রোবোটিক হাত ভেঙে দেবে বৈষম্যের দেয়াল
Published: 10th, November 2025 GMT
সুযোগের অভাবে কেন কেউ পিছিয়ে থাকবে—এই সাধারণ প্রশ্নের উত্তরের খোঁজ আমাকে নিয়ে গেছে উদ্ভাবনের পথে। সেখান থেকেই জন্ম নিয়েছে বাংলাদেশের প্রথম সাশ্রয়ী রোবোটিক হাত।
কেউ জন্মগতভাবে, কেউ দুর্ঘটনায় হারিয়েছেন হাত, আবার কেউ সমাজের সীমাবদ্ধতায় হারিয়েছেন নিজের স্বপ্ন। এসব দেখে ভাবতাম, প্রযুক্তি ব্যবহার করে কীভাবে এই বৈষম্য কিছুটা হলেও দূর করা যায়। মূলত সেই ভাবনা থেকেই আমার উদ্ভাবনের পথে যাত্রাটা শুরু।
কৌতূহল থেকে মানবিক উদ্ভাবনআমার জন্ম চট্টগ্রামের হাটহাজারী উপজেলার জোবরা গ্রামে। ছোটবেলা থেকেই বিজ্ঞান ও রোবোটিকসের প্রতি ছিল আমার অদম্য কৌতূহল। বিশ্বাস করতাম, প্রযুক্তি তখনই অর্থবহ, যখন তা মানুষের কষ্ট কমায়। এ বিশ্বাস থেকেই মনে হয়েছে, এমন কিছু তৈরি করা যায় কি না, যা হাত হারানো ব্যক্তিকে ফিরিয়ে দিতে পারে জীবনের স্বাভাবিক ছন্দ। তখনই রোবোটিক হাত তৈরি করার কথা মাথায় এল। ২০১৭ সালে সিদ্ধান্ত নিলাম, হাত হারানো মানুষের জন্য এই রোবোটিক হাতই তৈরি করব।
হার না মানা তারুণ্যরোবোটিক হাত তৈরির সিদ্ধান্ত নিলেও কাজটা মোটেও সহজ ছিল না। শুরুতেই উপকরণ আর অর্থ—এই দুটি বাধা পাহাড়ের মতো সামনেএসে দাঁড়াল।
বিদেশে রোবোটিক হাত তৈরি হলেও দাম এত বেশি যে এ দেশের সাধারণ মানুষ কখনো তা ব্যবহার করতে পারবে না। তাই ভাবলাম, হাতের নাগালে থাকার মতো কিছু করতে হলে দেশীয় প্রযুক্তি ও সহজলভ্য উপকরণ দিয়ে করতে হবে। এ কারণে প্লাস্টিক, হালকা ধাতু ও সাধারণ ইলেকট্রনিক সেন্সর ব্যবহার করে নিজেই গবেষণা শুরু করে দিই।
শুরুর দিকে কয়েকটি প্রোটোটাইপ (প্রাথমিক নমুনা বা মডেল, যা চূড়ান্ত পণ্য তৈরি করার আগে ধারণা যাচাই ও পরীক্ষা করার জন্য তৈরি করা হয়) একদমই কাজ করেনি। কখনো আঙুল নড়ত না, কখনো সার্কিট পুড়ে যেত। কিন্তু আমি হারতে রাজি নই, তাই থামিনি। প্রতিটি ব্যর্থতা থেকে শিখেছি, এই ব্যর্থতাই আমাকে আরও এক ধাপ এগিয়ে দিয়েছে।
একবার ভেঙেছে, দুইবার পুড়েছে, কিন্তু তৃতীয়বার জ্বলে উঠেছে সাফল্যের আলো। অবশেষে একদিন সফল হলাম। তৈরি হলো স্মার্ট রোবোটিক হাত, যা দিয়ে ব্যবহারকারী লিখতে, ধরতে, এমনকি দৈনন্দিন নিজের কাজওকরতে পারে।
এই প্রকল্পের মাধ্যমে বুঝেছি, প্রযুক্তি কেবল যন্ত্র নয়, এটি মানুষের একধরনের স্বাধীনতার প্রতীকও বটে। যখন দেখি, যে ব্যক্তি একসময় নিজ হাতে চামচ ধরতে পারতেন না, এখন তিনি রোবোটিক হাত দিয়ে নিজের হাতেই খেতে পারছেন; যিনি লিখতে পারতেন না, এখন তিনি নিজের হাত দিয়েই নিজের নাম লিখছেন—সে মুহূর্তটাই আমার কাছে সবচেয়ে বড় পুরস্কার।
রোবোলাইফের যাত্রা২০১৮ সালে রোবোটিক হাত সবার কাছে সহজে পৌঁছে দেওয়ার স্বপ্নটা বাস্তবে রূপ দিতে কয়েকজন তরুণ উদ্ভাবককে নিয়ে গড়ে তুলেছি রোবোলাইফ টেকনোলজিস। এখানে বর্তমানে দেশি-বিদেশি ১৫-১৬ জন তরুণ উদ্ভাবক কাজ করছেন। আমাদের লক্ষ্য, প্রযুক্তিকে মানুষের জীবনের অংশ করে তোলা।
বিশ্বের অনেক দেশেই রোবোটিক হাত নিয়ে গবেষণা হচ্ছে, কিন্তু সেসবের দাম লাখ লাখ টাকা। বাংলাদেশের একজন সাধারণ মানুষের সেই প্রযুক্তি ব্যবহারের সুযোগ বা সামর্থ্য প্রায় নেই বললেই চলে। তাই আমরা বিদেশি প্রযুক্তির দামের ১০ ভাগের ১ ভাগের মধ্যে সমমানের কার্যকর কৃত্রিম হাত তৈরির চেষ্টা করছি। আমাদের তৈরি কৃত্রিম হাতের খরচ এত কম যে এটি গ্রামীণ বা নিম্নবিত্ত মানুষও ব্যবহার করতে পারবেন।
আমরা বিশ্বাস করি, উদ্ভাবন তখনই সফল হয়, যখন তা সমাজের প্রতিটি স্তরে পৌঁছায়। তাই রোবোলাইফ শুধু পণ্য বিক্রি করে না, আমরা কাজ করি সচেতনতা, প্রশিক্ষণ ও পুনর্বাসন কর্মসূচি নিয়েও। আমরা দুর্ঘটনায় হাত হারানো মানুষদের পুনর্বাসনে কাজ করছি, তাঁদের জন্য আলাদাভাবে ডিজাইন করা কৃত্রিম হাত সরবরাহ করছি; যা শুধু চলাচল নয়, মানুষকে ফিরিয়ে দিচ্ছে আত্মবিশ্বাস।
দেশ পেরিয়ে বিদেশের স্বীকৃতিরোবোলাইফ টেকনোলজিসের যাত্রা খুব সাধারণভাবে শুরু হলেও এটি আজ বাংলাদেশে তরুণ উদ্ভাবকদের এক অনুপ্রেরণার নাম।
আমাদের অন্যতম বড় অর্জন হলো ২০২৫ সালে ‘স্টার্টআপ ওয়ার্ল্ড কাপ বাংলাদেশ’ প্রতিযোগিতায় চ্যাম্পিয়ন হওয়া। এর মাধ্যমে আমরা যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশের প্রতিনিধিত্ব করেছি। এ ছাড়া ‘বিটিআরসি ইনোভেশন ফেয়ার ২০২৫’-এ জাতীয় পর্যায়ে প্রথম স্থান অর্জন করেছি, যা আমাদের গবেষণার প্রতি সরকারের আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি।
এ ছাড়া আমরা ২০২৪ সালে ‘ইউএনডিপি স্প্রিংবোর্ড প্রোগ্রাম ৭.
আমরা এখন গর্ব করে বলতে পারি, বাংলাদেশে আমরাই প্রথম সাশ্রয়ী মূল্যের রোবোটিক হাত তৈরি করেছি। ইতিমধ্যে সৌদি আরব, মালয়েশিয়া, ভারত ও তুরস্কে এই প্রযুক্তি প্রদর্শনের সুযোগ পেয়েছি। এসব অর্জন আমাদের দেশের তরুণদের সক্ষমতা বিশ্বে তুলে ধরেছে।
আমাদের লক্ষ্য এখন আরও বড়—এই প্রযুক্তিকে শিল্পের পর্যায়ে নিয়ে যাওয়া, যেন বাংলাদেশ থেকে ‘মেড ইন বাংলাদেশ’ লেখা রোবোটিক হাত বিশ্বে রপ্তানি করা যায়। আমাদের বিশ্বাস, এই দেশ একদিন উদ্ভাবনের দেশ হিসেবে বিশ্বে অবস্থান করে নেবে।
তরুণ উদ্ভাবকদের নতুন সম্ভাবনাদেশে এখনো তরুণ উদ্ভাবকদের জন্য প্রাতিষ্ঠানিক সহায়তা খুব সীমিত। গবেষণা তহবিল, প্রশিক্ষণকেন্দ্র, আন্তর্জাতিক সহযোগিতা বা পেটেন্ট সহায়তা না থাকায় তরুণদের অনেক স্বপ্ন মাঝপথে থেমে যায়।
সরকার যদি তরুণ উদ্ভাবকদের জন্য আরও সুযোগ তৈরি করে, গবেষণার তহবিল, প্রযুক্তি হাব ও আন্তর্জাতিক প্রদর্শনীর সুযোগ দেয়, তাহলে আরও অনেক তরুণ এগিয়ে আসবেন।
সরকারি সহযোগিতা পেলে বাংলাদেশও বিশ্বে প্রযুক্তি উদ্ভাবনের কেন্দ্র হতে পারে। জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া বা চীনের উন্নতির মূলে ছিল তরুণদের উদ্ভাবনী শক্তি ও সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা। বাংলাদেশেও সেই সম্ভাবনা আছে। শুধু দরকার একটু আস্থা, একটু সহায়তা।
আমরা চাই, রোবোলাইফ টেকনোলজিস একটি উদাহরণ হোক। যেখান থেকে ভবিষ্যতের উদ্ভাবকেরা শিখবে উদ্ভাবন মানে কেবল অর্থ উপার্জন নয়, বরং সমাজে পরিবর্তন আনা।
বৈষম্য ভাঙার হাতরোবোলাইফের গবেষণা ও উদ্ভাবন কেবল প্রযুক্তিগত অর্জন নয়, এটি সামাজিক
পরিবর্তনের হাতিয়ার। আমরা এমন একটি বাংলাদেশ গড়তে চাই, যেখানে ‘হাত আছে’ আর ‘হাত নেই’—এই বৈষম্য থাকবে না। আমাদের রোবোটিক হাত এখন শুধু একটি পণ্য নয়, বরং মানবিকতার প্রতীক।
তরুণ প্রজন্মের উদ্দেশে বলতে চাই, স্বপ্ন দেখো, চেষ্টা করো, ব্যর্থ হও, আবার উঠে দাঁড়াও। প্রযুক্তি তোমার হাতকে শক্তি দেবে, কিন্তু তোমার মনই দেবে পথের দিশা। সীমাবদ্ধতা নয়, উদ্ভাবনই মানুষের আসল শক্তি।
আমি এমন এক বাংলাদেশ দেখতে চাই, যেখানে কেউ পিছিয়ে থাকবে না—না সুযোগে, না প্রযুক্তিতে, না জীবনে। যেখানে প্রত্যেকে নিজের সামর্থ্যে সমাজে অবদান রাখবে। আর সেই ভবিষ্যতের প্রথম পদক্ষেপই এই রোবোটিক হাত, যা শুধু একটি যন্ত্র নয়, এটি বাংলাদেশের মানবিক প্রযুক্তি বিপ্লবের সূচনা।
উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: ব যবহ র কর ক জ কর আম দ র র উদ ভ র জন য সরক র প রথম
এছাড়াও পড়ুন:
হ্যাটট্রিকে পুসকাস ও ডি স্টেফানোকে মনে করালেন লেভা
রবার্ট লেভানডফস্কির হ্যাটট্রিক, লামিনে ইয়ামালের টানা তিন ম্যাচে গোল, মার্কাস রাশফোর্ডের জোড়া অ্যাসিস্ট—আক্রমণভাগের কাছ থেকে বার্সেলোনা কোচ হান্সি ফ্লিক এর চেয়ে বেশি হয়তো চাইতে পারতেন না। লা লিগায় কাল ফ্লিকের মন ভরিয়ে দেওয়ার মতো পারফর্মই করেছেন ফরোয়ার্ডরা।
নিজেদের মাঠ বালাইদোসে সেলতা ভিগো দুই দফা সমতা ফেরালেও শেষ পর্যন্ত বার্সার কাছে ম্যাচটা হেরেছে ৪–২ গোলে। কাল রাতেই আরেক ম্যাচে ভায়েকানোর মাঠে গোলশূন্য ড্র করেছে রিয়াল মাদ্রিদ। রিয়াল হোঁচট খাওয়ায় তাদের সঙ্গে ব্যবধান কমিয়ে এনেছে বার্সা। শীর্ষে থাকা রিয়ালের পয়েন্ট ৩১, দুইয়ে উঠে আসা বার্সার ২৮। দুই দলই ১২টি করে ম্যাচ খেলেছে।
চোটের কারণে এক মাস মাঠের বাইরে ছিলেন লেভানডফস্কি। ২ নভেম্বর লা লিগায় এলচের বিপক্ষে ম্যাচ দিয়ে ফিরলেও বদলি নেমে খেলেছেন মাত্র ১৬ মিনিট। ৫ নভেম্বর চ্যাম্পিয়নস লিগে ক্লাব ব্রুগার বিপক্ষেও বদলি নেমেছিলেন। শতভাগ ফিট লেভা কাল সেলতার বিপক্ষে খেলেছেন শুরু থেকেই। প্রথমার্ধে জোড়া গোলের পর দ্বিতীয়ার্ধে করেন নিজের তৃতীয় ও দলের শেষ গোল।
লেভানডফস্কির তিন গোলের দুটিতে বলের জোগান দিয়েছেন মার্কাস রাশফোর্ড (ডানে)