কবি, প্রাবন্ধিক ও গবেষক ফরহাদ মজহার দেশের অন্যতম প্রভাবশালী রাজনৈতিক তাত্ত্বিক। তিনি বেসরকারি প্রতিষ্ঠান উন্নয়ন বিকল্পের নীতিনির্ধারণী গবেষণা-উবিনীগ এবং নয়াকৃষি আন্দোলনের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা। সম্পাদনা করছেন ‘চিন্তা’। ১৯৬৭ সালে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ঔষধশাস্ত্রে স্নাতক এবং পরে যুক্তরাষ্ট্রের দ্য নিউ স্কুল ফর সোশ্যাল রিসার্চ থেকে অর্থশাস্ত্রে উচ্চতর ডিগ্রি অর্জন করেন। তাঁর উল্লেখযোগ্য গ্রন্থের মধ্যে রয়েছে ‘গণঅভ্যুত্থান ও গঠন’, ‘মোকাবিলা’, ‘এবাদতনামা’, ‘সাম্রাজ্যবাদ’, ‘মার্কস, ফুকো ও রুহানিয়াত’, ‘ক্ষমতার বিকার’ ইত্যাদি। ফরহাদ মজহারের জন্ম ১৯৪৭ সালে নোয়াখালীতে। এই সাক্ষাৎকারের প্রথম অংশ আজ প্রকাশ হচ্ছে; বৃহস্পতিবার প্রকাশিত হবে দ্বিতীয় অংশ। সমকালের পক্ষে সাক্ষাৎকার নিয়েছেন সহসম্পাদক ইফতেখারুল ইসলাম।

সমকাল: জুলাই গণঅভ্যুত্থানের এক বছর হয়ে গেল; বাংলাদেশের রাজনীতি কোন দিকে এগোচ্ছে?

ফরহাদ মজহার: প্রশ্নটা কিন্তু বিমূর্ত হয়ে গেল। আমরা কোন দিকে যাচ্ছি, তা বুঝতে হলে আঞ্চলিক ও ভূরাজনৈতিক বাস্তবতা আমলে নিয়ে বাংলাদেশের বর্তমান পরিস্থিতি মাথায় নিতে হবে।
সমকাল: যেমন–

ফরহাদ মজহার: প্রথমে ৫ আগস্টের পরে ৮ আগস্ট শেখ হাসিনার ফ্যাসিস্ট সংবিধান রক্ষার শপথ নেওয়ার মধ্য দিয়ে বাংলাদেশে ‘সাংবিধানিক প্রতিবিপ্লব’ ঘটেছে। নতুন গঠনতন্ত্র প্রণয়নের যে গাঠনিক ক্ষমতা বা ‘কনস্টিট্যুয়েন্ট পাওয়ার’ জনগণ পেয়েছিল; জনগণের সেই ক্ষমতার সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করা হয়েছে। শেখ হাসিনার ফ্যাসিস্ট রাষ্ট্রক্ষমতা ও কাঠামো রক্ষার শপথ নেওয়ার পর পুরোনা আইন ও প্রতিষ্ঠানগুলো সংস্কারের নামে তামাশা চালানো হয়েছে। এই সংস্কার প্রক্রিয়ার জন্য দেশ-বিদেশ থেকে যাদের যুক্ত করা হলো, তাদের খুব কমই গণঅভ্যুত্থানের সঙ্গে সরাসরি জড়িত ছিলেন; কেউ কেউ গণঅভ্যুত্থানের সমর্থকও ছিলেন না। গণবিচ্ছিন্ন এলিট বা অভিজাত শ্রেণির নেতৃত্বে সংস্কার চলছে। এর একটা গালভরা নামও আছে– ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনাকে বাদ দিয়ে ‘নতুন রাজনৈতিক বন্দোবস্ত’। অর্থাৎ লুটেরা ও মাফিয়া শ্রেণিসহ দেশি-বিদেশি স্বার্থান্বেষী ও করপোরেট শক্তির মধ্যে নতুন বোঝাপড়া। পুরোনো ফ্যাসিস্ট ব্যবস্থা ও অকার্যকর প্রতিষ্ঠানগুলোর গায়ে নতুন রংচং মেখে হাজির করা।

সমকাল: নতুন রাজনৈতিক বন্দোবস্ত লাগবে না?

ফরহাদ মজহার: জনগণ সকল প্রকার ফ্যাসিবাদ, ফ্যাসিস্ট শক্তি ও ফ্যাসিস্ট রাষ্ট্রব্যবস্থার বিরুদ্ধে লড়ে চলেছে। এটাই বাস্তব ইতিহাস। জনগণ নতুনভাবে বাংলাদেশ গঠনের জন্য অকাতরে শহীদ হয়েছে আর পঙ্গু হয়ে পড়ে রয়েছে। এদের জীবনের কোনো মূল্য নেই। বিস্ময়কর যে, খোদ জনগণকেই এই তথাকথিত ‘নতুন রাজনৈতিক বন্দোবস্ত’ থেকে বাদ দিয়ে দেওয়া হয়েছে।

সমকাল: জনগণ বিক্ষোভ করতে পারছে; মত প্রকাশ করতে পারছে কি?

ফরহাদ মজহার: আপনি দেখবেন, জনগণের ক্ষোভ-বিক্ষোভকে ‘মব’ আখ্যা দেওয়া শুরু হয়েছে। কিন্তু যখন ‘মব’ সত্য সত্যই একের পর এক মাজার ভাঙা শুরু করেছিল, তখন কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হলো না। ধর্ম অবমাননার জন্য কোনো আইন-আদালত, নীতি-নৈতিকতার ধারেকাছে না থেকে ‘হাতের অধিকার’, অর্থাৎ নিজ হাতে নিজের দেওয়া মৃত্যদণ্ড কার্যকর করবার ঘোষণা দেওয়া হলো। তার বিরুদ্ধে কোনো আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হলো না। উল্টা কবি-সাহিত্যিকদের কবিতা লেখার জন্য কারাগারে পাঠানো হলো। অর্থাৎ একদিকে জনগণকে অস্বীকার; তাদের গণতান্ত্রিক সামষ্টিক শক্তি বা গাঠনিক ক্ষমতাকে দমন করা হলো, আবার অন্যদিকে বাংলাদেশকে নতুনভাবে গড়বার গণতান্ত্রিক অভিপ্রায়কে নস্যাৎ করে সংস্কারের নামে পুরোনা ফ্যাসিস্ট সংবিধান ও রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলো রক্ষার চেষ্টা দৃঢ়ভাবে চালিয়ে যাওয়া হচ্ছে। 

সমকাল: এই পরিস্থিতির তাৎক্ষণিক ফল কী?

ফরহাদ মজহার: গণঅভ্যুত্থান হয়ে গিয়েছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সহায়তায় ‘রেজিম চেঞ্জ’। মার্কিন অর্থনীতিবিদ ও বিশ্লেষক জেফরি স্যাকস ১৮ আগস্ট দাবি করলেন, ‘দ্য ভেরি স্ট্রং এভিডেন্স অব দ্য ইউএস রোল ইন টপলিং দ্য গভর্নমেন্ট অব ইমরান খান ইন পাকিস্তান রেইজেজ দ্য লাইকলিহুড দ্যাট সামথিং সিমিলার মে হ্যাভ অকারড ইন বাংলাদেশ’। কথাটা তো ফেলে দেওয়া যাচ্ছে না।

সমকাল: তাহলে দীর্ঘ মেয়াদে বাংলাদেশ পরিস্থিতি কীভাবে বিচার করব?

ফরহাদ মজহার: আরেকটি নতুন রাজনৈতিক বাস্তবতা তৈরি হতে শুরু করেছে। সেক্যুলার বাঙালি জাতিবাদী ফ্যাসিবাদের বিপরীতে বাংলাদেশকে ধর্মীয় জাতিবাদী ফ্যাসিবাদের উর্বর ভূমিতে পরিণত করা। প্রথমত, দীর্ঘকাল ইসলামবিদ্বেষ ও ইসলাম নির্মূল রাজনীতির ফলে ইসলামের সঙ্গে বুদ্ধিবৃত্তিক বা দার্শনিক বোঝাপড়া আমরা করিনি। পাশ্চাত্যে গ্রিক দর্শনের আশ্রয়ে এবং বুদ্ধিবৃত্তিক বা দার্শনিক বিপ্লবের মধ্য দিয়ে খ্রিষ্টীয় সমাজে চিন্তা ও রাজনৈতিক পরিসরে যে রূপান্তর ঘটেছে, আমরা আমাদের সমাজে সেই ইতিবাচক রূপান্তর ঘটাতে পারিনি। নামাজ-কালাম, এবাদত-বন্দেগি ছাড়া ইসলাম থেকে নৈতিক ও আদর্শিক শিক্ষা গ্রহণ করবার কোনো শক্তিশালী ধারা বাংলাদেশে গড়ে ওঠেনি। এমনই যে নানান ফেরকা, মতবাদ এবং পরস্পরকে কাফের-মুরতাদ প্রমাণ করার ছড়াছড়ির নাম ইসলাম হয়ে উঠেছে। দ্বিতীয়ত, লুটেরা ও মাফিয়া শ্রেণির লুটপাট এবং আন্তর্জাতিক বহুপক্ষীয় ও দ্বিপক্ষীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর আধিপত্যের কারণে আমরা একটি অনুন্নত ও সস্তায় শ্রম বেচাবিক্রির দেশে পরিণত হয়েছি। ফলে ইহলৌকিক জীবন মানুষের আকাঙ্ক্ষা ও বাসনা পূরণ করতে পারে– সে ভরসা গরিব ও প্রান্তিক জনগণ হারিয়ে ফেলেছে। এটা ভয়ংকর একটি আর্থসামাজিক পরিস্থিতি। ফলে মানুষ পরকালাশ্রয়ী অর্থাৎ পরকালই সত্য, ইহলোক মিথ্যা এবং ইহলোকে কিছু পাবার আশা নেই– এই বিশ্বাস গরিব ও প্রান্তিক জনগণের মধ্যে প্রবল হয়েছে। ফলে ধর্মচর্চাও ক্রমশ এক শ্রেণির পরকাল ব্যবসায়ীর হাতে চলে গিয়েছে। ধর্মতাত্ত্বিক আলোচনাও ইতিবাচকভাবে নয়; ইহলোকে অবিশ্বাসী বা পরকালবাদী তত্ত্বে পর্যবসিত হচ্ছে। এমনই– যা রীতিমতো পরকাল ব্যবসাতে পরিণত হয়েছে। সমাজ ও রাজনীতির জন্য ইহলোকবিমুখ পরকাল ব্যবসার ফল ভয়াবহ হতে পারে। বাঙালি জাতিবাদী ফ্যাসিস্ট শক্তির পরাজয়ের পর নতুন ধর্মবাদী ফ্যাসিস্ট শক্তি উত্থানের আর্থসামাজিক ও রাজনৈতিক শর্ত বাংলাদেশে হাজির হয়েছে। 

সমকাল: এই পরিপ্রেক্ষিতে ভূরাজনীতির পরিগঠন কেমন হবে বলে মনে করছেন? 

ফরহাদ মজহার: খেয়াল করুন– আগস্টের পর কয়েক মাসজুড়ে যে ভূরাজনৈতিক অবস্থা ছিল, সেটা এখন সম্পূর্ণভাবে বদলে গিয়েছে। আমরা ইতোমধ্যে তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের মধ্যে প্রবেশ করেছি– সেটা আগের চেয়ে পরিষ্কার। ইউক্রেন যুদ্ধের মধ্য দিয়ে এই যুদ্ধ শুরু হয়েছে। গাজাকে ধূলিসাৎ করে দেওয়া এবং জায়নিস্ট ইসরায়েলের রিয়েল টাইমে গণহত্যার দৃশ্য সারা দুনিয়ার মানুষ দেখেছে। ইরান হামলার মধ্য দিয়ে তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ আরও পরিণত রূপ গ্রহণ করেছে। এক মেরুর যে বিশ্ব, সেখান থেকে পৃথিবীর তিন মেরুর একটা লড়াই শুরু হয়েছে। এর বিরুদ্ধে বিশ্বব্যাপী প্রতিরোধের লড়াই দেখুন। জায়নবাদের বিরুদ্ধে ইহুদি-খ্রিষ্টান-মুসলিমসহ আস্তিক-নাস্তিক নির্বিশেষে যে লড়াই, সেটা বৈশ্বিক লড়াই হিসেবে হাজির হয়েছে। দেখুন, নিউইয়র্কে মেয়র হিসেবে জোহরান মামাদানি নির্বাচিত হয়েছেন। তিনি মুসলমান, নাকি সমাজতন্ত্রী– তা নিয়ে ভোটারদের মাথাব্যথা নেই। দুনিয়াব্যাপী যে ব্রুটাল পুঁজিতান্ত্রিক বিশ্বব্যবস্থা জারি রয়েছে এবং তাকে টিকিয়ে রাখার জন্য জায়নিস্ট ইসরায়েলকে সামনে রেখে যে মিলিটারি-ইন্ডাস্ট্রিয়াল কমপ্লেক্স দাঁড়িয়ে আছে; তার বিরুদ্ধে বিশ্বব্যাপী একটা ঐকমত্য গড়ে উঠেছে। বাংলাদেশের গণঅভ্যুত্থান সেই বৈশ্বিক রাজনীতির অংশ, বাইরের কিছু না। খুবই তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনা।

সমকাল: এমন পরিস্থিতিতে বাংলাদেশের কী করণীয়?

ফরহাদ মজহার: ভূরাজনৈতিক বাস্তবতা মাথায় রেখে বাংলাদেশের জন্য সঠিক রাজনৈতিক কৌশল ও নীতি ঠিক করতে সক্ষম কোনো রাজনৈতিক দল আমরা দেখছি না। আমি মনে করি, ছাত্র-তরুণদের যত ব্যর্থতাই থাকুক– গণমানুষের সামষ্টিক অভিপ্রায়কে রাজনৈতিক রূপ দেওয়া এবং তা বাস্তবায়নের জন্য গণরাজনৈতিক ধারা তারা অবশ্যই গড়ে তুলতে পারবে। সামনে অনেক ওঠাপড়া, বাধা-বিপদ আছে। তবে ৫ আগস্ট প্রমাণ করে দিয়েছে, এটা ঘটে যাচ্ছে। ঘটবে। আমি এবং আমার বন্ধুরা সেই প্রক্রিয়ার ভেতর কিংবা বাহির– সকলভাবেই হাজির থাকব। 

সমকাল: বর্তমান সরকারের মধ্যে কি আপনি বিশেষ কোনো প্রজ্ঞা দেখছেন না?

ফরহাদ মজহার: ড.

ইউনূসকে আমরা কেন চেয়েছি? আন্তর্জাতিক ব্যক্তিত্ব হিসেবে বাংলাদেশের এই ঐতিহাসিক রূপান্তরের কেন্দ্রে থেকে তিনি যেন জনগণের অভিপ্রায় বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে ইতিবাচক ভূমিকা রাখতে পারেন। কাজটা তো সহজ নয়। পরিস্থিতিও স্বাভাবিক নয়। তিনি তাঁর মতো চেষ্টা করছেন। ভারতকে তাৎক্ষণিক মোকাবিলার ক্ষেত্রে তাঁর ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ। আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে বিভিন্ন শক্তির সঙ্গে নেগোশিয়েট তিনি করতে পারবেন– এই আস্থা আমাদের আছে। ভারত যেন আমাদের রাজনীতি ও রাষ্ট্রের রূপান্তরে হস্তক্ষেপ করতে না পারে এবং বাংলাদেশকে লুটপাটের ক্ষেত্র মনে না করে, সে জন্য ড. ইউনূসকে আমাদের দরকার ছিল। এর কুফলটা হচ্ছে এই– জেফরি স্যাকসরা বলছেন– বাংলাদেশে এখন মার্কিন স্বার্থ রক্ষার জন্য রেজিম চেঞ্জ হয়েছে। এই হাল আমরা সহজে বদলাতে পারছি না। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র যেমন করে রেজিম চেঞ্জ করতে চেয়েছে, তেমনি বাংলাদেশেও রেজিম চেঞ্জ হয়েছে কি? এই সন্দেহ দেখা দিয়েছে। তিনি ব্যর্থ হলে জেফরি স্যাকসের মূল্যায়ন সঠিক বলে প্রমাণিত হবে। জেফরি স্যাকস আমাদের গণআকাঙ্ক্ষাকে উপেক্ষা করেছেন বটে, কিন্তু কথা পুরোটা মিথ্যা নয়। ইতিহাসের কাছে জবাবদিহি নিশ্চিত করতে হলে ড. ইউনূসকে অনেক প্রজ্ঞাবান ও সতর্ক হতে হবে।

সমকাল: তাহলে বাংলাদেশের নিকট ভবিষ্যৎ কেমন দেখছেন?

ফরহাদ মজহার: ওপরে যা বললাম, সেই সকল কারণে আমাদের ভবিষ্যৎটা খুব ভালো বলে আমি মনে করছি না। ফলে একটা দ্বন্দ্ব তৈরি হবে। একদিকে ফ্যাসিস্ট শক্তি– আওয়ামী লীগ নামে যেটি হাজির ছিল, বাঙালি জাতিবাদ আকারে হাজির ছিল; আমাদের দুর্বলতার সুযোগে পরাজিত শক্তি শক্তিমান হবে। পাশাপাশি তার সঙ্গে জোট বাঁধবে জাতিবাদী ইসলাম। জাতিবাদী ইসলাম ফ্যাসিবাদের অপর নাম। ফলে জনগণের গণসার্বভৌমত্ব বা গণআকাঙ্ক্ষার ভিত্তিতে যে একটা গণতান্ত্রিক রাজনীতি বিকাশের সুযোগ ছিল, সেটি অনেক বেশি রুদ্ধ হবে। 

সমকাল: আমরা কি তাহলে ভীত-সন্ত্রস্ত হবো?

ফরহাদ মজহার: আগামীর লড়াইটা কঠিন হবে– সন্দেহ নেই, কিন্তু ভীতির কোনো কারণ নেই। আমি মনে করি, এই পোলারাইজেশনটা ভালো। এই পোলারাইজেশন তরুণদের বিশাল একটা অংশকে অনুপ্রাণিত করবে যে আগস্ট-জুলাইয়ের বিপ্লবী স্পিরিটকে সামনে এগিয়ে নিতে হলে কী করা দরকার। এখন যাদের আমরা ভুল করতে দেখছি, এদিক-সেদিক করছে, এরা ঠিকই আবার রাস্তায় থাকবে। আমি এদের ওপর আশা ছাড়তে রাজি না। কারণ এরাই গণঅভ্যুত্থানটা করেছে। এই লড়াইয়ের ক্ষেত্রে আমরা বুদ্ধিজীবী হিসেবে যেমন এগিয়ে যেতে পারি, একই সঙ্গে সক্রিয় রাজনৈতিক কর্মী হিসেবেও।

সমকাল: জনগণের ওপর আপনার এত আস্থা কেন? 

ফরহাদ মজহার: যদি গণসার্বভৌমত্ব কায়েমই গণতন্ত্র হয়, তাহলে গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র গঠন করতে হলে জনগণের ওপর আস্থা রাখতেই হবে। আর লুটেরা ও মাফিয়া শ্রেণির পক্ষে থাকলে আপনি নির্বাচনকেই গণতন্ত্র বলে জনগণকে বিভ্রান্ত করতে থাকবেন। জনগণের ওপর আস্থা তো থাকতেই হবে। জনগণের যে অংশটা রূপান্তর চায়, তারা না খেয়ে হলেও তাদের নেতাদের বাঁচিয়ে রাখবে।

সমকাল: সেটা কীভাবে, উদাহরণ দিতে পারেন?

ফরহাদ মজহার: আমাদের জীবনেই উদাহরণ রয়েছে। একসময় ছিল, পুরো বাংলাদেশ ঘুরে আসতে আমাদের তো একটা টাকাও লাগত না। এটা আমি মতিন ভাইয়ের (ভাষাসংগ্রামী আবদুল মতিন) কাছে শিখেছি। মতিন ভাই বাসা থেকে বেরুতেন, আমার বাসায় আসতেন। তারপর আমার সঙ্গে কথাবার্তা বলে বাসের টিকিটের জন্য ৫/১০ টাকা নিয়ে বেরিয়ে পড়তেন। তারপর আরেক জেলায় আরেক কমরেডের বাড়িতে। এটা বামপন্থিদের প্র্যাকটিস ছিল। 
আমি এখনও নির্ঘাত অভিজ্ঞতা থেকে বলতে পারি, আমি যদি পকেটে কিচ্ছু না নিয়ে বের হই, আমি সাধারণ মানুষের কাছ থেকে পুরোনা কায়দায় চলতে পারব। মসজিদে থাকতে পারব, কারও বাসায় থাকতে পারব, আবার বন্ধুদের চাঁদা নিয়ে অন্যখানে যেতে পারব। এখনও আমরা বহু কাজ করি; বন্ধুরা সাহায্য করেন বলেই করতে পারি। সারাদেশে ঘুরতে পারব। এটা অত্যন্ত সহজ। 

সমকাল: গণঅভ্যুত্থানের আকাঙ্ক্ষা ধরে রাখতে হলে এই মুহূর্তে কী করণীয়?

ফরহাদ মজহার: আমাদের মনে রাখতে হবে, ৮ তারিখে একটা সাংবিধানিক প্রতিবিপ্লব হয়েছে। এই প্রতিবিপ্লবের পরে যদি আমরা এগোতে চাই, তাহলে সাময়িক হলেও জনগণের গাঠনিক শক্তিকে পুনর্নির্মাণ করতে হবে। এটা তো সহজ কাজ নয়। একবার যখন গাঠনিক মূহূর্ত বেহাত হয়, চলে যায়, তখন ফিরিয়ে আনা কঠিন কাজ। সমাজে যে শ্রেণি লুটেরা-মাফিয়াদের পক্ষে ছিল, তারাই কিন্তু কাজটা করেছে। সাংবিধানিক প্রতিবিপ্লব ও তার পক্ষে যেসব মতাদর্শ সমাজে কার্যকর এবং যে এলিট ও ধনীরা মিলে লুটেরা-মাফিয়াদের রাজনৈতিক ব্যবস্থা নতুন বন্দোবস্ত দ্বারা চালু রাখতে চায়, তাদের ধরে ধরে এনে আপনি কমিশন বানাবেন। আর নতুন গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান বানাবেন না; জনগণকে বানাতে দেবেন না। তথাকথিত সংস্কার করবেন– এই সংস্কার তো এমনিতেই ব্যর্থ হবে। যে সাংবিধানিক কাউন্সিলের কথা বলা হয়েছে, আজকের পত্রিকায় দেখলাম সেই ক্ষেত্রে ঐকমত্য সম্ভব হবে না। এটা তো আমরা প্রথম থেকেই বলছিলাম। লড়াইটা জনগণ বনাম ফ্যাসিস্ট শক্তির। 

সমকাল: এই সংকট থেকে বেরোনোর কি কোনো পথ নেই? 

ফরহাদ মজহার: এখান থেকে বেরোবার একমাত্র পথ হচ্ছে বুঝতে পারা যে, লুটেরা ও মাফিয়া শ্রেণির রাজনৈতিক প্রতিনিধিদের সঙ্গে ‘জাতীয় ঐকমত্য’ প্রতিষ্ঠার চেষ্টা আত্মঘাতী পথ। এখান থেকে বেরুতে হবে। এখান থেকে বেরুতে হলে প্রথমত আমাদের গণসার্বভৌমত্বের ধারণাটা পরিষ্কারভাবে বুঝতে হবে। জাতীয় ঐকমত্য গণঅভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে পরিষ্কার তৈরি হয়ে আছে। সেটা হলো, গণসার্বভৌমত্বের ভিত্তিতে নতুন গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ গঠন। বিপরীতে রাজনৈতিক দলের সঙ্গে তথাকথিত ঐকমত্য প্রতিষ্ঠার চেষ্টা গণঅভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে তৈরি হওয়া গণঅভিপ্রায় নস্যাৎ করা, প্রতিবিপ্লবী রাজনীতিকে বৈধকরণ প্রক্রিয়া জোরদার করা ইত্যাদি।

সমকাল: তাহলে সরকার যে নির্বাচনের কথা বলছে, তার কী হবে?

ফরহাদ মজহার: নির্বাচন যে বাংলাদেশকে একটা ভালো জায়গায় নেবে– এটা সাধারণ মানুষ তো বিশ্বাস করে না। তাহলে জবরদস্তি করে এটা চাপিয়ে দেওয়া ভুল। আবার সাধারণ মানুষ এই আস্থাও হারিয়েছে– ড. ইউনূস তাদের আকাঙ্ক্ষা পূরণ করবেন। এটা হলো রাজনৈতিক বাস্তবতা। জনগণ যা চাইছে তা বোঝার মতো মানসিকতা অন্তর্বর্তী সরকারের চাই। নির্বাচন করার ক্ষমতা অন্তর্বর্তী সরকারের আছে কি নেই? নির্বাচন করতে হলে আপনি কাকে দিয়ে নির্বাচন করবেন? যাদের দিয়ে নির্বাচন করবেন, তারা নিজেদের লোকদের নির্বাচিত করিয়ে আনবে। এই নির্বাচনে জনগণ কী পাবে? ঠিক ২০০৮ সালে বিএনপি যে ভুলটা করেছে, এটা হবে সেই ভুলেরই পুনরাবৃত্তি। 

সমকাল: তাহলে কি অন্তর্বর্তী সরকার অনির্দিষ্টকালের জন্য ক্ষমতায় থাকবে?

ফরহাদ মজহার: না। আমি সে কথা বলিনি। সরকার তো গঠনের প্রক্রিয়াই শুরু করেনি। গঠন প্রক্রিয়া মানে একটা গঠনতন্ত্র প্রণয়নের প্রক্রিয়া। আর গাঠনিক প্রক্রিয়া হলো সাংস্কৃতিক সমস্যা, অর্থনৈতিক সমস্যা, বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান পুনর্গঠন সমস্যার সমাধান। দেখুন, বাংলাদেশের ৩৫ ভাগ অর্থ শুধু আমলাদের পেছনে চলে যাচ্ছে। আপনি কি এত বড় আমলাতন্ত্র রাখবেন? স্থানীয় সরকারগুলো কি এসব দায়িত্ব নিতে পারে না?

সমকাল: সময় দেওয়ার জন্য ধন্যবাদ।

ফরহাদ মজহার: সমকালকেও ধন্যবাদ।

উৎস: Samakal

কীওয়ার্ড: ফরহ দ মজহ র গণঅভ য ত থ ন র ফরহ দ মজহ র গণত ন ত র ক ভ র জন ত র র জন ত পর স থ ত প রক র য় র প ন তর র জন ত র ব যবস থ ঐকমত য জনগণ র আম দ র র জন য বন দ ব ব শ বব রক ষ র র প রক অর থ ৎ ইউন স আগস ট করব ন র ওপর পরক ল সরক র ক ষমত সমক ল ইসল ম

এছাড়াও পড়ুন:

গণতন্ত্রের গভীর অসুখ!

প্রায় এক শ বছর আগে নির্জনতা ও নিঃসঙ্গতার কবি জীবনানন্দ দাশের কলমে ঝরে পড়েছিল পৃথিবীর গভীরতম ক্ষতের চিহ্ন, ‘সুচেতনা’ কবিতায় কবি লিখেছিলেন, ‘পৃথিবীর গভীর গভীরতর অসুখ এখন;’ যে গভীর গভীরতর অসুখের কথা কবিতার আখরে উঠে এসেছিল, পৃথিবীর সেই অসুখ কি সেরেছে? হয়তো সারেনি, বরং ডালপালা মেলে সেই সব অসুখ ছড়িয়ে পড়েছে পৃথিবীর পথে পথে। এই লেখার বিষয়বস্তু গণতন্ত্র, তাই একবিংশ শতাব্দীর সিকি ভাগ পেরিয়ে এসে পৃথিবীর গণতন্ত্রের দিকে তাকালে জীবনানন্দ দাশের কবিতায় যেন নবরূপে অনুরণিত হয়, ‘গণতন্ত্রের গভীর গভীরতর অসুখ এখন;’

গণতন্ত্র; যে শব্দ একদিন মানুষের অধিকার, সমতা ও স্বাধীনতার প্রতীক হয়ে উঠেছিল, আজ তা যেন ক্রমেই ক্ষয়ে ক্ষয়ে দুর্বল হয়ে যাচ্ছে অভ্যন্তরীণ অভিঘাতে। পৃথিবীব্যাপী গণতন্ত্র এখন এক কঠিন সংকটের মধ্য দিয়ে অতিক্রম করছে। ছদ্মবেশী কর্তৃত্ববাদ, লোকরঞ্জনবাদ, গুজব-প্রচারণা ও প্রাতিষ্ঠানিক দুর্বলতা যেন আজ এই শাসনব্যবস্থার প্রাণশক্তিকে ধীরে ধীরে নিঃশেষ করে ফেলছে! এই অসুখ শুধু রাষ্ট্রের কাঠামোতেই নয়, আমাদের সমাজের গভীরে, আমাদের চেতনার মূলে প্রবেশ করেছে। বাংলাদেশের মাটিতে, যেখানে গণতন্ত্রের শিকড় এখনো সুদৃঢ়ই হয়নি, এই অসুখের প্রভাব আরও তীব্র। তবু প্রশ্ন জাগে, এই অসুখ কি নিরাময়যোগ্য? আমরা কি এখনো চেষ্টা করলে সত্যিকারের গণতন্ত্রের স্বপ্নকে বাস্তবে রূপ দিতে পারি না?

আরও পড়ুননেতারা দেশে গণতন্ত্র চান, দলে চান না০১ মার্চ ২০২৫

আন্তর্জাতিক গবেষণা ও বৈশ্বিক সূচকগুলো বলছে, পৃথিবীর ৭১% জনগণ এখন স্বৈরতান্ত্রিক ব্যবস্থায় বসবাস করছে, যা এক দশক আগেও ছিল মাত্র ৪৮% (ভি-ডেম, ২০২৪)। ২০২১ সালের জানুয়ারিতে ক্ষমতার পালাবদলের সময় ক্যাপিটল হিলে কলঙ্কিত হামলার ঘটনার পর যুক্তরাষ্ট্রকেও প্রথমবারের মতো ‘ব্যাকস্লাইডিং ডেমোক্রেসি’ হিসেবে চিহ্নিত করেছিল ইন্টারন্যাশনাল ইনস্টিটিউট ফর ডেমোক্রেসি অ্যান্ড ইলেকটোরাল অ্যাসিস্ট্যান্স (ইন্টারন্যাশনাল আইডিয়া)। সাম্প্রতিক কালেও ডোনাল্ড ট্র্যাম্প আবার নির্বাচিত হয়ে এসে একের পর এক নির্বাহী আদেশে যেভাবে তাঁর দেশের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানকে অবজ্ঞা করে চলেছেন, তা যুক্তরাষ্ট্রের মতো উদার গণতান্ত্রিক দেশের ইতিহাসেই বিরল। ট্র্যাম্প অবশ্য এবার শুধু নিজ দেশেই থেমে নেই, বাকি বিশ্বের ওপর ইচ্ছেমতো ট্যারিফ বসিয়ে প্রায় অর্থনৈতিক যুদ্ধই বাধিয়ে দিতে চলেছেন।

ফ্রিডম হাউস, ভি-ডেম ইনস্টিটিউট, ইকোনমিস্ট ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের (ইআইইউ) মতো আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানগুলোর প্রতিবেদনে নিয়মিতই উঠে আসছে নাগরিক স্বাধীনতা, মত প্রকাশের অধিকার ও আইনের শাসন—সবই ক্রমাগত ক্ষয়প্রাপ্ত। উন্নত ও ঐতিহ্যবাহী গণতন্ত্রও এই পতনের বাইরে নেই। রাজনৈতিক নেতাদের কৌশলী ক্ষমতা দখল, জনতুষ্টিবাদ, তথ্য বিকৃতি ও গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে দুর্বল করাই এসব সংকটের মূল কারণ।

বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে স্বাধীনতার পর থেকেই এই দেশকে বিভিন্ন রাজনৈতিক সংকটের মধ্য দিয়ে যেতে হয়েছে, যা এ দেশের গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে কখনোই শক্ত ভিতের ওপর দাঁড়াতে দেয়নি। সামরিক শাসন, রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ড ও দলীয় সংঘাতের ছায়ায় গণতন্ত্রের স্বপ্ন যেভাবে বারবার বিঘ্নিত হয়েছে, একইভাবে রাজনৈতিক দলগুলোর অভ্যন্তরে ব্যক্তিপূজা, বংশপরম্পরায় নেতৃত্ব নির্বাচন, পারস্পরিক অবিশ্বাস ও দলান্ধতা যেন আমাদের গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে থেকে গেছে।

গণতন্ত্রের সুলুক সন্ধানে যাওয়ার আগে একটা মজার গল্প শোনা যাক। ‘একটি ছাগল শহরের চত্বরে ঘাস খেতে পারবে কি না’ তা নির্ধারণে দূরদেশ আইসল্যান্ডের ছোট্ট শহরে একবার অদ্ভুত এক গণভোট অনুষ্ঠিত হয়েছিল। কয়েক সপ্তাহের জোর কদম প্রচারণা শেষে ভোট গণনা করে দেখা গেল, ছাগলের পক্ষেই বেশি ভোট পড়েছে! অভাবনীয় সেই ছাগল–কাণ্ড শেষে স্থানীয় এক বাসিন্দা নাকি মন্তব্য করেছিল, ‘এটাই গণতন্ত্র, কখনো কখনো ছাগলও জিতে যায়’!

গণতন্ত্র কী? এই প্রশ্ন আমাদের ইতিহাসের গোলকধাঁধায় নিয়ে যায়। এটি কি কেবল ভোটের মাধ্যমে নেতৃত্ব নির্বাচনের প্রক্রিয়া? নাকি এটি একটি জীবনদর্শন, যেখানে প্রত্যেক মানুষের কণ্ঠস্বর সমান গুরুত্ব পায়? গণতন্ত্রের সূতিকাগার প্রাচীন গ্রিসের অনেক দার্শনিকের কাছেই গণতন্ত্র ছিল একটি সন্দেহজনক ধারণা। সক্রেটিস, প্লেটো, এমনকি অ্যারিস্টটলও বিশ্বাস করতেন যে রাষ্ট্র পরিচালনার জন্য প্রয়োজন দক্ষতা, নীতিবোধ ও প্রজ্ঞা। তাঁদের মতে, সংখ্যাগরিষ্ঠের শাসন প্রায়ই জনতুষ্টিবাদের ফাঁদে পড়ে, যেখানে ছলাকলা আর প্রোপাগান্ডা সত্যের ওপর বিজয়ী হয়। সংখ্যাগরিষ্ঠের ইচ্ছা সব সময় রাষ্ট্রের মঙ্গল বয়ে আনে না। প্লেটোর মতে, গণতন্ত্র মানুষের আবেগনির্ভর, অগভীর সিদ্ধান্তে গড়া এক অবয়ব। অ্যারিস্টটল তো আরেক ধাপ এগিয়ে গণতন্ত্রকে বলেছিলেন ‘গরিবতন্ত্র’! তাঁর মতে সংখ্যাগরিষ্ঠ দরিদ্র জনগণের হাতে ক্ষমতা গেলে শাসন হবে আত্মকেন্দ্রিক, নীতিকেন্দ্রিক নয়। যদিও বর্তমান সময়ের উদার গণতন্ত্র মোটেও এতটা সরল নয়।

আরও পড়ুনযেখানেই বৈষম্য বাড়ছে, সেখানেই গণতন্ত্র মার খাচ্ছে১৪ জুলাই ২০২৪

আধুনিক গণতন্ত্র এই প্রাচীন সমালোচনাকে অনেকাংশে অতিক্রম করেছে। আজকের উদার গণতন্ত্র কেবল সংখ্যাগরিষ্ঠের শাসন নয়, এটি সংখ্যালঘুদের অধিকারের নিশ্চয়তা, প্রতিষ্ঠানের স্বাধীনতা এবং ক্ষমতার ভারসাম্যের একটি জটিল কাঠামো। ফরাসি দার্শনিক আলবের কাম্যু বলেছিলেন, ‘গণতন্ত্র সংখ্যাগরিষ্ঠদের আইন নয়, বরং সংখ্যালঘুদের সুরক্ষা’। কিন্তু বাংলাদেশের মতো দেশে, যেখানে গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলো দুর্বল এবং জনগণের মধ্যে গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের বিকাশ এখনো প্রাথমিক পর্যায়ে রয়েছে, সেখানে এই আদর্শ বাস্তবায়ন একটি দীর্ঘ কণ্টকাকীর্ণ যাত্রা।

গণতন্ত্রের সংকট এককভাবে কোনো জাতিরাষ্ট্রের সমস্যা নয়, বরং এটি বৈশ্বিক। তবে সমস্যার রূপ ও গভীরতা ভিন্ন ভিন্ন রাষ্ট্রের বাস্তবতার ওপর নির্ভর করে। উদাহরণস্বরূপ, বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে স্বাধীনতার পর থেকেই এই দেশকে বিভিন্ন রাজনৈতিক সংকটের মধ্য দিয়ে যেতে হয়েছে, যা এ দেশের গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে কখনোই শক্ত ভিতের ওপর দাঁড়াতে দেয়নি। সামরিক শাসন, রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ড ও দলীয় সংঘাতের ছায়ায় গণতন্ত্রের স্বপ্ন যেভাবে বারবার বিঘ্নিত হয়েছে, একইভাবে রাজনৈতিক দলগুলোর অভ্যন্তরে ব্যক্তিপূজা, বংশপরম্পরায় নেতৃত্ব নির্বাচন, পারস্পরিক অবিশ্বাস ও দলান্ধতা যেন আমাদের গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে থেকে গেছে।

আরও পড়ুন‘মৌলিক গণতন্ত্র’ নয়, সংসদীয় গণতন্ত্র শক্তিশালী করাই লক্ষ্য০৫ মে ২০২৫

ব্যক্তিপূজার রাজনীতি এদেশীয় গণতন্ত্রের এক গভীরতর অসুখ। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর ‘প্রাচ্য সমাজ’ প্রবন্ধে বাঙালির এই প্রবৃত্তির কথা লিখেছিলেন। আমরা প্রায়ই ব্যক্তিকে দেবত্ব দিয়ে ফেলি, তাঁর কথাকে অলঙ্ঘনীয় সত্য মনে করি। ব্যক্তিপূজা থেকেই উৎপত্তি হয় বংশপরম্পরার নেতৃত্বের। রাজনৈতিক দলগুলোয় যোগ্যতার চেয়ে বংশগত উত্তরাধিকার বেশি গুরুত্ব পায়। এই প্রবণতা গণতান্ত্রিক নেতৃত্বের বিপরীত। এর ফলে নেতৃত্বের গুণাবলি, প্রজ্ঞা, দূরদর্শিতা, নীতিবোধ প্রভৃতির মূল্যায়ন হয় না। গণতন্ত্রের ভিত্তি হলো নেতৃত্ব পরিবর্তনের সুযোগ, জবাবদিহিতা এবং প্রতিষ্ঠানগুলোর স্বাধীনতা। যখন একজন নেতা তাঁর কাজ নয়, বরং পরিচয় বা বংশের কারণে অনুসরণযোগ্য হয়ে ওঠেন, তখন সেখানে গণতন্ত্র কেবল নামেই টিকে থাকে।

আজকের বাস্তবতায় গণতন্ত্রের সবচেয়ে বড় হুমকিগুলোর মধ্যে অন্যতম জনতুষ্টিবাদ, মিথ্যা তথ্য, বিভ্রান্তিকর প্রচারণা ও গুজব। নোয়াম চমস্কি বলেছিলেন, ‘গণমাধ্যম যাদের নিয়ন্ত্রণে, জনমতও তাদের নিয়ন্ত্রণে’। এই যুগে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ও কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার অপব্যবহার নতুন করে গণতন্ত্রের জন্য চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। এখন একটি মিথ্যা খবর কয়েক মিনিটেই লাখ লাখ মানুষকে প্রভাবিত করতে পারে।

অন্যদিকে জনতুষ্টিবাদী নেতারা জনতার মন পেতে দীর্ঘমেয়াদি কল্যাণের কথা না ভেবে স্বল্পমেয়াদি পদক্ষেপ নেন, যেমনঃ ভর্তুকি, সাময়িক সহায়তা, স্বল্প সুদে ঋণ ইত্যাদি। যেসব দেশে প্রতিষ্ঠান শক্তিশালী নয়, সেখানে এই জনতুষ্টিবাদ আরও ভয়ংকর রূপ নেয়। তখন নেতারা জনতার পক্ষের দাবি নিয়ে ক্ষমতায় আসেন, তারপর নিজেদের সুবিধামতো প্রতিষ্ঠানকে দুর্বল করে ফেলেন। জনতুষ্টিবাদ শুধু নীতিহীনতাকেই উৎসাহিত করে না, বরং জনগণের মধ্যে সমালোচনামূলক চিন্তার অভাবকেও তীব্র করে।

সমকালীন বাংলাদেশ প্রেক্ষাপটে এর চমৎকার উদাহরণ রয়েছে। সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশের সমাজ ও রাজনীতিতে দক্ষিণপন্থার উত্থান, মব সহিংসতা এবং নারীর প্রতি বিদ্বেষ উল্লেখযোগ্য হারে বেড়েছে। কিন্তু সামনেই যেহেতু নির্বাচন, জনতুষ্টিবাদের ফাঁদে পড়া নতুন-পুরোনো অধিকাংশ রাজনৈতিক দলের অনেক নেতাই এসব বিষয়ে বেশ মৌন। গণমানুষের কাছে অপ্রিয় হতে পারে, এমন কোনো কথা বললে পাছে তাঁদের ভোট কমে যায়, অথবা সোশ্যাল মিডিয়ায় সমালোচিত হয়ে পড়েন!

আরও পড়ুনরাজনৈতিক দল থেকে কেন সংস্কার শুরু করা জরুরি০৬ সেপ্টেম্বর ২০২৪

‘জনগণের সরকার, জনগণের দ্বারা, জনগণের জন্য’—আব্রাহাম লিংকনের এই সংজ্ঞা সর্বজনীনভাবে গণতন্ত্রের শেষ কথা। লিংকনকে নিয়ে বিখ্যাত একটি কৌতুক স্মরণ করা যেতে পারে। যখন কেউ একজন তাঁকে গণতন্ত্র কী, জিজ্ঞাসা করেছিলেন, জবাবে তিনি বলেছিলেন, ‘আমি যদি লেজকে পা বলি, তাতে কুকুরের কয়টি পা হবে?’ প্রশ্নকারী বললেন, ‘পাঁচটি।’ লিংকন বললেন, ‘না, লেজকে পা বললেও লেজ লেজই থাকে, পা হয়ে যায় না!’ লিংকন বোঝাতে চেয়েছিলেন যে গণতন্ত্র মানে কেবল সংখ্যাগরিষ্ঠ নয়, বরং সত্যের অনুসন্ধান। বিষয়টা নিয়ে আমাদের জনগণ ও রাজনীতিবিদদের বিস্তর ভাবনার সুযোগ রয়েছে। আমাদের সমাজে অধিকাংশ মানুষই গণতন্ত্র বলতে কেবল সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের শাসনই বুঝে থাকেন। আধুনিক উদার গণতন্ত্র মোটেই কেবল ‘সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের শাসন’ নয়, এর চেয়ে অনেক বেশি কিছু।

গণতন্ত্র রক্ষার দায় শুধু শাসকের নয়, নাগরিকদেরও। জনগণ যদি দায়িত্ব নিতে না চায়, তাহলে গণতন্ত্র ধীরে ধীরে ‘ভোটতন্ত্র’ হয়ে যাবে। অথচ গণতন্ত্র শুধু নির্বাচন নয়, এটি অংশগ্রহণ, জবাবদিহি, ভিন্নমতের প্রতি শ্রদ্ধা ও সহনশীলতা; সব মিলিয়ে এক সম্মিলিত চেতনা। গণতন্ত্র কারও একার যাত্রাও নয়, এটি আমাদের সবার। এখানে একযোগে কাজ করতে হবে সবাইকে। আমাদের ভবিষ্যৎ নির্ভর করছে আমাদের আজকের চর্চার ওপর। গণতন্ত্র এক দিনে তৈরি হয় না। এটি গড়ে ওঠে ধীরে ধীরে, প্রশ্নে প্রশ্নে, প্রতিবাদে, আলোচনায়, ভিন্নমতের প্রতি শ্রদ্ধায়।

আমাদের সমাজ, আমাদের শিক্ষা, আমাদের রাজনীতি; সবকিছুর কেন্দ্রে যদি থাকে গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ, তাহলে ভবিষ্যতের বাংলাদেশ হতে পারে একটি প্রগতিশীল, অন্তর্ভুক্তিমূলক ও ন্যায়ভিত্তিক রাষ্ট্র। গণতন্ত্রের পথ কঠিন, কিন্তু দুর্লঙ্ঘ্যনীয় নয়। এটা অনেকটা নদীর মতো, কখনো তীর ভাঙে, কখনো গতি মন্থর হয়। কিন্তু সঠিক দিকনির্দেশনা আর সমষ্টিগত প্রচেষ্টা যদি আমরা অব্যাহত রাখতে পারি, এই নদী একদিন নিশ্চয়ই সমুদ্রে গিয়ে মিশবে!

সাবেক ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী উইনস্টন চার্চিল বলেছিলেন, ‘গণতন্ত্র নিখুঁত তো নয়ই, এমনকি সবচেয়ে খারাপ ধরনের সরকার ব্যবস্থা। তবে বাকি যেসব ব্যবস্থা এর আগে ছিল বা আছে, সেগুলোর চেয়ে তুলনামূলক ভালো’! জীবনানন্দের যেই ‘সুচেতনা’ কবিতা দিয়ে এই লেখা শুরু হয়েছিল, সেই কবিতার আরেকটি পঙ্‌ক্তি দিয়েই লেখাটা শেষ করা যাক, “সুচেতনা, এই পথে আলো জ্বেলে—এ-পথেই পৃথিবীর ক্রমমুক্তি হবে!’

আশিনুর রেজা লেখক ও গবেষক

ই–মেইল: [email protected]

*মতামত লেখকের নিজস্ব

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • প্রধান উপদেষ্টার ঘোষিত সময়ে নির্বাচন হবে: স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা
  • বিভিন্ন অপরাধে যবিপ্রবিতে শিক্ষকসহ ৪ শিক্ষার্থীকে শাস্তি
  • সংস্কার, বিচার ও নির্বাচন একসঙ্গে এগিয়ে নিতে হবে: সাকি
  • আসন দিয়ে এনসিপি নেতাদের কেনা সম্ভব নয়, আমরা বিক্রি হতে আসিনি: হাসনাত আবদুল্লাহ
  • ‘মাঠ ও পার্কের দখলদারির কোনো পরিবর্তন আসেনি’
  • বৈষম্য দূরীকরণে ৯ দাবি রাবি শিক্ষক-কর্মকর্তাদের
  • নিজের নয়, জনগণের ইচ্ছায় সরকারপ্রধানের পদে বসেছি: সাক্ষাৎকারে অধ্যাপক ইউনূস
  • গণতন্ত্রের গভীর অসুখ!
  • শেখ মুজিব জাতির জনক নন, তবে তার ত্যাগ স্বীকার করি: নাহিদ
  • ফতুল্লায় শহীদ ও আহতদের স্বরণে এনসিপির দোয়া