জাতীয় সংসদ নির্বাচন যতই ঘনিয়ে আসছে, নির্বাচন কমিশনে নিবন্ধনের জন্য নতুন রাজনৈতিক দল গজিয়ে উঠছে একের পর এক। খাতা-কলমে আবেদন জমা পড়েছে ১৪৭টি। কিন্তু বাস্তবে দেখা যাচ্ছে, অনেক দল শুধু নামেই দল। নেই অফিস, নেই কার্যক্রম, নেই সাংগঠনিক কাঠামো। বেশ কিছু ‘কেন্দ্রীয় কার্যালয়’ খুঁজে পাওয়া গেল হোটেলের ভেতরে, ট্রাভেল এজেন্সির কক্ষ কিংবা তালাবদ্ধ ব্যক্তিগত বাসার ড্রয়িংরুমে।

রাজধানীর নয়াপল্টন, পুরানা পল্টন, সিদ্ধেশ্বরী, যাত্রাবাড়ীসহ বিভিন্ন এলাকায় সরেজমিন অনুসন্ধানে বেরিয়ে এসেছে এই ‘ঠিকানার ভেলকি’। এমন তথাকথিত রাজনৈতিক দলগুলোর অস্তিত্ব নিয়ে উঠেছে প্রশ্ন।

হোটেলের ভেতরে ‘দলীয় কার্যালয়’
পুরানা পল্টনের ৫৪ নম্বর বাড়ির নিচতলায় রয়েছে ‘মুসলিম হোটেল অ্যান্ড কাবাব ঘর’। অথচ এই ঠিকানাকেই কেন্দ্রীয় কার্যালয় বলে উল্লেখ করেছে ‘বাংলাদেশ তিসারী ইনসাফ দল’। বৃস্পতিবার (২৬ জুন)  দলের চেয়ারম্যান মো.

মিনহাজ প্রধান দাবি করেন, ভবনের তৃতীয় তলায় তাদের অফিস রয়েছে, যা বর্তমানে ‘সংস্কারে’।

কিন্তু স্থানীয়দের মতে, উক্ত তলা বহুদিন ধরে বন্ধ। হোটেল ম্যানেজার স্পষ্টভাবেই জানিয়ে দেন, “মিনহাজ সাহেব মাঝে মধ্যে নাশতা করতে আসেন। এখানে কোনো দলীয় অফিস নেই।”


ট্রাভেল এজেন্সি নয়, এখন ‘ন্যায় বিচার পার্টি’!
ইসলাম টাওয়ারের সপ্তম তলায় গেলে চোখে পড়ে ‘আল আমিন ট্রাভেলস’-এর সাইনবোর্ড। অথচ কাগজে-কলমে এখানে বসেছে ‘জাতীয় ন্যায় বিচার পার্টির’ কেন্দ্রীয় কার্যালয়। চেয়ারম্যান মো. কামরুজ্জামান বলেন, “তাড়াহুড়ো করে ঠিকানাটা দিয়েছি। পরে বদলাব।”

ঠিক এমনিভাবে, ‘বাংলাদেশ ইউনাইটেড পার্টি’, ‘আজাদী পার্টি’, ‘জাস্টিস ফর হিউমিনিটি পার্টি’, ‘বাংলাদেশ নাগরিক পার্টি’- সবাই কোনো না কোনো প্রতিষ্ঠানের ঠিকানা ব্যবহার করে নিবন্ধনের চেষ্টা চালাচ্ছে।

১২ বাই ৬ ফুট কক্ষেই কেন্দ্রীয় কার্যালয়!
পুরানা পল্টনের একটি ছোট্ট কক্ষে নাম দিয়েছে ‘বাংলাদেশ বেকার মুক্তি পরিষদ’। এক পাশে বুকশেলফ, অন্য পাশে দুই সিটের সোফা। দলের সভাপতি আতিকুর রহমান রাজা বলেন, “ছোট পরিসরে শুরু করেছি। আপাতত বড় অফিস নেওয়ার দরকার নেই।”

আর ‘বাংলাদেশ ডেমোক্রেটিক মুভমেন্ট পার্টি’র কেন্দ্রীয় কার্যালয় তালাবদ্ধ। পাশের ফ্ল্যাটের বাসিন্দারা বলছেন, তারা শুধু জানেন আলমগীর হোসেন একজন আইনজীবী। তিনি কোনো দলের সভাপতি, সে খবর তাদের অজানা।

ড্রয়িংরুম, আধাপাকা বাড়ি ঠিকানা
দক্ষিণ যাত্রাবাড়ীতে যে ভবনের ঠিকানা ‘জাস্টিস ফর হিউমিনিটি পার্টি’ দিয়েছে, বাস্তবে সেটি একটি আধাপাকা একতলা বাড়ি। 

বাড়ির মালিক আবুল কালাম বলেন, “এখানে কোনো অফিস বা দল কখনো ছিল না। আমাদের পরিবারই থাকে। অর্থাৎ, দল আছে খাতা-কলমে; বাস্তবে নয়।”

নির্বাচন কমিশনের অতিরিক্ত সচিব (নিবন্ধন) কে এম আলী নেওয়াজ বলেন, “নিবন্ধন প্রক্রিয়ার অংশ হিসেবে আমরা সরেজমিন যাচাই করছি। ঠিকানা ও সংগঠন নিয়ে মিথ্যা তথ্য দিলে সেই দল নিবন্ধন পাবে না।”

কমিশনের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, শুধু দলীয় নাম থাকলেই চলবে না—সাংগঠনিক কাঠামো, নেতৃত্ব, অফিস, কার্যক্রম—সব যাচাই করা হবে।

নামেই বড় দল
এইসব দলের নাম শুনে অনেকেরই মনে হতে পারে, বুঝি বিরাট কোনো রাজনীতির দল: মানবতার জাস্টিস পার্টি, বেকার মুক্তি পরিষদ, জনজোট, আজাদী মুভমেন্ট, নাগরিক পার্টি। বাস্তবতা হলো, সাইনবোর্ড নেই, কোনো সভা-সমাবেশ নেই, নেই কোনো রাজনৈতিক কর্মসূচি। শুধু আছে তালাবদ্ধ ঘর বা খাবারের দোকান, যেখানে মাঝে মাঝে নেতারা নাশতা করতে আসেন।

নিবন্ধন নয়, পেছনের দরজা
রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করছেন, এই ‘ঠিকানা ভিত্তিক’ নিবন্ধনের ধারা রাজনৈতিক ব্যবস্থাকে প্রশ্নবিদ্ধ করছে। নিবন্ধন একটি সাংবিধানিক প্রক্রিয়া। অথচ অনেকেই এই প্রক্রিয়াকে ব্যবহার করছে ক্ষমতার পেছনের দরজা খোলা রাখতে।

বিশিষ্ট রাজনীতি বিশ্লেষক ড. তানভীর আহমেদ বলেন, “যারা রাজনৈতিক কাঠামো গড়ার ক্ষমতা রাখে না, তারা শুধু কাগজে-কলমে দল তৈরি করে উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে নিবন্ধন নিতে চায়। এর মাধ্যমে গণতন্ত্র দুর্বল হয়, রাজনীতিতে দায়হীনতা বাড়ে।”

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) ছাত্র আবির রায়হান বলেন, “রাজনীতি জনগণের জন্য, গণতন্ত্রের জন্য, জবাবদিহিতার জন্য। সেই রাজনীতির মূলধারা যদি শুরু হয় মিথ্যা ঠিকানা আর লোক দেখানো কক্ষ দিয়ে, তাহলে ভবিষ্যতের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় কীভাবে বিশ্বাস রাখা যায়?”

এই নিবন্ধনের প্রক্রিয়া যেন লোক দেখানো ‘ঠিকানার খেলা’তে পরিণত না হয়, সেটা নিশ্চিত করাই এখন নির্বাচন কমিশনের প্রধান দায়িত্ব। না হলে, খাতায় ১৪৭টি নতুন দল থাকলেও বাস্তবে থাকবে না একটিও গণতান্ত্রিক দল।

ঢাকা/এস

উৎস: Risingbd

কীওয়ার্ড: চ কর চ কর প রক র য় র জন ত ক র জন য

এছাড়াও পড়ুন:

স্বৈরতন্ত্র উত্থানের দায় আসলে কাদের

প্রাচীন গ্রিসে ক্ষুদ্র অসংখ্য নগররাষ্ট্র ছিল। সেখানে নগরের অধিবাসীকেই বলা হতো নাগরিক, যাঁরা প্রত্যক্ষভাবে রাষ্ট্রীয় কর্মকাণ্ডে অংশগ্রহণ করতেন। রাষ্ট্রবিজ্ঞানের জনক অ্যারিস্টটল নাগরিকের সংজ্ঞা দিতে গিয়ে বলেছেন, ‘আমরা সেই সব ব্যক্তিকে নাগরিক বলব, যাদের আইন প্রণয়ন ও বিচারিক কার্যাবলিতে অংশগ্রহণের ক্ষমতা আছে।’ তাঁর মতে, যে ব্যক্তি নগররাষ্ট্রের শাসনকাজে সক্রিয়ভাবে অংশ নিতে অক্ষম, তিনি প্রকৃত নাগরিক নন।

আধুনিক রাষ্ট্রবিজ্ঞানীরা নাগরিককে সংজ্ঞায়িত করেছেন এভাবে—যেকোনো রাষ্ট্রে স্থায়ীভাবে বসবাস করেন, রাষ্ট্রের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করেন, রাষ্ট্র প্রদত্ত সামাজিক ও রাজনৈতিক অধিকার ভোগ করেন এবং দায়িত্ব ও কর্তব্য ন্যায়ের সঙ্গে পালন করেন, তাঁকেই নাগরিক বলা যায়। একই সঙ্গে নাগরিককে অবশ্যই অন্য মানুষের অধিকার ক্ষুণ্ন না করার ব্যাপারেও সজাগ থাকতে হবে।

প্রতিটি রাষ্ট্রের সবচেয়ে মূল্যবান সম্পদ হলো সৎ, যোগ্য ও নীতিবান নাগরিক। রাষ্ট্রের কাঠামো ও ভবিষ্যৎ নির্ভর করে নাগরিকের চরিত্র ও আচরণের ওপর। তাই রাষ্ট্রের অগ্রগতির জন্য প্রয়োজন সচেতন নাগরিক—যিনি নিজের অধিকার ও কর্তব্য সম্পর্কে অবহিত। এ জ্ঞান ও সচেতনতাই রাষ্ট্রকে তার কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যে পৌঁছে দিতে পারে। আধুনিক রাষ্ট্রব্যবস্থায় গণতন্ত্রকে বলা হয় জনগণের অংশগ্রহণে, জনগণের দ্বারা এবং জনগণের কল্যাণে পরিচালিত শাসনব্যবস্থা; কিন্তু প্রশ্ন হলো যদি জনগণ নিজেদের অধিকার সম্পর্কে অসচেতন থাকেন, তবে কি গণতন্ত্রের প্রকৃত স্বরূপ অক্ষুণ্ণ থাকে? বাস্তবতা হলো নাগরিকের অজ্ঞতা ও উদাসীনতাই স্বৈরতন্ত্রকে জন্ম দেয়।

প্রথমত, যেখানে মানুষ নিজের মৌলিক অধিকার সম্পর্কে অজ্ঞ, সেখানে শাসকগোষ্ঠী সহজেই ক্ষমতার অপব্যবহার করতে পারে। ভোটাধিকার, মতপ্রকাশের স্বাধীনতা, আইনের শাসন—এসব বিষয়ে নাগরিক উদাসীন থাকলে শাসকের জবাবদিহি বিলীন হয়ে যায়, তখন গণতান্ত্রিক কাঠামো টিকে থাকলেও এর প্রাণশক্তি নিঃশেষ হয়ে যায়।

দ্বিতীয়ত, নাগরিকেরা ভয়, অজ্ঞতা বা উদাসীনতার কারণে যখন অন্যায় ও অনিয়ম মেনে নেন, তখনই স্বৈরতন্ত্র শিকড় গাড়ে। শাসকের চাপিয়ে দেওয়া সিদ্ধান্ত তারা অন্ধভাবে মেনে নিলে সরকার জবাবদিহি এড়িয়ে স্বেচ্ছাচারী হয়ে ওঠে; কিন্তু ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়—শক্তিশালী শাসকের শাসন দীর্ঘস্থায়ী হয় কেবল তখনই, যখন জনগণ ঐক্যবদ্ধ প্রতিরোধ গড়ে তুলতে ব্যর্থ হয়। জার্মানি থেকে পাকিস্তান কিংবা বাংলাদেশের অতীত—সবখানেই দেখা যায়, নাগরিক–সচেতনতার অভাবেই স্বৈরতন্ত্রের বিস্তার ঘটেছিল।

তৃতীয়ত, নাগরিক সমাজ দুর্বল হলে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান যেমন গণমাধ্যম, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, শ্রমিক সংগঠন কিংবা নাগরিক সংগঠনগুলোও কার্যকর ভূমিকা রাখতে ব্যর্থ হয়। তখন শাসকেরা সহজেই বিকল্প কণ্ঠরোধ করে ‘নিয়ন্ত্রিত গণতন্ত্র’ প্রতিষ্ঠা করতে পারে। অর্থাৎ, নাগরিকের নীরবতাই শাসকের জন্য সবচেয়ে কার্যকর অস্ত্রে পরিণত হয়।

অতএব, স্বৈরতন্ত্রের কবল থেকে দেশকে রক্ষা করতে হলে সর্বাগ্রে প্রয়োজন নাগরিক শিক্ষা ও রাজনৈতিক সচেতনতা। পরিবার থেকে রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ প্রতিষ্ঠান পর্যন্ত প্রতিটি স্তরে মানুষকে জানতে হবে তাদের অধিকার, কর্তব্য ও রাষ্ট্রের কাছে দাবি করার উপায়। গণমাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম হতে হবে সত্য প্রকাশের প্ল্যাটফর্ম, তোষণ বা প্রোপাগান্ডার যন্ত্র নয়। মনে রাখতে হবে—অধিকার চর্চা না করলে অধিকার হারিয়ে যায়। তাই প্রত্যেক নাগরিকের কর্তব্য হলো নিজের অধিকার সম্পর্কে জানা ও তা প্রয়োগ করা।

সবশেষে বলা যায়, নাগরিকের অধিকার বিষয়ে অসচেতনতা কোনো ব্যক্তিগত দুর্বলতা নয়; বরং তা রাষ্ট্রের জন্য ভয়ংকর। সচেতন নাগরিক সমাজই পারে জবাবদিহিমূলক গণতন্ত্র গড়ে তুলতে আর অসচেতন নাগরিক সমাজই সৃষ্টি করে স্বৈরতন্ত্রের জন্মভূমি।

ইসরাত জাহান

শিক্ষার্থী, লোকপ্রশাসন বিভাগ, কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • মনোযোগ জুলাই সনদে, আছে নির্বাচনী ঐক্যের চিন্তাও
  • সক্ষমতাহীন ও নামসর্বস্ব সংস্থাগুলো বাদ দিন
  • এমন মানুষও আছে, যারা বলছে ৫ বছর থাকুন, ১০ বছর থাকুন, ৫০ বছর থাকুন
  • স্বৈরতন্ত্র উত্থানের দায় আসলে কাদের
  • পিআরের নামে জামায়াত ধর্মীয় উন্মাদনা সৃষ্টির অপপ্রয়াস চালাচ্ছে: কায়সার কামাল