শিক্ষাকে কালিমামুক্ত করা যাবে কীভাবে
Published: 10th, November 2025 GMT
এ বছরের এইচএসসি ও সমমান পরীক্ষার ফলাফল প্রকাশের পর নানান আলোচনা চোখে পড়েছে। অনেকেই দেশের ভবিষ্যৎ নিয়ে বেশ চিন্তিত। অনেকেই বলেছেন, দেশে গুণগত শিক্ষার অভাবের তীব্রতাই প্রতিফলিত হয়েছে এবারের ফলাফলে।
কেউ কেউ দেশের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর বেহাল চিত্রও তুলে ধরেছেন। অনেকে দুষছেন সরকারকে। অনেকেরই দুশ্চিন্তা—শিক্ষার এই দৈন্যদশার ফলে অনেক ভালো চাকরিই বিদেশিদের হাতে চলে যাবে। এবারের পরীক্ষায় গড় পাসের হার ৫৮ দশমিক ৮৩। গত বছর পাসের হার ছিল ৭৭ দশমিক ৭৮। আগের বছরের তুলনায় পাসের কমেছে ১৮ দশমিক ৯৫ শতাংশ।
বাংলাদেশ শিক্ষাতথ্য ও পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্য দেখাচ্ছে, ২০০৪ সালের পর এবারই উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষায় পাসের হার সর্বনিম্ন। ফলাফল বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, এবার সবচেয়ে বেশি শিক্ষার্থী অকৃতকার্য হয়েছেন ইংরেজিতে। ৯টি সাধারণ শিক্ষা বোর্ডের এক-তৃতীয়াংশের বেশি শিক্ষার্থী ইংরেজিতে পাস করতে পারেননি। তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তিতে (আইসিটি) পরীক্ষাতেও একই দশা। ইংরেজির পর সবচেয়ে বেশিসংখ্যক শিক্ষার্থী অকৃতকার্য হয়েছেন আইসিটিতে। গত বছরও অবশ্য সবচেয়ে বেশি অকৃতকার্য হয়েছিলেন ইংরেজিতে।
এ থেকে একটি বিষয় ধারণা করা যায়, শিক্ষার্থীরা আবশ্যিক বিষয়গুলোতে পাস করতে পারছেন না। এদিকে আরও আশঙ্কার বিষয় হলো, একজন শিক্ষার্থীও পাস করেননি, এমন প্রতিষ্ঠানের সংখ্যাও বেড়েছে। গত পাঁচ বছরের মধ্যে এবার রেকর্ড সর্বোচ্চ ২০২টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের কোনো শিক্ষার্থী উচ্চমাধ্যমিক পাস করতে পারেননি।
এই পরিস্থিতির পেছনে বহুমুখী কারণ রয়েছে। যার মধ্যে অন্যতম হলো, প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষার ভিত দুর্বল। মৌলিক শিক্ষার আধার এসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। সেখানে যদি শিক্ষার্থীরা কোনো বিষয় ভালোভাবে আয়ত্ত করতে না পারে, তাহলে স্বাভাবিকভাবেই উচ্চমাধ্যমিকে সে বিষয়ে তারা পিছিয়ে থাকবে। দেশের প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে বিষয়ভিত্তিক দক্ষ শিক্ষকের অভাব রয়েছে। অদক্ষ শিক্ষক দিয়ে পাঠদানে শিক্ষার্থীদের ভিত্তি দুর্বলই রয়ে গেছে।
২০২৩ সালের বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা ওয়েভ ফাউন্ডেশনের এক জরিপে দেখা গেছে, প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণির ১৩ দশমিক ৬২ শতাংশ শিশু গণিতে একক সংখ্যাই শনাক্ত করতে পারে না। ১৬ দশমিক ৭৮ শতাংশ ছেলেশিশু ইংরেজি বইয়ের একটি বর্ণও পড়তে পারে না। মেয়েশিশুদের মধ্যে পারে না ১৫ দশমিক ২২ শতাংশ। এ অবস্থা আমি নিজেও দেখেছি। শুধু প্রাথমিক বিদ্যালয়ে নয়, কিছু বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের অনুরোধে তাঁদের ক্লাস নিতে গিয়েও।
আরও পড়ুনএইচএসসি ফল বিপর্যয়: ব্যর্থতা নয়, জাগরণের বার্তা২২ অক্টোবর ২০২৫অন্যদিকে মাধ্যমিক বিদ্যালয়গুলোর মূল সংকট শিক্ষকের অভাব। এসব বিদ্যালয়ে রয়েছে ১০ হাজার ৯০০ শিক্ষক পদ। সহকারী শিক্ষকের পদ ৫ হাজার ৪৫২টি। এর বিপরীতে কর্মরত আছেন ২ হাজার ৭১০ জন। পদ শূন্য ২ হাজার ৭৪২টি। ফলে শ্রেণিকক্ষে শিক্ষার্থী-শিক্ষকের অনুপাতের ব্যবধান আন্তর্জাতিক মানদণ্ডের চেয়ে বেড়েছে।
এ ছাড়া শিক্ষাব্যবস্থায় ধারাবাহিক সংস্কার না হওয়া, শিক্ষক প্রশিক্ষণের ঘাটতি, মুখস্থবিদ্যা, প্রযুক্তিনির্ভরতার ঘাটতি এবং বিদ্যমান পাঠ্যক্রম—সব মিলিয়ে শিক্ষার গুণগত মান নিয়ে প্রশ্ন তো আছেই। এসবের প্রতিফলন উঠে এসেছিল বিশ্বব্যাংকের ২০২০ সালের হিউম্যান ক্যাপিটাল ইনডেক্সে। যেখানে দেখা যায়, দেশে একজন শিক্ষার্থী ১০ বছর ২ মাস শিক্ষাজীবনে যা শিখছে, তা আন্তর্জাতিক মান অনুযায়ী ষষ্ঠ শ্রেণির দক্ষতার সমান।
এসবের বাইরে এ বছরের নিম্নমুখী ফলাফলের পেছনে কিছু সাম্প্রতিক ঘটনার দায় রয়েছে। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে নানা পটভূমিতে শিক্ষার্থীদের মনঃক্ষুণ্ন করা কিংবা সংক্ষিপ্ত সিলেবাসে পরীক্ষা নেওয়ার কারণে তাঁদের শেখার ওপর পড়েছে নেতিবাচক প্রভাব। অন্যদিকে শিশুকাল থেকে শিক্ষাকে সহজীকরণের প্রবণতা শিক্ষার্থীদের প্রকৃত দক্ষতা অর্জনের পথে হয়ে দাঁড়িয়েছে অন্যতম অন্তরায়। গত চার বছরে উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষায় গড় পাসের হার ছিল যথাক্রমে ৯৫ দশমিক ৫৭, ৮৪ দশমিক ৩১, ৭৮ দশমিক ৬৪ ও ৭৭ দশমিক ৭৮।
বাড়াতে হবে শিক্ষা খাতে বিনিয়োগ। আর এর শুরুটা হতে হবে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তর থেকে। কেননা এসব শিক্ষার ভিত মজবুত না হলে উচ্চশিক্ষায় কোনো ইতিবাচক পরিবর্তন আসবে না। উচ্চশিক্ষার মান না বাড়লে তা কখনোই টেকসই ভবিষ্যৎ গড়তে সহায়ক হবে না।অবশ্য শিক্ষাসংশ্লিষ্ট অনেকেই বলছেন যে আগের সরকারের পক্ষ থেকে পাসের হার বেশি দেখানোর উদ্দেশ্যে শিক্ষার্থীদের প্রাপ্য নম্বরের তুলনায় বেশি নম্বর দেওয়ার নির্দেশনা ছিল। ফলে পাসের হার ও জিপিএ–৫ দুটোই ছিল বেশি। তবে গত বছর বা এবার সরকারের পক্ষ থেকে প্রকৃত মূল্যায়নের নির্দেশ দেওয়ায় পাসের হার ও জিপিএ–৫ উভয়ই কমেছে। অনেকের মতে, এবারের ফলাফল শিক্ষার গুণগত মানের প্রকৃত অবস্থা তুলে ধরেছে।
এমন পরিস্থিতিতে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও শিক্ষার মানোন্নয়ন ঘটাতে প্রয়োজন বেশ কিছু কার্যকর পদক্ষেপ। প্রয়োজন যুগোপযোগী শিক্ষাক্রম প্রণয়ন, পর্যাপ্তসংখ্যক যোগ্য ও প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত শিক্ষক, উপযুক্ত শিক্ষাদানের সামগ্রী ও অবকাঠামো তৈরি, উপযুক্ত শিক্ষণ-শিখন/পদ্ধতি তৈরি, উপযুক্ত মূল্যায়ন পদ্ধতি, ধারাবাহিক পর্যবেক্ষণের। এসব করতে প্রয়োজন অর্থায়ন। এদিকে জিডিপির বিপরীতে দেশে শিক্ষা খাতের বরাদ্দও অতি সামান্য।
সুতরাং বাড়াতে হবে শিক্ষা খাতে বিনিয়োগ। আর এর শুরুটা হতে হবে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তর থেকে। কেননা এসব শিক্ষার ভিত মজবুত না হলে উচ্চশিক্ষায় কোনো ইতিবাচক পরিবর্তন আসবে না। উচ্চশিক্ষার মান না বাড়লে তা কখনোই টেকসই ভবিষ্যৎ গড়তে সহায়ক হবে না।
আরও পড়ুনএইচএসসি পরীক্ষা: ‘ওভারমার্কিং’ না করার সিদ্ধান্ত কি যথার্থ হয়েছে১৮ অক্টোবর ২০২৫এ ব্যাপারে সম্ভবত কারোরই দ্বিমত নেই যে বাংলাদেশের সামগ্রিক শিক্ষাব্যবস্থাই দুষ্ট রাজনীতি আর সামাজিক অবক্ষয়ের শিকার। বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক নিয়োগে রাজনৈতিক সংযোগ বিবেচনা, নির্বাচনী দায়িত্বে তাঁদের সম্পৃক্ত করা, এমনকি তাঁদের পদোন্নতিতে ঘুষ-দুর্নীতির ঘটনা বাংলাদেশে নিয়মিতই ঘটে। এদিকে বিশ্ববিদ্যালয়ের ভালো ভালো শিক্ষককে রাষ্ট্রের লোভনীয় পদে পদায়নের মধ্য দিয়ে সরকারের খারাপ কাজের সহযোগী বানানো, এমনকি তাঁদের মাধ্যমে ছাত্রদেরও অনৈতিক কাজে জড়িয়ে ফেলার বিভিন্ন উদাহরণ আর পরিণাম আমরা দেখেছি।
স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন আসবে—শিক্ষাকে কালিমামুক্ত আর সময়োপযোগী করব কীভাবে? উত্তরটি খুব সোজা, আবার খুবই কঠিন। শিক্ষাকে ঠিক করতে হলে দেশের রাজনীতিকে ঠিক করতে হবে। সত্যিকার শিক্ষিতদের শিক্ষায় টেনে আনতে হবে, এমনকি বিদেশ থেকে হলেও। শিক্ষা গবেষণাকে সর্বব্যাপী প্রাধান্য দিতে হবে। ভালো শিক্ষকদের সুযোগ-সুবিধার দিকেও দিতে হবে নজর। উৎসাহিত করতে হবে একটা বিশ্বের সঙ্গে প্রতিযোগিতামূলক শিক্ষাদানের অবস্থাকে।
● মামুন রশীদ অর্থনীতি বিশ্লেষক
.উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: ব শ বব প স কর পর ক ষ বছর র সরক র ফল ফল দশম ক
এছাড়াও পড়ুন:
‘কালো হেলমেট পরা দুজন বাইকে এসে ককটেল ফাটিয়ে চলে যায়’
প্রবর্তনার সামনে আজ সোমবার সকালে যখন ককটেল বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটে, তখন প্রতিষ্ঠানটি বন্ধ ছিল। রাজধানীর মোহাম্মদপুরে খাদ্যপণ্যের প্রতিষ্ঠানে ককটেল বিস্ফোরণ হয় সকাল সাতটার একটু আগে। এর মূল ফটকের সামনে একটু দূরে দাঁড়িয়ে ছিলেন একজন নিরাপত্তারক্ষী। রাস্তায় লোকজনও ছিল কিছু। সেই সময় ইকবাল রোডের দিক থেকে আসা মোটরসাইকেলে দুই ব্যক্তি ককটেল ফাটিয়ে চলে যান। যদিও তার আগে এই দুই ব্যক্তি কয়েক মিনিট দাঁড়িয়ে ছিলেন।
সিসিটিভির ফুটেজ দেখে, বিস্ফোরণের আগে–পরের পরিস্থিতি তুলে ধরেন প্রবর্তনার ফাইন্যান্স ম্যানেজার মো. তানভীর আহমেদ। আজ বেলা দেড়টার দিকে তিনি জানান, এ ঘটনার পরপরই পুলিশ আসে। তারা তদন্ত করছে। এরপর প্রবর্তনার পক্ষ থেকে মামলা করা হবে।
‘প্রবর্তনা’ মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ উপদেষ্টা ফরিদা আখতার এবং কবি ও চিন্তক ফরহাদ মজহারের খাদ্যপণ্যের প্রতিষ্ঠান।
মো. তানভীর আহমেদ প্রথম আলোকে বলেন, ‘সিসিটিভির ফুটেজে যা দেখেছি, সকাল সাতটার একটু আগে দুজন প্রবর্তনার মূল ফটকের পাশে এসে দাঁড়ায়। তারপর দুজন দুই পাশে তাকাতে থাকে। এ সময় প্রবর্তনার একজন নিরাপত্তারক্ষী ফটকের উল্টো দিকে ছিলেন। দেখা যায়, এ সময় দুই যুবক কোনো কিছু না করে বাইক নিয়ে চলে যায়। খানিকক্ষণ পরে ইকবাল রোডের দিক থেকে তারা বাইক চালিয়ে আসতে থাকে। প্রবর্তনার ফটকের কাছাকাছি এসে ককটেল বা এ রকম কোনো বস্তু ফেলে। সেখানে ধোঁয়া ওঠে এবং প্রচণ্ড শব্দ হয়।’
মো. তানভীর আহমেদ বলেন, বিস্ফোরণের এ সময় রাস্তায় লোকজন চলাচল করছিল। এতে যে কেউ আঘাত পেতে পারত। কিন্তু কিছু হয়নি।
প্রবর্তনার সামনের অংশ