Prothomalo:
2025-08-15@16:18:27 GMT

আহমদ ছফা: দেশ, জাতি ও সংস্কৃতি

Published: 30th, June 2025 GMT

৩০ জুন জন্ম নিয়েছিলেন বাংলাদেশের স্বাধীনতা-পরবর্তী সময়ের অন্যতম চিন্তাবিদ, লেখক ও প্রতিবাদের প্রতীক। তাঁর পরিচয় বহুমাত্রিক—তিনি ছিলেন একাধারে কবি, ঔপন্যাসিক, প্রাবন্ধিক ও রাজনৈতিক চিন্তক। আহমদ ছফাকে শুধু ‘প্রাবন্ধিক’ বললে তাঁর গভীরতা, ব্যাপ্তি ও প্রভাবকে সীমাবদ্ধ করে ফেলা হয়। তিনি ছিলেন সেই দুর্লভ বাঙালি, যিনি এক হাতে বই লিখতেন আর অন্য হাতে দেশের বিবেক জাগিয়ে তুলতেন।

ছফার লেখার অন্যতম বৈশিষ্ট্য ছিল যুক্তিনির্ভরতা ও বুদ্ধিবৃত্তির স্বাধীনতা। তিনি ধর্মান্ধতা, কুসংস্কার এবং অন্ধ আনুগত্যের বিরুদ্ধে ছিলেন সর্বদা সচেতন। তাঁর মতে, জাতিকে যদি জাগ্রত করতে হয়, তবে আগে জাগাতে হবে চিন্তার স্বাধীনতা। একটি সমাজ তখনই বিকশিত হয়, যখন সেখানে মতপ্রকাশের অধিকার থাকে, মতভেদকে সম্মান করা হয় এবং বিতর্ককে অগ্রগতি হিসেবে দেখা হয়। সুতরাং ছফার স্বপ্নের বাংলাদেশ গড়তে হলে প্রয়োজন একটি যুক্তিবাদী, মুক্তচিন্তার পরিবেশ। পাঠ্যক্রমে মুক্তচিন্তা, যুক্তি ও দর্শনের চর্চা বাড়াতে হবে। গণমাধ্যম, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ও সাহিত্য-সংস্কৃতিতেও ভিন্নমতকে দমন নয়, বরং উৎসাহ দিতে হবে। আজকের তরুণ প্রজন্ম যদি প্রশ্ন করতে শেখে, তবে ছফার পথেই তারা হেঁটে চলেছে।

আহমদ ছফা এমন এক বাংলাদেশ কল্পনা করেছিলেন, যা হবে মানুষের, মানবতার, ন্যায়ের ও সংস্কৃতির। তাঁর লেখায় শুধু সাহিত্যের সৌন্দর্য নয়, ছিল রাষ্ট্রচিন্তার বিশ্লেষণ, ইতিহাসের নির্মোহ পুনর্মূল্যায়ন এবং ভবিষ্যৎ নির্মাণের দিকনির্দেশ। ছফার ভাবনায় ছিল রাষ্ট্র কেবল ভূগোল নয়, এটি এক আত্মিক প্রকাশ। ছফা যে বাংলাদেশ কল্পনা করতেন, সেখানে রাষ্ট্র হবে জনগণের। দল নয়, ক্ষমতালিপ্সু গোষ্ঠী নয়, বরং সাধারণ মানুষের মৌলিক অধিকার, মতপ্রকাশের স্বাধীনতা ও সম্মানজনক জীবনের নিশ্চয়তা থাকবে সেই রাষ্ট্রে। কিন্তু আজকের বাংলাদেশে রাজনীতি যেভাবে ব্যক্তি ও দলের সংকীর্ণতাকে কেন্দ্র করে আবর্তিত হচ্ছে, তা ছফার আদর্শ থেকে সম্পূর্ণ বিচ্যুত। এই অবস্থা থেকে উত্তরণে প্রয়োজন সাংবিধানিক সংস্কার, রাজনৈতিক দলগুলোর জবাবদিহি এবং নাগরিক সমাজের সক্রিয় ভূমিকা। ছফা চাইতেন রাজনীতির কেন্দ্রে থাকুক নীতির প্রশ্ন, আদর্শের প্রশ্ন, মানবিকতার প্রশ্ন। এই চেতনা প্রতিষ্ঠা করতে হলে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে শুরু করে প্রশাসন পর্যন্ত সব জায়গায় আদর্শিক মানদণ্ড ফেরত আনতে হবে।

আহমদ ছফার সবচেয়ে বড় হতাশার জায়গা ছিল—স্বাধীন বাংলাদেশের বুদ্ধিজীবীদের ভূমিকা। তিনি দেখতে পেয়েছিলেন, কীভাবে অনেক বুদ্ধিজীবী পাকিস্তানি আমলে ক্ষমতার পদলেহন করেছেন, আর স্বাধীনতার পর সেই একই পন্থায় বেঁচে থেকেছেন। তিনি বলেছিলেন: এই জাতির সবচেয়ে দুর্ভাগ্য এই যে তাদের যারা বুদ্ধিজীবী, যারা চিন্তার দায়িত্ব নিয়েছেন, তারা অধিকাংশই মেরুদণ্ডহীন। ছফার মতে, যদি জাতির চিন্তানেতৃত্ব ব্যর্থ হয়, তবে গণতন্ত্র, ন্যায়বিচার বা মানবিকতা—কোনো কিছুরই বিকাশ সম্ভব নয়। একটি জাতির ‘বুদ্ধিবৃত্তিক মেরুদণ্ড’ ভেঙে গেলে জাতি হয়ে পড়ে দিশাহীন। একদিকে রাজনৈতিক দুর্বৃত্তায়ন, অন্যদিকে চিন্তার পঙ্গুত্ব—এই দুইয়ের সম্মিলনে জাতি ধীরে ধীরে আত্মবিস্মৃত হয়ে পড়ে। এই উক্তি আজও সমান প্রাসঙ্গিক। যখন চিন্তাবিদেরা দলকানা হয়ে পড়েন, সত্যকে এড়িয়ে যান, অথবা ভয়ে চুপ থাকেন—তখন ছফার এই উচ্চারণ যেন ঘনঘোর সতর্কবার্তা হয়ে ফিরে আসে। একবিংশ শতাব্দীর বাংলাদেশেও নৈতিক নেতৃত্বের অভাব, একচেটিয়া ভাবনাচর্চা এবং মতপ্রকাশের সংকট এই সমস্যারই প্রকাশ।

ছফা চাইতেন এক সাহসী বুদ্ধিজীবী সমাজ, যারা সত্য বলবে, অন্যায়ের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াবে এবং রাষ্ট্রের বিবেক হয়ে কাজ করবে। এ ধরনের সমাজ গড়তে হলে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে হতে হবে স্বাধীন চিন্তার অগ্রভাগ। লেখক, শিক্ষক, সাংবাদিক, শিল্পী—এঁদের দায়িত্ব নিতে হবে সমাজকে নৈতিকভাবে জাগিয়ে তোলার। নৈতিকতা ছাড়া জ্ঞান যেমন অন্ধ, তেমনি ছফার বাংলাদেশও অসম্ভব।

স্বাধীনতা-পরবর্তীকালের বাংলাদেশের মানুষের ভাষা ও সংস্কৃতিচর্চাকে ছফা দুটি দলে চিহ্নিত করেছেন—এক দলে আছেন ঔপনিবেশিক শাসন-শোষণে উৎপীড়িত ও লাঞ্ছিত মানুষ, অপর দলে আছেন ঔপনিবেশিক শাসন-শোষণের সুবিধাভোগী জনগোষ্ঠী। ভাষা ব্যবহারের ক্ষেত্রেও দুদলের রুচি ও ধরন আলাদা।.

..সমাজ ও সংস্কৃতির মতো ভাষাও বাংলাদেশের সমাজবদলের হাতিয়ার হিসেবে অবদান রাখতে পারে বলে ছফা বিশ্বাস করতেন। তাই ভাষার সক্ষমতা অর্জনকে ছফা সমাজ-অর্থনীতি-রাজনীতি থেকে বিচ্ছিন্ন করে দেখেননি। ঔপনিবেশিক সমাজকাঠামো ঔপনিবেশিক আর্থকাঠামোরই সৃষ্টি এবং ভাষাদেহেও সেই ঔপনিবেশিক নির্ভরতা প্রবহমান। উপনিবেশিতের সংস্কৃতির ওপর উপনিবেশক যে আধিপত্য বিস্তার করে, ভাষাই সে চিহ্ন বহন করে থাকে। তাই একযোগে ভাষার সব কটি অঙ্গপ্রত্যঙ্গ থেকে ঔপনিবেশিকতা তথা দাসত্বের চিহ্নগুলো মুছে ফেলাই স্বাধীন জাতির প্রথম কর্তব্য। এটিও একটি সাংস্কৃতিক বিপ্লবের সুবর্ণরেখা। যেখান থেকে পুরো সমাজ এবং অর্থনীতির খোলনলচে বদলে দিয়ে এক নতুন, আত্মমর্যাদাসম্পন্ন জাতির উত্থান ঘটবে।

বাঙালি মুসলমান হিসেবে আত্মপরিচয়ের সংকট দূর করতে হলে ছফার দেখানো পথে ফিরতে হবে। আমাদের ইতিহাস, ভাষা, সংস্কৃতি, ঐতিহ্য—এই উপাদানগুলোর মধ্যেই রয়েছে আমাদের জাতিসত্তা। এই আত্মপরিচয়কে ভিত্তি করেই তৈরি করতে হবে একটি সাংস্কৃতিক জাগরণ, যেখানে ‘বাঙালি’ পরিচয় গৌরবের ও একতাবদ্ধ হওয়ার শক্তি হবে। আহমদ ছফা বিশ্বাস করতেন, উন্নয়নের প্রথম ও প্রধান হাতিয়ার হচ্ছে শিক্ষা ও সংস্কৃতি। তাঁর স্বপ্নের বাংলাদেশ গড়তে হলে শিক্ষাকে মানবিক ও অন্তর্দৃষ্টিপূর্ণ করে গড়ে তুলতে হবে। পাঠ্যবই থেকে শুরু করে পাঠদর্শন পর্যন্ত ঢেলে সাজাতে হবে। শুধু তথ্য নয়, মানুষ গড়ার শিক্ষা দরকার। পাশাপাশি সংস্কৃতির প্রতিটি শাখায় উৎসাহ দিতে হবে মুক্তচিন্তা, সৃজনশীলতা ও সাহসী প্রকাশকে।

আহমদ ছফা কখনো সংখ্যাগুরু চিন্তাধারার অংশ হননি। তিনি ছিলেন সেই বিরল লেখক, যিনি বরাবর শোষিত মানুষের পক্ষে কলম ধরেছেন। সাহিত্যে, সাংবাদিকতায় কিংবা বক্তৃতায়—সব জায়গায় তাঁর অবস্থান ছিল অবিচল ও আপসহীন। তিনি বিশ্বাস করতেন, লেখকের কাজ শুধু সাহিত্য রচনা নয়, বরং সময়ের অন্যায়-অবিচারের বিরুদ্ধে সোচ্চার হওয়া। এই কারণেই তাঁর লেখায় বারবার উঠে এসেছে ক্ষমতার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ, শোষিতের প্রতি সহমর্মিতা এবং বাংলাদেশি জাতিসত্তার জাগরণ। আহমদ ছফার সবচেয়ে আলোচিত গ্রন্থগুলোর মধ্যে রয়েছে ‘বুদ্ধিবৃত্তির নতুন বিন্যাস’ এবং ‘বাঙালি মুসলমানের মন’। এই দুই গ্রন্থে তিনি গভীরভাবে বিশ্লেষণ করেছেন বাঙালির জাতিসত্তা ও মুসলমান মধ্যবিত্ত শ্রেণির মনস্তত্ত্ব। তিনি দেখিয়েছেন কীভাবে পাকিস্তানি আমলে বাঙালি বুদ্ধিজীবীরা জাতীয় স্বার্থকে বিসর্জন দিয়ে ব্যক্তিস্বার্থে কাজ করেছেন, কীভাবে তাঁরা মুক্তিযুদ্ধের সময়ও দ্বিধাগ্রস্ত থেকেছেন। তাঁর লেখা কোনো দল বা প্রতিষ্ঠানের পক্ষ নেয়নি, বরং সব ধরনের পক্ষপাতিত্বকে চ্যালেঞ্জ করেছে।

১৯৭২ সালে গণকণ্ঠে ‘বুদ্ধিবৃত্তির নতুন বিন্যাস’ ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হলে তা সাহিত্য সমাজে ভূকম্পনের মতো অভিঘাত হানে। সরকার, বুদ্ধিজীবী, এমনকি লেখক সমাজ—সবাই তাঁর কলমের সামনে দাঁড়িয়ে পড়ে নিঃশব্দ। কারণ, তিনি তুলে ধরেন সেই অপ্রিয় সত্য, যা সবাই এড়িয়ে যেতে চায়। যুবক বয়সে আহমদ ছফা সরাসরি রাজনীতিতে যুক্ত হন। কমিউনিস্ট আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত হয়ে চট্টগ্রাম-দোহাজারী রেললাইন উপড়ে ফেলার মতো বিপ্লবী কর্মকাণ্ডে অংশ নেন। মাস্টারদা সূর্য সেনের বিপ্লবী আদর্শে উদ্বুদ্ধ হয়ে পুলিশের চোখ ফাঁকি দিয়ে পার্বত্য চট্টগ্রামে আত্মগোপনে যান। এই জীবনধারা পরবর্তী সময়ে তাঁর চিন্তায়, লেখায় ও মননে গভীর ছাপ ফেলেছিল। তাঁর বন্ধু ও সমকালীন লেখকেরা যখন সুবিধাবাদিতা, পদক-পদবির পেছনে ছুটেছেন, তখন ছফা ছিলেন উল্টো পথে হেঁটে যাওয়া এক সাহসী মানুষ।

আহমদ ছফা ছিলেন ধর্মান্ধতা, কুসংস্কার ও সামাজিক বৈষম্যের বিরুদ্ধে এক অবিচল কণ্ঠ। তাঁর লেখায় বারবার উঠে এসেছে সমাজের গোঁড়ামি ও রাজনৈতিক শঠতার বিরুদ্ধে দাঁড়ানোর আহ্বান। তিনি কখনো ধর্মকে ব্যক্তিগত বিশ্বাসের বাইরে সমাজ নিয়ন্ত্রণের অস্ত্র হিসেবে গ্রহণ করেননি। তাঁর মতে, জাতি গঠনের মূল ভিত্তি হতে হবে মুক্তচিন্তা, মানবতাবাদ ও সাংস্কৃতিক চেতনা। আহমদ ছফা অনুধাবন করেছিলেন: যারা বাংলাদেশের সর্বমানবের জীবনের মঙ্গলের মতো একটি প্রাণোচ্ছল সংস্কৃতি কামনা করেন, তাদের রাজনীতি ও সংস্কৃতিকে পিঠাপিঠি ভাইবোনের মতো দেখা ছাড়া উপায় নেই। কেননা, রাজনীতিতে যদি ফ্যাসিবাদ শিকড় গেড়ে বসে, সাংস্কৃতিক অগ্রসরণের প্রশ্নই ওঠে না। সাংস্কৃতিক অগ্রগতি ছাড়া কোনো রাজনৈতিক অগ্রগতি নেই। রাজনীতি সুন্দরভাবে, সুস্থভাবে অপরের সঙ্গে ভ্রাতৃত্ব সম্পর্ক স্থাপন করে বাঁচার সংগ্রাম।’ আহমদ ছফার সাহিত্যচর্চা ছিল তাত্ত্বিক, অথচ জীবনঘনিষ্ঠ। তাঁর উপন্যাস অলাতচক্র, গাভী বিত্তান্ত কেবল সাহিত্যের দৃষ্টিকোণ থেকে নয়, সমাজ ও রাষ্ট্র বিশ্লেষণের এক গুরুত্বপূর্ণ দলিল। তাঁর ভাষা সহজ, অথচ বিষয়ের গভীরতা অতল। তিনি সাহিত্যের মাধ্যমে জনগণের কণ্ঠস্বর হয়ে উঠেছেন, যেখানে দুর্বল, প্রান্তিক, নিপীড়িত মানুষের জীবন কথা বলে।

আহমদ ছফা

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: র স ব ধ নত ঔপন ব শ ক র জন ত ক কর ছ ন র অন য প রক শ আদর শ ক ষমত করত ন

এছাড়াও পড়ুন:

ইমাম বুখারির নিঃসঙ্গ মৃত্যু

৮৭০ খ্রিষ্টাব্দ, হিজরি ২৫৬ সন। মুহাম্মদ ইবন ইসমাঈল বুখারি (রহ.), যিনি ইমাম বুখারি নামে সুপরিচিত, তখন মুসলিম বিশ্বে একজন কিংবদন্তি। তাঁর রচিত সহিহ বুখারি, বিশুদ্ধ হাদিসের এক অমর গ্রন্থ, তাঁর নাম আরব থেকে আজম পর্যন্ত ছড়িয়ে দিয়েছে (আজ-জাহাবি, মুহাম্মদ ইবন আহমদ, ১৯৮৫, সিয়ার আ‘লাম আন-নুবালা, বৈরুত: মুয়াসসাসাতুর রিসালাহ, ১২/৪০০)

যেখানেই তিনি যেতেন, মানুষ তাঁকে সম্মান ও শ্রদ্ধার সঙ্গে বরণ করে নিতেন। তাঁর বয়স তখন প্রায় ৬০ বছর। এই সময়ে ইরানের নিশাপুর শহরের মানুষ তাঁকে তাঁদের শহরে আমন্ত্রণ জানান। তাঁরা ইমামের মুখ থেকে হাদিস শুনতে এবং সহিহ বুখারি সংকলনের গল্প জানতে আগ্রহী ছিলেন (আল-খতিব আল-বাগদাদি, আহমদ ইবন আলী, ২০০১, তারিখে বাগদাদ, বৈরুত: দারুল গারব আল-ইসলামি, ১০/৩০০)। তাঁদের আবদার রক্ষায় ইমাম বুখারি নিশাপুরে পৌঁছান।

ইরানের নিশাপুর শহরের মানুষ তাঁকে তাঁদের শহরে আমন্ত্রণ জানান। তাঁরা ইমামের মুখ থেকে হাদিস শুনতে এবং সহিহ বুখারি সংকলনের গল্প জানতে আগ্রহী ছিলেন।নিশাপুরে বিতর্কের সূচনা

নিশাপুরে তখন শাইখ আবু আবদুল্লাহ মুহাম্মদ ইবন ইয়াহইয়া নামের একজন প্রখ্যাত আলেম হাদিসের দরস দিতেন। তিনি ইমাম বুখারিকে সম্মান করতেন এবং তাঁর ছাত্রদের বলেছিলেন, ‘যাও, এই মহান হাদিসবিদের কাছ থেকে জ্ঞানার্জন করো’ (আজ-জাহাবি, মুহাম্মদ ইবন আহমদ, ১৯৮৫, সিয়ার আ‘লাম আন-নুবাল,. বৈরুত: মুয়াসসাসাতুর রিসালাহ, ১২/৪০৫)

কিন্তু কিছুদিনের মধ্যেই ইমাম বুখারির দরসে ছাত্রদের ভিড় বাড়তে থাকে। নিশাপুরের অধিকাংশ ছাত্র তাঁর মজলিশে যোগ দিতে শুরু করেন। এই জনপ্রিয়তা দেখে মুহাম্মদ ইবন ইয়াহইয়ার মনে হিংসার সূচনা হয়।

তখন মুসলিম বিশ্বে ‘কোরআন মাখলুক বা সৃষ্ট কি না’ এ নিয়ে তীব্র বিতর্ক চলছিল। এই বিতর্কের জেরে ইমাম আহমদ ইবন হাম্বল (রহ.)–সহ অনেক আলেম কারাবরণ ও নির্যাতন সহ্য করেছিলেন। মুহাম্মদ ইবন ইয়াহইয়া এই সুযোগে ইমাম বুখারির বিরুদ্ধে অভিযোগ তোলেন, তিনি ‘কোরআন মাখলুক’ বলে স্বীকৃতি দিয়েছেন (ইবন আবি হাতিম, আবদুর রহমান, ২০০২, আল-জারহ ওয়াত-তাআদিল, বৈরুত: দারুল কুতুব আল-ইলমিয়্যাহ, ৪/২৫০)

আরও পড়ুনইমাম মালিক (রহ.)-এর জ্ঞানচর্চা ও শিক্ষার আদর্শ০৬ মে ২০২৫

এই অভিযোগে নিশাপুরের মানুষের মনে ইমাম বুখারির প্রতি নেতিবাচক ধারণা তৈরি হয়। জনতা বিক্ষুব্ধ হয়ে ওঠেন।

বিষয়টি নিশাপুরের গভর্নরের কাছে পৌঁছায়। তিনি বিতর্কিত পরিস্থিতির মুখে ইমাম বুখারির কাছে ফরমান পাঠান, ‘আপনাকে অবিলম্বে নিশাপুর ত্যাগ করতে হবে। আমি আমার শহরে কোনো বিতর্কিত ব্যক্তিকে আশ্রয় দিতে রাজি নই।’ (আজ-জাহাবি, মুহাম্মদ ইবন আহমদ, ১৯৮৫, সিয়ার আ‘লাম আন-নুবালা, বৈরুত: মুয়াসসাসাতুর রিসালাহ, ১২/৪১০)

নিশাপুর ত্যাগ ও বুখারায় প্রত্যাবর্তন

ইমাম বুখারি তাঁর আদর্শ ও সম্মানের সঙ্গে আপস করতে রাজি ছিলেন না। তিনি কোনো প্রতিবাদ না করে নিশাপুর থেকে তাঁর কিতাব ও প্রয়োজনীয় সামগ্রী নিয়ে প্রায় ৯০০ কিলোমিটার পথ পাড়ি দিয়ে নিজ শহর বুখারায় ফিরে আসেন। (আল-খতিব আল-বাগদাদি, আহমদ ইবন আলী, ২০০১, তারিখে বাগদাদ, বৈরুত: দারুল গারব আল-ইসলামি, ১০/৩০৫)

বুখারায় ফিরে তিনি পুনরায় হাদিসের দরস শুরু করেন। তাঁর মজলিশে বিভিন্ন শহর থেকে হাজার হাজার ছাত্র জ্ঞানার্জনের জন্য ভিড় জমান।

হাদিসের জ্ঞান মজলিশে বসে অর্জন করতে হয়, ঘরে ঘরে বিলি করা হয় না। হাদিসের জ্ঞান রাসুলের উত্তরাধিকার, যা সবার জন্য সমান। এখানে ধনী-গরিবের পার্থক্য নেই।ইমাম মুহাম্মদ ইবন ইসমাঈল বুখারি (রহ.), বুখারি শরিফের সংকলক

কিন্তু বুখারায়ও তিনি বিতর্ক থেকে মুক্ত থাকতে পারলেন না। বুখারার গভর্নর খালিদ ইবন আহমদ জাহলি তাঁর কাছে ফরমান পাঠান, তিনি যেন গভর্নরের বাসভবনে গিয়ে তাঁর সন্তানদের হাদিস পড়ান। ইমাম বুখারি উত্তরে বলেন, ‘হাদিসের জ্ঞান মজলিশে বসে অর্জন করতে হয়, ঘরে ঘরে বিলি করা হয় না। আপনার সন্তানেরা আমার মজলিশে এসে জ্ঞানার্জন করতে পারে।’ (ইবন আবি ইয়ালা, আহমদ, ১৯৯৭, তাবকাতুল হানাবিলা, বৈরুত: দারুল কুতুব আল-ইলমিয়্যাহ, ২/১৮০)

গভর্নর খালিদ ইবন আহমদ জাহলি তখন বলেন, ‘আমার সন্তানেরা যখন আপনার দরসে বসবে, তখন অন্য ছাত্রদের প্রবেশ করতে দেওয়া যাবে না। আমার দারোয়ানরা আপনার মজলিশের দরজায় পাহারা দেবে।’ (আজ-জাহাবি, মুহাম্মদ ইবন আহমদ, ১৯৮৫, সিয়ার আ‘লাম আন-নুবালা, বৈরুত: মুয়াসসাসাতুর রিসালাহ, ১২/৪১৫)

ইমাম বুখারি এই অপমানজনক শর্ত মেনে নিতে পারলেন না। তিনি বলেন, ‘হাদিসের জ্ঞান রাসুলের উত্তরাধিকার, যা সবার জন্য সমান। এখানে ধনী-গরিবের কোনো পার্থক্য নেই।’ (ইবন আবি ইয়ালা, আহমদ, ১৯৯৭, তাবকাতুল হানাবিলা, বৈরুত: দারুল কুতুব আল-ইলমিয়্যাহ, ২/১৮৫)

এই জবাবে গভর্নর ক্রুদ্ধ হয়ে ফরমান জারি করেন, ইমাম বুখারিকে বুখারা ত্যাগ করতে হবে, অন্যথায় তাঁকে কারারুদ্ধ করা হবে। (আল-খতিব আল-বাগদাদি, আহমদ ইবন আলী, ২০০১, তারিখে বাগদাদ, বৈরুত: দারুল গারব আল-ইসলামি, ১০/৩১০)।

আরও পড়ুনকে ছিলেন ইমাম নববি২৩ জুন ২০২৫নিঃসঙ্গ যাত্রা ও মৃত্যু

বাধ্য হয়ে ইমাম বুখারি তাঁর জন্মভূমি বুখারা ত্যাগ করেন। তখন তাঁর গন্তব্য ছিল অনিশ্চিত। তাঁর একমাত্র সঙ্গী ছিলেন তাঁর শিষ্য ইব্রাহিম ইবন মাকিল। তিনি দোয়া করেন, ‘হে আল্লাহ! পৃথিবী আমার জন্য সংকীর্ণ হয়ে গেছে, আমাকে নিজের কাছে তুলে নাও।’ (আজ-জাহাবি, মুহাম্মদ ইবন আহমদ, ১৯৮৫, সিয়ার আ‘লাম আন-নুবালা, বৈরুত: মুয়াসসাসাতুর রিসালাহ, ১২/৪২০)

ক্লান্তি ও অসুস্থতায় তিনি বেশি দূর এগোতে পারেননি। রাস্তার পাশে বসে পড়েন এবং শুয়ে পড়েন। শিষ্য ইব্রাহিম তাঁকে ডাকলে কোনো সাড়া পাননি।

ইমাম বুখারি সমরকন্দের কাছে খাতরাঙ্গ নামক একটি নিভৃত গ্রামে তাঁর এক আত্মীয়ের কাছে আশ্রয় নেওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। কিন্তু সেখানেও তাঁর বিরোধীদের চক্রান্ত পিছু ছাড়ল না। সমরকন্দের গভর্নরের কাছে তাঁর অবস্থান জানিয়ে তাঁকে বহিষ্কারের আবেদন জানানো হয়। গভর্নর ফরমান জারি করেন, ইমাম বুখারিকে অবিলম্বে সমরকন্দ ত্যাগ করতে হবে। (আল-খতিব আল-বাগদাদি, আহমদ ইবন আলী, ২০০১, তারিখে বাগদাদ, বৈরুত: দারুল গারব আল-ইসলামি, ১০/৩১৫)

সেদিন ছিল পবিত্র ঈদুল ফিতরের রাত, ২৫৬ হিজরির শাওয়াল মাসের প্রথম রাত। ফরমানে বলা হয়, ঈদের পরে নয়, সেই রাতেই তাঁকে সমরকন্দ ত্যাগ করতে হবে।

অসুস্থ শরীর নিয়ে ইমাম বুখারি তাঁর শিষ্য ইব্রাহিম ইবন মাকিলের সঙ্গে যাত্রা শুরু করেন। কিন্তু ক্লান্তি ও অসুস্থতায় তিনি বেশি দূর এগোতে পারেননি। রাস্তার পাশে বসে পড়েন এবং শুয়ে পড়েন। শিষ্য ইব্রাহিম তাঁকে ডাকলে কোনো সাড়া পাননি। ইমাম বুখারি ততক্ষণে আল্লাহর ডাকে সাড়া দিয়ে জান্নাতের পথে চলে গেছেন। (আজ-জাহাবি, মুহাম্মদ ইবন আহমদ, ১৯৮৫, সিয়ার আ‘লাম আন-নুবালা, বৈরুত: মুয়াসসাসাতুর রিসালাহ, ১২/৪২৫)

৮৭০ খ্রিষ্টাব্দের ১ সেপ্টেম্বর, হিজরি ২৫৬ সনের শাওয়াল মাসের প্রথম রাতে, সমরকন্দের খাতরাঙ্গ গ্রামে, রাস্তার পাশে নিঃসঙ্গ অবস্থায় হাদিসশাস্ত্রের এই মহান ইমাম ইন্তেকাল করেন।

আরও পড়ুনবুখারি শরিফের অপার মহিমা১৮ জুলাই ২০২৫

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • হলে হঠাৎ অসুস্থ, হাসপাতালে মৃত্যু ঢাবি ছাত্রীর
  • ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে আলাদা হলো ৭ কলেজ
  • পৃথক হলো ঢাবি ও সাত কলেজ
  • ইমাম বুখারির নিঃসঙ্গ মৃত্যু
  • সিলেটে ছুকিরাঘাতে মাদরাসা শিক্ষক নিহত