নিত্যখাদ্যপণ্যে ভ্যাট, করনীতি সংস্কার যেখানে জরুরি
Published: 29th, June 2025 GMT
সাম্প্রতিক বছরগুলোতে নিত্যপ্রয়োজনীয় খাদ্যপণ্যের দাম বেড়েছে, যার ফলে দরিদ্র জনগণের জীবনযাত্রায় নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে। দীর্ঘমেয়াদি অর্থনৈতিক পরিবর্তনে বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রয়োজনীয় সংস্কার পদক্ষেপ এখনো দৃশ্যমান নয়। বরং সরকার গত জানুয়ারিতে নিত্যপ্রয়োজনীয় খাদ্যপণ্যসহ শতাধিক পণ্যের ওপর ভ্যাট বাড়ানোর পদক্ষেপ নিয়েছে।
বাংলাদেশের করব্যবস্থা দীর্ঘদিন ধরে কাঠামোগত সমস্যায় জর্জরিত। মূল্য সংযোজন কর (ভ্যাট) একটি পরোক্ষ কর, যা পণ্য ও সেবার মাধ্যমে জনগণের কাছ থেকে আদায় করা হয়। এটি সবার জন্য সমানভাবে প্রযোজ্য হলেও, বাস্তবে এর প্রভাব গরিব জনগণের ওপর বেশি পড়ছে।
গত জানুয়ারিতে যেসব পণ্যে ভ্যাট বাড়ানো হয়েছে, সেগুলোর মধ্যে রয়েছে নিত্যখাদ্যপণ্য যেমন পাউরুটি, বিস্কুট এবং কেক; যেগুলো সাধারণত দরিদ্র ও শ্রমজীবী মানুষের খাদ্য হিসেবে পরিচিত। গত ১৬ মে ‘বিস্কুট, পাউরুটি, কেকের প্যাকেট ছোট হচ্ছে, কষ্টে শ্রমজীবী মানুষ’ শিরোনামে প্রথম আলোর একটি বিশেষ প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এসব নিত্যখাদ্যপণ্যের দাম বেড়েছে, অথবা প্যাকেটের আকার ছোট হয়ে গেছে।
ভ্যাট একটি ‘রিগ্রেসিভ’ করব্যবস্থার অংশ, যেখানে করের পরিমাণ সাধারণত ধনী-গরিব সব শ্রেণির জন্য সমানভাবে প্রযোজ্য। তবে এটি বৈষম্যমূলক। কারণ, ধনীরা সবচেয়ে বেশি সেবা পেয়ে থাকে, যেমন সড়কে সবচেয়ে বেশি গাড়ি ব্যবহার করে ধনীরাই। তাই ধনী ও গরিবের জন্য কর সমান হওয়াটাও ন্যায্য নয়। অথচ আমাদের করনীতিতে উচ্চবিত্তদের ছাড় দিয়ে দরিদ্রদের ওপর চাপ সৃষ্টির প্রবণতা দৃশ্যমান, যা রিগ্রেসিভ করনীতির থেকেও আরও বৈষম্যমূলক।এই পণ্যগুলো শ্রমজীবী মানুষের জন্য সস্তা খাবার হিসেবে পরিচিত এবং ভ্যাট বৃদ্ধির কারণে তাঁরা তাঁদের দৈনন্দিন খাবারের জন্য অতিরিক্ত খরচ করতে বাধ্য হচ্ছেন। নিত্যখাদ্যপণ্যে ভ্যাট দরিদ্রদের জীবনে আর্থিক চাপ বাড়াচ্ছে। কারণ, তাঁদের আয়ের সিংহভাগ খরচ হয় খাবার কেনার জন্য। বেঁচে থাকার জন্য মৌলিক প্রয়োজনীয় পণ্যের ওপর ভ্যাট সামাজিক ন্যায্যতার পরিপন্থী। মানুষের বেঁচে থাকা ও কর্মক্ষমতা সবই নির্ভর করে খাবারের ওপর।
সুপারশপগুলোতে সাধারণত মধ্যবিত্ত বা উচ্চবিত্তরা কেনাকাটা করেন, অথচ সেখানে ভ্যাট প্রত্যাহার করা হয়েছে। এই বৈষম্য সমাজে কেবল অস্থিরতাই সৃষ্টি করছে তা নয়; বরং এটি অর্থনৈতিক সমতা এবং সামাজিক ন্যায্যতার পরিপন্থী।
ভ্যাট একটি ‘রিগ্রেসিভ’ করব্যবস্থার অংশ, যেখানে করের পরিমাণ সাধারণত ধনী-গরিব সব শ্রেণির জন্য সমানভাবে প্রযোজ্য। তবে এটি বৈষম্যমূলক। কারণ, ধনীরা সবচেয়ে বেশি সেবা পেয়ে থাকে, যেমন সড়কে সবচেয়ে বেশি গাড়ি ব্যবহার করে ধনীরাই। তাই ধনী ও গরিবের জন্য কর সমান হওয়াটাও ন্যায্য নয়। অথচ আমাদের করনীতিতে উচ্চবিত্তদের ছাড় দিয়ে দরিদ্রদের ওপর চাপ সৃষ্টির প্রবণতা দৃশ্যমান, যা রিগ্রেসিভ করনীতির থেকেও আরও বৈষম্যমূলক।
‘প্রগ্রেসিভ’ ট্যাক্সেশন হলো এমন একটি ব্যবস্থা, যেখানে ধনীদের ওপর কর বেশি আরোপ করা হয় এবং দরিদ্রদের জন্য কর কমানো হয়। উন্নত দেশগুলোর করনীতিতে আমরা এই প্রগ্রেসিভ ধারণা দেখতে পাই। যেমন ইউরোপীয় ইউনিয়নের কিছু দেশ এবং স্ক্যান্ডিনেভিয়ান দেশগুলোতে উচ্চ আয়ের মানুষদের ওপর করের চাপ বেশি। ধনীদের কাছ থেকে নেওয়া কর সমাজের বৃহত্তর অংশের কল্যাণে ব্যয় করা হয়। এই ধরনের করনীতি সব নাগরিকের জীবনযাত্রার ন্যূনতম মান নিশ্চিত করতে সহায়তা করে।
বাংলাদেশে এই প্রগ্রেসিভ ট্যাক্সেশন কাঠামোটি কার্যকর নয়। এখানে কর প্রশাসন এবং নীতিনির্ধারণে কাঠামোগত সমস্যা রয়েছে। প্রগ্রেসিভ ট্যাক্সেশন বা ধনীদের ওপর বেশি কর আরোপের ধারণা সঠিকভাবে বাস্তবায়নের বিষয়টি প্রশাসনিক কাঠামোর দক্ষতার ওপর নির্ভরশীল। বর্তমানে আমাদের কর প্রশাসন যথেষ্ট দক্ষ ও কার্যকর নয়, ফলে তারা নির্দিষ্ট পণ্যের ওপর ভ্যাটের পরিমাণ কতটা নির্ধারণ করা উচিত, তা ঠিক করতে সক্ষম নয়। তারা সহজে আদায়যোগ্য পণ্যগুলোতে কোনো বিবেচনা ছাড়াই কর বসিয়ে দেয়। এর ফলে যেসব পণ্য দরিদ্র জনগণের সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন, যেমন খাদ্যপণ্য, সেখানে ভ্যাটের চাপ আরও বাড়ছে।
বিশ্বব্যাংকের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশে করব্যবস্থার কার্যকারিতা ও দক্ষতা উন্নয়নের জন্য সংস্কারের প্রয়োজন। যদি প্রগ্রেসিভ করব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়, তবে আমাদের দরিদ্র জনগণের খাদ্যনিরাপত্তা নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে বড় ধরনের পরিবর্তন আসবে। আমাদের নীতিনির্ধারণের দায়িত্বে থাকা কর্মকর্তাদের দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তন করা প্রয়োজন। করব্যবস্থায় সুসংগঠিত সংস্কার আনা প্রয়োজন, যেখানে একদিকে গরিবদের জন্য খাদ্যনিরাপত্তা নিশ্চিত হবে, অন্যদিকে প্রগ্রেসিভ করব্যবস্থা প্রাধান্য পাবে।
সরকারের উচিত করনীতি প্রগ্রেসিভ করার পদক্ষেপ নেওয়া, যাতে সমাজের সব শ্রেণি, বিশেষ করে গরিব জনগণ, এর সুস্পষ্ট ও কার্যকর সুবিধা পেতে পারে। এটি শুধু আমাদের দেশের দরিদ্র জনগণের জন্য নয়, বরং দেশে সামগ্রিক অর্থনৈতিক উন্নতির জন্যও একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ হবে।
● হোসেন জিল্লুর রহমান চেয়ারম্যান, পিপিআরসি
.উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: করব যবস থ প রগ র স ভ খ দ যপণ য র স ভ কর র জন য স স ধ রণত দ র ওপর ব যবস থ র করন ত পদক ষ প আম দ র সবচ য়
এছাড়াও পড়ুন:
আবার জনগণের ভোটাধিকার হরণের ষড়যন্ত্র চলছে: জামায়াত
আবারও দেশের জনগণের ভোটাধিকার হরণের পাঁয়তারা চলছে বলে মন্তব্য করেছেন বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর নায়েবে আমির সৈয়দ আবদুল্লাহ মুহাম্মদ তাহের। সরকার ও রাজনৈতিক দলগুলোকে উদ্দেশ করে তিনি বলেন, জনগণের বিপরীতে দাঁড়াবেন না। আরেকটি এক-এগারোর ক্ষেত্র তৈরি করবেন না।
আজ বুধবার বিকেলে রাজধানীর বিজয়নগরে এক বিক্ষোভ সমাবেশে জামায়াতের এই নায়েবে আমির এ কথা বলেন। জুলাই ঘোষণা এবং জুলাই সনদকে আইনি ভিত্তি দিয়ে নিরপেক্ষ নির্বাচনের দাবিতে এ কর্মসূচির আয়োজন করে ঢাকা মহানগর উত্তর ও দক্ষিণ জামায়াত।
আবদুল্লাহ তাহের বলেন, ‘নির্বাচন যে তারিখে দিছে, এটা ঠিক আছে। আমরা তার আগেও নির্বাচন চাইছিলাম। ডিসেম্বর হলেও আমরা করতাম। মানুষ আশা করে, এবার একটি সুষ্ঠু নির্বাচন হবে। আমরা ইলেকশন চাই, সিলেকশন চাই না।’
বিদেশের ডিজাইনে (ছকে) পরিকল্পিত নির্বাচনের বিষয়ে হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করে সমাবেশে আবদুল্লাহ তাহের বলেন, দেশের মানুষ জীবন এবং রক্ত দিয়ে একটি সুষ্ঠু নির্বাচন আদায় করবে। তিনি বলেন, জামায়াতে ইসলামী নির্বাচনে যেতে চায়, কিন্তু তার আগে সুষ্ঠু নির্বাচন হওয়ার বিষয়গুলো জনগণের সামনে তুলে ধরতে হবে। নির্বাচনের জন্য আনন্দমুখর পরিবেশ তৈরি করতে হবে।
অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের জন্য রাজনৈতিক দলগুলোকে নিয়ে সরকারকে আলোচনা টেবিলে বসার জন্য আহ্বান জানান জামায়াত নেতা আবদুল্লাহ তাহের। তিনি বলেন, ‘দেশকে অনিশ্চয়তার দিকে নিয়ে যাবেন না। জনগণের বিপরীতে দাঁড়াবেন না। আরেকটি এক-এগারোর ক্ষেত্র তৈরি করবেন না।’
আবদুল্লাহ তাহের বলেন, ‘আমরা রাজনৈতিক দল এবং রাজনীতিবিদেরা দায়িত্বশীলতার পরিচয় দিয়ে সবাই মিলে একটি অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন করতে হবে। অতীতের মতো অংশগ্রহণহীন নির্বাচন করলে এবার বাংলাদেশ টিকবে না, স্বাধীনতা টিকবে না।’
জামায়াতের নায়েবে আমির আবদুল্লাহ তাহের বলেন, এই সরকারের প্রধান কাজ সংস্কার করা। তারা সংস্কারের জন্যই কমিশন তৈরি করেছে। সে কমিশনের সবাই ঐকমত্য হওয়ার পর সরকার বলে এটির আইনি ভিত্তি নেই। তাহলে সংস্কার হলো কোথায়? তিনি বলেন, যেসব বিষয় ঐকমত্য হয়েছে, তার ওপর ভিত্তি করে আগামী নির্বাচন হতে হবে।
একটি জরিপের কথা উল্লেখ করে আবদুল্লাহ তাহের বলেন, ‘দেশের ৭১ শতাংশ মানুষ পিআর পদ্ধতিতে নির্বাচন চায়। তারা পিআরের পক্ষে। কিন্তু আপনারা যাঁরা বিরোধিতা করছেন, আপনাদের কি বিরোধিতা করার অধিকার আছে?’
জামায়াতের সহকারী সেক্রটারি জেনারেল রফিকুল ইসলাম খান বলেন, ‘আমরা নির্বাচনের আগেই দেখছি, কোনো কোনো দলের কেন্দ্রীয় নেতারা নির্বাচনে দাঁড়িপাল্লায় ভোট দিলে জিহ্বা কেটে দেওয়া হবে বলে ঘোষণা দিচ্ছেন। আমরা লক্ষ করছি, স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা নির্বাচনের জন্য প্রস্তুতি ঘোষণা করছেন; কিন্তু এখনো জিহ্বা কেটে নেওয়ার কথা বলা এই সন্ত্রাসীকে কেন গ্রেপ্তার করতে পারেননি?’
ঢাকা মহানগর দক্ষিণ জামায়াতের সেক্রেটারি শফিকুল ইসলাম মাসুদের সঞ্চালনায় বিক্ষোভ সমাবেশে সভাপতিত্ব করেন ঢাকা মহানগর দক্ষিণ জামায়াতের আমির নুরুল ইসলাম বুলবুল। সমাবেশে অন্যদের মধ্যে বক্তব্য দেন জামায়াতের সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল রফিকুল ইসলাম খান, আবদুল হালিম, ঢাকা মহানগর উত্তর জামায়াতের আমির সেলিম উদ্দিন প্রমুখ।
সমাবেশ শেষে সন্ধ্যা সোয়া ছয়টার দিকে বিজয়নগর থেকে বিক্ষোভ মিছিল শুরু হয়। মিছিলটি কাকরাইল ও মৎস্য ভবন হয়ে শাহবাগে গিয়ে শেষ হয়। এ সময় নেতা-কর্মীদের হাতে প্রয়োজনীয় মৌলিক সংস্কার, নির্বাচনে লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড (সবার জন্য সমান সুযোগ) নিশ্চিত করা, পিআর পদ্ধতিতে জাতীয় নির্বাচনসহ বিভিন্ন দাবিসংবলিত প্ল্যাকার্ড দেখা যায়।