাণ বিতরণ কেন্দ্রে হামলার পর মধ্য গাজার আল–আওদা হাসপাতালের মেঝেতে মরদেহ ছড়িয়ে–ছিটিয়ে পড়ে থাকতে দেখা যায়। হাসপাতালটির এক মুখপাত্র জানান, অর্ধাহার–অনাহারে থাকা হাজারো ফিলিস্তিনি যুক্তরাষ্ট্রের সমর্থিত বিতর্কিত গাজা হিউম্যানিটারিয়ান ফাউন্ডেশনের (জিএইচএফ) ত্রাণ বিতরণকেন্দ্রে ত্রাণের জন্য অপেক্ষা করছিলেন। এ সময় তাঁদের লক্ষ্য করে ইসরায়েলি সেনারা গুলি করলে হতাহতের এ ঘটনা ঘটে।

হামলার সময়কার কিছু ছবি ও ভিডিও চিত্রে দেখা যায়, ত্রাণ বিতরণকেন্দ্রের পাশে সড়কে যত্রতত্র মরদেহ পড়ে রয়েছে। আহত ব্যক্তিদের নিয়ে ছোটাছুটি করছেন তাঁদের স্বজনেরা। এর আগে গত

বৃহস্পতিবার ইসরায়েলি বাহিনীর হামলায় গাজায় অন্তত ৭৭ জন ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছিলেন।

গতকাল টানা অষ্টম দিনের মতো ইরানে হামলা চালিয়েছে ইসরায়েলি বাহিনী। গত শুক্রবার থেকে ইসরায়েলের নজিরবিহীন এই হামলার জবাবে ইরানও দেশটিতে পাল্টা হামলা চালাচ্ছে। অনেকে ধারণা করছিল, ইরানে হামলার কারণে গাজায় ইসরায়েলি বাহিনীর হামলার তীব্রতা কমবে। কিন্তু এই এক সপ্তাহে গাজায় ইসরায়েলের হামলায় কয়েক শ ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন।

২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর থেকে গাজায় হামলা চালাচ্ছে ইসরায়েলি বাহিনী। এর পর থেকে ইসরায়েলের হামলায় গাজায় অন্তত ৫৫ হাজার ৭০৬ ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন। তাঁদের বেশির ভাগই নারী ও শিশু। ইসরায়েলি বাহিনী এই সময়ে গাজার ১৫ হাজারের বেশি শিশুকে হত্যা করেছে।

ত্রাণ নিতে গিয়ে চার শতাধিক নিহত

গতকাল ইসরায়েলি সেনাদের গুলিতে ত্রাণ নিতে যাওয়া ফিলিস্তিনিদের হতাহতের বিষয়টি নিয়ে জানতে চাইলে ইসারয়েলের সামরিক বাহিনীর পক্ষ থেকে কোনো সাড়া পাওয়া যায়নি। গাজার গণমাধ্যম কার্যালয় জানিয়েছে, গত মে মাসের শেষ দিক থেকে ত্রাণ বিতরণকেন্দ্রে ইসরায়েলি সেনাদের গুলিতে ৪০৯ ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন। আহত হয়েছেন আরও অন্তত ৩ হাজার ২০৩ জন।

দুই মাসের যুদ্ধবিরতি শেষ হওয়ার আগেই গত ২ মার্চ থেকে গাজায় ত্রাণ প্রবেশ পুরোপুরি বন্ধ করে দেয় ইসরায়েল। আন্তর্জাতিক সমালোচনার মুখে প্রায় তিন মাস পর মে মাসের শেষ দিকে কিছু ত্রাণ প্রবেশের অনুমতি দেয়; কিন্তু জাতিসংঘসহ আন্তর্জাতিক দাতব্য সংস্থাগুলোকে বাদ দিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের অর্থায়নে জিএইচএফ নামের একটি ফাউন্ডেশন প্রতিষ্ঠা করে এর মাধ্যমে গাজার অল্প কিছু স্থানে ত্রাণ দেওয়া হচ্ছে। এর পর থেকে প্রায় প্রতিদিনই জিএইচএফের ত্রাণ বিতরণকেন্দ্রে ত্রাণ নিতে আসা ফিলিস্তিনিদের গুলি করে হত্যার ঘটনা ঘটেছে।

গত বৃহস্পতিবার ত্রাণ নিতে গিয়ে ইসরায়েলি সেনাদের গুলিতে ২৩ ফিলিস্তিনি নিহত হন। এর আগে বুধবার ২৯ জন এবং মঙ্গলবার দক্ষিণ গাজার খান ইউনিসে ত্রাণ নিতে গেলে ৭০ জনকে গুলি করে হত্যা করেন ইসরায়েলের সেনারা। তারও আগে সোমবার রাফায় ৩৮ জন ও এর আগে রোববার দক্ষিণ ও মধ্য গাজায় ত্রাণ নিতে গেলে ১৭ ফিলিস্তিনিকে গুলি করে হত্যা করা হয়।

জাতিসংঘের ‘কালোতালিকায়’ ইসরায়েল

শিশুদের ওপর সহিংসতা নিয়ে জাতিসংঘের তৈরি ‘কালোতালিকায়’ টানা দ্বিতীয় বছরের মতো নাম উঠেছে ইসরায়েলের। গত বৃহস্পতিবার প্রকাশিত ওই প্রতিবেদনে জাতিসংঘ বলেছে, ২০২৪ সালে বিশ্বজুড়ে শিশুদের ওপর নজিরবিহীন সহিংসতার ঘটনা ঘটেছে। সবচেয়ে বেশি সহিংসতার শিকার হয়েছে ফিলিস্তিনের শিশুরা।

ইসরায়েলকে কালোতালিকাভুক্ত করার কারণ হিসেবে জাতিসংঘ বলছে, ইসরায়েলি বাহিনীর অবিরত হামলায় হাজার হাজার ফিলিস্তিনি শিশু প্রাণ হারিয়েছে, নয়তো পঙ্গু হয়ে গেছে। ইসরায়েল বিদ্যালয় ও হাসপাতালেও নিয়মিত হামলা চালিয়ে শিশুদের হত্যা করেছে।

‘চিলড্রেন ইন আর্মড কনফ্লিক্ট’ শীর্ষক এই প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০২৩ সালের তুলনায় গত বছর বিশ্বব্যাপী শিশুদের ওপর গুরুতর সহিংসতা ২৫ শতাংশ বেড়েছে। এতে বলা হয়েছে, গত বছর শিশুদের বিরুদ্ধে ৪১ হাজার ৩৭০টি গুরুতর সহিংসতার তথ্য যাচাই করতে পেরেছে তারা। এর মধ্যে ২০ শতাংশ সহিংসতার ঘটনা ঘটেছে ইসরায়েলি বাহিনীর হাতে।

গাজায় মানবসৃষ্ট পানির সংকট নিয়ে সতর্ক করেছে জাতিসংঘের শিশুবিষয়ক সংস্থা ইউনিসেফ। গতকাল সুইজারল্যান্ডের জেনেভায় সংস্থাটির মুখপাত্র জেমস এল্ডার সাংবাদিকদের বলেন, গাজায় সুপেয় পানির তীব্র সংকট চলছে। সুপেয় পানির ৬০ শতাংশ উৎস ধ্বংস হয়ে গেছে। এভাবে চলতে থাকলে তৃষ্ণায় মারা যাবে শিশুরা।

.

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: ত র ণ ব তরণক ন দ র গ জ য় ইসর য় ল ইসর য় ল র হ য় ইসর য় ল র গতক ল

এছাড়াও পড়ুন:

নিরস্ত্রীকরণে সম্মতির খবর নাকচ: হামাস বলল, দখলদারির মোকাবিলা জাতীয় ও আইনি অধিকার

গাজায় যুদ্ধবিরতি নিয়ে ইসরায়েলের সঙ্গে আলোচনা চলাকালে অস্ত্রত্যাগের বিষয়ে সম্মতি জানানোর খবরের বিরোধিতা করেছে ফিলিস্তিনের স্বাধীনতাকামী সংগঠন হামাস। তারা বলেছে, ফিলিস্তিনি ভূখণ্ডে ইসরায়েলি দখলদারি মোকাবিলার জাতীয় ও আইনি অধিকার তাদের রয়েছে।

যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের মধ্যপ্রাচ্যবিষয়ক বিশেষ দূত স্টিভ উইটকফ গাজায় আটক থাকা ইসরায়েলি জিম্মিদের স্বজনদের সঙ্গে বৈঠক করেছেন। বৈঠকে উইটকফ তাঁদের বলেন, হামাস জানিয়েছে, তারা ‘নিরস্ত্রীকরণে প্রস্তুত’। ইসরায়েলি সংবাদমাধ্যম হারেৎজ এটা ফলাও করে প্রচার করেছে।

মার্কিন দূতের এমন মন্তব্য সংবাদমাধ্যমে প্রচারের পর গতকাল শনিবার এর তীব্র বিরোধিতা করে হামাস। এক বিবৃতিতে সংগঠনটি বলেছে, যতক্ষণ (ইসরায়েলি) দখলদারি বহাল থাকবে, ততক্ষণ তা প্রতিরোধ করা এবং সেটার বিরুদ্ধে অস্ত্র ধরা তাদের জাতীয় ও আইনি অধিকার।

‘(ফিলিস্তিনি ভূখণ্ড) পুনরুদ্ধার না হওয়া পর্যন্ত (দখলদারির বিরুদ্ধে অস্ত্র ধরা) আমাদের পূর্ণ জাতীয় অধিকার। এর মধ্যে প্রধান হলো, জেরুজালেমকে রাজধানী করে একটি সম্পূর্ণ সার্বভৌম ও স্বাধীন ফিলিস্তিনি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করা। এ অধিকার ত্যাগ করা যাবে না’, বলেছে হামাস।

স্টিভ উইটকফ গতকাল ইসরায়েলের তেল আবিবে জিম্মিদের স্বজনদের সঙ্গে দেখা করেন। এর এক দিন আগে তিনি গাজায় গিয়ে যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েল–সমর্থিত ‘বিতর্কিত’ সংস্থা জিএইচএফ পরিচালিত ত্রাণ সরবরাহ কেন্দ্র ঘুরে দেখেন।

আরও পড়ুনস্বাধীন ফিলিস্তিন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা না হওয়া পর্যন্ত প্রতিরোধ চলবে: হামাস০১ আগস্ট ২০২৫

গাজার এখনকার অপুষ্টিজনিত সংকটময় পরিস্থিতিতে স্টিভ উইটকফের এ সফরকে ‘সাজানো অনুষ্ঠান’ বলে সমালোচনা করেছে হামাস।

গত সপ্তাহে জাতিসংঘ জানিয়েছে, গত মে মাসে জিএইচএফ ত্রাণকেন্দ্র পরিচালনা শুরু করার পর থেকে এ পর্যন্ত ১ হাজার ৩০০–এর বেশি ফিলিস্তিনি ত্রাণ নিতে গিয়ে হামলায় নিহত হয়েছেন।

আরও পড়ুনভাইরাল হওয়া ছবিটি নিয়ে বিশ্বজুড়ে ক্ষোভ-বিতর্ক, পেছনের সত্যটা কী১৮ ঘণ্টা আগে

গাজায় হত্যাকাণ্ড আর জিএইচএফের কার্যক্রমের ক্রমবর্ধমান সমালোচনা সত্ত্বেও ট্রাম্প প্রশাসন দৃঢ়ভাবে এ সংস্থার পাশে দাঁড়িয়েছে। গত জুনে ওয়াশিংটন জিএইচএফের জন্য ৩০ মিলিয়ন (৩ কোটি) ডলার তহবিল অনুমোদনের কথা জানিয়েছে।

একদিকে গাজায় দুর্ভিক্ষ পরিস্থিতি, অন্যদিকে ফিলিস্তিনকে রাষ্ট্রের স্বীকৃতি দেওয়ার বিষয়ে ক্রমবর্ধমান আন্তর্জাতিক চাপের মধ্যে হামাসের নিরস্ত্রীকরণের বিষয়ে ওই মন্তব্য করেছেন স্টিভ উইটকফ।

আরও পড়ুনগাজার নাসের হাসপাতালে পাঁচ দিনে কী কী দেখলেন রয়টার্সের সাংবাদিকেরা৩১ জুলাই ২০২৫আরও পড়ুনগাজায় নৃশংসতা চালিয়ে ইসরায়েল কি পশ্চিমা বিশ্বেও একঘরে হয়ে যাচ্ছে০১ আগস্ট ২০২৫

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • খেলাধুলায় ‘চ্যাম্পিয়ন’ ফিলিস্তিনি কিশোরকে মরতে হলো খাবারের অভাবে
  • নিরস্ত্রীকরণে সম্মতির খবর নাকচ: হামাস বলল, দখলদারির মোকাবিলা জাতীয় ও আইনি অধিকার
  • গাজায় ইসরায়েলি হামলায় প্রাণ গেল আরো ৬৮ ফিলিস্তিনির
  • ক্ষুধায় গাজার শিশুর মৃত্যু আর ইসরায়েলি টিভির রান্নার অনুষ্ঠান