‘বেশি মুনাফা পাবেন’ এই আশায় জীবনের সঞ্চয় তুলে দিয়েছিলেন অনেকেই। কেউ পোশাক কারখানায় ঘাম ঝরানো টাকা, কেউবা শেষ বয়সের ভরসা তুলে দেন, কিন্তু মুনাফার মুখ দেখেননি বেশি দিন। উল্টো আসল টাকাই মিলছে না। এই শোকে কেউ মারা গেছেন, কেউ দ্বারে দ্বারে ঘুরছেন টাকা ফেরত পাওয়ার আশায়, আবার কেউ আশ্রয় নিয়েছেন আদালতের।
নেত্রকোনার দুর্গাপুর উপজেলার গাঁওকান্দিয়া ইউনিয়নের জাগিরপাড়া এলাকার ‘প্যাসিফিক ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী সমবায় সমিতি লিমিটেড’ ঘিরেই ঘটেছে এই প্রতারণা। ২০১৯ সালে প্রতিষ্ঠিত এই সমিতি নানা কৌশলে মানুষের আস্থা অর্জন করে। প্রতি লাখে মাসে চার হাজার টাকা লাভের প্রতিশ্রুতি দিয়ে বহু মানুষের অর্থ জমা নেয় সমিতির লোকজন।
এই সমিতিতে টাকা জমা করেন পোশাক শ্রমিক রেহেনা খাতুন। ২০২১ সালে সাড়ে চার লাখ টাকা দিয়েছিলেন প্রতি লাখে মাসে ৪ হাজার টাকা লাভের আশায়। শুরুতে দুই মাস মুনাফা পেয়েছনে। এরপর থেকে মুনাফা বন্ধ, আসল টাকাও পাচ্ছেন না।
রেহেনা খাতুন জানান, তাঁর প্রতিবেশী চাচা জলিলকে বিশ্বাস করে টাকাগুলো দিয়েছিলেন। বলেছিলেন মাসে মাসে লাভ দেওয়া হবে। শুরুতে দুই মাস লাভের টাকা দিয়ে হঠাৎ বন্ধ করে দেয়। তখন থেকেই টাকার জন্য ঘুরছেন তিনি। তিনি বলেন, ‘চিন্তায় আমি অসুস্থ হয়ে গেছি, চারবার ব্রেইন স্ট্রোক হয়েছে আমার। আমি এখন শুধু চাই আমার টাকা উদ্ধার হোক।’
একই ফাঁদে পড়েছেন স্থানীয় বাজারের দোকানি তাইজুল ইসলামও। তাঁর ভাষ্য, বেশি মুনাফার লোভে পড়ে ২০ লাখ টাকা জমা রেখেছিলেন। এখন লাভ দূরের কথা, জমা টাকাই ফেরত পাচ্ছেন না। আদালতের আশ্রয় নিয়েছেন তিনি। ঋণ করে সমিতিতে টাকা রেখেছিলেন, জমি বিক্রি করে সেই ঋণ পরিশোধ করতে হয়েছে তাঁকে।
ভুক্তভোগী আমিনুল ইসলাম বলেন, ‘আমি ১২ লাখ দিয়েছিলাম, আমারে পাঁচ মাস লাভ দিছে, পরে বন্ধ করে দিছে। আমি আসল টাকা চাইলে দিব দিব বলে আর দেয়নি, পরে আমি টাকা ফেরত পেতে আইনের আশ্রয় নিয়েছি। আদালতে মামলা করেছি।’ তাঁর দাবি, তাঁর মতো বহু মানুষ প্রতারক চক্রের খপ্পরে পড়ে নিঃস্ব হয়েছেন। কেবল আর্থিক ক্ষতিই হয়নি, কেড়ে নিয়েছে মানুষের জীবনও। গাঁওকান্দিয়া গ্রামের অধিবেষ সরকার নামে এক ব্যক্তি এই সমিতিতে জমা রেখেছিলেন ১৯ লাখ টাকা। প্রতারণার শিকার হয়ে মানসিক কষ্টে অসুস্থ হয়ে পড়েন। চিকিৎসার অভাবে আগে মারা যান তাঁর স্ত্রী। পরে গত ৬ জুন তাঁরও মৃত্যু হয়।
মৃত অধিবেষের ছেলে আশিস সরকার জানান, তাঁর বাবার শেষ সম্বল ছিল ওই টাকাগুলোই। তিনি ভেবেছিলেন, সমিতিতে দিলে কিছু আসবে এটাই ছিল তাঁর আশা। কিন্তু টাকা জমা রাখার পরই তাঁর মা হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়লে সমিতির কাছে আসল টাকা ফেরত চান। কিন্তু সমিতির লোকজন তাদের কোনো অনুনয়-বিনয় শোনেনি। চিকিৎসার অভাবে তাঁর মা মারা যান, কিছু দিন পর তাঁর বাবাও মারা যান। টাকার জন্য বাধ্য হয়ে আদালতে মামলা করেছেন। তিনি বলেন, ‘টাকা হারিয়ে বাবা সব সময় দুশ্চিন্তায় থাকতেন। একবার স্ট্রোক করলে চিকিৎসা নিয়ে কিছুটা সুস্থও হন। কিন্তু পরে আবারও স্ট্রোক করে আমাদের ছেড়ে চলে যান। এই টাকার শোকে মা-বাবা দু’জনকেই হারিয়েছি।’
জানা গেছে, প্যাসিফিক ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী সমবায় সমিতিটি জাগিরপাড়ায় একটি ঘরে ২০১৯ সালে চালু হয়। কিন্তু এখন সেখানে সেই অফিস আর নেই, নেই সমিতির কোনো কার্যক্রম। সমিতি পরিচালনা বোর্ডের সভাপতি পদে ছিলেন জাগিরপাড়া এলাকার আবদুল জলিল, সাধারণ সম্পাদক আবদুর রশিদ, যুগ্ম সম্পাদক আবুল কাশেম, কোষাধ্যক্ষ ইদ্রিস আলী, সদস্য মাহফুজুল ইসলাম।
বিষয়টি নিয়ে কথা বলার চেষ্টা করা হলেও খোঁজ পাওয়া যায়নি সভাপতি আবদুল জলিলের। তাঁর মোবাইল ফোনে কল দিয়ে নম্বর বন্ধ পাওয়া গেছে।
দুর্গাপুর উপজেলা সমবায় কর্মকর্তা বিজন কান্তি ধর বলেন, ‘সমিতিটি আমাদের থেকে রেজিস্ট্রেশন নিয়েছে ঠিকই। তবে পরবর্তীতে আমাদের সঙ্গে কোনো কার্যক্রম পরিচালনা করেনি। প্রতারণার বিষয়ে লিখিত অভিযোগ পেলে তদন্ত করে দেখা হবে।’
উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) নাভিদ রেজওয়ানুল কবীর জানান, লাভ দেওয়ার কথা বলে মানুষের কাছ থেকে টাকা নেওয়ার বিষয়টি তাঁর জানা নেই। খোঁজ নিয়ে দেখবেন তিনি।

.

উৎস: Samakal

কীওয়ার্ড: আসল ট ক

এছাড়াও পড়ুন:

দুর্গাপূজার আগে ভারতে গেল ১ লাখ ৩০ হাজার কেজি ইলিশ

দুর্গাপূজাকে সামনে রেখে এবার ১২ লাখ কেজি ইলিশ রপ্তানির অনুমতি দিয়েছিল সরকার। এ অনুমতির মেয়াদ রয়েছে ৫ অক্টোবর পর্যন্ত। এর আগে গত সোমবার পর্যন্ত ভারতে রপ্তানি হয়েছে ১ লাখ ৩০ হাজার কেজি ইলিশ। জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) সূত্রে এ তথ্য পাওয়া গেছে।

এ বছর ৩৭টি প্রতিষ্ঠানকে ইলিশ রপ্তানির অনুমতি দিয়েছে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। সোমবার পর্যন্ত ১৬টি প্রতিষ্ঠান ইলিশ রপ্তানি করেছে। অর্থাৎ ২১টি প্রতিষ্ঠান কোনো ইলিশ রপ্তানি করতে পারেনি। ইলিশ রপ্তানি হয়েছে বেনাপোল ও আখাউড়া স্থলবন্দর দিয়ে। এ দুটি স্থলবন্দর দিয়ে শেষ মুহূর্তে আর ইলিশ রপ্তানি হওয়ার খুব বেশি সুযোগ নেই।

এনবিআরের হিসাবে, সব মিলিয়ে এবার ইলিশ রপ্তানি থেকে আয় হয়েছে ১৬ লাখ ৩৭ হাজার ডলার। বাংলাদেশি মুদ্রায় রপ্তানি আয়ের পরিমাণ ২০ কোটি টাকা।

এনবিআরের হিসাবে, সব মিলিয়ে এবার ইলিশ রপ্তানি থেকে আয় হয়েছে ১৬ লাখ ৩৭ হাজার ডলার। বাংলাদেশি মুদ্রায় রপ্তানি আয়ের পরিমাণ ২০ কোটি টাকা।সবচেয়ে কম ইলিশ রপ্তানি

এনবিআরের তথ্য অনুযায়ী, গত এক দশকের মধ্যে ইলিশ রপ্তানি প্রথম শুরু হয় ২০১৯–২০ অর্থবছরে। গত সাত বছরে সবচেয়ে বেশি ইলিশ রপ্তানি হয়েছে ২০২০–২১ অর্থবছরে। ওই সময় ১৭ লাখ কেজি ইলিশ রপ্তানি হয়। এর আগে সবচেয়ে কম রপ্তানি হয় ২০১৯–২০ অর্থবছরে। সেবার ৪ লাখ ৭৬ হাজার কেজি ইলিশ রপ্তানি হয়েছিল। সেই হিসাবে এবারই সবচেয়ে কম ইলিশ রপ্তানি হচ্ছে ভারতে।

এ বছর ইলিশ রপ্তানির অনুমোদন পাওয়া ৩৭টি প্রতিষ্ঠানের একটি চট্টগ্রামের কালুরঘাটের প্যাসিফিক সি ফুডস। প্রতিষ্ঠানটি ৪০ হাজার কেজি ইলিশ রপ্তানির অনুমোদন পেয়েছে। তবে সিংহভাগই রপ্তানি করতে পারেনি।

জানতে চাইলে প্যাসিফিক সি ফুডসের পরিচালক আবদুল মান্নান প্রথম আলোকে বলেন, ‘স্থানীয় বাজারে ইলিশের দাম কমতে পারে, এমন আশায় ছিলাম আমরা। তবে স্থানীয় বাজারে ইলিশের দাম কমেনি। ফলে মাত্র দেড় হাজার কেজি ইলিশ রপ্তানি করেছি আমরা। তাতেও লোকসান হয়েছে। দাম বেশি থাকায় আর রপ্তানি করছি না।’

আবদুল মান্নান বলেন, বাংলাদেশের চেয়ে মিয়ানমারের ইলিশের রপ্তানি মূল্য কম। ফলে ভারতের বাজারে মিয়ানমারের ইলিশ বেচাকেনা হচ্ছে বেশি।

ভারতের বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের ওয়েবসাইটের তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশ ও মিয়ানমার থেকে দেশটি ইলিশ আমদানি করে ভারত। দেশটি বাংলাদেশের চেয়ে বেশি পরিমাণে কম দামে ইলিশ আমদানি করে মিয়ানমার থেকে।

যেমন ২৪–২৫ অর্থবছরে (এপ্রিল–মার্চ) দেশটি মিয়ানমার থেকে সাড়ে ছয় লাখ কেজি ইলিশ আমদানি করেছে। গড়ে ভারতের আমদানি মূল্য ছিল ৬ ডলার ২৩ সেন্ট। অন্যদিকে একই সময়ে বাংলাদেশ থেকে আমদানি করেছে ৫ লাখ ৪২ হাজার কেজি ইলিশ। গড় আমদানি মূল্য ছিল ১০ ডলার ৯৩ সেন্ট।

এর আগে সবচেয়ে কম রপ্তানি হয় ২০১৯-২০ অর্থবছরে। সেবার ৪ লাখ ৭৬ হাজার কেজি ইলিশ রপ্তানি হয়েছিল। সেই হিসাবে এবারই সবচেয়ে কম ইলিশ রপ্তানি হচ্ছে ভারতে।ন্যূনতম রপ্তানি মূল্যেই ইলিশ গেল

বাণিজ্য মন্ত্রণালয় এবার সাড়ে ১২ ডলার বা ১ হাজার ৫৩২ টাকা দরে ন্যূনতম রপ্তানি মূল্য বেঁধে দিয়েছে। এর মানে হলো, এর চেয়ে কমে ইলিশ রপ্তানি করা যাবে না। তবে চাইলেই বেশি দামে রপ্তানি করা যাবে।

এনবিআরের তথ্যে দেখা গেছে, ২০১৯–২০ অর্থবছর থেকে এখন পর্যন্ত বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের ন্যূনতম মূল্যে ইলিশ রপ্তানি হয়ে আসছে। ন্যূনতম রপ্তানি মূল্যের চেয়ে বেশি দামে ইলিশ রপ্তানির নজির খুব কম।

এ বছর রপ্তানি হওয়া ৪৫টি চালানের মধ্যে ৪৪টি চালানের ইলিশ রপ্তানি হয়েছে ন্যূনতম রপ্তানি মূল্য অর্থাৎ সাড়ে ১২ ডলারে। শুধু একটি চালান ন্যূনতম রপ্তানি মূল্যের চেয়ে বেশি দামে রপ্তানি হয়েছে। এই চালান রপ্তানি করেছে ভোলার চরফ্যাশনের রাফিদ এন্টারপ্রাইজ। প্রতিষ্ঠানটি ৪২০ কেজি ইলিশ কেজিপ্রতি ১৩ ডলার ৬০ সেন্টে রপ্তানি করেছে।

স্থানীয় বাজারে ইলিশের দাম কমতে পারে, এমন আশায় ছিলাম আমরা। তবে স্থানীয় বাজারে ইলিশের দাম কমেনি। ফলে মাত্র দেড় হাজার কেজি ইলিশ রপ্তানি করেছি আমরা। তাতেও লোকসান হয়েছে। দাম বেশি থাকায় আর রপ্তানি করছি না।আবদুল মান্নান, পরিচালক, প্যাসিফিক সি ফুডসপ্রতিবারই অনুমতির চেয়ে কম রপ্তানি

বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের অনুমতি এবং এনবিআরের রপ্তানির হিসাব তুলনা করে দেখা গেছে, প্রতিবারই যে পরিমাণ ইলিশ রপ্তানির অনুমোদন দেওয়া হয়, বাস্তবে রপ্তানি হয় খুব কম। যেমন গত বছর ২৪ লাখ কেজি ইলিশ রপ্তানির অনুমোদন দেওয়া হলেও বাস্তবে রপ্তানি হয়েছে ৪ লাখ ৪৪ হাজার কেজি ইলিশ। অর্থাৎ অনুমতির ২৩ শতাংশ ইলিশ রপ্তানি হয়েছে। এবারও এখন পর্যন্ত অনুমতির ১১ শতাংশ ইলিশ রপ্তানি হয়েছে।

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • দুর্গাপূজার আগে ভারতে গেল ১ লাখ ৩০ হাজার কেজি ইলিশ