রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে মৌলিক পরিবর্তন আনতে হবে: আমীর খসরু
Published: 10th, August 2025 GMT
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী বলেছেন, “রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে পরিবর্তন আনতে হবে। সাংঘর্ষিক সংস্কৃতি থেকে (রাজনৈতিক দলগুলোকে) বেরিয়ে আসতে হবে। এই পরিবর্তন সম্ভব না হলে শত সংস্কার করেও কোনো লাভ হবে না। আমাদের মধ্যে ফাউন্ডেশনাল চেঞ্জ (মৌলিক পরিবর্তন) আনতে হবে।”
রবিবার (১০ আগস্ট) দুপুরে রাজধানীর গুলশানে লেকশোর গ্র্যান্ড হোটেলে সেন্টার ফর পলিসি ডায়লগের (সিপিডি) উদ্যোগে ‘অন্তর্বর্তী সরকারের ৩৬৫ দিন’ শীর্ষক সেমিনার অংশ নিয়ে এসব কথা বলেন তিনি।
আমীর খসরু বলেন,“ফ্যাসিস্ট বা স্বৈরাচার পলায়নের মাধ্যমে দেশের জনগণের মনোজগতে বিশাল পরিবর্তন হয়েছে। এই যদি রাজনৈতিক দল ও রাজনীতিবিদরা ধারণ করতে না পারেন, তাহলে সেই দল ও রাজনীতিবিদদের দরকার আছে বলে মনে করি না।”
আরো পড়ুন:
ডাকাতি করতে গিয়ে গণধোলাইয়ের শিকার, বিএনপি নেতা বহিষ্কার
নেত্রকোনায় মসজিদের টাকা আত্মসাৎ, বিএনপি নেতা বহিষ্কার
আমীর খসরু বলেন, “সবাই মন খুলে কথা বলতে পারছি। এটা দেশ ও জনগণের জন্য মুক্ত মতপ্রকাশের সৌন্দর্য। এ কথা বলার সুযোগ অব্যাহত রাখা গেলে অনেক সমস্যার সমাধান সহজ হবে।”
আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী বলেন, “বিভিন্ন দেশের বিপ্লব পরবর্তী ইতিহাস বলে যেসব দেশ বিপ্লব পরবর্তী দ্রুত গণতান্ত্রিক পন্থায় ফিরতে পেরেছে তারা পরবর্তীতে ভালো করেছে। আর যেসব দেশ দ্রুত গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় ফিরতে পারেনি তারা গৃহযুদ্ধ, অর্থনৈতিক বিপর্য়ের দিকে গেছে।”
বিএনপির এই জ্যেষ্ঠ নেতা বলেন, “কোনো বিকল্প নেই জনগণের প্রতিনিধি নির্বাচন করা।নির্বাচিত প্রতিনিধি যারা জনগণের কাছে দায়বদ্ধ থাকবে, জবাবদিহি থাকবে। তা না হলে যেসব দেশে বিপ্লব পরবর্তী ডিসঅর্ডার হয়েছে বাংলাদেশেও সেই আশঙ্কা থাকবে।”
আমীর খসরু বলেন, “আমাদের সবাইকে এক জায়গায় আসতে হবে, একমতে আসতে হবে। মানি লন্ডারিং বন্ধ হয়েছে। যারা করত তারা পালিয়ে গেছে।ফলে স্বাভাবিকভাবে রেমিট্যান্স বেড়ে গেছে। এক্সপোর্ট ইনকাম (রপ্তানি আয়) বেড়েছে। এতে স্বাভাবিকভাবে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বেড়েছে। বিনিময় হার স্থিতিশীল হয়েছে।”
আমীর খসরু বলেন, “বাজেটে সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচিতে অগ্রাধিকার দেওয়া হয়নি। লুটপাটের অর্থনীতিতে যে ধরনের বাজেট ছিল, এই সরকারও সেরকম বাজেটই করেছে। এই জায়গাটায় ভুল হয়েছে।”
“আগামী দিনে শিক্ষা, স্বাস্থ্য তথা সামগ্রিক সামাজিক উন্নয়নে আমাদের সুযোগ হলে এক নম্বর বাংলাদেশ ওভার রেগুলেটেড কান্ট্রি। আমরা সিরিয়াস ডিরেগুলেশন করব। একটা রেস্টুরেন্ট করতে ১৯টি পারমিশন লাগে। প্রত্যেকটি জায়গায় এত রেগুলেট করে রাখা হয়েছে বিনিয়োগ কোনোভাবেই উৎসাহিত হয় না। সিরিয়াস ডিরেগুলেশন ছাড়া হবে না।”
আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী বলেন, “বিনিয়োগকারীরা কখনই অন্তর্বর্তী সরকারের সময়ে বিনিয়োগে আসবে না। তারা দেখতে চাইবে পরবর্তী সরকার কী করে। ইজ অব ডুয়িং বিজনেস এ বাংলাদেশ অনেক পেছনে। ফলে ডিরেগুলেশন। আপনি যদি সত্যিকারের উন্নয়ন চান, তাহলে সরকারের ভূমিকা কমিয়ে আনতে হবে। ট্রেড বডিগুলো আর কী কী করতে পারবেন, সেজন্য তৈরি হন। আমরা ক্ষমতায় এলে ট্রেড বডিগুলোকে সেলফ রেগুলেটেড করার দায়িত্ব দেওয়া হবে। ফিজিক্যাল প্রেজেন্স কমানোর সব চেষ্টা আমরা করব। আমরা চাই, বিদেশি বিনিয়োগকারীরা বাংলাদেশে এসে এয়ারপোর্টে বসেই যেন অনলাইনে কোম্পানির রেজিস্ট্রেশন করতে পারেন।”
আমীর খসরু বলেন, “যত বেশি রেগুলেশন থাকবে, তত করাপশন থাকবে। এই কারণে আগের সরকারের সময়ে অলিগার্ক সৃষ্টি হয়েছে। কিছু নির্দিষ্ট লোকই ব্যবসা করতে পেরেছে।অন্যরা পারেনি। ইকোনোমি মাস্ট বি ডেমোক্রেটাইজ। গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা অব্যাহত থাকতে হবে। স্বচ্ছতা, জবাবদিহিতা থাকতে হবে। এজন্য ইলেকশন থাকতে হবে। রাজনীতিবিদদের মানুষের কাছে যেতে হবে।”
তিনি আরো বলেন, “কর্মসংস্থানে ইউনিভার্সাল হেলথ কেয়ার থাকতে হবে। আমরা সিদ্ধান্ত নিয়েছি, ইউকে মডেলে ইউনিভার্সাল হেলথ কেয়ার ব্যবস্থা চালু করা হবে। মাধ্যমিক পর্যন্ত শিক্ষা বিনা বেতনে করে দেওয়া হবে। দেশের জিডিপির ২ শতাংশের কম শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতে ব্যয় হয়। আমাদের টার্গেট জিডিপির ৫ শতাংশ করে এই দুই খাতে ব্যয় করা।”
বিএনপির এই নেতা বলেন, “আমরা দক্ষতা উন্নয়নে জোর দেব। আমরা ওয়ার্ক আউট করেছি কোথায় কি কর্মসংস্থান হবে। সেজন্য কত বিনিয়োগ করতে হবে। আমাদের পরিকল্পনা আছে ক্রিয়েটিভ ইকোনোমি। যারা মেইনস্ট্রিমে আসেনি তাদেরকে বৈশ্বিক বাজারে অনলাইনে সংযুক্ত করে দেওয়া হবে, যাতে ঘরে বসে একজন তার পণ্য অ্যামাজনে বিক্রি করতে পারে। এর মাধ্যমে মানুষের জীবনমান উন্নত করা হবে।”
আমীর খসরু বলেন, “একজন থেকে ট্যাক্স নিতে চাইলে ট্যাক্স বাড়বে না। ট্যাক্স নেট বাড়াতে হবে। ইকোনোমিক কর্মকাণ্ড বাড়লে ট্যাক্স নেটও বাড়বে। দেশের বাইরে অনেক বাংলাদেশি আছেন, যারা দেশে আসতে চায়। সহায়তা চায়। ইতিবাচক নীতি চায়।”
বিএনপির এই নেতা বলেন, “শ্রমিকদের ব্যাপারে যে আকাঙ্ক্ষা জেগেছে তা রাজনীতিবিদদের পূরণ করতে হবে। বক্তৃতা দিয়ে হবে না। আমি ও আমার দল জনগণের আকাঙ্ক্ষা ধারণ করার চেষ্টা করছে। কারণ জনগণ আমাদেরকে রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্ব দিলে আমরা যাতে ডে ওয়ান থেকে পারফর্ম করতে পারি। তবে সবার সহযোগিতা লাগবে।”
ঢাকা/সাইফ
.উৎস: Risingbd
কীওয়ার্ড: চ কর চ কর ব এনপ র জন ত ব র জন ত ক সরক র র ব এনপ র জনগণ র পরবর ত আম দ র
এছাড়াও পড়ুন:
নেতারা বলবেন, জনতা শুনবে—এই সংস্কৃতি বদলাতে চায় মানুষ: দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য
সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) সম্মাননীয় ফেলো ও নাগরিক প্ল্যাটফর্মের আহ্বায়ক অর্থনীতিবিদ দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেছেন, ‘দেশের মানুষ এখন রাজনৈতিক সংস্কৃতির পরিবর্তন চায়। আগে নেতারা বলতেন আর জনতা শুনত। কিন্তু এখন জনগণ সেই পরিস্থিতির বদল চায়। তারা চায়, জনপ্রতিনিধিরা শুধু বলবেন না, জনগণের কথাও শুনবেন।’
আজ শনিবার রাজশাহীর পবা উপজেলার বায়াতে ব্র্যাক লার্নিং সেন্টারে ‘নাগরিক প্ল্যাটফর্ম’ আয়োজিত প্রাক্-নির্বাচনী আঞ্চলিক পরামর্শ সভা শেষে সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য এ কথাগুলো বলেন। আগামী ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে সাধারণ মানুষের প্রত্যাশা ও দাবিগুলো তুলে ধরতে এই নাগরিক সংলাপের আয়োজন করা হয়।
দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, ‘আগামী নির্বাচনকে সামনে রেখে যে বার্তাটি পরিষ্কারভাবে উঠে আসছে তা হলো, জনগণ এমন একটি নির্বাচন দেখতে চায়, যেখানে প্রকৃত জনপ্রতিনিধিরা নির্বাচিত হবেন। মানুষ এখন নির্বাচনের ব্যয় নিয়ন্ত্রণ, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের অপব্যবহার রোধ এবং দলগুলোকে যোগ্য প্রার্থী মনোনয়নের ওপর জোর দিচ্ছে। জনগণ মনে করে, নির্বাচনের ব্যয় যদি কমানো না যায়, তাহলে দুর্নীতি কমানো প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়বে।’
জনপ্রতিনিধিদের জবাবদিহির ওপর গুরুত্বারোপ করে এই অর্থনীতিবিদ বলেন, ‘মানুষ চায়, প্রত্যেক জনপ্রতিনিধি তাঁর কাজের বার্ষিক হিসাব দেবেন। এই জবাবদিহির সংস্কৃতি প্রতিষ্ঠা করা জরুরি।’ রাজশাহীর স্থানীয় সমস্যাগুলোর কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘এই অঞ্চলের জন্য চারটি প্রধান বিষয় উঠে এসেছে। এগুলো হলো—রাজশাহীর মরুকরণ ও তিস্তাসহ পানির সংকট, জ্বালানি সংকট, যোগাযোগব্যবস্থার উন্নয়ন এবং কৃষিভিত্তিক শিল্পের অভাব।’
দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, সবচেয়ে লক্ষণীয় বিষয় হলো—নিরাপত্তার প্রসঙ্গটি খুব জোরালোভাবে এসেছে। এই নিরাপত্তা কেবল অর্থনৈতিক নয়; এর সঙ্গে সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও ব্যবসায়িক নিরাপত্তার বিষয়গুলোও জড়িত। সুশাসন, বিচার বিভাগের স্বাধীনতা এবং প্রশাসনের দক্ষতার সঙ্গে এই নিরাপত্তার বিষয়টি অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত। এই সার্বিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করা না গেলে একটি সুষ্ঠু নির্বাচন আয়োজন করাও কঠিন হবে বলে তিনি মনে করেন।
এর আগে বেলা ১১টার দিকে অনুষ্ঠান শুরু হয়। চলে দুপুর আড়াইটা পর্যন্ত। ‘আগামী নির্বাচনে কী প্রত্যাশায় ভোট দেবেন?’, ‘নবনির্বাচিত সরকারের কাছে কী প্রত্যাশা?’ এই শিরোনামে মুক্ত আলোচনা হয়। এতে রাজনীতিবিদ, আইনজীবী, উন্নয়নকর্মী, শিক্ষক, সাংবাদিক, সাংস্কৃতিক কর্মী, শিক্ষার্থী, কৃষকসহ নানা শ্রেণির মানুষ অংশ নেন। তবে স্থানীয় বিএনপি ও জামায়াতের কোনো প্রতিনিধি ছিলেন না।
সভায় আগামী নির্বাচন, জনপ্রতিনিধিদের জবাবদিহি, সুশাসন এবং স্থানীয় নানা সংকট নিয়ে সাধারণ মানুষ তাঁদের ক্ষোভ ও প্রত্যাশা তুলে ধরেন। তাঁরা আগামী সরকারের কাছে নানা বিষয়ের বাস্তবায়ন চান।
সংলাপে আদিবাসী জনগোষ্ঠীর প্রতিনিধিরা ভূমি হারানোর শঙ্কা প্রকাশ করেন এবং তৃতীয় লিঙ্গের জনগোষ্ঠীর প্রতিনিধিরা তাঁদের আশ্রয়ণ প্রকল্প দখল ও কর্মসংস্থানে বাধার অভিযোগ তোলেন। একজন রাজনৈতিক কর্মী প্রশাসনের দলীয়করণ নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, পুলিশ কর্মকর্তারাও রাজনৈতিক পরিচয়ের ভিত্তিতে আচরণ করেন।
সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) রাজশাহী জেলা শাখার সাধারণ সম্পাদক মাহমুদ আলম মাসুদ বলেন, ‘আমরা এমন প্রতিশ্রুতি চাই না, যা বাস্তবায়ন হয় না। আমরা এমন ব্যক্তিদের নির্বাচিত করতে চাই, যাঁরা একটি নতুন বাংলাদেশ বিনির্মাণে ভূমিকা রাখবেন।’
জবাবদিহির অভাবকে দুর্নীতির অন্যতম কারণ হিসেবে চিহ্নিত করেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সহ-উপাচার্য (শিক্ষা) মোহা. ফরিদ উদ্দীন খান। তিনি বলেন, একজন প্রার্থী নির্বাচনে কোটি কোটি টাকা ব্যয় করেন, যা তার পাঁচ বছরের বেতনের চেয়ে অনেক গুণ বেশি। এই টাকা তুলে আনার জন্য নির্বাচিত হওয়ার পর তিনি দুর্নীতির আশ্রয় নেন। তিনি মনে করেন, সুষ্ঠু নির্বাচন ও প্রার্থীদের জবাবদিহি নিশ্চিত করা গেলে এই দুর্নীতি কমানো সম্ভব।
সভা শেষে নাগরিক প্ল্যাটফর্মের অন্যতম সংগঠক মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, ‘জুলাই-আগস্টের আন্দোলন আমাদের বলে দেয়, পরিবর্তনের আকাঙ্ক্ষা থাকলে আমরা পরিবর্তন করতে পারি। হতাশ হওয়ার কিছু নেই। এই আলোচনা থেকে উঠে আসা বিষয়গুলো নিয়ে একটি “নাগরিক ইশতেহার” তৈরি করা হবে। এটি রাজনৈতিক দলগুলোর কাছে উপস্থাপন করে একটি চাপ সৃষ্টি করা হবে। কারণ, তাদের ছাড়া এই আকাঙ্ক্ষার বাস্তবায়ন সম্ভব নয়।’