কয়েক দিনের পাল্টাপাল্টি হামলার পর ইরান ও ইসরায়েল একটি সম্পূর্ণ ও সর্বাত্মক যুদ্ধবিরতিতে সম্মত হয়েছে বলে জানিয়েছেন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। ইরান ও ইসরায়েলের সংবাদমাধ্যম থেকেও যুদ্ধবিরতি শুরুর খবর দেওয়া হয়েছে। তবে এর মধ্যেই ইসরায়েলে ইরানের হামলা চালানোর খবর আসছে।

এ যুদ্ধবিরতির মাধ্যমে হয়তো মধ্যপ্রাচ্যে আরেকটি সর্বাত্মক যুদ্ধের সম্ভাবনা এড়ানো সম্ভব হবে—১৩ জুন ইরানে ইসরায়েলের আকস্মিক হামলার মধ্য দিয়ে যে সংঘাতের সূচনা হয়েছিল।

ইরানের তিনটি পারমাণবিক স্থাপনায় হামলা চালিয়ে যুক্তরাষ্ট্রও এই সংঘাতে সরাসরি জড়িয়ে পড়েছিল।

প্রায় ১২ দিন ধরে চলা এ সংঘাতে বারবারই একটি নাম উচ্চারিত হয়েছে, সেটি হলো হরমুজ প্রণালি।

ইসরায়েল ও যুক্তরাষ্ট্রের হামলার পর প্রতিশোধমূলক ব্যবস্থা হিসেবে নৌপথে জ্বালানি, বিশেষ করে তেল পরিবহনের গুরুত্বপূর্ণ এ পথটি বন্ধ করে দেওয়ার কথা বিবেচনা করছে ইরান। দেশটির পার্লামেন্টও এ ধরনের পদক্ষেপে সমর্থন দিয়েছে।

হরমুজ প্রণালি দিয়ে প্রতিদিন বিশ্বের প্রায় এক–পঞ্চমাংশ তেল পরিবহন করা হয়। সত্যিই কি হরমুজ প্রণালি বন্ধ করে দিতে পারে ইরান? যদি বন্ধ করে দেয় তবে বিশ্ব বাণিজ্যের ওপর এর কী প্রভাব পড়তে পারে—আল–জাজিরার বিশ্লেষণে তা তুলে ধরা হয়েছে।

এ প্রণালি পারস্য উপসাগরকে ওমান উপসাগর ও আরব সাগরের সঙ্গে যুক্ত করেছে। ভৌগোলিকভাবে বলতে গেলে, প্রণালিটি পারস্য উপসাগরকে সরাসরি ওমান উপসাগরের সঙ্গে যুক্ত করে এবং সে পথ ধরে জাহাজগুলো আরব সাগরে তথা ভারত মহাসাগরে প্রবেশ করে।হরমুজ প্রণালি কোথায়

হরমুজ প্রণালি পারস্য উপসাগরে যাওয়ার একমাত্র সামুদ্রিক প্রবেশপথ। এর এক পাশে ইরান, অন্য পাশে ওমান ও সংযুক্ত আরব আমিরাত। এ প্রণালি দিয়ে প্রতিদিন বিশ্বের মোট তেল সরবরাহের এক-পঞ্চমাংশ, অর্থাৎ প্রায় ২ কোটি ব্যারেল তেল ও বিপুল পরিমাণ তরলীকৃত গ্যাস পরিবহন করা হয়।

এ প্রণালি পারস্য উপসাগরকে ওমান উপসাগর ও আরব সাগরের সঙ্গে যুক্ত করেছে। ভৌগোলিকভাবে বলতে গেলে, প্রণালিটি পারস্য উপসাগরকে সরাসরি ওমান উপসাগরের সঙ্গে যুক্ত করে এবং সে পথ ধরে জাহাজগুলো আরব সাগরে তথা ভারত মহাসাগরে প্রবেশ করে।

যুক্তরাষ্ট্রের জ্বালানি তথ্য সংস্থা হরমুজ প্রণালিকে ‘বিশ্বের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ তেল পরিবহন পথ’ বলে বর্ণনা করেছে।

প্রণালিটির সবচেয়ে সরু অংশ ৩৩ কিলোমিটার (২১ মাইল) চওড়া। তবে জাহাজ চলাচলের পথ আরও সরু, মাত্র ৩ কিলোমিটার (২ মাইল) চওড়া।

১৩ জুন ইসরায়েল ইরানে আকস্মিক হামলা চালানোর পর থেকে জ্বালানি ব্যবসায়ীরা উচ্চ সতর্কতায় রয়েছেন। গতকাল সোমবার পর্যন্ত তেল পরিবহন করে এমন অন্তত পাঁচটি জাহাজ হরমুজ প্রণালি থাকে ফিরে গেছে।

এ প্রণালি বন্ধের অনুমোদন কে দিতে পারে

ইরান অতীতেও হরমুজ প্রণালি বন্ধ করার হুমকি দিয়েছে, কিন্তু কখনো সে হুমকি কার্যকর করেনি।

ইসরায়েল ও যুক্তরাষ্ট্রের হামলার পর প্রতিশোধ হিসেবে ইরান এ প্রণালি বন্ধ করে দেওয়ার কথা বলেছে। দেশটির পার্লামেন্ট এ–সংক্রান্ত একটি প্রস্তাবে অনুমোদনও দিয়েছে। এ বিষয়ে ইরানের সর্বোচ্চ জাতীয় নিরাপত্তা পরিষদ চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেয় বলে গত রোববার খবরে জানিয়েছে ইরানের প্রেস টিভি।

তেহরান নৌপথটি বন্ধ করবে কি না, এমন এক প্রশ্নের সরাসরি জবাব রোববার এড়িয়ে গেছেন ইরানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী আব্বাস আরাগচি। তিনি বলেন, ‘ইরানের কাছে নানা ধরনের বিকল্প পথ খোলা রয়েছে।’

যদি ইরান প্রণালিটি বন্ধ করে দেয়, তবে সেটি তাদের অর্থনীতির জন্য আত্মহত্যার শামিল হবে। আমরা এর সম্ভাব্য বিকল্প ভাবছি, তবে অন্য দেশগুলোকেও বিষয়টি নিয়ে সচেতন হতে হবে। এটি আমাদের চেয়ে অন্য দেশের অর্থনীতিকে অনেক বেশি ক্ষতিগ্রস্ত করবে।মার্কো রুবিও, যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রীইরান কীভাবে হরমুজ প্রণালি বন্ধ করতে পারে

জাহাজ চলাচল বন্ধ করতে ইরান হরমুজ প্রণালিজুড়ে মাইন স্থাপন করতে পারে।

ইরানের ইসলামিক রেভল্যুশনারি গার্ড কোর (আইআরজিসি) উপসাগরে জাহাজে হামলা চালাতে বা সেগুলো জব্দ করার চেষ্টা করতে পারে, যা তারা অতীতে কয়েকবার করেছে।

১৯৮০-এর দশকে ইরান-ইরাক যুদ্ধের সময়, দুই পক্ষ পারস্য উপসাগরে তথাকথিত ‘ট্যাংকার যুদ্ধ’ চালায়। সে সময় ইরাক ইরানের জাহাজগুলো লক্ষ্যবস্তু করেছিল, আর ইরান বাণিজ্যিক জাহাজে হামলা চালিয়েছিল। সৌদি আবর ও কুয়েতের তেল ট্যাংকার, এমনকি মার্কিন জাহাজগুলোও সে সময় ইরানের হামলার লক্ষ্যবস্তু হয়।

হরমুজ প্রণালি বন্ধ হলে চীনের ওপরও বড় আঘাত পড়ত। কারণ, ইরানের রপ্তানি করা প্রায় ৯০ শতাংশ তেল বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম অর্থনীতির এই দেশটিতে যায়। এর পরিমাণ দৈনিক প্রায় ১৬ লাখ ব্যারেল। ইরানের তেল রপ্তানির ওপর আন্তর্জাতিক নিষেধাজ্ঞা রয়েছে।

২০০৭ সালের শেষ দিকে ইরান ও মার্কিন নৌবাহিনীর মধ্যে একাধিক ছোটবড় সংঘর্ষের জেরে হরমুজ প্রণালি ঘিরে উত্তেজনা আবার বৃদ্ধি পায়।

২০২৩ সালের এপ্রিলে ইরান ওমান উপসাগরে যুক্তরাষ্ট্রের অন্যতম বৃহৎ তেল কোম্পানি শেভরনের মালিকানাধীন একটি ট্যাংকার জব্দ করে। এক বছরের বেশি সময় পর ট্যাংকারটি ছেড়ে দেওয়া হয়।

আরও পড়ুনহরমুজ প্রণালি কী, ইসরায়েলের বিরুদ্ধে ইরান কি তার ‘ট্রাম্প কার্ড’ ব্যবহার করবে১৫ জুন ২০২৫বিশ্ববাণিজ্যে কী প্রভাব পড়তে পারে

যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী মার্কো রুবিও রোববার চীনের প্রতি ইরানকে হরমুজ প্রণালি বন্ধ না করতে রাজি করানোর আহ্বান জানিয়েছিলেন।

ফক্স নিউজকে রুবিও বলেছিলেন, ‘যদি ইরান প্রণালিটি বন্ধ করে দেয়, তবে সেটি তাদের অর্থনীতির জন্য আত্মহত্যার শামিল হবে। আমরা এর সম্ভাব্য বিকল্প ভাবছি, তবে অন্য দেশগুলোকেও বিষয়টি নিয়ে সচেতন হতে হবে। এটি আমাদের চেয়ে অন্য দেশের অর্থনীতিকে অনেক বেশি ক্ষতিগ্রস্ত করবে।’

হরমুজ প্রণালি বন্ধ করা উপসাগরীয় আরব দেশগুলোকে যুদ্ধে টেনে আনার ঝুঁকি তৈরি করতে পারে। এ দেশগুলো ইরানের ওপর ইসরায়েলের হামলার যথেষ্ট সমালোচনা করেছে। কারণ, ইসরায়েল ও যুক্তরাষ্ট্রের ওপর প্রতিশোধ নিতে ইরান এ প্রণালি বন্ধ করে দিলে তাদের নিজস্ব বাণিজ্যিক স্বার্থও ক্ষতিগ্রস্ত হবে।

হরমুজ বন্ধ হলে চীনের ওপরও বড় আঘাত পড়বে। কারণ, ইরানের রপ্তানি করা প্রায় ৯০ শতাংশ তেল বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম অর্থনীতির এ দেশটিতে যায়। এর পরিমাণ দৈনিক প্রায় ১৬ লাখ ব্যারেল। ইরানের তেল রপ্তানির ওপর আন্তর্জাতিক নিষেধাজ্ঞা রয়েছে।

গোল্ডম্যান স্যাকসের তথ্য, হরমুজ প্রণালি অবরোধ করলে তেলের দাম ব্যারেলপ্রতি ১০০ ডলার ছাড়াতে পারে। এতে বিশ্বজুড়ে তেলের উৎপাদন খরচ বাড়বে এবং শেষ পর্যন্ত ভোক্তামূল্যে এর বড় প্রভাব পড়বে; বিশেষ করে খাদ্য, পোশাক ও রাসায়নিকের মতো পণ্যের ক্ষেত্রে।

আরও পড়ুনহরমুজ প্রণালি থেকে ফিরে গেল দুই তেল পরিবহন জাহাজ ২৩ জুন ২০২৫

গোল্ডম্যান স্যাকস হলো বিশ্ববাজারে অত্যন্ত প্রভাবশালী একটি আর্থিক প্রতিষ্ঠান, যা অর্থনীতি ও বিনিয়োগ–সম্পর্কিত তথ্যের বিশ্লেষণ এবং পূর্বাভাস দিয়ে থাকে।

দ্বিতীয় উপসাগরীয় যুদ্ধ (ইরাক যুদ্ধ) শুরুর আগে বিশ্ববাজারে অপরিশোধিত তেলের দাম প্রায় ৪৬ শতাংশ পর্যন্ত বেড়ে গিয়েছিল।

একইভাবে ২০২২ সালের ফেব্রুয়ারিতে রাশিয়া ইউক্রেন আক্রমণ করলে বিশ্ববাজারে তেলের দাম হঠাৎ বেড়ে ব্যারেলপ্রতি ১৩০ ডলারে পৌঁছে যায়। পরে ওই বছরই আগস্টের মাঝামাঝি দাম আবার আক্রমণ–পূর্ব স্তরে, অর্থাৎ ৯৫ ডলারে নেমে আসে।

আরও পড়ুনট্রাম্পের যুদ্ধবিরতি ঘোষণা: কত ঘণ্টায় কীভাবে কার্যকর হবে ৬ ঘণ্টা আগে.

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: য ক তর ষ ট র র ত ল পর বহন ইসর য় ল র অন য দ শ য ক ত কর ন র ওপর ব শ বব

এছাড়াও পড়ুন:

পেঁয়াজের দাম প্রতিবছর বাড়ে কেন?

বাঙালির রান্নাঘরের অন্যতম প্রধান উপাদান হলো পেঁয়াজ। কিন্তু প্রতিবছর একটা নির্দিষ্ট সময়ে এই পেঁয়াজের ঝাঁঝে পুড়তে হয়। বাজারে পেঁয়াজের মূল্যবৃদ্ধি এখন দেশের সাধারণ মানুষের কাছে একটি বার্ষিক আতঙ্ক হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। কিন্তু এই অস্থিরতার কারণ কী? 

সাধারণ সরবরাহের ঘাটতি, নাকি এর আড়ালে লুকিয়ে রছে অসাধু ব্যবসায়ীদের সংঘবদ্ধ কারসাজি? কেন সরকার শত চেষ্টা করেও এই নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যটির দাম নিয়ন্ত্রণে আনতে ব্যর্থ হচ্ছে। ক্রেতা-বিক্রেতাদের সঙ্গে কথা বলে এইসব প্রশ্নের উত্তরে বেশ কিছু তথ্য জানা গেছে।

উৎপাদন ও সরবরাহের সমস্যা:
দেশে সাধারণত শীতকালে (রবি মৌসুম) পেঁয়াজ উৎপাদন হয় এবং তা সংরক্ষণ করে সারা বছরের চাহিদা মেটানো হয়। গ্রীষ্মকালে দেশি পেঁয়াজ প্রায় শেষ হয়ে এলে বাজারে সরবরাহ কমে যায়। নতুন পেঁয়াজ (মুড়িকাটা) বাজারে আসার আগ পর্যন্ত একটি সংকটকাল তৈরি হয়। পেঁয়াজ উৎপাদনের বীজ, সার এবং শ্রমিকের মজুরি বৃদ্ধির কারণে পেঁয়াজের উৎপাদন ব্যয় ক্রমাগত বাড়ছে বলে দাবি করছে বিক্রেতারা।

এছাড়া দেশে পেঁয়াজ সংরক্ষণের জন্য আধুনিক ও পর্যাপ্ত ব্যবস্থা নেই। ফলে উৎপাদনের পর প্রায় ২৫ শতাংশ পেঁয়াজ সংরক্ষণ, পরিবহন ও প্রক্রিয়াজাতকরণের সময় নষ্ট হয়ে যায়। এই বিপুল পরিমাণ নষ্ট হওয়া সরবরাহকে মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করে। ফলে বাজারে পেঁয়াজের দাম বাড়তে থাকে। 

মজুতদার ও অসাধু ব্যবসায়ীদের কারসাজি:
বাজারে অতি মুনাফার লোভে এক শ্রেণির মজুতদার ও অসাধু ব্যবসায়ীদের কারসাজি করে প্রতি বছর মৌসুমের শেষে যখন সরবরাহ কমতে শুরু করে তখন কৃত্রিম সংকট তৈরি করে পেঁয়াজ গুদামজাত করে রাখেন এবং বাজারে সরবরাহ কমিয়ে দেন। ফলে বাজারে পেঁয়াজের দাম বাড়তে থাকে।

সাধারণ খুচরা বিক্রেতারা বলছে, পেঁয়াজের দামের অস্বাভাবিক বৃদ্ধি স্বাভাবিক নিয়মে হয় না বরং একটি পরিকল্পিত সিন্ডিকেট এর পেছনে কাজ করে। যারা বিভিন্ন অজুহাতে দাম বাড়িয়ে দ্রুত বিপুল মুনাফা লুটতে চায়। এর সাথে জড়িত বড় বড় কোম্পানির আমদানিকারক। এছাড়া সরকারকে চাপে রাখতে অনেক সময় এই ধরনের সিন্ডিকেট পরিকল্পিতভাবে দাম বাড়িয়ে সরকারকে আমদানির অনুমতি দিতে বাধ্য করার চেষ্টা করে থাকে। ফলে সরকার বাধ্য হয়ে আমদানির অনুমতি দেয়।

আমদানি নির্ভরতা ও ভারতের রপ্তানি নীতি:
দেশে অভ্যন্তরীণ চাহিদা পুরোপুরি মেটানোর মতো পর্যাপ্ত ও দীর্ঘস্থায়ী মজুত না থাকায় বাংলাদেশকে একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ পেঁয়াজ আমদানি করতে হয়। মূলত, প্রতিবেশী দেশ ভারতের উপর এই নির্ভরতা অনেক বেশি।

এই সুযোগে ভারতে যখন পেঁয়াজের দাম বাড়ে বা উৎপাদন কম হয়, তখন সেখানকার সরকার তাদের অভ্যন্তরীণ বাজার নিয়ন্ত্রণ করার জন্য পেঁয়াজ রপ্তানিতে শুল্ক আরোপ করে আবার কখনো কখনো পুরোপুরি বন্ধ করে দেয়। এর সরাসরি প্রভাব পড়ে বাংলাদেশের বাজারে, কারণ আমদানির সুযোগ বন্ধ হয়ে যাওয়ায় দেশি পেঁয়াজের ওপর চাপ বাড়ে এবং দাম লাফিয়ে বাড়ে। 

এছাড়া দেশি কৃষকদের স্বার্থ রক্ষার জন্য অনেক সময় সরকার নির্দিষ্ট সময়ে পেঁয়াজ আমদানির অনুমতি দিতে দেরি করে। এই বিলম্বও বাজারে সরবরাহ কমিয়ে দিয়ে দাম বাড়িয়ে দেয় অতি মুনাফার লোভী ব্যবসায়ীরা।

সংরক্ষণে দুর্বলতা ও প্রাকৃতিক দুর্যোগ:
দেশে পেঁয়াজ সংরক্ষণের জন্য পর্যাপ্ত ও আধুনিক অবকাঠামো নেই। ফলে কৃষকের ঘরে বা সাধারণ গুদামে দীর্ঘ সময় রাখলে আর্দ্রতা ও অন্যান্য কারণে অনেক পেঁয়াজ পচে নষ্ট হয়ে যায়। বিক্রেতারা বলছে যদি পেঁয়াজ সংরক্ষণে জন্য আধুনিক হিমাগার তৈরি করা হয় তাহলে কিছু বাজারে সরবরাহ ঠিক থাকলে প্রতিবছর পেঁয়াজ দাম বাড়ার প্রবণতা কমে আসবে।

এছাড়া অনাবৃষ্টি, অতিবৃষ্টি, বন্যা বা বৈরী আবহাওয়ার জন্য পেঁয়াজের ফলনকে সরাসরি প্রভাবিত করে। আবার, অতিরিক্ত বৃষ্টিপাত মজুত করা পেঁয়াজ নষ্ট হওয়ার হার অনেক বাড়িয়ে দেয়। ফলে বাজারে সরবরাহ কমে যাওয়ায় পেঁয়াজের দাম বাড়তে থাকে।

কৃষক ও ক্রেতাদের মনোভাব:
বেশি লাভের আশায় অনেক সময় কৃষক তাদের উৎপাদিত পেঁয়াজ মজুত করে রাখে। আবার এই মজুত করা পেঁয়াজ বৈরী আবহাওয়ার জন্য অনেক সময় নষ্ট হয়ে যায়। ফলে বাজারে পেঁয়াজের সংকট দেখা যায়। যাতে দাম বেড়ে যায়।

আবার এক শ্রেণির ক্রেতা আছে যারা দাম বাড়ার প্রবণতা শুরু হলেই আতঙ্কিত হয়ে অতিরিক্ত পেঁয়াজ কিনে মজুত করা শুরু করেন। যা বাজারে বিদ্যমান সংকটকে আরো অস্থির করে তোলে। এই ধরনের ক্রেতাদের জন্য বাজারে পেঁয়াজের দাম আরও দ্রুত বৃদ্ধি পেতে থাকে।

সরকারি বিপণন সংস্থা ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) তথ্য মতে, গত এক সপ্তাহের ব্যবধানে দেশের বাজারে পেঁয়াজের দাম ৪০ শতাংশ বেড়েছে। মাসের ব্যবধানে যা বেড়েছে ৪৪.৮৩ শতাংশ।

কৃষি বিভাগের তথ্য মতে, গত অর্থবছরে বাংলাদেশে পেঁয়াজ উৎপাদনের লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয় ৩৬ লাখ টন। উৎপাদন হয়েছিল ৩৪ লাখ ১৭ হাজার টন। এ অর্থবছরে পেঁয়াজ উৎপাদনের লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছে ৩৮ লাখ টন। চলতি মৌসুমে দেশে পেঁয়াজের উৎপাদন প্রত্যাশিত মাত্রার কাছাকাছি হয়েছে। এবার উৎপাদন হয়েছে প্রায় ৩৬ লাখ টন। 

শুক্রবার (৭ নভেম্বর) রাজধানীর কারওয়ান বাজার, নিউমার্কেট, রায়েরবাজারসহ গুরুত্বপূর্ণ বাজারগুলোতে বিক্রেতাদের সঙ্গে কথা বলে যানা যায়, গত এক সপ্তাহে পেঁয়াজের দাম বেড়েছে ৪০ টাকা। গত সপ্তাহের প্রতি কেজি পেঁয়াজ বিক্রি হয়েছে ৮০ থেকে ৮৫ টাকা, এ সপ্তাহে বিক্রি হচ্ছে ১২০ থেকে ২২৫ টাকা। বিক্রেতারা আশঙ্কা করছে সামনের দিনগুলোতে পেঁয়াজের দাম আরো বাড়তে পারে।

রাজধানীর কারওয়ান বাজারের পেঁয়াজ বিক্রেতা শফিক বেপারির কাছে হঠাৎ দাম বাড়ার কারণ জানতে চাইলে তিনি রাইজিংবিডি ডটকমকে বলেন, “এটা তো আর নতুন কথা নয়! প্রতিবছর এই সময়ে পেঁয়াজের দাম বাড়িয়ে দেওয়া হয়। কিছুদিনের মধ্যেই দেশি পেঁয়াজ বাজারে আসবে, এই মুহূর্তে আমদানি অনুমতি যাতে দেওয়া হয় সেজন্য বড় বড় ব্যবসায়ী কৃত্রিম সংকট তৈরি করছে। কিন্তু সাধারণ ক্রেতারা এসে তাদের ক্ষোভ আমাদের উপর প্রকাশ করে। পেঁয়াজের দাম বাড়ার ক্ষেত্রে আমাদের কোন হাত নেই।”

রাজধানীর নিউমার্কেটের আরেক পেঁয়াজ ব্যবসায়ী নাজমুল সিকদার রাইজিংবিডি ডটকমকে বলেন, “গত সপ্তাহে পেঁয়াজ বিক্রি করেছি ৮০ থেকে ৮৫ টাকায়। এ সপ্তাহে আমাদের কিনতে হয়েছে ১০৫ থেকে ১১০ টাকায়। পরিবহন, লেবার, দোকান ভাড়া ও কর্মচারী খরচ দিয়ে ১২০ টাকা বিক্রি করলে আমাদের লস হয়। তারপরও ১২০ টাকা বিক্রি করতে হয়। পাইকারি পর্যায়ে পেঁয়াজের দাম এখন বাড়তি। আমরাও চাহিদা তুলনায় কম নিয়েছি। কিন্তু এক শ্রেণির ক্রেতা আছে যারা দাম বাড়বে শুনে বেশি করে কিনে রাখে। তাদের জন্য এই সমস্যাটা বেশি সৃষ্টি হয়। কারন যারা কম কেনে তখন তারা এসে আর নিতে পারে না। পাইকারি বিক্রেতারা আমাদেরকে জানিয়েছে পেঁয়াজের দাম আরো বাড়তে পারে। তাই খুচরা ব্যবসায়ীরা যে যার মত করে পারছে নিয়ে রাখছে।”

রাজধানীর কারওয়ান বাজারের পেঁয়াজের পাইকারি বিক্রেতারা শাহিন হাওলাদার রাইজিংবিডি ডটকমকে বলেন, “যদি সরবরাহ বাড়ে অথবা সরকার যদি পেঁয়াজ আমদানের অনুমতি দেয় তাহলে সামনের দাম কমতে পারে। অন্যথায় দাম কমার কোন সম্ভাবনা নেই। দেশে এখন পেঁয়াজের মজুত সেইভাবে নেই। আর এবার বৃষ্টির কারণে পেঁয়াজ উৎপাদনের প্রথমদিকে অনেকের ক্ষেত নষ্ট হয়ে গেছে। ফলে বাজারে নতুন পেঁয়াজ আসা পর্যন্ত দাম বলে আশঙ্কা করছি।”

রাজধানীর নিউমার্কেটে পেঁয়াজ কিনতে আসা গৃহিণী কাকলী আক্তার বলেন, “বাংলাদেশ সবকিছু সম্ভবের দেশ। যে যার মত করে পারছে সে সেভাবে কামিয়ে নিচ্ছে। এদেশের সাধারণ মানুষের কথা কেউ কখনো ভাবেনি। গত সপ্তাহে পেঁয়াজ কিনেছি ৮০ টাকায়, এ সপ্তাহের পেঁয়াজ কিনতে হচ্ছে ১২০ টাকায়! এর থেকে দুঃখের বিষয় কি আছে! এখানে সাধারণ মানুষের কথার কোন মূল্য নেই। আমাদের তো আয় ইনকাম বাড়ে না, কিন্তু দিনকে দিন সবকিছু দাম বাড়তে থাকে।”

ঢাকা/এস

সম্পর্কিত নিবন্ধ