ওয়েস্ট ইন্ডিজকে হারিয়ে নেপালের ইতিহাস
Published: 28th, September 2025 GMT
শারজাতে নতুন ইতিহাস লিখল হিমালয়ের দেশ নেপাল। তিন ম্যাচ টি-টোয়েন্টি সিরিজের প্রথমটিতে ওয়েস্ট ইন্ডিজকে ১৯ রানে হারিয়েছে এশিয়ান দলটি, যা আইসিসির পূর্ণ সদস্য দলের বিপক্ষে নেপালের প্রথম জয়।
২০১৪ সালে আফগানিস্তানকে হারিয়েছিল নেপাল, তবে আফগানিস্তান তখন সহযোগী সদস্য ছিল।
ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে গতকালই প্রথম মুখোমুখি হয়েছিল নেপাল। আইসিসির পূর্ণ সদস্য দলের বিপক্ষে এটি নেপালের প্রথম দ্বিপক্ষীয় সিরিজ। আর সেই মঞ্চেই দুইবারের বিশ্বচ্যাম্পিয়নদের হারিয়ে দিল তারা। টসে হেরে প্রথমে ব্যাটিং করে নেপাল ২০ ওভারে করে ৮ উইকেটে ১৪৮ রান। তাড়া করতে নেমে ওয়েস্ট ইন্ডিজ আটকে যায় ১২৯ রানে।
ব্যাটিং, বোলিং, ফিল্ডিং—তিন বিভাগেই দলগত পারফরম্যান্সে উজ্জ্বল ছিল নেপাল। দলের ছয়জন ব্যাটসম্যান কমপক্ষে একটি ছক্কা মেরেছেন, ছয় বোলার উইকেট নিয়েছেন, সঙ্গে ছিল দুর্দান্ত ফিল্ডিংও।
তিন ম্যাচের এই টি-টোয়েন্টি সিরিজে দ্বিতীয় সারির দল খেলাচ্ছে ওয়েস্ট ইন্ডিজ। গতকাল রাতের ম্যাচটিতে অভিষেক হয়েছে চারজনের। বল হাতে শুরুটা ভালোই ছিল ওয়েস্ট ইন্ডিজের। ১২ রানের মধ্যেই নেপালের দুই ওপেনারকে ফেরান আকিল হোসেন ও জেসন হোল্ডার।
পঞ্চম ওভার পর্যন্ত নেপালের ব্যাটসম্যানেরা মাত্র দুই বাউন্ডারি মারতে পেরেছেন। ষষ্ঠ ওভারে রোহিত পৌডেল টানা দুটি চার মেরে সেই সংখ্যা দ্বিগুণ করেন। এরপর ইনিংসে গতি আনেন কুশল মল্লা। তাঁর ২১ বলে ৩০ রানের ইনিংস নেপালকে বেশ খানিকটা এগিয়ে দেয়। রোহিত ও কুশল গড়েন ৫৮ রানের জুটি।
৩৫ বলে ৩৮ রান করেন রোহিত। এরপর ইনিংসের শেষদিকে গুলশান জার ২২ এবং দীপেন্দ্র সিংয়ের ১৭ রানে ভর করে ১৪৮-এ পৌঁছায় নেপাল। ২০ রানে ৪ উইকেট নেন হোল্ডার।
তাড়া করতে নেমে ওয়েস্ট ইন্ডিজ পাওয়ার প্লেতে তোলে ৪০ রান। পাওয়ারপ্লেতে দলটি কাইল মায়ার্স ও আকিম অগাষ্টির উইকেট হারায়। প্রথম ৬ ওভার শেষেই নেপালের স্পিনাররা ম্যাচের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নেন।
অধিনায়ক রোহিত নিজের প্রথম ওভারে ফেরান চারে খেলা জুয়েল অ্যান্ড্রুকে। পরের ওভারেই আমির জাঙ্গুকে আউট করেন আরেক স্পিনার ললিত রাজবানসি। তখন ৫৩ রানে ওয়েস্ট ইন্ডিজ হারায় চার উইকেট।
এরপর কিসি কার্টি ও জেসন হোল্ডার দ্রুত ফিরে গেলে বিপদ বাড়ে ক্যারিবীয়দের। শেষ ৩ ওভারে ওয়েস্ট ইন্ডিজের দরকার ছিল ৪৯ রান। এমন সময়ে অধিনায়ক আকিল ও অ্যালেন মিলে সোমপাল কামির এক ওভারে নেন ১৯ রান। সমীকরণ নেমে আসে শেষ দুই ওভারে ৩০ রান। তবে ১৯তম ওভারে করণ কেসির বলে আকিল ৯ বলে ১৮ রান করে আউট হলে ওয়েস্ট ইন্ডিজের ম্যাচ জেতার সম্ভাবনা শেষ হয়ে যায়।
টি-টোয়েন্টিতে পূর্ণ সদস্য দলের বিপক্ষে আট ম্যাচ খেলে প্রথম জয় পেল নেপাল। অন্যদিকে সহযোগী দলের বিপক্ষে আবারও হারল ওয়েস্ট ইন্ডিজ। ২০২২ টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে স্কটল্যান্ডের কাছে হেরেছিল তারা। ২০১৪ সালে হেরেছিল আয়ারল্যান্ডের কাছে, আর ২০১৬ বিশ্বকাপে হেরেছিল আফগানিস্তানের কাছে—তখনো আফগানিস্তান ছিল সহযোগী দেশ।
জয়ের পর উচ্ছ্বসিত নেপাল অধিনায়ক রোহিত বলেছেন, ‘অনুভূতিটা দারুণ। অনেক দিন অপেক্ষার পর অবশেষে কোনো টেস্ট খেলুড়ে দেশকে হারাতে পারলাম। সেটাও আবার এমন এক সিরিজে, যা আমরা সংযুক্ত আরব আমিরাতে আয়োজন করেছি। এটা শুধু শুরু, সামনে আরও অনেক কিছু আসবে। আমাদের মনোভাব পরিষ্কার ছিল—যখন আমরা এখানে খেলতে এসেছি, তখন লক্ষ্যই ছিল সিরিজ জেতা। আমরা এখনো মাটিতে পা রেখে এগোচ্ছি। প্রক্রিয়াটা ঠিকভাবে করব, এরপর যা আসবে দেখা যাবে।’
তিন ম্যাচ সিরিজের দ্বিতীয় টি-টোয়েন্টি আগামীকাল।
সংক্ষিপ্ত স্কোর:নেপাল: ১৪৮/৮ ( রোহিত ৩৮, কুশল ৩০; হোল্ডার ৪/২০, আকিল ১/১৮)
ওয়েস্ট ইন্ডিজ: ১২৯/৯ ( নভীন বিদাইসি ২২, আকিল ১৮; কুশল ২/ ১৭, রোহিত ১/২০)
ফল: নেপাল ১৯ রানে জয়ী
ম্যাচসেরা: রোহিত পৌডেল।.
উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: আফগ ন স ত ন র প রথম সদস য উইক ট
এছাড়াও পড়ুন:
৪১ বছর ধরে হেঁটে হেঁটে পত্রিকা বিলি করেন গাইবান্ধার রহিম
গাইবান্ধার পত্রিকা বিক্রেতা আবদুর রহিম। বাড়ি পলাশবাড়ী পৌরসভার নুনিয়াগাড়ি এলাকায়। বয়স ৭১ বছর। এই বয়সেও তিনি ঘুমভাঙা চোখে একনজর পত্রিকার শিরোনাম দেখে নেন। পত্রিকা গুছিয়ে বগলে চেপে ছুটে চলেন পাঠকের কাছে। ‘ভাই, আজকে গরম খবর আছে’ বলেই পাঠকের হাতে এগিয়ে দেন পত্রিকা।
এক পাঠক থেকে আরেক পাঠকের কাছে যান আবদুর রহিম। পত্রিকা বিলি করেন সকাল ৬টা থেকে টানা ৭ ঘণ্টা। বিকেল ৫টা থেকে ৪ ঘণ্টা বিলি করা পত্রিকার টাকা সংগ্রহ করেন। ১১ ঘণ্টার বেশির ভাগ সময় হেঁটে পত্রিকা বিলি ও টাকা সংগ্রহ করেন। দূরের পাঠকের কাছে যান বাইসাইকেলে। প্রতিদিন গড়ে ১০ থেকে ১২ কিলোমিটার হেঁটে বিলি করেন পত্রিকা। এভাবেই দীর্ঘ ৪১ বছর ধরে গাইবান্ধায় পত্রিকা বিলির কাজ করছেন তিনি।
আবদুর রহিম বলেন, ‘সকাল ৬টা থেকে পত্রিকা বিলির কাজ শুরু করি। বেলা ১টার দিকে শেষ হয়। উপজেলা সদরে হেঁটে বিলি করি। তবে সদর থেকে ৬-৭ কিলোমিটার দূরে জুনদহ, কালীতলা, ঢোলভাঙ্গা, হোসেনপুর এলাকায় সাইকেলে যাই। এসব জায়গায় সাইকেল রেখে হেঁটে পত্রিকা বিলি করি। দুপুরে বাড়িতে বিশ্রাম নিই। এরপর পত্রিকা বিক্রির টাকা তোলা শুরু করি। টাকা তুলতে বিকেল ৫টা থেকে রাত ৯টা পর্যন্ত সময় লাগে। সব মিলিয়ে প্রতিদিন ১০ থেকে ১২ কিলোমিটার হাঁটাহাঁটি হয়ে যায়। এ রকম ব্যস্ততায় কীভাবে ৪১ বছর কেটে গেল, টেরই পেলাম না! তবে পত্রিকা বিলি করে আনন্দ পাই। অনেক পাঠক আমাকে ভালোবাসেন, খোঁজখবর নেন।’
দীর্ঘ সময় পত্রিকা বিলি করতে সমস্যা হয় কি না, তা জানতে চাইলে আবদুর রহিম বলেন, ‘আমার কোনো অসুখবিসুখ নেই। যত দিন শরীর ভালো থাকবে, তত দিন এই কাজ চালিয়ে যাব।’
ব্যবসার শুরুরহিমের পৈতৃক বাড়ি রংপুর শহরের আরাজি গুলাল বুদাই এলাকায়। সেখানে তাঁর বাবার ৩ শতাংশ জমিতে বসতভিটা ছিল। এ ছাড়া কোনো সম্পদ ছিল না। বাবা আবেদ আলী অনেক আগেই মারা গেছেন। তিন ভাই ও চার বোনের মধ্যে সবার বড় তিনি। লেখাপড়া করেছেন তৃতীয় শ্রেণি পর্যন্ত। ছোটবেলা থেকেই কৃষিকাজ করতেন। ১৯৭৫ সালে বিয়ে করেন একই এলাকায়। তাঁর ছয় মেয়ে ও এক ছেলে। দারিদ্র্যের কারণে সংসার চালানো একসময় কঠিন হয়ে পড়ে।
রহিমের খালাতো ভাই রংপুর শহরে পত্রিকা বিলি করতেন। তাঁর পরামর্শে ১৯৮৪ সাল থেকে রংপুরে স্থানীয় পত্রিকা দিয়ে আবদুর রহিমের এই ব্যবসার যাত্রা শুরু। এরপর তিনি বাসে ফেরি করে বিক্রি করতে থাকেন পত্রিকা। প্রতিদিন রংপুর থেকে বাসে উঠে পলাশবাড়ী পর্যন্ত আসেন। এভাবে তিন বছর কেটে যায়। এরপর পলাশবাড়ীর স্থানীয় এক সাংবাদিকের বাড়িতে থেকে পত্রিকা বিক্রি শুরু করেন। ছয় মাস থাকেন সেখানে। এরপর জমানো ও ঋণের টাকায় নুনিয়াগাড়ি এলাকায় সোয়া ৮ শতাংশ জমি কিনে টিনশেড ঘর বানান। বাড়ি থেকে ব্যবসা করতে থাকেন। পলাশবাড়ী চারমাথা এলাকায় বসে ঢাকা, রংপুর ও বগুড়া থেকে প্রকাশিত দৈনিক পত্রিকা সংগ্রহ করে পলাশবাড়ী উপজেলা সদরে বিক্রি করতে থাকেন।
হকার থেকে এজেন্টকয়েক বছর পর আবদুর রহিম নিজের নামে বেশ কিছু পত্রিকার এজেন্সি নেন। পত্রিকার চাহিদা বেড়ে যাওয়ায় একা সামলাতে পারছিলেন না। তাই চারজন লোক নিয়োগ করেন। তাঁরা এখনো রহিমের কাছে কমিশনে পত্রিকা নিয়ে জীবিকা নির্বাহ করছেন। ব্যবসা শুরুর সময় প্রতিদিন ২০০ থেকে ২৫০ কপি পত্রিকা বিলি করতেন। মাসিক আয় ছিল ১ হাজার ৫০০ থেকে ১ হাজার ৮০০ টাকা। কয়েক বছর পর পাঠকের চাহিদা বেড়ে যায়। সে সময় মাসিক আয় হতো ২২ থেকে ২৫ হাজার টাকা। বর্তমানে ছাপা পত্রিকার পাঠক কমে গেছে। এখন প্রতিদিন ১৫০ থেকে ১৬০ কপি পত্রিকা বিলি করছেন। বর্তমানে তাঁর মাসিক আয় গড়ে ১৬ থেকে ১৭ হাজার টাকা।
আবদুর রহিম প্রথম আলোকে বলেন, ‘পত্রিকার ব্যবসা করে রংপুর থেকে এসে পলাশবাড়ীতে বাড়ি করতে পেরেছি, মেয়েদের বিয়ে দিয়েছি। সততার সঙ্গে চলছি। এতেই আমি সন্তুষ্ট।’
পলাশবাড়ী মহিলা ডিগ্রি কলেজের অধ্যক্ষ আবু সুফিয়ান সরকার বলেন, ‘আবদুর রহিমকে বহু বছর ধরেই পত্রিকা বিক্রি করতে দেখছি। তাঁকে দেখে মনে হয় না ৭১ বছর বয়স হয়েছে। তাঁর মধ্যে ক্লান্তি দেখা যায় না। দিন-রাত পরিশ্রম করেন। কখনো তাঁকে মিথ্যা বলতে শুনিনি। এলাকার মানুষ তাঁকে ভালোবাসেন।’