ছেলেমেয়েকে ২০ কোটি টাকার শেয়ার উপহার দিলেন বাবা
Published: 10th, November 2025 GMT
নিজের দুই সন্তানকে ২০ কোটি টাকার সমমূল্যের শেয়ার উপহার দিলেন বাবা। শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত ক্রাউন সিমেন্টের উদ্যোক্তা–পরিচালক মোহাম্মদ আলমাস শিমুল তাঁর দুই সন্তানকে কোম্পানিটির ২০ লাখ করে মোট ৪০ লাখ শেয়ার উপহার দিয়েছেন। এরই মধ্যে এই শেয়ার হস্তান্তরের প্রক্রিয়াও সম্পন্ন হয়েছে।
দেশের প্রধান শেয়ারবাজার ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) মাধ্যমে আজ সোমবার উপহারের এই শেয়ার হস্তান্তরের বিষয়টি জানিয়েছে ক্রাউন সিমেন্ট উদ্যোক্তা–পরিচালক আলমাস শিমুল। বর্তমানে তিনি কোম্পানিটির পরিচালনা পর্ষদেও রয়েছেন। জানা যায়, দ্বিতীয় প্রজন্মকে ব্যবসার সঙ্গে যুক্ত করার পরিকল্পনার অংশ হিসেবে প্রথম প্রজন্মের উদ্যোক্তা হিসেবে নিজেদের হাতের শেয়ারের একটি অংশ সন্তানদের মধ্যে হস্তান্তর করা হচ্ছে। তারই অংশ হিসেবে আলমাস শিমুল তাঁর ছেলে সায়হাম সাদিক পিয়াল ও মেয়ে শোভা সোহাকে ২০ লাখ করে মোট ৪০ লাখ শেয়ার উপহার হিসেবে হস্তান্তর করেছেন। ঢাকার বাজারে আজ সোমবার ক্রাউন সিমেন্টের প্রতিটি শেয়ারের বাজারমূল্য ছিল প্রায় ৫১ টাকা। সেই হিসাবে ৪০ লাখ শেয়ারের বাজারমূল্য দাঁড়ায় ২০ কোটি ৪০ লাখ টাকা।
শেয়ার উপহার দেওয়ার কারণ জানতে চাইলে আলমাস শিমুল প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা ব্যবসায় সক্রিয় থাকতে থাকতে আমাদের পরবর্তী প্রজন্মকে ব্যবসার উত্তরাধিকার হিসেবে যোগ্য ও দক্ষ করে তুলতে চাই। এ কারণে তাদের মধ্যে শেয়ারের ন্যূনতম মালিকানা হস্তান্তরের পাশাপাশি ব্যবসায়ও যুক্ত করা হচ্ছে, যাতে তারা দেশ ও কোম্পানির জন্য এখন থেকেই যোগ্য হয়ে উঠতে পারেন। এ ছাড়া আমাদের ব্যবসার পরিধিও এখন অনেক বড় হয়েছে। তাই আমরা তাদের ওপর কিছু দায়িত্ব দিয়ে নতুন নতুন ব্যবসাকে আরও এগিয়ে নিতে বেশি মনোযোগী হতে চাই।’
বিশ্বজুড়ে শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত কোম্পানিগুলোর মধ্যে উত্তরাধিকার নির্ধারণের প্রক্রিয়াটি সহজে হয়ে থাকে শেয়ার হস্তান্তরের মাধ্যমে। বাংলাদেশেও শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত ভালো কোম্পানিগুলোর ক্ষেত্রে গত কয়েক বছরে এ প্রবণতা দেখা যাচ্ছে। এরই মধ্যে ক্রাউন সিমেন্টের অন্য পরিচালকেরাও শেয়ার হস্তান্তরের মাধ্যমে তাঁদের একাধিক সন্তানকে ব্যবসায় যুক্ত করেছেন।
জানা যায়, আলমাস শিমুলের ছেলে সায়হাম সাদিক কানাডা থেকে স্নাতক সম্পন্ন করে এরই মধ্যে বাবার সঙ্গে ব্যবসায় যুক্ত হয়েছেন। আর মেয়ে শোভা সোহা মালয়েশিয়ায় পড়াশোনা করছেন।
পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) বিধান অনুযায়ী, শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত কোনো কোম্পানির পরিচালক হতে হলে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিকে ওই কোম্পানির ন্যূনতম ২ শতাংশ শেয়ার ধারণ করতে হয়। তাই ক্রাউন সিমেন্টের দ্বিতীয় প্রজন্মের প্রতিনিধিদের পর্ষদে আসতে হলে ওই কোম্পানির ন্যূনতম ২ শতাংশ শেয়ার তাঁদের হাতে থাকতে হবে। আর ২ শতাংশ শেয়ার ধারণের এই শর্ত পূরণ করতে হলে বর্তমানে কোম্পানিটির ২৯ লাখ শেয়ারের দরকার হবে।
ক্রাউন সিমেন্ট ২০১১ সালে শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত হয়। এটি শেয়ারবাজারে ভালো মানের কোম্পানি হিসেবে ‘এ’ শ্রেণিভুক্ত। ডিএসইর তথ্য অনুযায়ী, কোম্পানিটির শেয়ারের অর্থাৎ মালিকানার ৫২ শতাংশের বেশি রয়েছে উদ্যোক্তা–পরিচালকদের হাতে। আর ব্যক্তিশ্রেণির সাধারণ বিনিয়োগকারীদের হাতে রয়েছে প্রায় ২৯ শতাংশ শেয়ার। বাকি প্রায় ১৯ শতাংশ শেয়ারের মালিকানায় রয়েছে প্রাতিষ্ঠানিক ও বিদেশি বিনিয়োগকারীরা।
.উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: ক র উন স ম ন ট র শ য় র উপহ র দ আলম স শ ম ল শ য় রব জ র উদ য ক ত ব যবস য় প রজন ম ৪০ ল খ
এছাড়াও পড়ুন:
ডিসেম্বর যা বলেছিল
১. শহর এক রূপকথা
আমার ধারণা কাজটা অর্ফিয়ুস করেছিল ইচ্ছা করেই। মৃত্যুর জগৎ থেকে ইউরিডিসকে নিয়ে যখন সে ফিরে আসছিল জীবন আর আলোর জগতে, তার মাথার ওপরে হেডিসের সেই শর্ত যে পেছন ফিরে তাকানো যাবে না।
তবু অর্ফিয়ুস ফিরে তাকিয়েছিল, যদিও তখনো সে ভুলে যায়নি যে পেছনে ফিরে তাকালেই তার আর ইউরিডিসকে নিয়ে ফেরা হবে না, ইউরিডিস তখনই অদৃশ্য হয়ে যাবে, থেকে যাবে মৃত্যুর জগতে। তারপরও, সচেতনভাবেই, ইচ্ছা করেই অর্ফিয়ুস ফিরে তাকাল পেছন দিকে।
পুরো ঘটনার মধ্যে শেষে এসে শুধু পেছন ফিরে তাকানোর কারণে অর্ফিয়ুসের ইউরিডিসকে মৃত্যুর জগৎ থেকে ফিরিয়ে আনতে আনতেও আর ফিরিয়ে আনা হলো না। শুধু ওইটুকু, ওই অনুশোচনা করবে বলে, ওই আফসোস যুগ যুগ ধরে চলবে বলে অর্ফিয়ুস ইচ্ছা করেই পেছনে তাকিয়েছিল। একটা অনুতাপবিহীন, অনুশোচনাবিহীন জীবন আর কে চায়! মানুষ তো দূরের কথা, দেবতারাও অনুতাপবিহীন জীবন চায় না!
যা হয় আর যা হতে পারত, এর মধ্যে জীবন সব সময় টিকে থাকে যা যা হতে পারত, সেই অনুশোচনার মধ্যে।
সমগ্র মানবজাতি তার অস্তিত্ব নিয়ে গিয়ে ঠেকায় সেই এক সামষ্টিক অনুশোচনাতেই—আদম গন্ধম ফল খেয়েছিল কেন! এত এত নিষেধ সত্ত্বেও কেন তাকে ওই গন্ধম ফল খেতে হলো! আর কেন ছেড়ে আসতে হলো সেই ফুলের বাগান আর ফলের বাগান আর বিশাল পর্বত আর বিস্তৃত উপত্যকার ওই এডেন! কেন ওই জান্নাত আর ওই বেহেশত ছেড়ে আসতে হল দুর্দশা আর যন্ত্রণার পৃথিবীতে! অনুশোচনার বাইরে আর কোথায় জীবন!
মাঝে মাঝে ভোরবেলায় আমার ঘুম ভেঙে অচেনা নতুন কোনো শহরে জেগে উঠতে ইচ্ছা করে। একটা সময় জীবন এমন এক জায়গায় এসে পৌঁছায়, যখন নতুন কোনো মানুষের সাথে পরিচিত হওয়ার ইচ্ছা আর শক্তি অবশিষ্ট থাকে না। আমি নিশ্চিত যে সেই সময় চলে এসেছে, জীবন আমাকে সেই জায়গায় নিয়ে এসেছে।
এক শহরের কোনো এক ডিপার্টমেন্টাল স্টোরে ক্লোজ সার্কিট ক্যামেরা ছিল আর তাই শৈশবে আমি কখনো কখনো সেই দোকানের ভেতরের কোনায় গিয়ে দাঁড়াতাম টেলিভিশন স্ক্রিনে নিজেকে দেখার জন্য। আরেক শহরে আমার স্কুল থেকে ফেরার পথের রাস্তায় স্টেডিয়ামের উলটা দিকে ছিল এক অদ্ভুত পুকুর। একটা শহরে ছিল সারি সারি রেলগেট। একটা শহরে হেমন্ত নেমে আসত শরৎকাল শেষ হওয়ার আগেই। আর শীতকালে রাত দশটার পর কোথা থেকে সাদা কুয়াশা নেমে এসে আচ্ছন্ন করে দিত চারদিক আর আমি রিকশায় করে ঘরে ফিরতাম।
মাঝে মাঝে ভোরবেলায় আমার ঘুম ভেঙে অচেনা নতুন কোনো শহরে জেগে উঠতে ইচ্ছা করে। একটা সময় জীবন এমন এক জায়গায় এসে পৌঁছায়, যখন নতুন কোনো মানুষের সাথে পরিচিত হওয়ার ইচ্ছা আর শক্তি অবশিষ্ট থাকে না। আমি নিশ্চিত যে সেই সময় চলে এসেছে, জীবন আমাকে সেই জায়গায় নিয়ে এসেছে।যেসব শহরে আমি বেড়ে উঠেছি, বড় হয়েছি যেসব শহরে, আমার আত্মা হরক্রাক্সের মতো অবিনশ্বর ও খণ্ড খণ্ড হয়ে ছড়িয়ে আছে সেসব শহরে। কোনো মানুষের কাছে নয়, সেসব শহরে ছড়িয়ে আছে আমার আত্মার একেকটা অংশ। সেই সব খণ্ডাংশ খুঁজে খুঁজে সংগ্রহ করার ইচ্ছা হয় না আমার।
তবে মাঝে মাঝে আমার শুধু ইচ্ছা করে ভোরবেলা নতুন অচেনা কোনো শহরে ঘুম ভেঙে জেগে উঠতে। এর মধ্যে কোনো একদিন হয়তো মার্কো পোলোর মতো আমাকে হাজির হতে হবে কুবলাই খানের মতো কারও দরবারে। আর সেই সব শহরের গল্প শোনাতে হবে তাকে। সেই সব না দখল করতে পারা শহরের গল্প শুনে আমি তার ভেতরে, সেই কুবলাই খানের ভেতরে ক্ষমতার অভিমান জেগে উঠতে দেখব। ক্ষমতার অভিমানের চেয়ে তীব্র আর কী আছে!
আর আমি তাকে সেই শহরের কথাও বলব, যে শহরে আমার ডোরসিয়া কাজানের সাথে দেখা হয়েছিল, যে শহরে আমি বারবার ফিরতে চেয়েছি বা আমি আসলে কখনো ওই শহর ছেড়ে আসতেই পারিনি।
২. দূর থেকে ভেসে এল কোন গান?সকালে ঘর থেকে বের হয়ে দরজা বন্ধ করার সময় দেখলাম, সিঁড়ির ল্যান্ডিংয়ে চশমা পরা ছোটখাটো এক বৃদ্ধ লোক দাঁড়িয়ে আছেন। এতটাই বৃদ্ধ যে বেশি লম্বা না হলেও বয়সের ভারে ঝুঁকে পড়েছেন সামনের দিকে। তাতে আরও খর্বাকৃতির মনে হয় তাঁকে। এক হাতে বুকের কাছে একটা বই ধরে রাখা, আরেক হাতে একটা লাঠিতে ভর দেওয়া।
আমাকে দেখে ‘হ্যালো’ বললেন। উত্তরে আমিও ‘হ্যালো’ বলে জিজ্ঞেস করলাম, আর ইউ আ গেস্ট?
হাসলেন তিনি। বললেন, নো নো, দিস ইজ মাই প্লেস। মাই সন...
আমি বললাম, ওহ! ইউ আর হেমরাজ’স ফাদার?
উনি বললেন, ইয়েস। ইউ কেম হিয়ার অন ফ্রাইডে?
আমি বললাম, হ্যাঁ। জিজ্ঞেস করলাম, কী বই আপনার হাতে?
উনি বললেন, এটা নেপালি ভাষায় লেখা একটা বই। ধর্মের ওপরে।
জিজ্ঞাসা করলাম, হুইচ রিলিজিয়ন? বুদ্ধিস্ট?
উনি মাথা নাড়লেন। বললেন, না না। এটা কবীরপন্থার ওপরে লেখা। আমরা কবীরপন্থার অনুসারী, দ্যাটস হোয়াই উই আর ভেজিটেরিয়ান।
আমি জানতাম, ওনাদের পরিবার ক্রিশ্চিয়ান। কিন্তু ক্রিশ্চিয়ান হওয়ার পরও কেন নিরামিষাশী, এই জিজ্ঞাসা আমার ভেতরে আগে আসছে কয়েকবার। আজ বিষয়টা পরিষ্কার হলো।
আমি বললাম, আমি মুসলিম, তবে আমি কবীরের সম্পর্কে একটু একটু জানি। কবীরের ভজন আমার পছন্দ।
উনি হাসছিলেন। ভদ্রলোক খুব সুন্দর করে হাসেন।
আমি জিজ্ঞেস করলাম, আপনি শুধু নেপালি ভাষার বই পড়েন?
উনি একটু উত্তেজিত হয়ে উঠলেন। বললেন, না না। নেপালি, হিন্দি, ইংরেজি, বাংলা... সব পড়ি
আমি অবাক হলাম। বললাম, বাংলা পড়তে পারেন?
উনি উত্তর দিলেন, হ্যাঁ, আমি সুন্দর বাংলা বলতেও পারি। আমি শিলিগুড়িতে অনেক লম্বা সময় ধরে ছিলাম।
আমি এবার বাংলায় কথা বলা শুরু করলে উনি বললেন, ইউ আর বেঙ্গলি?
আমি বললাম, হ্যাঁ।
এরপর আর দুয়েকটা বাক্য বাংলাতেই হলো। বললাম, পরে আবার কথা হবে আপনার সাথে।
উনি মাথা নাড়লেন। বললেন, না না। এটা কবীরপন্থার ওপরে লেখা। আমরা কবীরপন্থার অনুসারী, দ্যাটস হোয়াই উই আর ভেজিটেরিয়ান। আমি জানতাম, ওনাদের পরিবার ক্রিশ্চিয়ান। কিন্তু ক্রিশ্চিয়ান হওয়ার পরও কেন নিরামিষাশী, এই জিজ্ঞাসা আমার ভেতরে আগে আসছে কয়েকবার। আজ বিষয়টা পরিষ্কার হলো।কাল রাতে অর্ডার করা কেএফসির দুই পিস চিকেন ছিল, হাতে করে নিয়ে ডাইনিংয়ে এসেছিলাম। কিচেনের দিদিকে বললে উনি ওভেনে গরম করে দিলেন।
ওনাদের তরফ থেকে আজ আমাকে দিয়েছিল পরিজ, ব্রেড, বাটার, জ্যাম আর কলা। একটা ব্রেড যখন আমি অর্ধেকের বেশি খেয়ে ফেলেছি, তখন আমাকে থামতে বললেন কিচেনের উনি। বললেন, ব্রেড আসতেছে, আমি যেন ওইটা না খাই। সম্ভবত দেওয়ার পরে মনে পড়েছে যে ফ্রেশ ব্রেড দেওয়া উচিত। আমি রেখে দিলাম।
এরপর কেএফসির ওই বিস্বাদ চিকেন যখন শেষ করে ফেলেছি, তখন ব্রেড আর গ্রোসারির ব্যাগ নিয়ে হেমরাজ ঢুকল। আমার প্লেটের দিকে তাকাতেই ব্যস্ত হয়ে উঠল।
হেসে বলল, ইউ আর হ্যাভিং মিট ওভার হিয়ার!?
আমি বললাম, আই ওয়াজ কনফিউজড, সো আই আস্কড দিদি। কিন্তু আমাকে না করেনি। আমি আসলে স্যরি।
হেমরাজ বলল, ইয়েস। ইউ আর নট অ্যালাউড টু হ্যাভ মিট ইন দ্য ডাইন-ইন।
আমাকে একজন বলেছে যে এক সাইকিয়াট্রি ইউনিটে এক পেশেন্ট নাকি ‘স্টেয়ারওয়ে টু হ্যাভেন’ লেড জেপলিনের চেয়ে সুন্দর করে গাইতে থাকে।
তাই আমি স্টেয়ারওয়ে টু হ্যাভেন শুনে এই সকাল সকাল যদি ব্রেইন ড্যামেজ না শুনতে থাকতাম, তাহলে কবীরের ভজন শুনতাম। যূথিকা রায়ের গাওয়া, ‘ঘুঙ্ঘট কে পাট খোল রে, তোহে পিয়া মিলেঙ্গে…’
৩. জানালার বাইরে মেঘ, তারপরই সন্ধ্যাজ্বর আর প্রচণ্ড ঠান্ডা-সর্দির কারণে ঘরের ভেতরে রুম হিটার ছেড়ে সারা দিন জানালার পাশে বসে বসে বইয়ের পাতা ওলটানো ছাড়া আর কিছুই করি নাই আজকে, কিছুই করতে চাইও নাই। অবশ্য আজ যে ঘরের বাইরে বের হব না, সেটা কাল রাতেই ঠিক করা ছিল।
দুপুরের পরে যখন তাপমাত্রা কমে এল আর মেঘ এসে সামনের পাহাড় এবং পাহাড়ের ঢালে শহরের সবকিছু ঢেকে দিচ্ছিল, আমার আসলে এর উল্টাটা মনে হচ্ছিল। মনে হচ্ছিল, সাদা মেঘের ভেতর থেকে শহরটা জেগে উঠছে আমার সামনে। আমি জানালার কাচ সরিয়ে দেখছিলাম। সেই গল্পের কথা মনে পড়ছিল যেখানে মরুভূমি অঞ্চলের বাসিন্দারা মাঝে মাঝে আকাশে মেঘের আড়াল থেকে বিশাল এক শহর ভেসে উঠতে দেখে। তারা সেটাকে বলে স্বর্গের শহর।
আরেকবার জানালার বাইরে চোখ ছিনিয়ে নেওয়ার মতো দৃশ্য দেখা দিল সন্ধ্যার ঠিক আগে আগে। অন্ধকার নামার ঠিক আগে, আরবিতে যে সময়টাকে বলে আলঘাসাক, আকাশ কালো হয়ে আসছে আর তখনো হালকা মেঘ জড়িয়ে আছে পাহাড়ের ঢালের ওই শহরকে, পুরো শহরে আলো জ্বলে উঠল আর জ্বলজ্বল করতে থাকল। আমি আবার জানালার কাচ সরিয়ে দিলাম। আর কেউ যেন তখন হাজার হাজার মাইল দূর থেকে কানে কানে ফিসফিস করে বলল, আ সিটি অব ফেইরি টেইলস!
আমি তাকে শোনালাম সমতলের মাছেদের গল্প। কীভাবে নদীর মাছের স্বাদ হাজার গুণে আলাদা বদ্ধ জলাশয়ের মাছেদের স্বাদ থেকে। শোনালাম আমাদের সমতলে টাইগার প্রন বা গলদা চিংড়ির কেমন প্রাচুর্য। আর শোনালাম বাংলার রকস্টারদের গল্প। অঞ্জন দত্তের গাওয়া আমার প্রিয় গান, জেরেমির বেহালা এবং মেরি অ্যান।একটা লাইন মনে পড়ল আমার—ডাস্ক, সাইলেন্স, আয়রন চিল; সামথিং লোনলি ইন দ্য বোন। নাহ, নাথিং লোনলি ইন দ্য বোন।
বরং এই লাইনটা ভালো, জ্বলজ্বল করতে থাকা ওই শহর যখন আমার সামনে, দেয়ার ইজ আ লেডি হু ইজ শিওর, অল দ্যাট গ্লিটারস ইজ গোল্ড। ওই শহরের নাম যেন এরেবর, লর্ড অব দ্য রিংসের সেই এরেবর।
আর দুই শ টাকা দিয়ে যে পরিমাণ কমলালেবু আনালাম, এক ব্যাগ; মনে হচ্ছিল, জীবনানন্দ দাশের কবিতার সংখ্যা আর দুই শ টাকার কমলালেবুর সংখ্যা সমান।
নিচে নামতে হয়েছিল, তিনবেলায় তিনবার শুধু। খাওয়ার জন্য। এর মধ্যে সকালের নাশতার পরে আর রাতে খাওয়ার সময় হেমরাজের সাথে কয়েক ঘণ্টা গল্প হলো।
হেমরাজ আমাকে শোনাল কেন ট্রাউট মাছ শুধু পাহাড়েই পাওয়া যায়; আর তার রক মিউজিক ক্যারিয়ারের গল্প। গ্লেনারির মিউজিক দেখাশোনা করার সময় কত সালে যেন অঞ্জন দত্ত তাকে অনুরোধ করে জোর করে পাঁচ মিনিটের জন্য সিনেমায় অভিনয় করিয়েছিল।
শোনাল বারো বছর সে কাঠমান্ডুতে শুধু সময় দিয়েছে তার ব্যান্ড রাস্টি নেইলের জন্য। শোনাল, প্রতি শনিবার সন্ধ্যায় সে গ্লেনারিতে বিটলস আর এলভিস প্রিসলি গায়। প্রথম অ্যালবাম করার সময় সে কীভাবে তিনিদিন ট্রেনে জার্নি করে তার বিশাল ড্রামস সেট নিয়ে গিয়েছিল মুম্বাইতে। আর সকালেই তখন, আমাকে নিয়ে গিয়ে দেখাল তার প্র্যাকটিস রুম আর ছোট স্টুডিও।
আর আমি সকালে তাকে শোনালাম সমতলের মাছেদের গল্প। কীভাবে নদীর মাছের স্বাদ হাজার গুণে আলাদা বদ্ধ জলাশয়ের মাছেদের স্বাদ থেকে। শোনালাম আমাদের সমতলে টাইগার প্রন বা গলদা চিংড়ির কেমন প্রাচুর্য। আর শোনালাম বাংলার রকস্টারদের গল্প। বললাম, অঞ্জন দত্তের গাওয়া আমার প্রিয় গান, জেরেমির বেহালা এবং মেরি অ্যান। সে কখনো শোনেনি অঞ্জন দত্ত, আর তাই তাকে মোবাইলে প্লে করে শোনালাম সেই ভায়োলিন প্লেয়ার ভূতের গান—জেরেমির বেহালা। আর শোনালাম, জেমসের ‘আমি তারায় তারায় রটিয়ে দেব…’
আর রাতের আলাপে গুর্খা রেজিমেন্ট, তার ছেত্রী পদবি, অ্যাডভেঞ্চার, স্নো লিওপার্ডসহ আরও আরও গল্পে ঘুরেফিরে এল আবার সেই মিউজিক। আমি মেঘালয়ের চেরি ব্লসম ফেস্টিভ্যালের কথা তুলতেই, হেমরাজ আমাকে শোনাল বব ডিলানের ভক্ত শিলংয়ের এক মিউজিশিয়ান লোউ মাজাউয়ের গল্প। বয়সের কারণে যে লোউ মাজাউয়ের চুল এখন গ্যান্ডালফের মতো রুপালি হয়ে গেছে।
আর আমি তাকে বললাম, কেন আমি ভালোবাসি পাহাড়, কেন পাহাড়কে পবিত্র জ্ঞান করা সত্ত্বেও শেরপারা ভারবাহী পোর্টার হয়ে অভিযাত্রীদের পথ দেখিয়ে নিয়ে যায় এভারেস্ট, অন্নপূর্ণা, মানাসলু আর লোটসের চূড়ায়, কেন তেনজিং নোরগে এডমান্ড হিলারিকে পাহাড়ে টেনে টেনে তুলেও তাঁকে আগে পা রাখতে দিয়েছিলেন এভারেস্টের চূড়ায়!
????️ অন্য আলোর ফেসবুক পেজ ফলো করুন