কয়েক দিনের পাল্টাপাল্টি হামলার পর ইরান ও ইসরায়েল একটি সম্পূর্ণ ও সর্বাত্মক যুদ্ধবিরতিতে সম্মত হয়েছে বলে জানিয়েছেন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। ইরান ও ইসরায়েলের সংবাদমাধ্যম থেকেও যুদ্ধবিরতি শুরুর খবর দেওয়া হয়েছে। তবে এর মধ্যেই ইসরায়েলে ইরানের হামলা চালানোর খবর আসছে।

এ যুদ্ধবিরতির মাধ্যমে হয়তো মধ্যপ্রাচ্যে আরেকটি সর্বাত্মক যুদ্ধের সম্ভাবনা এড়ানো সম্ভব হবে—১৩ জুন ইরানে ইসরায়েলের আকস্মিক হামলার মধ্য দিয়ে যে সংঘাতের সূচনা হয়েছিল।

ইরানের তিনটি পারমাণবিক স্থাপনায় হামলা চালিয়ে যুক্তরাষ্ট্রও এই সংঘাতে সরাসরি জড়িয়ে পড়েছিল।

প্রায় ১২ দিন ধরে চলা এ সংঘাতে বারবারই একটি নাম উচ্চারিত হয়েছে, সেটি হলো হরমুজ প্রণালি।

ইসরায়েল ও যুক্তরাষ্ট্রের হামলার পর প্রতিশোধমূলক ব্যবস্থা হিসেবে নৌপথে জ্বালানি, বিশেষ করে তেল পরিবহনের গুরুত্বপূর্ণ এ পথটি বন্ধ করে দেওয়ার কথা বিবেচনা করছে ইরান। দেশটির পার্লামেন্টও এ ধরনের পদক্ষেপে সমর্থন দিয়েছে।

হরমুজ প্রণালি দিয়ে প্রতিদিন বিশ্বের প্রায় এক–পঞ্চমাংশ তেল পরিবহন করা হয়। সত্যিই কি হরমুজ প্রণালি বন্ধ করে দিতে পারে ইরান? যদি বন্ধ করে দেয় তবে বিশ্ব বাণিজ্যের ওপর এর কী প্রভাব পড়তে পারে—আল–জাজিরার বিশ্লেষণে তা তুলে ধরা হয়েছে।

এ প্রণালি পারস্য উপসাগরকে ওমান উপসাগর ও আরব সাগরের সঙ্গে যুক্ত করেছে। ভৌগোলিকভাবে বলতে গেলে, প্রণালিটি পারস্য উপসাগরকে সরাসরি ওমান উপসাগরের সঙ্গে যুক্ত করে এবং সে পথ ধরে জাহাজগুলো আরব সাগরে তথা ভারত মহাসাগরে প্রবেশ করে।হরমুজ প্রণালি কোথায়

হরমুজ প্রণালি পারস্য উপসাগরে যাওয়ার একমাত্র সামুদ্রিক প্রবেশপথ। এর এক পাশে ইরান, অন্য পাশে ওমান ও সংযুক্ত আরব আমিরাত। এ প্রণালি দিয়ে প্রতিদিন বিশ্বের মোট তেল সরবরাহের এক-পঞ্চমাংশ, অর্থাৎ প্রায় ২ কোটি ব্যারেল তেল ও বিপুল পরিমাণ তরলীকৃত গ্যাস পরিবহন করা হয়।

এ প্রণালি পারস্য উপসাগরকে ওমান উপসাগর ও আরব সাগরের সঙ্গে যুক্ত করেছে। ভৌগোলিকভাবে বলতে গেলে, প্রণালিটি পারস্য উপসাগরকে সরাসরি ওমান উপসাগরের সঙ্গে যুক্ত করে এবং সে পথ ধরে জাহাজগুলো আরব সাগরে তথা ভারত মহাসাগরে প্রবেশ করে।

যুক্তরাষ্ট্রের জ্বালানি তথ্য সংস্থা হরমুজ প্রণালিকে ‘বিশ্বের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ তেল পরিবহন পথ’ বলে বর্ণনা করেছে।

প্রণালিটির সবচেয়ে সরু অংশ ৩৩ কিলোমিটার (২১ মাইল) চওড়া। তবে জাহাজ চলাচলের পথ আরও সরু, মাত্র ৩ কিলোমিটার (২ মাইল) চওড়া।

১৩ জুন ইসরায়েল ইরানে আকস্মিক হামলা চালানোর পর থেকে জ্বালানি ব্যবসায়ীরা উচ্চ সতর্কতায় রয়েছেন। গতকাল সোমবার পর্যন্ত তেল পরিবহন করে এমন অন্তত পাঁচটি জাহাজ হরমুজ প্রণালি থাকে ফিরে গেছে।

এ প্রণালি বন্ধের অনুমোদন কে দিতে পারে

ইরান অতীতেও হরমুজ প্রণালি বন্ধ করার হুমকি দিয়েছে, কিন্তু কখনো সে হুমকি কার্যকর করেনি।

ইসরায়েল ও যুক্তরাষ্ট্রের হামলার পর প্রতিশোধ হিসেবে ইরান এ প্রণালি বন্ধ করে দেওয়ার কথা বলেছে। দেশটির পার্লামেন্ট এ–সংক্রান্ত একটি প্রস্তাবে অনুমোদনও দিয়েছে। এ বিষয়ে ইরানের সর্বোচ্চ জাতীয় নিরাপত্তা পরিষদ চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেয় বলে গত রোববার খবরে জানিয়েছে ইরানের প্রেস টিভি।

তেহরান নৌপথটি বন্ধ করবে কি না, এমন এক প্রশ্নের সরাসরি জবাব রোববার এড়িয়ে গেছেন ইরানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী আব্বাস আরাগচি। তিনি বলেন, ‘ইরানের কাছে নানা ধরনের বিকল্প পথ খোলা রয়েছে।’

যদি ইরান প্রণালিটি বন্ধ করে দেয়, তবে সেটি তাদের অর্থনীতির জন্য আত্মহত্যার শামিল হবে। আমরা এর সম্ভাব্য বিকল্প ভাবছি, তবে অন্য দেশগুলোকেও বিষয়টি নিয়ে সচেতন হতে হবে। এটি আমাদের চেয়ে অন্য দেশের অর্থনীতিকে অনেক বেশি ক্ষতিগ্রস্ত করবে।মার্কো রুবিও, যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রীইরান কীভাবে হরমুজ প্রণালি বন্ধ করতে পারে

জাহাজ চলাচল বন্ধ করতে ইরান হরমুজ প্রণালিজুড়ে মাইন স্থাপন করতে পারে।

ইরানের ইসলামিক রেভল্যুশনারি গার্ড কোর (আইআরজিসি) উপসাগরে জাহাজে হামলা চালাতে বা সেগুলো জব্দ করার চেষ্টা করতে পারে, যা তারা অতীতে কয়েকবার করেছে।

১৯৮০-এর দশকে ইরান-ইরাক যুদ্ধের সময়, দুই পক্ষ পারস্য উপসাগরে তথাকথিত ‘ট্যাংকার যুদ্ধ’ চালায়। সে সময় ইরাক ইরানের জাহাজগুলো লক্ষ্যবস্তু করেছিল, আর ইরান বাণিজ্যিক জাহাজে হামলা চালিয়েছিল। সৌদি আবর ও কুয়েতের তেল ট্যাংকার, এমনকি মার্কিন জাহাজগুলোও সে সময় ইরানের হামলার লক্ষ্যবস্তু হয়।

হরমুজ প্রণালি বন্ধ হলে চীনের ওপরও বড় আঘাত পড়ত। কারণ, ইরানের রপ্তানি করা প্রায় ৯০ শতাংশ তেল বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম অর্থনীতির এই দেশটিতে যায়। এর পরিমাণ দৈনিক প্রায় ১৬ লাখ ব্যারেল। ইরানের তেল রপ্তানির ওপর আন্তর্জাতিক নিষেধাজ্ঞা রয়েছে।

২০০৭ সালের শেষ দিকে ইরান ও মার্কিন নৌবাহিনীর মধ্যে একাধিক ছোটবড় সংঘর্ষের জেরে হরমুজ প্রণালি ঘিরে উত্তেজনা আবার বৃদ্ধি পায়।

২০২৩ সালের এপ্রিলে ইরান ওমান উপসাগরে যুক্তরাষ্ট্রের অন্যতম বৃহৎ তেল কোম্পানি শেভরনের মালিকানাধীন একটি ট্যাংকার জব্দ করে। এক বছরের বেশি সময় পর ট্যাংকারটি ছেড়ে দেওয়া হয়।

আরও পড়ুনহরমুজ প্রণালি কী, ইসরায়েলের বিরুদ্ধে ইরান কি তার ‘ট্রাম্প কার্ড’ ব্যবহার করবে১৫ জুন ২০২৫বিশ্ববাণিজ্যে কী প্রভাব পড়তে পারে

যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী মার্কো রুবিও রোববার চীনের প্রতি ইরানকে হরমুজ প্রণালি বন্ধ না করতে রাজি করানোর আহ্বান জানিয়েছিলেন।

ফক্স নিউজকে রুবিও বলেছিলেন, ‘যদি ইরান প্রণালিটি বন্ধ করে দেয়, তবে সেটি তাদের অর্থনীতির জন্য আত্মহত্যার শামিল হবে। আমরা এর সম্ভাব্য বিকল্প ভাবছি, তবে অন্য দেশগুলোকেও বিষয়টি নিয়ে সচেতন হতে হবে। এটি আমাদের চেয়ে অন্য দেশের অর্থনীতিকে অনেক বেশি ক্ষতিগ্রস্ত করবে।’

হরমুজ প্রণালি বন্ধ করা উপসাগরীয় আরব দেশগুলোকে যুদ্ধে টেনে আনার ঝুঁকি তৈরি করতে পারে। এ দেশগুলো ইরানের ওপর ইসরায়েলের হামলার যথেষ্ট সমালোচনা করেছে। কারণ, ইসরায়েল ও যুক্তরাষ্ট্রের ওপর প্রতিশোধ নিতে ইরান এ প্রণালি বন্ধ করে দিলে তাদের নিজস্ব বাণিজ্যিক স্বার্থও ক্ষতিগ্রস্ত হবে।

হরমুজ বন্ধ হলে চীনের ওপরও বড় আঘাত পড়বে। কারণ, ইরানের রপ্তানি করা প্রায় ৯০ শতাংশ তেল বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম অর্থনীতির এ দেশটিতে যায়। এর পরিমাণ দৈনিক প্রায় ১৬ লাখ ব্যারেল। ইরানের তেল রপ্তানির ওপর আন্তর্জাতিক নিষেধাজ্ঞা রয়েছে।

গোল্ডম্যান স্যাকসের তথ্য, হরমুজ প্রণালি অবরোধ করলে তেলের দাম ব্যারেলপ্রতি ১০০ ডলার ছাড়াতে পারে। এতে বিশ্বজুড়ে তেলের উৎপাদন খরচ বাড়বে এবং শেষ পর্যন্ত ভোক্তামূল্যে এর বড় প্রভাব পড়বে; বিশেষ করে খাদ্য, পোশাক ও রাসায়নিকের মতো পণ্যের ক্ষেত্রে।

আরও পড়ুনহরমুজ প্রণালি থেকে ফিরে গেল দুই তেল পরিবহন জাহাজ ২৩ জুন ২০২৫

গোল্ডম্যান স্যাকস হলো বিশ্ববাজারে অত্যন্ত প্রভাবশালী একটি আর্থিক প্রতিষ্ঠান, যা অর্থনীতি ও বিনিয়োগ–সম্পর্কিত তথ্যের বিশ্লেষণ এবং পূর্বাভাস দিয়ে থাকে।

দ্বিতীয় উপসাগরীয় যুদ্ধ (ইরাক যুদ্ধ) শুরুর আগে বিশ্ববাজারে অপরিশোধিত তেলের দাম প্রায় ৪৬ শতাংশ পর্যন্ত বেড়ে গিয়েছিল।

একইভাবে ২০২২ সালের ফেব্রুয়ারিতে রাশিয়া ইউক্রেন আক্রমণ করলে বিশ্ববাজারে তেলের দাম হঠাৎ বেড়ে ব্যারেলপ্রতি ১৩০ ডলারে পৌঁছে যায়। পরে ওই বছরই আগস্টের মাঝামাঝি দাম আবার আক্রমণ–পূর্ব স্তরে, অর্থাৎ ৯৫ ডলারে নেমে আসে।

আরও পড়ুনট্রাম্পের যুদ্ধবিরতি ঘোষণা: কত ঘণ্টায় কীভাবে কার্যকর হবে ৬ ঘণ্টা আগে.

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: য ক তর ষ ট র র ত ল পর বহন ইসর য় ল র অন য দ শ য ক ত কর ন র ওপর ব শ বব

এছাড়াও পড়ুন:

যাচাই-বাছাই ছাড়াই ফেসবুকে পোস্ট দিয়েছেন হাসনাত: দুদক

সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) দক্ষিণাঞ্চলের মুখ্য সংগঠক হাসনাত আব্দুল্লাহর একটি পোস্ট দৃষ্টি গোচর হয়েছে দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক)। সংস্থাটি বলছে, পোস্টটিতে তিনি যাচাই-বাছাই ছাড়াই দুদকের মহাপরিচালকসহ কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে মানহানিকর বক্তব্য দিয়েছেন।এ বিষয়ে সবার অবগতির জন্য জানানো যাচ্ছে, একটি প্রতারক দুদকের চেয়ারম্যান, মহাপরিচালক বা কর্মকর্তা পরিচয়ে মামলা থেকে অব্যাহতি দেওয়ার কথা বলে প্রতারণা করে আসছে। এর সঙ্গে দুদকের কর্মকর্তাদের কোনো সম্পর্ক নেই। 

মঙ্গলবার দুদক মহাপরিচালক ও মুখপাত্র মো. আক্তার হোসেন সাংবাদিকদের এসব কথা বলেন। 

তিনি আরও বলেন, দুদক ইতোমধ্যে এ বিষয়ে আইনি ব্যবস্থা নিয়েছে এবং প্রতারক চক্রের অনেককে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। এর আগেও দুদক প্রতারণা রোধে সবাইকে সতর্ক করে আসছে। যা বিভিন্ন জাতীয় গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে। এমন প্রতারণার শিকার হয়ে অনেকে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে দুদককে দোষারোপ করে, যার ফলে দুদকের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হয়।

দুদক মহাপরিচালক বলেন, প্রতারণামূলক ফোন কল, বার্তা বা ব্যক্তিগত যোগাযোগের মাধ্যমে কারও কাছ থেকে টাকা চাওয়া হলে কিংবা কোনো প্রতারণা বা অনিয়মের তথ্য পাওয়া গেলে দুদকের টোল ফ্রি হটলাইন-১০৬ নম্বরে জানানোর অথবা নিকটস্থ দুদক কার্যালয় বা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সহায়তা নেওয়ার জন্য অনুরোধ করা হলো।
 

সম্পর্কিত নিবন্ধ