জুলাই গণ–অভ্যুত্থানে গুলি করে ছাত্র-জনতাকে হত্যার সঙ্গে জড়িত প্রত্যেক খুনির বিচার করা হবে বলে জানিয়েছেন প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম। তিনি বলেন, এই বিচার আন্তর্জাতিক মানদণ্ড মেপে করা হবে। কেউ যেন বলতে না পারে, যে নিয়ম না মেনে অবিচার করা হয়েছে।

অতীতে ‘ক্যাঙারু কোর্ট’ বসিয়ে অনেককে ফাঁসি দেওয়া হয়েছে দাবি করে শফিকুল আলম বলেন, ‘আমরা বিদেশি কনসাল্ট্যান্ট রেখেছি, যাতে কেউ না বলতে পারে যে না উনারা এসে একটা ক্যাঙারু কোর্ট সেটআপ করেছে। আপনারা জানেন আমাদের হিস্ট্রি আছে ক্যাঙারু কোর্ট করার। কতজনকে তাঁরা ফাঁসি দিয়েছেন। আমরা চাই না বাংলাদেশে এ ধরনের ক্যাঙারু কোর্ট। সময় নিচ্ছি একটু। আপনারা ধৈর্য ধরেন, প্রত্যেক খুনির বিচার হবে। কেউ বাদ যাবে না। এটা শহীদদের সঙ্গে আমাদের ওয়াদা।’

উল্লেখ্য, ক্যাঙারু কোর্ট হলো এমন আদালত বা বিচারব্যবস্থা, যেখানে প্রচলিত আইন ও বিচারব্যবস্থার নিয়মকানুনকে উপেক্ষা করা হয় বা সেগুলোর প্রতি শ্রদ্ধাশীল থাকে না। সাধারণত পূর্বনির্ধারিত সিদ্ধান্ত কার্যকর করতে দ্রুত বিচারকাজ পরিচালনা করে।

আজ রোববার সাভারের আশুলিয়ায় মানারাত ইন্টারন্যাশনাল বিশ্ববিদ্যালয়ে এক আলোচনা সভায় সম্মানিত অতিথির বক্তব্যে শফিকুল আলম এসব কথা বলেন। জুলাই বিপ্লব ২০২৪-এর বর্ষপূর্তি উপলক্ষে পক্ষকালব্যাপী অনুষ্ঠানের আজ ছিল সমাপনী অনুষ্ঠান। সেখানে জুলাই বিপ্লবে শহীদ হওয়া এই বিশ্ববিদ্যালয়ের দুই শিক্ষার্থীকে স্মরণ করা হয়।

ন্যায়বিচার করতে হলে সত্যিকার অর্থে সময় দিতে হবে উল্লেখ করে প্রেস সচিব বলেন, ‘আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে ৪টি বড় মামলার কার্যক্রম শুরু হয়েছে, ২৭টি মামলার তদন্ত চলছে। ১৮টি মামলার চার্জশিট (অভিযোগপত্র) দেওয়া হয়েছে। ন্যায়বিচার করতে হলে সত্যিকার অর্থে একটু সময় দিতে হবে। আমরা তাড়াহুড়ো করে যদি অন্যায়-অবিচার করি, তাহলে সেটি নিয়ে বাইরে কথা ওঠবে, যে উনারা জোর করে উনাকে (শেখ হাসিনা) ফাঁসি দিচ্ছেন। জোর করে ওনার প্রতি অন্যায় চাপিয়ে দিচ্ছে। আমরা এটা চাই না।’

বাংলাদেশ থেকে রাজতন্ত্রের ইতি টানতে জুলাই যোদ্ধারা শহীদ হয়েছেন বলে মন্তব্য করেছেন অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব। তিনি বলেন, ‘আমরা শেখ পরিবারের দাস-দাসী ছিলাম। সেখান থেকে আমাদেরকে মুক্ত করে একটা ডেমোক্রেটিক কান্ট্রি (গণতান্ত্রিক দেশ) করার জন্য তাঁরা শহীদ হয়েছেন, আত্মদান করেছেন। আমরা সেই জায়গায় যেতে চাই।’

শফিকুল আলম বলেন, জুলাই যোদ্ধারা ভোটের জন্য, মানুষের অধিকারের জন্য শহীদ হয়েছেন। তিনি সবাইকে আগামী নির্বাচনে ভোট দিতে যাওয়ার আহ্বান জানিয়ে বলেন, আগামী ফেব্রুয়ারি মাসে অনুষ্ঠিত হতে যাওয়া জাতীয় নির্বাচন বাংলাদেশের ইতিহাসে সবচেয়ে অবাধ, স্বচ্ছ ও উৎসবমুখর হবে।

আজকের অনুষ্ঠানে প্রধান আলোচক ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শিবিরের সাবেক সভাপতি ও জুলাই যোদ্ধা আবু সাদেক কায়েম। তিনি বলেন, এক বছর পরও বিপ্লবের প্রত্যাশিত অগ্রগতি হয়নি। শহীদদের আকাঙ্ক্ষা ছিল বৈষম্যহীন, ন্যায়ভিত্তিক বাংলাদেশ গড়া, কিন্তু বিচারপ্রক্রিয়া ধীরগতির। এখনো শহীদ পরিবারের পূর্ণাঙ্গ তালিকা হয়নি, পুনর্বাসন ও যথাযথ সম্মান দেওয়া হয়নি। তিনি বলেন, ‘যাঁদের রক্তে আমরা স্বাধীনতা পেয়েছি, সেই পরিবারগুলো কষ্টে দিন কাটাচ্ছে—এটি রাষ্ট্রের জন্য লজ্জাজনক। আহত ও পঙ্গুদের চিকিৎসা এবং পুনর্বাসনের দায়িত্ব রাষ্ট্রকেই নিতে হবে।’ পাশাপাশি তিনি খুনি হাসিনার সহযোগীদের বিচারের আওতায় আনার দাবি জানান।

বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক মোহাম্মদ আবদুর রবের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন বিশ্ববিদ্যালয়ের বোর্ড অব ট্রাস্টিজের চেয়ারম্যান ও সাবেক সচিব মোহাম্মদ ফজলুর রহমান, বিশেষ অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন বোর্ড অব ট্রাস্টিজের সদস্য ও সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী মো.

মতিউর রহমান আকন্দ।

জুলাই অভ্যুত্থানে এই বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যবসায় প্রশাসন বিভাগের ছাত্র শাকিল হোসেন পারভেজ ও ইলেকট্রিক অ্যান্ড ইলেকট্রনিক ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের ছাত্র আহনাফ আবির আশরাফুল্লাহ শহীদ হন। আজ শহীদ শাকিলের নামে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রবেশপথে চত্বর উদ্বোধনের মাধ্যমে দিনের কর্মসূচি শুরু হয়। চত্বরটি উদ্বোধন করেন শাকিলের বাবা বেলায়েত হোসেন। এরপর আহনাফ আবির আশরাফুল্লাহর নামে লাইব্রেরি উদ্বোধন করবেন তাঁর মা আসিয়া খাতুন। দুপুর পৌনে ১২টায় দুই শহীদের স্মৃতিতে বৃক্ষরোপণ করা হয়।

১৮ জুলাই লক্ষ্মীপুরে শহীদ শাকিল হোসেন পারভেজের কবর জিয়ারতের মধ্য দিয়ে পক্ষকালব্যাপী এ কর্মসূচি শুরু হয়। এরপর ছিল টাঙ্গাইলে শহীদ আহনাফ আবির আশরাফুল্লাহর কবর জিয়ারত, শহীদ ও আহতদের স্মরণে আলোচনা সভা ও দোয়া মাহফিল, ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে পবিত্র কোরআন বিতরণ, জুলাই বিপ্লবে নারীদের অবদান শীর্ষক সেমিনার, পোস্টার ও রচনা প্রতিযোগিতা, বিতর্ক প্রতিযোগিতা, রক্তদান কর্মসূচি এবং পৃথক ইন্ডোর গেমস প্রতিযোগিতা।

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: অন ষ ঠ ন ব চ র কর র জন য

এছাড়াও পড়ুন:

৪১ বছর ধরে হেঁটে হেঁটে পত্রিকা বিলি করেন গাইবান্ধার রহিম

গাইবান্ধার পত্রিকা বিক্রেতা আবদুর রহিম। বাড়ি পলাশবাড়ী পৌরসভার নুনিয়াগাড়ি এলাকায়। বয়স ৭১ বছর। এই বয়সেও তিনি ঘুমভাঙা চোখে একনজর পত্রিকার শিরোনাম দেখে নেন। পত্রিকা গুছিয়ে বগলে চেপে ছুটে চলেন পাঠকের কাছে। ‘ভাই, আজকে গরম খবর আছে’ বলেই পাঠকের হাতে এগিয়ে দেন পত্রিকা।

এক পাঠক থেকে আরেক পাঠকের কাছে যান আবদুর রহিম। পত্রিকা বিলি করেন সকাল ৬টা থেকে টানা ৭ ঘণ্টা। বিকেল ৫টা থেকে ৪ ঘণ্টা বিলি করা পত্রিকার টাকা সংগ্রহ করেন। ১১ ঘণ্টার বেশির ভাগ সময় হেঁটে পত্রিকা বিলি ও টাকা সংগ্রহ করেন। দূরের পাঠকের কাছে যান বাইসাইকেলে। প্রতিদিন গড়ে ১০ থেকে ১২ কিলোমিটার হেঁটে বিলি করেন পত্রিকা। এভাবেই দীর্ঘ ৪১ বছর ধরে গাইবান্ধায় পত্রিকা বিলির কাজ করছেন তিনি।

আবদুর রহিম বলেন, ‘সকাল ৬টা থেকে পত্রিকা বিলির কাজ শুরু করি। বেলা ১টার দিকে শেষ হয়। উপজেলা সদরে হেঁটে বিলি করি। তবে সদর থেকে ৬-৭ কিলোমিটার দূরে জুনদহ, কালীতলা, ঢোলভাঙ্গা, হোসেনপুর এলাকায় সাইকেলে যাই। এসব জায়গায় সাইকেল রেখে হেঁটে পত্রিকা বিলি করি। দুপুরে বাড়িতে বিশ্রাম নিই। এরপর পত্রিকা বিক্রির টাকা তোলা শুরু করি। টাকা তুলতে বিকেল ৫টা থেকে রাত ৯টা পর্যন্ত সময় লাগে। সব মিলিয়ে প্রতিদিন ১০ থেকে ১২ কিলোমিটার হাঁটাহাঁটি হয়ে যায়। এ রকম ব্যস্ততায় কীভাবে ৪১ বছর কেটে গেল, টেরই পেলাম না! তবে পত্রিকা বিলি করে আনন্দ পাই। অনেক পাঠক আমাকে ভালোবাসেন, খোঁজখবর নেন।’

দীর্ঘ সময় পত্রিকা বিলি করতে সমস্যা হয় কি না, তা জানতে চাইলে আবদুর রহিম বলেন, ‘আমার কোনো অসুখবিসুখ নেই। যত দিন শরীর ভালো থাকবে, তত দিন এই কাজ চালিয়ে যাব।’

ব্যবসার শুরু

রহিমের পৈতৃক বাড়ি রংপুর শহরের আরাজি গুলাল বুদাই এলাকায়। সেখানে তাঁর বাবার ৩ শতাংশ জমিতে বসতভিটা ছিল। এ ছাড়া কোনো সম্পদ ছিল না। বাবা আবেদ আলী অনেক আগেই মারা গেছেন। তিন ভাই ও চার বোনের মধ্যে সবার বড় তিনি। লেখাপড়া করেছেন তৃতীয় শ্রেণি পর্যন্ত। ছোটবেলা থেকেই কৃষিকাজ করতেন। ১৯৭৫ সালে বিয়ে করেন একই এলাকায়। তাঁর ছয় মেয়ে ও এক ছেলে। দারিদ্র্যের কারণে সংসার চালানো একসময় কঠিন হয়ে পড়ে।

রহিমের খালাতো ভাই রংপুর শহরে পত্রিকা বিলি করতেন। তাঁর পরামর্শে ১৯৮৪ সাল থেকে রংপুরে স্থানীয় পত্রিকা দিয়ে আবদুর রহিমের এই ব্যবসার যাত্রা শুরু। এরপর তিনি বাসে ফেরি করে বিক্রি করতে থাকেন পত্রিকা। প্রতিদিন রংপুর থেকে বাসে উঠে পলাশবাড়ী পর্যন্ত আসেন। এভাবে তিন বছর কেটে যায়। এরপর পলাশবাড়ীর স্থানীয় এক সাংবাদিকের বাড়িতে থেকে পত্রিকা বিক্রি শুরু করেন। ছয় মাস থাকেন সেখানে। এরপর জমানো ও ঋণের টাকায় নুনিয়াগাড়ি এলাকায় সোয়া ৮ শতাংশ জমি কিনে টিনশেড ঘর বানান। বাড়ি থেকে ব্যবসা করতে থাকেন। পলাশবাড়ী চারমাথা এলাকায় বসে ঢাকা, রংপুর ও বগুড়া থেকে প্রকাশিত দৈনিক পত্রিকা সংগ্রহ করে পলাশবাড়ী উপজেলা সদরে বিক্রি করতে থাকেন।

হকার থেকে এজেন্ট

কয়েক বছর পর আবদুর রহিম নিজের নামে বেশ কিছু পত্রিকার এজেন্সি নেন। পত্রিকার চাহিদা বেড়ে যাওয়ায় একা সামলাতে পারছিলেন না। তাই চারজন লোক নিয়োগ করেন। তাঁরা এখনো রহিমের কাছে কমিশনে পত্রিকা নিয়ে জীবিকা নির্বাহ করছেন। ব্যবসা শুরুর সময় প্রতিদিন ২০০ থেকে ২৫০ কপি পত্রিকা বিলি করতেন। মাসিক আয় ছিল ১ হাজার ৫০০ থেকে ১ হাজার ৮০০ টাকা। কয়েক বছর পর পাঠকের চাহিদা বেড়ে যায়। সে সময় মাসিক আয় হতো ২২ থেকে ২৫ হাজার টাকা। বর্তমানে ছাপা পত্রিকার পাঠক কমে গেছে। এখন প্রতিদিন ১৫০ থেকে ১৬০ কপি পত্রিকা বিলি করছেন। বর্তমানে তাঁর মাসিক আয় গড়ে ১৬ থেকে ১৭ হাজার টাকা।

আবদুর রহিম প্রথম আলোকে বলেন, ‘পত্রিকার ব্যবসা করে রংপুর থেকে এসে পলাশবাড়ীতে বাড়ি করতে পেরেছি, মেয়েদের বিয়ে দিয়েছি। সততার সঙ্গে চলছি। এতেই আমি সন্তুষ্ট।’

পলাশবাড়ী মহিলা ডিগ্রি কলেজের অধ্যক্ষ আবু সুফিয়ান সরকার বলেন, ‘আবদুর রহিমকে বহু বছর ধরেই পত্রিকা বিক্রি করতে দেখছি। তাঁকে দেখে মনে হয় না ৭১ বছর বয়স হয়েছে। তাঁর মধ্যে ক্লান্তি দেখা যায় না। দিন-রাত পরিশ্রম করেন। কখনো তাঁকে মিথ্যা বলতে শুনিনি। এলাকার মানুষ তাঁকে ভালোবাসেন।’

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • বাস ধুয়েমুছে চালকের সহকারী ওয়াশরুমে গিয়েছিলেন, ফিরে দেখেন আগুন জ্বলছে
  • ‘বাসটির সঙ্গে একটি ট্রাকের ধাক্কা লাগে, এরপর আর কিছু মনে নেই’
  • রেলের ৭ লাখ টাকার যন্ত্র ২৭ হাজারে বানালেন তিনি
  • রাতে এক ঘণ্টার ব্যবধানে সাভার-ধামরাইয়ে দুই বাসে আগুন
  • জনস্বাস্থ্য নিয়ে গবেষণাই তাঁর নেশা 
  • ইডেনে স্পিন বিষ, ১৫ উইকেটের দিনে উড়ছে ভারত
  • বিচারকের ছেলে হত্যা মামলার আসামি লিমন পাঁচ দিনের রিমান্ডে
  • বিচারকের ছেলে হত্যা: লিমন ৫ দিনের রিমান্ডে
  • ‘তোকে গুলি করে মারব না, ব্লেড দিয়ে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে মারব’
  • ৪১ বছর ধরে হেঁটে হেঁটে পত্রিকা বিলি করেন গাইবান্ধার রহিম