ময়মনসিংহে পুরোনো ব্রহ্মপুত্র নদের তীরে বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসের প্রায় ২৪ একর জায়গাজুড়ে বিরল প্রজাতির উদ্ভিদের সংগ্রহ নিয়ে ১৯৬৩ সালে বোটানিক্যাল গার্ডেন প্রতিষ্ঠা করা হয়।
এই বোটানিক্যাল গার্ডেনে গিয়েছিলাম চলতি বছরের ১০ মে। প্রকৃতিতে তখন বৈশাখের শেষ। খুব গরম পড়েছিল সেদিন। তারপরও নতুন কোনো উদ্ভিদের সন্ধান পাই কি না, কোনো উদ্ভিদে ফুল ফুটল কি না, তা দেখার কৌতূহলের কারণেই যাওয়া।
বাগানের বিভিন্ন পথ দিয়ে হাঁটছিলাম আর দুই পাশের উদ্ভিদ দেখছিলাম। হঠাৎ হাঁটাপথের এক জায়গায় গ্রিলের প্রবেশপথের গায়ে দেখা পেলাম উজ্জ্বল লাল রঙের আকর্ষণীয় একধরনের ঝুমকোলতা ফুলের। গ্রিলের পেছনে এক দেবদারুগাছের ডালপালা ঝুলে আছে। লতার গা আলো করে ফুটে আছে প্যাশন ফ্লাওয়ার। খুব ভালো লাগল। গরম আর ক্লান্তি গেলাম ভুলে। এই উদ্ভিদের ফুল এই প্রথম দেখলাম। ছবি তুলে ফেললাম ঝটপট। সুগন্ধ আছে এ ফুলের। তাই ইংরেজিতে এই ফুল পারফিউমড প্যাশন ফ্লাওয়ার নামে পরিচিত। আর এর পাতা আঙুরের পাতার মতো বলে আরেক নাম গ্রেপ লিভড প্যাশন ফ্রুট। এই উদ্ভিদের বৈজ্ঞানিক নাম Passiflora vitifolia, এটি Passifloraceae পরিবারের লতানো উদ্ভিদ। প্যাসিফ্লোরা গণে ৫০০-৫৫০টি প্রজাতি রয়েছে। এর বেশির ভাগই লতানো উদ্ভিদ। প্যাসিফ্লোরা এডুলিসের ফল প্যাশন ফ্রুট হিসেবে জনপ্রিয় এবং বাণিজ্যিক ভিত্তিতে চাষ করা হয়।
গ্রেপ লিভড প্যাশন ফ্রুট উদ্ভিদের কাণ্ড সরু। উদ্ভিদের পাতার গোড়ায় একজোড়া গ্রন্থি থাকে। পাতা চকচকে, চামড়ার মতো, গাঢ় সবুজ, তিনটি খণ্ডযুক্ত। এটি শক্তিশালী এক লতা। গ্রীষ্মের শুরু থেকে শরৎ পর্যন্ত এতে উজ্জ্বল লাল ফুল ফোটে। ফুল ২০ সেন্টিমিটার পর্যন্ত প্রশস্ত হয়। ফুলে লাল, সাদা বা হলুদ ফিলামেন্ট থাকে। এর ফুলের গঠন এমনভাবে তৈরি যে এটি হামিংবার্ড বা প্রজাপতির মাধ্যমে পরাগায়িত হয়।
কচি অবস্থায় নলাকার এই লতা লাল-বাদামি লোমে ঢাকা থাকে। পাতাগুলো তিন খণ্ডযুক্ত, ১৫ সেন্টিমিটার পর্যন্ত লম্বা এবং ১৮ সেন্টিমিটার পর্যন্ত চওড়া। ফুলগুলো অত্যাশ্চর্য, উজ্জ্বল লাল, ব্যাস ৯ সেন্টিমিটার পর্যন্ত হয়। ফুল কুঁড়ি অবস্থায় লাল শিরাসহ তিনটি উজ্জ্বল গেরুয়া রঙের ব্র্যাক্ট দিয়ে আবৃত থাকে। প্রস্ফুটিত হওয়ার পর তীব্র উজ্জ্বল লাল রঙের বৃতি ও পাপড়ি দেখা যায়। বৃত্যংশগুলোর একটি সূক্ষ্ম শীর্ষ থাকে। পরাগদণ্ড ও গর্ভদণ্ডগুলো লাল রঙের হয়।
ফল হলদে সবুজ। ফল ৫ সেন্টিমিটার লম্বা ও ৩ সেন্টিমিটার চওড়া হয়। এই ফল সামান্য পাতলা লোমসহ সবুজ মাংসযুক্ত। ফলের মধ্যে অসংখ্য বীজ থাকে। এ ছাড়া ফলের গায়ে সাদা বিন্দু থাকে। ফল দেখতে ডিমের মতো।
এই উদ্ভিদের বহুবর্ষজীবী মূল রয়েছে। কাণ্ড বর্ষজীবী থেকে বহুবর্ষজীবী। উদ্ভিদ ৫-২০ মিটার লম্বা, মাঝেমধ্যে ৩০ মিটার পর্যন্ত লম্বা হতে পারে। এরা মাটির ওপর হামাগুড়ি দিয়ে চলে এবং অন্য গাছপালা বা গ্রিলকে আঁকশির সাহায্যে আঁকড়ে ধরে ওপরে উঠে যায়।
এই উদ্ভিদের ফুল যেমন বাগানের শোভা বাড়িয়ে দেয়, তেমনি এর ফলও খাওয়া যায়। এর আদি নিবাস দক্ষিণ–মধ্য আমেরিকা (কোস্টারিকা, নিকারাগুয়া, পানামা) এবং উত্তর-পশ্চিম ও দক্ষিণ আমেরিকা (ভেনেজুয়েলা, কলম্বিয়া, ইকুয়েডর, পেরু)। এসব অঞ্চলে এর ভোজ্য ফলটি মাঝেমধ্যে বন থেকে সংগ্রহ করা হয় এবং স্থানীয়ভাবে খাওয়া হয়। যদিও এই ফল ব্যাপকভাবে সমাদৃত নয়।
কাণ্ডের কাটিং এবং বীজ থেকে উদ্ভিদের বংশবৃদ্ধি করা হয়। লতার গায়ে উদারভাবে ফুল ফোটায় কাটিং থেকে তৈরি উদ্ভিদ। বীজ থেকে উৎপন্ন গাছে ফুল ফোটার নিশ্চয়তা নেই। তাই কাটিং পদ্ধতিই জনপ্রিয়।
গাছ থেকে পড়ে গেলে এর ফল টক হয়। এক মাস সময় নিয়ে পাকলে স্বাদ স্ট্রবেরির মতো হয়। সুগন্ধি ফলের কারণে ক্যারিবীয় অঞ্চলে ছোট আকারে এই উদ্ভিদের চাষ করা হয়।
চয়ন বিকাশ ভদ্র: অধ্যাপক, উদ্ভিদবিজ্ঞান বিভাগ, মুমিনুন্নিসা সরকারি মহিলা কলেজ, ময়মনসিংহ
.উৎস: Prothomalo
এছাড়াও পড়ুন:
কম্পিউটারবিজ্ঞানে স্নাতক আফিফুরের গফরগাঁওয়ে প্রযুক্তি শিক্ষার উদ্যোগ
তথ্যপ্রযুক্তির যুগে বাংলাদেশি তরুণেরা যেখানে বিদেশে পাড়ি জমান ভালো চাকরির আশায়, সেখানে ময়মনসিংহের আফিফুর রহমান বেছে নিয়েছেন ভিন্ন পথ। কম্পিউটারবিজ্ঞান ও প্রকৌশলে পাস করে দেশের বাইরে নয়, ফিরে গেছেন নিজ উপজেলায়, ময়মনসিংহের গফরগাঁওয়ের ষোলহাসিয়া গ্রামে। প্রযুক্তির জ্ঞানকে ছড়িয়ে দিয়ে গড়ে তুলছেন ভবিষ্যতের ডিজিটাল নাগরিকদের।
মানবসম্পদ গড়ার কারিগর
আফিফুর রহমান, বর্তমানে একজন তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তি (আইসিটি) শিক্ষক ও প্রশিক্ষক। ২০১৭ সালে প্রথম ৩ জন শিক্ষার্থী নিয়ে তাঁর বন্ধুর কোচিং সেন্টারের একটি কক্ষে শুরু করেন টিউশনি। দিন দিন শিক্ষার্থীর সংখ্যা বাড়লে তিনি আলাদা একটি কক্ষ ভাড়া নিয়ে পড়ানো শুরু করেন। এরই ধারাবাহিকতায় ২০২০ সালে তিনি প্রতিষ্ঠা করেন আধুনিক প্রযুক্তিসম্পন্ন কোরডেফট আইসিটি প্রাইভেট প্রোগ্রাম ও কোরডেফট কম্পিউটার ট্রেনিং ইনস্টিটিউট। কোরডেফট আইসিটি প্রাইভেট প্রোগ্রামের আওতায় পড়ানো হয় উচ্চমাধ্যমিক স্তরের আইসিটি বিষয় এবং কোরডেফট কম্পিউটার ট্রেনিং ইনস্টিটিউটে শেখানো হয় বাংলাদেশ কারিগরি শিক্ষা বোর্ডের অধীনে ৩ মাস ও ৬ মাস মেয়াদি সার্টিফিকেট ইন কম্পিউটার অফিস অ্যাপ্লিকেশন কোর্স এবং সেই সঙ্গে ৩ মাস মেয়াদি গ্রাফিক ডিজাইন কোর্স।
আফিফুরের চাকরিজীবন
ঢাকার আমেরিকান ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি বাংলাদেশ (এআইইউবি) থেকে বিজ্ঞান ও প্রকৌশলে স্নাতক (সম্মান) হয়ে আফিফুরের লক্ষ্য ছিল উচ্চতর ডিগ্রির জন্য বিদেশে যাওয়া। পরিবারে একমাত্র ছেলে হওয়ায় বাবা-মায়ের আপত্তিতে সেই স্বপ্ন স্থগিত রাখেন। সিদ্ধান্ত নেন, দেশেই পেশাজীবন গড়বেন। পরবর্তী সময়ে একটি বহুজাতিক প্রতিষ্ঠানে চট্টগ্রামে চাকরির সুযোগ পেয়েও সেখানে না গিয়ে নিজ জেলা ময়মনসিংহের ক্যাপিটাল কলেজে শিক্ষকতা শুরু করেন।
চোখ বাঁচাতে চাকরি ছাড়েন
পরবর্তী সময়ে তিনি ঢাকায় দুটি কোম্পানিতে ওয়েব ডেভেলপার হিসেবে কাজ করেন। একটিতে ৬ মাস ও অন্যটিতে ৩ মাসের মতো চাকরি করেন। সে জায়গায় কাজটি ছিল সম্পূর্ণ কম্পিউটার–নির্ভর। কয়েক মাস পরই তাঁর জন্য চাকরিটি করা কঠিন হয়ে পরে। দীর্ঘ সময় কম্পিউটার পর্দায় তাকিয়ে থাকার কারণে, আফিফুরের চোখে দেখা দেয়, ‘ড্রাই আই সিনড্রোম’। চিকিৎসকের পরামর্শ নিলে তাঁরা জানান, দীর্ঘ সময় কম্পিউটারে কাজ করা আফিফুরের জন্য বিপজ্জনক হতে পারে। অনতিবিলম্বে তাঁকে পেশা পরিবর্তনের পরামর্শ দেন চিকিৎসকেরা। চোখ বাঁচাতে চাকরি ছাড়েন আফিফুর। এরপর ভিন্ন ভিন্ন পেশায় কয়েকটি চাকরি সন্ধান করেন। কিন্তু আশানুরূপ না হওয়ায় সিদ্ধান্ত নেন নিজ গ্রামে ফিরে যাওয়ার।
নিজ এলাকায় ফিরে যাওয়া
নিজ উপজেলা ময়মনসিংহের গফরগাঁও ফিরে গিয়ে পুরোনো বন্ধুদের সঙ্গে যোগাযোগ বাড়ান। ধীরে ধীরে দেখলেন, তিনি ছাড়া বন্ধুরা সবাই ব্যস্ত, বারবার আড্ডা দিতে ডাকলে তাঁরাও কিছুটা বিরক্তই হন। খোঁজ নিয়ে জানলেন, বেশির ভাগ বন্ধুই মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিকের ইংরেজি, পদার্থ, গণিত ইত্যাদি বিষয়ে প্রাইভেট পড়াচ্ছেন। পরবর্তী সময়ে বন্ধুদের উৎসাহে তিনি অবসর সময় কাটানোর জন্য মাত্র ৩ জন শিক্ষার্থী নিয়ে প্রাইভেট পড়ানো শুরু করেন।
ক্লাস নিচ্ছেন আফিফুর রহমান