যাঁরা তাঁর স্বামীকে মেরেছে, তাদের ভিডিওতে দেখা যাচ্ছে। কিন্তু তাদের এখনো ধরা হয়নি। পুলিশের উচিত তাদের ধরা। মামলা কতজনের নামে হয়েছে, তিনি জানেন না। থানায় তিনি যাননি, পুলিশ বাড়িতে এসে স্বাক্ষর নিয়ে গেছে। ভিডিওতে যাদের দেখা যাচ্ছে, তারাই তাঁর স্বামীকে মেরেছে।

আজ শুক্রবার সকালে কথাগুলো বলছিলেন ভারতী রানী। গত শনিবার রাতে রংপুরের তারাগঞ্জ উপজেলার সয়ার ইউনিয়নের বটতলা বুড়িরহাটে গণপিটুনিতে নিহত হন তাঁর স্বামী কুর্শা ইউনিয়নের ঘনিরামপুর গ্রামের রূপলাল দাস। একই ঘটনায় নিহত হন তাঁর আত্মীয় মিঠাপুকুরের ছড়ান বালুয়া গ্রামের প্রদীপ লাল। রূপলাল স্থানীয় বাজারে জুতা সেলাই করতেন ও প্রদীপ লাল ভ্যান চালিয়ে জীবিকা নির্বাহ করতেন।

প্রকাশ্যে জনসমক্ষে পিটিয়ে হত্যার এক সপ্তাহ হয়ে গেলেও চিহ্নিতদের গ্রেপ্তারে পুলিশের কোনো দৃশ্যমান পদক্ষেপ না থাকায় ক্ষোভ ও হতাশা প্রকাশ করেছেন নিহতের পরিবারের সদস্যরা। ভারতী রানী বলেন, ঘটনাস্থলের ভিডিও ফুটেজে স্পষ্টভাবে হত্যাকারীদের দেখা যাচ্ছে, তাঁদের নাম-পরিচয়ও সবার জানা। তিনি চান আসল অপরাধীদের গ্রেপ্তার ও বিচার, তবে নিরপরাধ কেউ যেন হয়রানির শিকার না হন।

কয়েকজন প্রত্যক্ষদর্শীর ভাষ্য, ঘটনার দেড় কিলোমিটারের মধ্যে থাকা বুড়িরহাট, পাইকারপাড়া, বালাপুর ও রহিমাপুর গ্রামের প্রায় ২০-২৫ জন মারধরে অংশ নিয়েছিলেন। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া ভিডিওতেও তাঁদের স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। অথচ মামলায় আসামি করা হয়েছে ৭০০ জনকে।

রূপলালের ছেলে জয় দাস বলেন, ‘আসামি কতজন করেছে, জানি না। কিন্তু ভিডিওতে যাদের দেখা যাচ্ছে, তাদের তো ধরা উচিত। চারজনকে ধরে বসে আছে। বাকিদের কেন ধরা হচ্ছে না? কোনো পদক্ষেপ নিচ্ছে না তারা। তাহলে আমরা বিচার পাব কি পাব না?’

এলাকায় সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, ৭০০ জনের বিরুদ্ধে মামলা হওয়ার পর গ্রেপ্তারের আতঙ্কে অনেক গ্রাম প্রায় পুরুষশূন্য হয়ে পড়েছে।

তারাগঞ্জ উপজেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক মেহেদী হাসান বলেন, ‘গুটিকয় লোক—২০ থেকে ২৫ জন—ঘটনার সঙ্গে জড়িত। কিন্তু এত লোক নয়। ৭০০ জনের নামে মামলা ব্যবসার জন্য করা হয়েছে।’

কুর্শা ইউনিয়নের সাবেক সদস্য গোলাম মোস্তফা বলেন, ‘রূপলাল খুব নিরীহ ও ভালো মানুষ ছিলেন। অথচ তাঁকে নির্মমভাবে পিটিয়ে হত্যা করা হয়েছে। বিচারের দাবিতে মানববন্ধন করার পর পুলিশ কয়েকজনকে ধরেছে, এরপর আর কিছু করছে না। ভিডিওতে যাদের দেখা যাচ্ছে, তাদের কাউকে ধরছে না।’

আরও পড়ুনচরম বর্বরতা দেখিয়ে, উল্লাস করে রূপলাল ও প্রদীপকে হত্যা করা হয়১৩ আগস্ট ২০২৫

তারাগঞ্জ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) এম এ ফারুক বলেন, ‘আসামি ধরতে অভিযান চালাচ্ছি না, এ অভিযোগ ঠিক নয়। যাদের শনাক্ত করা হয়েছে, তারা এলাকার বাইরে পালিয়ে গেছে। তাই গ্রেপ্তার সম্ভব হয়নি।’ ৭০০ জনের নামে মামলা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘বাদী অভিযোগ দিয়েছে, মামলা নেওয়া হয়েছে। তবে নিরপরাধ কাউকে হয়রানি করা হবে না।’

নিহত রূপলালের পরিবার জানায়, রূপলাল দাসের মেয়ে নূপুর রানীর বিয়ের কথাবার্তা চলছিল মিঠাপুকুরের শ্যামপুর এলাকার এক যুবকের সঙ্গে। গত রোববার বিয়ের দিন-তারিখ ঠিক করার কথা ছিল। এ জন্য মিঠাপুকুর থেকে নিজের ভ্যান চালিয়ে রূপলালের ভাগনির স্বামী প্রদীপ লাল আগের দিন শনিবার ঘনিরামপুর গ্রামে রূপলালের বাড়ির উদ্দেশে রওনা হন। কিন্তু গ্রামের ভেতর দিয়ে রাস্তা না চেনায় প্রদীপ কাজীরহাট এলাকায় এসে রূপলালকে ফোন করেন। সেখানে রূপলাল গিয়ে দুজন ভ্যানে চড়ে ঘনিরামপুর গ্রামের দিকে রওনা হন।

পরিবার আরও জানায়, রাত ৯টার দিকে তারাগঞ্জ-কাজীরহাট সড়কের বটতলা এলাকায় পৌঁছালে কয়েকজন যুবক তাঁদের আটকে দেন। প্রদীপ লালের ভ্যানে থাকা বস্তা থেকে কয়েকটি প্লাস্টিকের ছোট বোতল বের করা হয়। এ নিয়ে ধস্তাধস্তির একপর্যায়ে লোক জমতে থাকে। কিছুক্ষণ পর তাঁদের চোর বলে গুজব ছড়িয়ে পড়ে। তখন উপস্থিত এক ব্যক্তি বোতলের গন্ধ শুঁকে নাটকীয় ভঙ্গিতে পড়ে যান। এরপর দুজন তাঁকে সরিয়ে নিয়ে গেলে পরিস্থিতি আরও উত্তপ্ত হয়। শতাধিক লোক জড়ো হয়ে রূপলাল ও প্রদীপ লালকে মারতে শুরু করেন। তাঁদের বুড়িরহাট উচ্চবিদ্যালয়ের মাঠে নিয়ে যাওয়া হয়। প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, পুলিশ ঘটনাস্থলে এলেও উদ্ধার না করে চলে যায়। প্রায় এক ঘণ্টা পর তাঁদের উদ্ধার করা হলেও হাসপাতালে নেওয়ার আগে একজনের মৃত্যু হয়; অন্যজন কয়েক ঘণ্টা পর মারা যান।

আরও পড়ুনহাত জোড় করে বাঁচার আকুতি, তবু শেষ রক্ষা হয়নি রূপলাল ও প্রদীপের১১ আগস্ট ২০২৫.

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: র পল ল র

এছাড়াও পড়ুন:

৪১ বছর ধরে হেঁটে হেঁটে পত্রিকা বিলি করেন গাইবান্ধার রহিম

গাইবান্ধার পত্রিকা বিক্রেতা আবদুর রহিম। বাড়ি পলাশবাড়ী পৌরসভার নুনিয়াগাড়ি এলাকায়। বয়স ৭১ বছর। এই বয়সেও তিনি ঘুমভাঙা চোখে একনজর পত্রিকার শিরোনাম দেখে নেন। পত্রিকা গুছিয়ে বগলে চেপে ছুটে চলেন পাঠকের কাছে। ‘ভাই, আজকে গরম খবর আছে’ বলেই পাঠকের হাতে এগিয়ে দেন পত্রিকা।

এক পাঠক থেকে আরেক পাঠকের কাছে যান আবদুর রহিম। পত্রিকা বিলি করেন সকাল ৬টা থেকে টানা ৭ ঘণ্টা। বিকেল ৫টা থেকে ৪ ঘণ্টা বিলি করা পত্রিকার টাকা সংগ্রহ করেন। ১১ ঘণ্টার বেশির ভাগ সময় হেঁটে পত্রিকা বিলি ও টাকা সংগ্রহ করেন। দূরের পাঠকের কাছে যান বাইসাইকেলে। প্রতিদিন গড়ে ১০ থেকে ১২ কিলোমিটার হেঁটে বিলি করেন পত্রিকা। এভাবেই দীর্ঘ ৪১ বছর ধরে গাইবান্ধায় পত্রিকা বিলির কাজ করছেন তিনি।

আবদুর রহিম বলেন, ‘সকাল ৬টা থেকে পত্রিকা বিলির কাজ শুরু করি। বেলা ১টার দিকে শেষ হয়। উপজেলা সদরে হেঁটে বিলি করি। তবে সদর থেকে ৬-৭ কিলোমিটার দূরে জুনদহ, কালীতলা, ঢোলভাঙ্গা, হোসেনপুর এলাকায় সাইকেলে যাই। এসব জায়গায় সাইকেল রেখে হেঁটে পত্রিকা বিলি করি। দুপুরে বাড়িতে বিশ্রাম নিই। এরপর পত্রিকা বিক্রির টাকা তোলা শুরু করি। টাকা তুলতে বিকেল ৫টা থেকে রাত ৯টা পর্যন্ত সময় লাগে। সব মিলিয়ে প্রতিদিন ১০ থেকে ১২ কিলোমিটার হাঁটাহাঁটি হয়ে যায়। এ রকম ব্যস্ততায় কীভাবে ৪১ বছর কেটে গেল, টেরই পেলাম না! তবে পত্রিকা বিলি করে আনন্দ পাই। অনেক পাঠক আমাকে ভালোবাসেন, খোঁজখবর নেন।’

দীর্ঘ সময় পত্রিকা বিলি করতে সমস্যা হয় কি না, তা জানতে চাইলে আবদুর রহিম বলেন, ‘আমার কোনো অসুখবিসুখ নেই। যত দিন শরীর ভালো থাকবে, তত দিন এই কাজ চালিয়ে যাব।’

ব্যবসার শুরু

রহিমের পৈতৃক বাড়ি রংপুর শহরের আরাজি গুলাল বুদাই এলাকায়। সেখানে তাঁর বাবার ৩ শতাংশ জমিতে বসতভিটা ছিল। এ ছাড়া কোনো সম্পদ ছিল না। বাবা আবেদ আলী অনেক আগেই মারা গেছেন। তিন ভাই ও চার বোনের মধ্যে সবার বড় তিনি। লেখাপড়া করেছেন তৃতীয় শ্রেণি পর্যন্ত। ছোটবেলা থেকেই কৃষিকাজ করতেন। ১৯৭৫ সালে বিয়ে করেন একই এলাকায়। তাঁর ছয় মেয়ে ও এক ছেলে। দারিদ্র্যের কারণে সংসার চালানো একসময় কঠিন হয়ে পড়ে।

রহিমের খালাতো ভাই রংপুর শহরে পত্রিকা বিলি করতেন। তাঁর পরামর্শে ১৯৮৪ সাল থেকে রংপুরে স্থানীয় পত্রিকা দিয়ে আবদুর রহিমের এই ব্যবসার যাত্রা শুরু। এরপর তিনি বাসে ফেরি করে বিক্রি করতে থাকেন পত্রিকা। প্রতিদিন রংপুর থেকে বাসে উঠে পলাশবাড়ী পর্যন্ত আসেন। এভাবে তিন বছর কেটে যায়। এরপর পলাশবাড়ীর স্থানীয় এক সাংবাদিকের বাড়িতে থেকে পত্রিকা বিক্রি শুরু করেন। ছয় মাস থাকেন সেখানে। এরপর জমানো ও ঋণের টাকায় নুনিয়াগাড়ি এলাকায় সোয়া ৮ শতাংশ জমি কিনে টিনশেড ঘর বানান। বাড়ি থেকে ব্যবসা করতে থাকেন। পলাশবাড়ী চারমাথা এলাকায় বসে ঢাকা, রংপুর ও বগুড়া থেকে প্রকাশিত দৈনিক পত্রিকা সংগ্রহ করে পলাশবাড়ী উপজেলা সদরে বিক্রি করতে থাকেন।

হকার থেকে এজেন্ট

কয়েক বছর পর আবদুর রহিম নিজের নামে বেশ কিছু পত্রিকার এজেন্সি নেন। পত্রিকার চাহিদা বেড়ে যাওয়ায় একা সামলাতে পারছিলেন না। তাই চারজন লোক নিয়োগ করেন। তাঁরা এখনো রহিমের কাছে কমিশনে পত্রিকা নিয়ে জীবিকা নির্বাহ করছেন। ব্যবসা শুরুর সময় প্রতিদিন ২০০ থেকে ২৫০ কপি পত্রিকা বিলি করতেন। মাসিক আয় ছিল ১ হাজার ৫০০ থেকে ১ হাজার ৮০০ টাকা। কয়েক বছর পর পাঠকের চাহিদা বেড়ে যায়। সে সময় মাসিক আয় হতো ২২ থেকে ২৫ হাজার টাকা। বর্তমানে ছাপা পত্রিকার পাঠক কমে গেছে। এখন প্রতিদিন ১৫০ থেকে ১৬০ কপি পত্রিকা বিলি করছেন। বর্তমানে তাঁর মাসিক আয় গড়ে ১৬ থেকে ১৭ হাজার টাকা।

আবদুর রহিম প্রথম আলোকে বলেন, ‘পত্রিকার ব্যবসা করে রংপুর থেকে এসে পলাশবাড়ীতে বাড়ি করতে পেরেছি, মেয়েদের বিয়ে দিয়েছি। সততার সঙ্গে চলছি। এতেই আমি সন্তুষ্ট।’

পলাশবাড়ী মহিলা ডিগ্রি কলেজের অধ্যক্ষ আবু সুফিয়ান সরকার বলেন, ‘আবদুর রহিমকে বহু বছর ধরেই পত্রিকা বিক্রি করতে দেখছি। তাঁকে দেখে মনে হয় না ৭১ বছর বয়স হয়েছে। তাঁর মধ্যে ক্লান্তি দেখা যায় না। দিন-রাত পরিশ্রম করেন। কখনো তাঁকে মিথ্যা বলতে শুনিনি। এলাকার মানুষ তাঁকে ভালোবাসেন।’

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • বাস ধুয়েমুছে চালকের সহকারী ওয়াশরুমে গিয়েছিলেন, ফিরে দেখেন আগুন জ্বলছে
  • ‘বাসটির সঙ্গে একটি ট্রাকের ধাক্কা লাগে, এরপর আর কিছু মনে নেই’
  • রেলের ৭ লাখ টাকার যন্ত্র ২৭ হাজারে বানালেন তিনি
  • রাতে এক ঘণ্টার ব্যবধানে সাভার-ধামরাইয়ে দুই বাসে আগুন
  • জনস্বাস্থ্য নিয়ে গবেষণাই তাঁর নেশা 
  • ইডেনে স্পিন বিষ, ১৫ উইকেটের দিনে উড়ছে ভারত
  • বিচারকের ছেলে হত্যা মামলার আসামি লিমন পাঁচ দিনের রিমান্ডে
  • বিচারকের ছেলে হত্যা: লিমন ৫ দিনের রিমান্ডে
  • ‘তোকে গুলি করে মারব না, ব্লেড দিয়ে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে মারব’
  • ৪১ বছর ধরে হেঁটে হেঁটে পত্রিকা বিলি করেন গাইবান্ধার রহিম