নেই অফিস, নিবন্ধনের আড়ালে লোক দেখানো রাজনীতি!
Published: 27th, June 2025 GMT
জাতীয় সংসদ নির্বাচন যতই ঘনিয়ে আসছে, নির্বাচন কমিশনে নিবন্ধনের জন্য নতুন রাজনৈতিক দল গজিয়ে উঠছে একের পর এক। খাতা-কলমে আবেদন জমা পড়েছে ১৪৭টি। কিন্তু বাস্তবে দেখা যাচ্ছে, অনেক দল শুধু নামেই দল। নেই অফিস, নেই কার্যক্রম, নেই সাংগঠনিক কাঠামো। বেশ কিছু ‘কেন্দ্রীয় কার্যালয়’ খুঁজে পাওয়া গেল হোটেলের ভেতরে, ট্রাভেল এজেন্সির কক্ষ কিংবা তালাবদ্ধ ব্যক্তিগত বাসার ড্রয়িংরুমে।
রাজধানীর নয়াপল্টন, পুরানা পল্টন, সিদ্ধেশ্বরী, যাত্রাবাড়ীসহ বিভিন্ন এলাকায় সরেজমিন অনুসন্ধানে বেরিয়ে এসেছে এই ‘ঠিকানার ভেলকি’। এমন তথাকথিত রাজনৈতিক দলগুলোর অস্তিত্ব নিয়ে উঠেছে প্রশ্ন।
হোটেলের ভেতরে ‘দলীয় কার্যালয়’
পুরানা পল্টনের ৫৪ নম্বর বাড়ির নিচতলায় রয়েছে ‘মুসলিম হোটেল অ্যান্ড কাবাব ঘর’। অথচ এই ঠিকানাকেই কেন্দ্রীয় কার্যালয় বলে উল্লেখ করেছে ‘বাংলাদেশ তিসারী ইনসাফ দল’। বৃস্পতিবার (২৬ জুন) দলের চেয়ারম্যান মো.
কিন্তু স্থানীয়দের মতে, উক্ত তলা বহুদিন ধরে বন্ধ। হোটেল ম্যানেজার স্পষ্টভাবেই জানিয়ে দেন, “মিনহাজ সাহেব মাঝে মধ্যে নাশতা করতে আসেন। এখানে কোনো দলীয় অফিস নেই।”
ট্রাভেল এজেন্সি নয়, এখন ‘ন্যায় বিচার পার্টি’!
ইসলাম টাওয়ারের সপ্তম তলায় গেলে চোখে পড়ে ‘আল আমিন ট্রাভেলস’-এর সাইনবোর্ড। অথচ কাগজে-কলমে এখানে বসেছে ‘জাতীয় ন্যায় বিচার পার্টির’ কেন্দ্রীয় কার্যালয়। চেয়ারম্যান মো. কামরুজ্জামান বলেন, “তাড়াহুড়ো করে ঠিকানাটা দিয়েছি। পরে বদলাব।”
ঠিক এমনিভাবে, ‘বাংলাদেশ ইউনাইটেড পার্টি’, ‘আজাদী পার্টি’, ‘জাস্টিস ফর হিউমিনিটি পার্টি’, ‘বাংলাদেশ নাগরিক পার্টি’- সবাই কোনো না কোনো প্রতিষ্ঠানের ঠিকানা ব্যবহার করে নিবন্ধনের চেষ্টা চালাচ্ছে।
১২ বাই ৬ ফুট কক্ষেই কেন্দ্রীয় কার্যালয়!
পুরানা পল্টনের একটি ছোট্ট কক্ষে নাম দিয়েছে ‘বাংলাদেশ বেকার মুক্তি পরিষদ’। এক পাশে বুকশেলফ, অন্য পাশে দুই সিটের সোফা। দলের সভাপতি আতিকুর রহমান রাজা বলেন, “ছোট পরিসরে শুরু করেছি। আপাতত বড় অফিস নেওয়ার দরকার নেই।”
আর ‘বাংলাদেশ ডেমোক্রেটিক মুভমেন্ট পার্টি’র কেন্দ্রীয় কার্যালয় তালাবদ্ধ। পাশের ফ্ল্যাটের বাসিন্দারা বলছেন, তারা শুধু জানেন আলমগীর হোসেন একজন আইনজীবী। তিনি কোনো দলের সভাপতি, সে খবর তাদের অজানা।
ড্রয়িংরুম, আধাপাকা বাড়ি ঠিকানা
দক্ষিণ যাত্রাবাড়ীতে যে ভবনের ঠিকানা ‘জাস্টিস ফর হিউমিনিটি পার্টি’ দিয়েছে, বাস্তবে সেটি একটি আধাপাকা একতলা বাড়ি।
বাড়ির মালিক আবুল কালাম বলেন, “এখানে কোনো অফিস বা দল কখনো ছিল না। আমাদের পরিবারই থাকে। অর্থাৎ, দল আছে খাতা-কলমে; বাস্তবে নয়।”
নির্বাচন কমিশনের অতিরিক্ত সচিব (নিবন্ধন) কে এম আলী নেওয়াজ বলেন, “নিবন্ধন প্রক্রিয়ার অংশ হিসেবে আমরা সরেজমিন যাচাই করছি। ঠিকানা ও সংগঠন নিয়ে মিথ্যা তথ্য দিলে সেই দল নিবন্ধন পাবে না।”
কমিশনের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, শুধু দলীয় নাম থাকলেই চলবে না—সাংগঠনিক কাঠামো, নেতৃত্ব, অফিস, কার্যক্রম—সব যাচাই করা হবে।
নামেই বড় দল
এইসব দলের নাম শুনে অনেকেরই মনে হতে পারে, বুঝি বিরাট কোনো রাজনীতির দল: মানবতার জাস্টিস পার্টি, বেকার মুক্তি পরিষদ, জনজোট, আজাদী মুভমেন্ট, নাগরিক পার্টি। বাস্তবতা হলো, সাইনবোর্ড নেই, কোনো সভা-সমাবেশ নেই, নেই কোনো রাজনৈতিক কর্মসূচি। শুধু আছে তালাবদ্ধ ঘর বা খাবারের দোকান, যেখানে মাঝে মাঝে নেতারা নাশতা করতে আসেন।
নিবন্ধন নয়, পেছনের দরজা
রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করছেন, এই ‘ঠিকানা ভিত্তিক’ নিবন্ধনের ধারা রাজনৈতিক ব্যবস্থাকে প্রশ্নবিদ্ধ করছে। নিবন্ধন একটি সাংবিধানিক প্রক্রিয়া। অথচ অনেকেই এই প্রক্রিয়াকে ব্যবহার করছে ক্ষমতার পেছনের দরজা খোলা রাখতে।
বিশিষ্ট রাজনীতি বিশ্লেষক ড. তানভীর আহমেদ বলেন, “যারা রাজনৈতিক কাঠামো গড়ার ক্ষমতা রাখে না, তারা শুধু কাগজে-কলমে দল তৈরি করে উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে নিবন্ধন নিতে চায়। এর মাধ্যমে গণতন্ত্র দুর্বল হয়, রাজনীতিতে দায়হীনতা বাড়ে।”
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) ছাত্র আবির রায়হান বলেন, “রাজনীতি জনগণের জন্য, গণতন্ত্রের জন্য, জবাবদিহিতার জন্য। সেই রাজনীতির মূলধারা যদি শুরু হয় মিথ্যা ঠিকানা আর লোক দেখানো কক্ষ দিয়ে, তাহলে ভবিষ্যতের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় কীভাবে বিশ্বাস রাখা যায়?”
এই নিবন্ধনের প্রক্রিয়া যেন লোক দেখানো ‘ঠিকানার খেলা’তে পরিণত না হয়, সেটা নিশ্চিত করাই এখন নির্বাচন কমিশনের প্রধান দায়িত্ব। না হলে, খাতায় ১৪৭টি নতুন দল থাকলেও বাস্তবে থাকবে না একটিও গণতান্ত্রিক দল।
ঢাকা/এস
উৎস: Risingbd
কীওয়ার্ড: চ কর চ কর প রক র য় র জন ত ক র জন য
এছাড়াও পড়ুন:
দেশ যেন এক মগের মুল্লুকে পরিণত হয়েছে: হাফিজ উদ্দিন
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য মেজর (অব.) হাফিজ উদ্দিন আহমদ বলেছেন, ‘দেশে আইনশৃঙ্খলা বলে কিছু নেই। কখনো সাংবাদিককে কুপিয়ে হত্যা, কখনো সাধারণ মানুষকে হত্যা—দেশ যেন এক মগের মুল্লুকে পরিণত হয়েছে।’
শনিবার দুপুরে খুলনা প্রেসক্লাবের ব্যাংকোয়েট হলে ‘একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধ ও গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠায় শহীদ জিয়া’ শীর্ষক আলোচনা সভায় প্রধান অতিথির বক্তব্যে তিনি এ কথাগুলো বলেন। জাতীয়তাবাদী মুক্তিযোদ্ধা দল খুলনা মহানগর ও জেলা শাখা এ সভার আয়োজন করে।
হাফিজ উদ্দিন আহমদ বলেন, ‘একমাত্র একজন উপদেষ্টা আসিফ নজরুল ছাড়া কেউ গণ-আন্দোলনে অংশগ্রহণ করেনি। এদের অনেকেই শেখ হাসিনার দোসর ছিল। যে কারণে শেখ হাসিনার রেখে যাওয়া প্রশাসন ও পুলিশ বাহিনী একই আছে। মাঝখান থেকে সুযোগ নিয়েছে একটি রাজনৈতিক দল—যারা একাত্তরে আমাদের স্বাধীনতাযুদ্ধের বিরোধিতা করেছিল। তারা গুরুত্বপূর্ণ জায়গায় কীভাবে জানি না, তাদের প্রতিনিধি বসিয়ে দিয়েছে এবং তারা রাষ্ট্রক্ষমতায় গেলে যেসব সুযোগ পাওয়া যায়, সেটি দিব্যি ব্যবহার করছে। আর আমরা বিএনপির কর্মীরা শুধু যুদ্ধ করে গেলাম, জীবন দিয়ে গেলাম, কতবার জেলে গিয়েছি তার হিসাব নাই।’
মুক্তিযুদ্ধ ও গণতন্ত্র প্রসঙ্গে বিএনপির এই নেতা বলেন, ‘একাত্তরে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্য আমরা যুদ্ধ করেছিলাম। মুক্তিযুদ্ধের পর ইতিহাস বিকৃত করা হয়েছে তৎকালীন ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের দ্বারা। ১৯৭০ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ বিজয়ী হয়েছিল। প্রত্যেক রাজনৈতিক দলের উদ্দেশ্যই থাকে রাষ্ট্রক্ষমতায় যাওয়া। আওয়ামী লীগের উদ্দেশ্যও সেটিই ছিল। কিন্তু বাংলাদেশ স্বাধীন হবে—এ কথা তারা তখন চিন্তাই করেনি। স্বাধীনতার পর তারা কল্পকাহিনি শুরু করল যে অনেক আগে থেকেই তারা স্বাধীনতার জন্য লড়ছিল। বাংলাদেশের ছাত্র, জনতা, যুবক, শ্রমিকদের বীরত্বের কাহিনি আওয়ামী লীগের আমলে জনগণকে জানতে দেওয়া হয়নি।’
একাত্তরের স্মৃতিচারণা করতে গিয়ে হাফিজ উদ্দিন আহমদ বলেন, ‘প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধাদের এ জাতি চিনল না—এটা দুঃখের বিষয়। অধিকাংশ প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন লুঙ্গি পরা, খালি পায়ে, মাথায় গামছা বেঁধে খেটে খাওয়া মানুষ। কিন্তু স্বাধীনতার পর দেখলাম ঢাকা, চট্টগ্রাম, খুলনা, রাজশাহী মহানগরের ছেলেরা সব মুক্তিযোদ্ধা হয়ে গেছে। প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধাদের পরিচয় রাজনৈতিক দলগুলো আলোতে আসার সুযোগ দেয়নি।’
জামায়াতের পিআর পদ্ধতিতে নির্বাচন চাওয়া নিয়ে বিএনপির এই নেতা বলেন, ‘তারা নির্বাচন চায় না। তারা তো অলরেডি ক্ষমতা ভোগ করছে। নির্বাচন বিলম্বিত করার চেষ্টা করছে। তারা বলে পিআর সিস্টেমে নির্বাচন। এই দেশের মানুষ দীর্ঘকাল ধরে ভোট দিয়ে আসছে একজন প্রতিনিধিকে—এলাকার মানুষের আপদ-বিপদে যাঁকে পাওয়া যায়। যিনি কল্যাণরাষ্ট্র গঠনের জন্য নিবেদিতপ্রাণ, এমন মানুষকেই ভোট দেয়। কিন্তু তারা মনে করে আগামী দিনে তো আমরা ক্ষমতায় যেতে পারব না, বিএনপি ক্ষমতায় যাবে। সুতরাং বিএনপি যাতে ক্ষমতায় যেতে না পারে, এ জন্যই তারা পিআর সিস্টেমে নির্বাচন চায়। বাংলাদেশের জনগণ পিআর সিস্টেম বোঝে না, তারা পছন্দের ব্যক্তিকে দেখতে চায় তাদের প্রতিনিধি হিসেবে।’
আলোচনা সভায় প্রধান বক্তা ছিলেন জাতীয়তাবাদী মুক্তিযোদ্ধা দলের সভাপতি ইসতিয়াক আজিজ উলফাত। বিশেষ অতিথি ছিলেন বিএনপির জাতীয় নির্বাহী কমিটির তথ্যবিষয়ক সম্পাদক আজিজুল বারী হেলাল, খুলনা মহানগর বিএনপির সভাপতি শফিকুল আলম মনা, জেলা বিএনপির আহ্বায়ক মো. মনিরুজ্জামান এবং খুলনা মহানগর বিএনপির সাধারণ সম্পাদক মো. শফিকুল আলম। সভায় সভাপতিত্ব করেন জাতীয়তাবাদী মুক্তিযোদ্ধা দলের খুলনা মহানগরের সভাপতি শেখ আলমগীর হোসেন।