‘ড্রাগন ৮০ টাকা, ড্রাগন ১০০ টাকা। নিয়ে যান, মজা করে খান।’
সন্ধ্যা হলেই রাজধানীর কারওয়ান বাজারে ফল বিক্রেতাদের এভাবে হাঁকডাক শুরু হয়। কেউ মুখে, কেউবা হ্যান্ড মাইকে স্বয়ংক্রিয় ভয়েস রেকর্ড চালিয়ে ক্রেতাদের আকৃষ্ট করার চেষ্টা করেন।

অফিস শেষ করে বাসায় যাওয়ার পথে প্রায়ই কারওয়ান বাজার থেকে ড্রাগন ফল কেনেন একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের বিক্রয় প্রতিনিধি আজহার উদ্দিন। গতকাল সন্ধ্যায় তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘বছর কয়েক আগে ড্রাগন কেনার সাহস করতাম না। এমনকি আশপাশেও যেতাম না। ৬০০ টাকা দিয়ে এক কেজি ড্রাগন কেনার কথা ভাবতেই পারতাম না। দাম ছিল নাগালের বাইরে। এখন ১০০ টাকার মধ্যে পাই, তাই সন্তানদের জন্য নিয়ে যাই।’

বছর তিনেক আগেও ড্রাগনকে মনে করা হতো ‘উচ্চবিত্তের ফল’। এই ফল কেজিতে বিক্রি হতো গড়ে ৫০০ টাকায়। ২০২৩ সাল থেকে ড্রাগন ফলের দাম কমতে শুরু করে। এখন কোথাও ৮০ টাকা, কোথাও ১০০ থেকে ১২০ টাকা কেজি দরে ড্রাগন ফল বিক্রি হতে দেখা যায়।

জামালপুরের সুধীর দাশ কারওয়ান বাজারে দীর্ঘদিন ধরে ড্রাগন ফল বিক্রি করে আসছেন। গতকাল সন্ধ্যায় তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘এ ফলের দাম কমতাছে বছরখানেক হইল। আগে ৫০০ টাকা কেজি বিক্রি করতাম। এখন প্রতি কেজি ১০০ থেকে ১২০ টাকায় বিক্রি করি। কারওয়ান বাজারের অধিকাংশ ড্রাগন ফল আসে ঝিনাইদহ ও রাজশাহী থেকে।’

বছর কয়েক আগে ড্রাগন কেনার সাহস করতাম না। এমনকি আশপাশেও যেতাম না। ৬০০ টাকা দিয়ে এক কেজি ড্রাগন কেনার কথা ভাবতেই পারতাম না। দাম ছিল নাগালের বাইরে। এখন ১০০ টাকার মধ্যে পাই, তাই সন্তানদের জন্য নিয়ে যাই।বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের বিক্রয় প্রতিনিধি আজহার উদ্দিন

কীভাবে দাম কমল

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্যে দেখা যায়, গত তিন বছরে ড্রাগন ফলের উৎপাদন প্রায় ৪০০ শতাংশ বেড়েছে।

২০২১-২২ সালে ১ হাজার ১১৫ হেক্টর জমিতে ড্রাগন চাষ হয়। ড্রাগন ফল উৎপাদন হয় ১৩ হাজার ৮৭২ মেট্রিক টন। ২০২২-২৩ সালে ২ হাজার ৫৮৮ হেক্টর জমিতে ড্রাগন ফলের উৎপাদন দাঁড়ায় ৫১ হাজার ২৮৭ মেট্রিক টন। ২০২৩-২৪ সালে উৎপাদন বেড়ে দাঁড়ায় ৬৮ হাজার ৮১৩ মেট্রিক টন।

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উদ্যানতত্ত্ববিদ মো.

ময়নুল হক প্রথম আলোকে বলেন, ড্রাগন চাষে অতিরিক্ত মুনাফার আশায় ২০২৩ সালের দিকে ব্যাপকভাবে ওভার গ্রোথ হরমোনের ব্যবহার শুরু হয়। ফলে উৎপাদন অনেক বেড়ে যায়। তবে ঝুঁকির কারণে অনেক ক্রেতা ড্রাগন থেকে মুখ ফিরিয়ে নেন। ফলে ড্রাগনের দামে পতন ঘটে।

ওভার গ্রোথ হরমোন ব্যবহারের জন্য বড় বাগানিদের দায়ী করেন ময়নুল হক। তিনি বলেন, যাঁরা বড় পরিসরে ড্রাগনের চাষ করেন, তাঁরাই মূলত এই ওভার গ্রোথ হরমোন ব্যবহার করেন। ছোট চাষিদের জন্য এই হরমোনের ব্যবহার লাভজনক নয়। এই হরমোন ভারত থেকে চোরাই পথে বাংলাদেশে প্রবেশ করে। দেশের সীমান্তবর্তী জেলাগুলোতে এই হরমোনের ব্যবহার বেশি।

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উদ্যানতত্ত্ববিদ মো. ময়নুল হক প্রথম আলোকে বলেন, ড্রাগন চাষে অতিরিক্ত মুনাফার আশায় ২০২৩ সালের দিকে ব্যাপকভাবে ওভার গ্রোথ হরমোনের ব্যবহার শুরু হয়। ফলে উৎপাদন অনেক বেড়ে যায়। তবে ঝুঁকির কারণে অনেক ক্রেতা ড্রাগন থেকে মুখ ফিরিয়ে নেন। ফলে ড্রাগনের দামে পতন ঘটে।

দেশে দুই পদ্ধতিতে ড্রাগনের চাষ হয় বলে জানান ময়নুল হক। তিনি বলেন, একটা প্রচলিত পদ্ধতি, আরেকটি চায়না পদ্ধতি। চায়না পদ্ধতিতে প্রতি বিঘায় ড্রাগনের উৎপাদন হয় ২ হাজার ৫০০ থেকে ৩ হাজার কেজি। খরচ হয় দেড় থেকে দুই লাখ টাকা। ১০০ টাকা কেজি দরে বিক্রি করলেও প্রতি বিঘায় গড়ে এক লাখ টাকা লাভ থাকে উৎপাদনকারীর।

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, ড্রাগন উৎপাদনের শীর্ষে আছে ঝিনাইদহ জেলা। এখানে গত অর্থবছরে উৎপাদন হয় ৩২ হাজার ৭৬৮ মেট্রিক টন ড্রাগন। এরপরে রয়েছে যশোর জেলা। এখানে গত অর্থবছরে উৎপাদন হয় ১২ হাজার ৫৫৩ মেট্রিক টন ড্রাগন। আর তৃতীয় শীর্ষ জেলা রাজশাহীতে উৎপাদন হয় ৪ হাজার ৪৭৭ মেট্রিক টন ড্রাগন।

ঝিনাইদহের কালীগঞ্জ উপজেলার ছুরত আলী ২০১৭ সাল থেকে ড্রাগন চাষ করেন। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, যখন শুরু করেন, তখন তাঁর এলাকার খুব বেশি মানুষ ড্রাগন চাষ করতেন না। ধীরে ধীরে চাষিদের সংখ্যা অনেক বাড়ে। বাড়ে উৎপাদনও। আগে এক বিঘা জমিতে উৎপাদিত ড্রাগন প্রায় ১০ লাখ টাকায় বিক্রি করতেন। এখন তা কমে তিন থেকে সাড়ে তিন লাখ টাকায় চলে এসেছে।

ড্রাগনের উৎপাদন বাড়ায় দাম কমেছে বলে মনে করেন ছুরত আলী। ‘ওভার গ্রোথ হরমোন’ সম্পর্কে (যা টনিক নামে চাষিদের কাছে পরিচিত) জানতে চাইলে তিনি বলেন, এটার ব্যবহার কয়েক বছর আগে শুরু হয়েছে। লাভ বেশি করার লোভ থেকে এটা ব্যবহার করা হচ্ছে। তবে এটার কারণে ড্রাগন ব্যবসা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। তাঁর জানামতে, বাজারে যে ফল দেখতে অর্ধেক সবুজ ও অর্ধেক লাল, সেগুলোতে টনিক ব্যবহার করা হয়েছে।

দেশে কীভাবে এল ড্রাগন ফল

বাংলাদেশে কীভাবে ড্রাগন ফলের চাষ শুরু হয়েছে, তা নিয়ে বিতর্ক আছে। কৃষি মন্ত্রণালয়ের কৃষিবিষয়ক প্রকাশনা ‘কৃষি বাতায়ন’-এ বলা হয়েছে, ২০০৭ সালে থাইল্যান্ড, যুক্তরাষ্ট্র ও ভিয়েতনাম থেকে বিভিন্ন জাত এনে বাংলাদেশে ড্রাগনের চাষাবাদ শুরু হয়। তবে কার হাত ধরে বাংলাদেশে ড্রাগনের চাষ শুরু, সে সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য এখানে নেই।

অবশ্য বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটের ফল বিভাগের প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা মো. মসিউর রহমান বলেন, ২০০২-০৩ সালে এই ইনস্টিটিউট ড্রাগনের একটি জাত উদ্ভাবন করে। এখন সেটিরই সবচেয়ে বেশি বাণিজ্যিক চাষ হয়। এ জাতের ফল মাঝারি, মিষ্টি। উৎপাদনও ভালো হয়।

কার হাত ধরে কীভাবে ড্রাগনের চাষ দেশে ছড়িয়ে পড়ল, সে সম্পর্কে বিস্তারিত জানাতে পারেননি মসিউর রহমান।

ভিয়েতনামসহ যেসব দেশ ড্রাগন ফল উৎপাদনে অগ্রপথিক, তারা সবাই সাদা জাতকে বেছে নিলেও আমাদের এখানে লালটাই সবচেয়ে বেশি জনপ্রিয়তা পায়। সাদা রঙের শাঁসসম্পন্ন ড্রাগন ফল ডায়াবেটিক রোগীরা যত খুশি খেতে পারেন। কিন্তু আমাদের দেশের লাল শাঁসের ড্রাগন বেশি খেতে পারবেন না তাঁরা।বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটের ফল বিভাগের প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা মো. মসিউর রহমান

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের একটি সূত্র জানায়, সংস্থার সাবেক পরিচালক এস এম কামরুজ্জামান ড্রাগন চাষ নিয়ে কাজ করেছিলেন।

২০১৬ সালে অবসরে যাওয়া কামরুজ্জামান প্রথম আলোকে বলেন, ২০০৯ সালে কৃষি মন্ত্রণালয়ের উচ্চপর্যায় থেকে তাঁর কাছে জানতে চাওয়া হয়েছিল, দেশে ড্রাগন চাষ করতে হলে কী করতে হবে। তখন তিনি করণীয় বলেন। পরে তাঁকে ভিয়েতনাম থেকে চাষপদ্ধতি শিখে আসতে পাঠানো হয়। তিনি ভিয়েতনামে গিয়ে ড্রাগনচাষিদের সঙ্গে ৯ দিন কাটান। তাঁদের কাছ থেকে চাষপদ্ধতি ভালোভাবে রপ্ত করেন। চাষিদের খেতে থাকা বিভিন্ন জাতের ড্রাগন খেয়ে দেখেন। যেগুলোর স্বাদ বেশি—এ রকম পাঁচটি জাতের ড্রাগনের এক ফুট দৈর্ঘ্যের ৬০টি কাটিং (ড্রাগনগাছের একটি অংশ) নিয়ে দেশে ফেরেন। দেশে সফলভাবে চারা করেন। ২০১৩ সালের দিকে ‘মানসম্পন্ন উদ্যান উন্নয়ন প্রকল্পে’র অধীনে সারা দেশে ড্রাগনের এক লাখ চারা দিয়ে এক হাজার প্লটে প্রদর্শনী করেন।

আরও পড়ুনড্রাগন ফলে ‘টনিক’ — সত্যিই কি ক্ষতিকর২৬ ডিসেম্বর ২০২৩

কামরুজ্জামান বলেন, ‘ভিয়েতনামসহ যেসব দেশ ড্রাগন ফল উৎপাদনে অগ্রপথিক, তারা সবাই সাদা জাতকে বেছে নিলেও আমাদের এখানে লালটাই সবচেয়ে বেশি জনপ্রিয়তা পায়। সাদা রঙের শাঁসসম্পন্ন ড্রাগন ফল ডায়াবেটিক রোগীরা যত খুশি খেতে পারেন। কিন্তু আমাদের দেশের লাল শাঁসের ড্রাগন বেশি খেতে পারবেন না তাঁরা।’

২০১১ সালে নাটোরের বড়াই গ্রামের হাদিউল নামের এক কৃষকের জমিতে সরকারিভাবে প্রথম ড্রাগনের চারা রোপণ করা হয় বলে জানান কামরুজ্জামান।

আরও পড়ুনপাহাড়ে ড্রাগন ফলের চাষ০৩ জুলাই ২০২৫

কী বলছেন গবেষকেরা

ড্রাগনে টনিকের ব্যবহার ও দাম কমার বিষয়ে জানতে চাইলে বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটের ফল বিভাগের প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা মসিউর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, ড্রাগন মূলত হাই ভ্যালু ক্রপ (উচ্চমূল্যের ফসল)। এটার দাম কমার পেছনে উৎপাদনের চেয়ে বড় ভূমিকা পালন করেছে টনিকের ব্যবহার। বিশেষ করে সীমান্তবর্তী কয়েকটি উপজেলায় টনিক দিয়ে ড্রাগন চাষের বিষয়টি সংবাদমাধ্যমসহ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে। এই তথ্য ভোক্তাদের মধ্যে ড্রাগন ফল নিয়ে অনীহা তৈরি করে। এর পর থেকে দাম কমা শুরু হয়।

আরও পড়ুনযে ৮ কারণে ড্রাগন ফল খাবেন১৮ অক্টোবর ২০২৩

মাঝারি আকৃতি ও উপরিভাগের পুরোপুরি লাল রঙের খোসার ড্রাগন কেনার পরামর্শ ক্রেতাদের দেন মসিউর রহমান।

বাংলাদেশ নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষের এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে প্রথম আলোকে বলেন, বাজারে যে ড্রাগন ফল পাওয়া যায়, তা কতটা নিরাপদ, সে বিষয়টি পরীক্ষা করার জন্য সংস্থাটি একটি উদ্যোগ নিয়েছে। তবে আপাতত অতিরিক্ত বড় আকারের ড্রাগন ফল এড়িয়ে চলার জন্য ক্রেতাদের পরামর্শ দিচ্ছেন তিনি।

আরও পড়ুনযে কারণে দাম পড়ে যাচ্ছে ড্রাগন ফলের২০ জানুয়ারি ২০২৪আরও পড়ুনমৌসুম ছাড়াও ড্রাগন ফলের চাষ হচ্ছে বৈদ্যুতিক বাতি জ্বালিয়ে০৩ ডিসেম্বর ২০২৪

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: হরম ন র ব যবহ র ক রওয় ন ব জ র প রথম আল ক ক কর মকর ত ম ট র ক টন ১০০ ট ক র জন য দ ম কম চ ষ কর আম দ র

এছাড়াও পড়ুন:

লক্ষ্মীপুরে অস্ত্রসহ সাবেক যুবদল নেতা গ্রেপ্তার

লক্ষ্মীপুরে যৌথ বাহিনীর অভিযানে একটি একনলা বন্দুকসহ জেলা যুবদলের সাবেক এক নেতা গ্রেপ্তার হয়েছেন। গতকাল রোববার দিবাগত রাত একটার দিকে সদর উপজেলার পালেরহাট এলাকায় অভিযান চালিয়ে তাঁকে গ্রেপ্তার করা হয়।

গ্রেপ্তার ব্যক্তির নাম এ কে এম ফরিদ উদ্দিন। তিনি জেলা যুবদলের যুগ্ম আহ্বায়ক পদে ছিলেন। তাঁর বাড়ি পালেরহাট এলাকাতেই। ফরিদ উদ্দিনের কাছ থেকে বন্দুক ছাড়াও নগদ ১ লাখ ৫ টাকা জব্দ করা হয়েছে।

পুলিশ জানিয়েছে, এ কে এম ফরিদ উদ্দিনের বিরুদ্ধে হত্যার অভিযোগ, অস্ত্র আইনসহ বিভিন্ন অভিযোগে একাধিক মামলা রয়েছে। অস্ত্রসহ অবস্থানের খবর পেয়ে ঘরে অভিযান চালিয়ে তাঁকে গ্রেপ্তার করা হয়।

লক্ষ্মীপুর সদর থানার কর্মকর্তা মো. আবদুল মোন্নাফ প্রথম আলোকে বলেন, পুলিশ ও সেনাবাহিনীর যৌথ অভিযানে ফরিদ উদ্দিনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। তাঁর কাছ থেকে অস্ত্র উদ্ধারের ঘটনায় নতুন করে থানায় মামলা হয়েছে।

সম্পর্কিত নিবন্ধ