চট্টগ্রাম বন্দরের নিউমুরিং টার্মিনাল ‘ডিপি ওয়ার্ল্ড’ নামে আবুধাবির একটি কোম্পানিকে দরপত্র ছাড়া ইজারা দেওয়ার জন্য অন্তর্বর্তী সরকার রীতিমতো জোরজবরদস্তি করছে। চুক্তি সম্পাদিত না হলেও এই কোম্পানির কর্মকর্তারা বন্দরে আসা–যাওয়া করছেন বলে পত্রিকায় খবর বের হয়েছে। প্রধান উপদেষ্টাও এই উদ্যোগের বিরোধীদের প্রতিহত করার আহ্বান জানিয়েছেন। ইতিমধ্যে দেশের অর্থনীতি ও ব্যবসায়ীদের বিপন্ন করে লাভজনক হওয়া সত্ত্বেও বন্দরের সব রকম মাশুল অনেক বাড়ানো হয়েছে। আগে থেকেই বিদেশি কোম্পানির উচ্চ মুনাফা নিশ্চিত করা ছাড়া এর আর কোনো যুক্তি নেই।

চট্টগ্রাম বন্দর বিদেশি কোম্পানির কাছে ইজারা দেওয়ার প্রথম তৎপরতা শুরু হয় ১৯৯৭ সালের দিকে। সে সময় আমরা ক্রমাগত শুনেছি প্রয়োজনের তুলনায় চট্টগ্রাম বন্দরের কর্মক্ষমতা খুবই অপ্রতুল, ভবিষ্যৎ ঝুঁকিপূর্ণ। সুতরাং বলা হয়েছে অবিলম্বে একটি মার্কিন কোম্পানিকে চট্টগ্রাম বন্দরের এলাকা ইজারা দিয়ে বিদেশি কোম্পানির কর্তৃত্বে নতুন কনটেইনার টার্মিনাল না করলে বাংলাদেশ সমূহ বিপদে পড়বে।

আরও পড়ুনচট্টগ্রাম বন্দর: আমাদের সোনার ডিম পাড়া রাজহাঁসটি.

..২৫ অক্টোবর ২০২৫

১৯৯৭ সালের ৩ মার্চ ব্রিটিশ কনসোর্টিয়াম চট্টগ্রাম বন্দর এলাকায় ‘প্রাইভেট পোর্ট’ নির্মাণের প্রস্তাব জমা দেয়। একই বছরের ২৯ ডিসেম্বর প্রস্তাব জমা দেয় মার্কিন এসএসএ কোম্পানি। ১৯৯৮ সালের ২০ ফেব্রুয়ারি একই ধরনের প্রস্তাব জমা দেয় অস্ট্রেলিয়ার পিএনও পোর্ট। ১৯৯৯ সালের ৪ জানুয়ারি লন্ডনের পোর্ট ভেঞ্চার এবং ১৮ জানুয়ারি সিঙ্গাপুর পোর্ট জমা দেয় তাদের প্রস্তাব। এই সব কটি প্রস্তাবের সঙ্গেই দেশের ভেতরে নানা লবিস্ট গোষ্ঠী সক্রিয় হয়ে ওঠে।

চট্টগ্রাম পোর্টেরও নিজস্ব প্রস্তাব ছিল; কিন্তু তার প্রতি মনোযোগ নেই, তা আটকে থাকে ফাইলে। আর দ্রুত বিদেশি কোম্পানিগুলোর মধ্যে সবাইকে ছাড়িয়ে সামনে আসে মার্কিন এসএসএ কোম্পানি। টেন্ডার ছাড়াই তাদের সঙ্গে চুক্তির কার্যক্রম শুরু করে তৎকালীন সরকার।

মার্কিন কোম্পানির কনটেইনার টার্মিনাল স্থাপনের স্থান নির্ধারণ করা হয়েছিল কর্ণফুলীর মোহনায়, চট্টগ্রাম বন্দর থেকে সমুদ্রে বের হওয়ার মুখে। কর্ণফুলী নদীর ডান তীরের পতেঙ্গায় চট্টগ্রাম বন্দর এলাকায় ‘২০ দশমিক ৯৭ একর জমি লিজের মাধ্যমে প্রথম পর্যায়ে ৯৯ বছর মেয়াদে এবং পরবর্তী পর্যায়ে আরও ৯৯ বছরের জন্য ইজারা এবং প্রথম দফায় ৩০ বছর এবং পরবর্তী সময়ে আরও ৬ দফা ৩০ বছর মেয়াদি অর্থাৎ মোট ২১০ বছর মেয়াদি লাইসেন্স প্রদান’ ছিল চুক্তির মূল দিক।

মন্ত্রণালয় এবং বিভিন্ন ‘বিশেষজ্ঞ’ কার্যক্রম কীভাবে এসব কোম্পানির স্বার্থে গোছানো হয়, তা এই সময়ের বিভিন্ন সভার প্রস্তাব, সিদ্ধান্ত ও কমিটি গঠন ইত্যাদি পদক্ষেপ খেয়াল করলে বোঝা যায়। ১৯৯৭ সালে প্রস্তাব জমা দেওয়ার পর তা মন্ত্রিপরিষদের প্রাথমিক সম্মতি পেয়ে নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ে যায়। ২০০০ সালের ১৬ ফেব্রুয়ারি এই প্রস্তাব পরীক্ষা নিরীক্ষা এবং এ নিয়ে এসএসএ কোম্পানির সঙ্গে ‘নেগোসিয়েশনে বিশেষজ্ঞ সার্ভিস প্রদানের জন্য’ মন্ত্রণালয় যাদের সঙ্গে ‘ডেভেলপমেন্ট সার্ভিসেস অ্যাগ্রিমেন্ট’ স্বাক্ষর করে, তারা হলো বিশ্বব্যাংকের অর্থ ও নীতিমালায় পরিচালিত ‘সরকারি’ প্রতিষ্ঠান আইআইএফসি (ইনফ্রাস্ট্রাকচার ইনভেস্টমেন্ট ফ্যাসিলিটেশন সেন্টার)।

২০০১ সালে নতুন সরকার আসে ক্ষমতায়; কিন্তু বন্দর নিয়ে চুক্তির ধারাবাহিকতা চলতে থাকে। বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের ছয়জন সচিবকে সদস্য করে গঠিত ‘সচিব কমিটি’, ৩০ এপ্রিল ২০০২ তাঁদের প্রতিবেদনে এসএসএর প্রকল্পের পক্ষে জোর সুপারিশ করে। বন্দরের উপরিউক্ত প্রকল্পের পক্ষে তদবির বা চাপ দিতে গিয়ে তৎকালীন মার্কিন রাষ্ট্রদূত এই আইআইএফসিকে ‘বিশ্বব্যাংকের প্রতিষ্ঠান’ বলেই অভিহিত করেছেন এবং এর সমীক্ষাকেই সাক্ষী মেনেছেন।

বাংলাদেশের জাতীয় নিরাপত্তা ও অর্থনীতির বিকাশ নিশ্চিত করতে ইজারা কর্মসূচি বাদ দিয়ে কৌশলগতভাবে খুবই গুরুত্বপূর্ণ জাতীয় প্রতিষ্ঠান হিসেবে চট্টগ্রাম ও মোংলা সমুদ্রবন্দরকে বিকশিত করা এবং এর জাতীয় সক্ষমতা বৃদ্ধি একমাত্র করণীয়। জানি যে লুম্পেন ও কমিশনভোগী দৃষ্টিভঙ্গি এই পথে যেতে চাইবে না। জনগণেরই এই পথ তৈরি করতে হবে।

তৎকালীন নৌপরিবহনমন্ত্রীর কাছে মার্কিন কোম্পানির সঙ্গে অবিলম্বে চুক্তি স্বাক্ষরের পক্ষে জোর সুপারিশ করে ‘আগের দিনের আলোচনার সূত্রে’ লেখা চিঠিতে তৎকালীন মার্কিন রাষ্ট্রদূত মেরি অ্যান পিটার্স স্পষ্ট করে বলেন, ‘এর জন্য কোনো টেন্ডারের প্রয়োজন নেই।’ কারণ হিসেবে তিনি বলেন, ‘স্বচ্ছতার সঙ্গে সব আলোচনা অনুষ্ঠিত হয়েছে, বিশ্বব্যাংকের প্রতিষ্ঠান আইআইএফসি এই বিষয়ে কনসালট্যান্ট হিসেবে কাজ করে অনুকূল মতামত দিয়েছে’ ইত্যাদি।

বিশ্বব্যাংকের তৎকালীন কান্ট্রি ডিরেক্টর ফ্রেডরিক টেম্পলও একই সময় এই চুক্তি সম্পাদনের জন্য বারবার তাগিদ দিয়েছেন। ঠিক একই ধারার যুক্তি, একই রকম কর্মপ্রক্রিয়া আমরা এখনো দেখতে পাচ্ছি। নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ের ভূমিকাও একই রকম। আগেরবার পরপর দুই সরকার এবং মার্কিন দূতাবাস, বিশ্বব্যাংক, এডিবি ও আমলা গোষ্ঠীর সম্মিলিত এই সর্বনাশা তৎপরতার বিরুদ্ধে জনগণের বড় এক প্রতিরোধ আন্দোলন তৈরি হয়েছিল। বন্দরশ্রমিকদের আন্দোলনের পাশাপাশি সে সময় এই অপতৎপরতা ঠেকানোর জন্য ‘তেল–গ্যাস–খনিজ সম্পদ ও বিদ্যুৎ–বন্দর রক্ষা জাতীয় কমিটি’ অন্যান্য কর্মসূচির সঙ্গে ঢাকা–চট্টগ্রাম লংমার্চও সংঘটিত করেছিল।

আরও পড়ুনবিদেশি কোম্পানিকে বন্দর ব্যবস্থাপনার ইজারা দেওয়ার ঝুঁকিগুলো কী১৪ জুন ২০২৫

পাশাপাশি আদালতে এ নিয়ে মামলাও হয়। হাইকোর্টে রিট আবেদন করেন চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের সাবেক চেয়ারম্যান প্রকৌশলী মাহমুদ-উল-ইসলামসহ কয়েকজন। তাঁদের পক্ষে মামলা পরিচালনা করেন ড. কামাল হোসেন। তাঁর সঙ্গে ছিলেন হরিসাধন দেব ব্রাহ্মণ। ২০০২ সালের শেষে আদালতের শুনানিতে প্রমাণিত হয়, বন্দর নিয়ে পুরো প্রকল্পটি জালিয়াতিপূর্ণ। মূল কোম্পানির নাম ব্যবহার করে গঠিত নতুন একটি কোম্পানি বন্দর চুক্তির ওপর ভর করে বিপুল পরিমাণ ঋণের ধান্দা করছিল। অথচ এর পক্ষেই দেশি–বিদেশি শক্তিশালী সব পক্ষ কাজ করছিল। আদালতের রায় ও জনপ্রতিরোধে এই জালিয়াতি প্রকল্প শেষ পর্যন্ত বাতিল হয়।

বিদেশি কোম্পানির কাছে বন্দর ইজারা দেওয়ার পক্ষে নীতি প্রণয়নে তখন এবং এখন যেসব যুক্তি জনগণের সামনে হাজির করা হয়, তার মধ্যে অন্যতম হলো বাংলাদেশকে সিঙ্গাপুর বানানোর গল্প; কিন্তু সিঙ্গাপুরের ভৌগোলিক অবস্থান, ইতিহাস এবং অর্থনৈতিক উন্নয়নের নীতি সবই ভিন্ন। অর্থনীতির মূল আয় আসে কাঁচামাল আমদানি ও তা প্রক্রিয়াজাত করে রপ্তানি থেকে। সিঙ্গাপুর বন্দরের শতকরা ৮০ ভাগ তৎপরতা সে জন্য ট্রান্সশিপমেন্টকেন্দ্রিক।

আরও পড়ুনবন্দর পরিচালনা বিদেশিদের দেওয়া কতটা যৌক্তিক১৯ মে ২০২৫

সিঙ্গাপুরের জাতীয় আয় বা জিডিপির বেশির ভাগ আসে এমন অর্থনৈতিক তৎপরতা থেকে যা হয় রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন বা তার নিয়ন্ত্রিত। তদুপরি সিঙ্গাপুরের উন্নয়ন–দর্শন মোটেও বন্দরের মতো একটি কৌশলগতভাবে গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা ব্যক্তিপুঁজি কিংবা বিদেশি কোম্পানির হাতে ছেড়ে দেওয়ার পক্ষে নয়।

সিঙ্গাপুর বন্দর রাষ্ট্রীয় কর্তৃত্বে পরিচালিত, যে রাষ্ট্রীয় সংস্থা এই বন্দর পরিচালনা করে, সেটির নাম ‘পোর্ট অব সিঙ্গাপুর অথরিটি’ (পিএসএ)। ১৯৯৭ সালে এটিকে অধিকতর বাণিজ্যিকভাবে পরিচালনার জন্য করপোরেটাইজ করা হয়, যাতে এটি স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারে। এরপর ‘মেরিটাইম অ্যান্ড পোর্ট অথরিটি অব সিঙ্গাপুর’ নামে একটি সংস্থা বন্দর কার্যক্রমের একটি বড় অংশের দায়িত্ব গ্রহণ করে।

বন্দর পরিচালনায় এ রকম নানা সংস্কার কর্মসূচি নেওয়া হলেও কোনো কনটেইনার টার্মিনাল ব্যক্তি বা অন্য দেশের কোম্পানির কর্তৃত্বে না দেওয়ার ধারা এখনো অব্যাহত আছে। পোর্টে শ্রমিকদের ইউনিয়নও সক্রিয়। ‘পোর্ট অব সিঙ্গাপুর অথরিটি ইন্টারন্যাশনাল’ বিশ্বব্যাপী বিভিন্ন বন্দরের মালিকানা ও পরিচালনাতেও এখন অংশগ্রহণ করছে।

আরও পড়ুনচট্টগ্রাম বন্দর: ঘরের চাবি কি পরের হাতে তুলে দেওয়া হচ্ছে১২ জুন ২০২৩

আর বাংলাদেশের সরকার যে কোম্পানির কাছে স্বচ্ছতা ছাড়া প্রধান বন্দর ইজারা দিতে উঠেপড়ে লেগেছে, সেই ‘ডিপি ওয়ার্ল্ড’ও রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান। বাংলাদেশের সরকারগুলোর মতো আত্মমর্যাদাবর্জিত তৎপরতা দিয়ে কোনো দেশই পায়ের নিচে শক্ত মাটি তৈরি করতে পারেনি। এটা খুবই ঠিক যে সমুদ্রবন্দর থাকায় বাংলাদেশ অন্য অনেক দেশের চেয়ে সুবিধাজনক অবস্থানে আছে। বাংলাদেশের দক্ষিণ দিক সমুদ্রে উন্মুক্ত এবং এরই দুই প্রান্ত আছে দুটি নদী ও সমুদ্রবন্দর। আন্তর্জাতিক যোগাযোগ ও পরিবহনের বাড়তি সুবিধা ছাড়াও এই সমুদ্র জানা ও অজানা অনেক সম্পদের আধার। বঙ্গোপসাগরে বিপুল পরিমাণ তেল–গ্যাস ও খনিজ সম্পদ আছে বলে আন্তর্জাতিক বিশেষজ্ঞরা নিশ্চিত।

জাতীয় সক্ষমতার বিকাশ না ঘটিয়ে এই বন্দর ও সমুদ্রসীমার সম্পদ বিদেশি কোম্পানিকে দেওয়ার ব্যাপারে দেশের বিভিন্ন সরকারের আগ্রহ যে একই রকম, তা খুব তাৎপর্যপূর্ণ।

কৌশলগত অবস্থানের কারণেই বাংলাদেশের সমুদ্র এখন বহুপক্ষের নজরে। সবচেয়ে তৎপর যুক্তরাষ্ট্র, এ ছাড়া সঙ্গে কিংবা পেছনে আছে চীন ও ভারত। যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দপ্তর ও সেনা, নৌ কর্মকর্তারা, সেই সঙ্গে বহুজাতিক কোম্পানির লবিস্টরা নানা কারণ ও বাহানায় বাংলাদেশে এলেই যে সমুদ্র অঞ্চলে আমাদের ‘নিরাপত্তা বিধানের’ জন্য আগ্রহ দেখাচ্ছেন, সেটিও খুব উদ্বেগজনক। কেননা, বিশ্বের অভিজ্ঞতা দেখায় যে তাদের ‘নিরাপত্তা’ কর্মসূচি বহু দেশের জন্যই দীর্ঘমেয়াদি বিপদ ডেকে এনেছে।

তাই বাংলাদেশের জাতীয় নিরাপত্তা ও অর্থনীতির বিকাশ নিশ্চিত করতে ইজারা কর্মসূচি বাদ দিয়ে কৌশলগতভাবে খুবই গুরুত্বপূর্ণ জাতীয় প্রতিষ্ঠান হিসেবে চট্টগ্রাম ও মোংলা সমুদ্রবন্দরকে বিকশিত করা এবং এর জাতীয় সক্ষমতা বৃদ্ধি একমাত্র করণীয়। জানি যে লুম্পেন ও কমিশনভোগী দৃষ্টিভঙ্গি এই পথে যেতে চাইবে না। জনগণেরই এই পথ তৈরি করতে হবে।

আনু মুহাম্মদ শিক্ষক, লেখক এবং ত্রৈমাসিক জার্নাল সর্বজনকথার সম্পাদক

মতামত লেখকের নিজস্ব

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: র প রস ত ব ব শ বব য ন র জন য তৎক ল ন প রকল প জনগণ র পর চ ল মন ত র সরক র ক ষমত এই পথ

এছাড়াও পড়ুন:

সমুদ্রবন্দরে বিদেশি কোম্পানি ও সিঙ্গাপুর বানানোর গল্প

চট্টগ্রাম বন্দরের নিউমুরিং টার্মিনাল ‘ডিপি ওয়ার্ল্ড’ নামে আবুধাবির একটি কোম্পানিকে দরপত্র ছাড়া ইজারা দেওয়ার জন্য অন্তর্বর্তী সরকার রীতিমতো জোরজবরদস্তি করছে। চুক্তি সম্পাদিত না হলেও এই কোম্পানির কর্মকর্তারা বন্দরে আসা–যাওয়া করছেন বলে পত্রিকায় খবর বের হয়েছে। প্রধান উপদেষ্টাও এই উদ্যোগের বিরোধীদের প্রতিহত করার আহ্বান জানিয়েছেন। ইতিমধ্যে দেশের অর্থনীতি ও ব্যবসায়ীদের বিপন্ন করে লাভজনক হওয়া সত্ত্বেও বন্দরের সব রকম মাশুল অনেক বাড়ানো হয়েছে। আগে থেকেই বিদেশি কোম্পানির উচ্চ মুনাফা নিশ্চিত করা ছাড়া এর আর কোনো যুক্তি নেই।

চট্টগ্রাম বন্দর বিদেশি কোম্পানির কাছে ইজারা দেওয়ার প্রথম তৎপরতা শুরু হয় ১৯৯৭ সালের দিকে। সে সময় আমরা ক্রমাগত শুনেছি প্রয়োজনের তুলনায় চট্টগ্রাম বন্দরের কর্মক্ষমতা খুবই অপ্রতুল, ভবিষ্যৎ ঝুঁকিপূর্ণ। সুতরাং বলা হয়েছে অবিলম্বে একটি মার্কিন কোম্পানিকে চট্টগ্রাম বন্দরের এলাকা ইজারা দিয়ে বিদেশি কোম্পানির কর্তৃত্বে নতুন কনটেইনার টার্মিনাল না করলে বাংলাদেশ সমূহ বিপদে পড়বে।

আরও পড়ুনচট্টগ্রাম বন্দর: আমাদের সোনার ডিম পাড়া রাজহাঁসটি...২৫ অক্টোবর ২০২৫

১৯৯৭ সালের ৩ মার্চ ব্রিটিশ কনসোর্টিয়াম চট্টগ্রাম বন্দর এলাকায় ‘প্রাইভেট পোর্ট’ নির্মাণের প্রস্তাব জমা দেয়। একই বছরের ২৯ ডিসেম্বর প্রস্তাব জমা দেয় মার্কিন এসএসএ কোম্পানি। ১৯৯৮ সালের ২০ ফেব্রুয়ারি একই ধরনের প্রস্তাব জমা দেয় অস্ট্রেলিয়ার পিএনও পোর্ট। ১৯৯৯ সালের ৪ জানুয়ারি লন্ডনের পোর্ট ভেঞ্চার এবং ১৮ জানুয়ারি সিঙ্গাপুর পোর্ট জমা দেয় তাদের প্রস্তাব। এই সব কটি প্রস্তাবের সঙ্গেই দেশের ভেতরে নানা লবিস্ট গোষ্ঠী সক্রিয় হয়ে ওঠে।

চট্টগ্রাম পোর্টেরও নিজস্ব প্রস্তাব ছিল; কিন্তু তার প্রতি মনোযোগ নেই, তা আটকে থাকে ফাইলে। আর দ্রুত বিদেশি কোম্পানিগুলোর মধ্যে সবাইকে ছাড়িয়ে সামনে আসে মার্কিন এসএসএ কোম্পানি। টেন্ডার ছাড়াই তাদের সঙ্গে চুক্তির কার্যক্রম শুরু করে তৎকালীন সরকার।

মার্কিন কোম্পানির কনটেইনার টার্মিনাল স্থাপনের স্থান নির্ধারণ করা হয়েছিল কর্ণফুলীর মোহনায়, চট্টগ্রাম বন্দর থেকে সমুদ্রে বের হওয়ার মুখে। কর্ণফুলী নদীর ডান তীরের পতেঙ্গায় চট্টগ্রাম বন্দর এলাকায় ‘২০ দশমিক ৯৭ একর জমি লিজের মাধ্যমে প্রথম পর্যায়ে ৯৯ বছর মেয়াদে এবং পরবর্তী পর্যায়ে আরও ৯৯ বছরের জন্য ইজারা এবং প্রথম দফায় ৩০ বছর এবং পরবর্তী সময়ে আরও ৬ দফা ৩০ বছর মেয়াদি অর্থাৎ মোট ২১০ বছর মেয়াদি লাইসেন্স প্রদান’ ছিল চুক্তির মূল দিক।

মন্ত্রণালয় এবং বিভিন্ন ‘বিশেষজ্ঞ’ কার্যক্রম কীভাবে এসব কোম্পানির স্বার্থে গোছানো হয়, তা এই সময়ের বিভিন্ন সভার প্রস্তাব, সিদ্ধান্ত ও কমিটি গঠন ইত্যাদি পদক্ষেপ খেয়াল করলে বোঝা যায়। ১৯৯৭ সালে প্রস্তাব জমা দেওয়ার পর তা মন্ত্রিপরিষদের প্রাথমিক সম্মতি পেয়ে নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ে যায়। ২০০০ সালের ১৬ ফেব্রুয়ারি এই প্রস্তাব পরীক্ষা নিরীক্ষা এবং এ নিয়ে এসএসএ কোম্পানির সঙ্গে ‘নেগোসিয়েশনে বিশেষজ্ঞ সার্ভিস প্রদানের জন্য’ মন্ত্রণালয় যাদের সঙ্গে ‘ডেভেলপমেন্ট সার্ভিসেস অ্যাগ্রিমেন্ট’ স্বাক্ষর করে, তারা হলো বিশ্বব্যাংকের অর্থ ও নীতিমালায় পরিচালিত ‘সরকারি’ প্রতিষ্ঠান আইআইএফসি (ইনফ্রাস্ট্রাকচার ইনভেস্টমেন্ট ফ্যাসিলিটেশন সেন্টার)।

২০০১ সালে নতুন সরকার আসে ক্ষমতায়; কিন্তু বন্দর নিয়ে চুক্তির ধারাবাহিকতা চলতে থাকে। বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের ছয়জন সচিবকে সদস্য করে গঠিত ‘সচিব কমিটি’, ৩০ এপ্রিল ২০০২ তাঁদের প্রতিবেদনে এসএসএর প্রকল্পের পক্ষে জোর সুপারিশ করে। বন্দরের উপরিউক্ত প্রকল্পের পক্ষে তদবির বা চাপ দিতে গিয়ে তৎকালীন মার্কিন রাষ্ট্রদূত এই আইআইএফসিকে ‘বিশ্বব্যাংকের প্রতিষ্ঠান’ বলেই অভিহিত করেছেন এবং এর সমীক্ষাকেই সাক্ষী মেনেছেন।

বাংলাদেশের জাতীয় নিরাপত্তা ও অর্থনীতির বিকাশ নিশ্চিত করতে ইজারা কর্মসূচি বাদ দিয়ে কৌশলগতভাবে খুবই গুরুত্বপূর্ণ জাতীয় প্রতিষ্ঠান হিসেবে চট্টগ্রাম ও মোংলা সমুদ্রবন্দরকে বিকশিত করা এবং এর জাতীয় সক্ষমতা বৃদ্ধি একমাত্র করণীয়। জানি যে লুম্পেন ও কমিশনভোগী দৃষ্টিভঙ্গি এই পথে যেতে চাইবে না। জনগণেরই এই পথ তৈরি করতে হবে।

তৎকালীন নৌপরিবহনমন্ত্রীর কাছে মার্কিন কোম্পানির সঙ্গে অবিলম্বে চুক্তি স্বাক্ষরের পক্ষে জোর সুপারিশ করে ‘আগের দিনের আলোচনার সূত্রে’ লেখা চিঠিতে তৎকালীন মার্কিন রাষ্ট্রদূত মেরি অ্যান পিটার্স স্পষ্ট করে বলেন, ‘এর জন্য কোনো টেন্ডারের প্রয়োজন নেই।’ কারণ হিসেবে তিনি বলেন, ‘স্বচ্ছতার সঙ্গে সব আলোচনা অনুষ্ঠিত হয়েছে, বিশ্বব্যাংকের প্রতিষ্ঠান আইআইএফসি এই বিষয়ে কনসালট্যান্ট হিসেবে কাজ করে অনুকূল মতামত দিয়েছে’ ইত্যাদি।

বিশ্বব্যাংকের তৎকালীন কান্ট্রি ডিরেক্টর ফ্রেডরিক টেম্পলও একই সময় এই চুক্তি সম্পাদনের জন্য বারবার তাগিদ দিয়েছেন। ঠিক একই ধারার যুক্তি, একই রকম কর্মপ্রক্রিয়া আমরা এখনো দেখতে পাচ্ছি। নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ের ভূমিকাও একই রকম। আগেরবার পরপর দুই সরকার এবং মার্কিন দূতাবাস, বিশ্বব্যাংক, এডিবি ও আমলা গোষ্ঠীর সম্মিলিত এই সর্বনাশা তৎপরতার বিরুদ্ধে জনগণের বড় এক প্রতিরোধ আন্দোলন তৈরি হয়েছিল। বন্দরশ্রমিকদের আন্দোলনের পাশাপাশি সে সময় এই অপতৎপরতা ঠেকানোর জন্য ‘তেল–গ্যাস–খনিজ সম্পদ ও বিদ্যুৎ–বন্দর রক্ষা জাতীয় কমিটি’ অন্যান্য কর্মসূচির সঙ্গে ঢাকা–চট্টগ্রাম লংমার্চও সংঘটিত করেছিল।

আরও পড়ুনবিদেশি কোম্পানিকে বন্দর ব্যবস্থাপনার ইজারা দেওয়ার ঝুঁকিগুলো কী১৪ জুন ২০২৫

পাশাপাশি আদালতে এ নিয়ে মামলাও হয়। হাইকোর্টে রিট আবেদন করেন চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের সাবেক চেয়ারম্যান প্রকৌশলী মাহমুদ-উল-ইসলামসহ কয়েকজন। তাঁদের পক্ষে মামলা পরিচালনা করেন ড. কামাল হোসেন। তাঁর সঙ্গে ছিলেন হরিসাধন দেব ব্রাহ্মণ। ২০০২ সালের শেষে আদালতের শুনানিতে প্রমাণিত হয়, বন্দর নিয়ে পুরো প্রকল্পটি জালিয়াতিপূর্ণ। মূল কোম্পানির নাম ব্যবহার করে গঠিত নতুন একটি কোম্পানি বন্দর চুক্তির ওপর ভর করে বিপুল পরিমাণ ঋণের ধান্দা করছিল। অথচ এর পক্ষেই দেশি–বিদেশি শক্তিশালী সব পক্ষ কাজ করছিল। আদালতের রায় ও জনপ্রতিরোধে এই জালিয়াতি প্রকল্প শেষ পর্যন্ত বাতিল হয়।

বিদেশি কোম্পানির কাছে বন্দর ইজারা দেওয়ার পক্ষে নীতি প্রণয়নে তখন এবং এখন যেসব যুক্তি জনগণের সামনে হাজির করা হয়, তার মধ্যে অন্যতম হলো বাংলাদেশকে সিঙ্গাপুর বানানোর গল্প; কিন্তু সিঙ্গাপুরের ভৌগোলিক অবস্থান, ইতিহাস এবং অর্থনৈতিক উন্নয়নের নীতি সবই ভিন্ন। অর্থনীতির মূল আয় আসে কাঁচামাল আমদানি ও তা প্রক্রিয়াজাত করে রপ্তানি থেকে। সিঙ্গাপুর বন্দরের শতকরা ৮০ ভাগ তৎপরতা সে জন্য ট্রান্সশিপমেন্টকেন্দ্রিক।

আরও পড়ুনবন্দর পরিচালনা বিদেশিদের দেওয়া কতটা যৌক্তিক১৯ মে ২০২৫

সিঙ্গাপুরের জাতীয় আয় বা জিডিপির বেশির ভাগ আসে এমন অর্থনৈতিক তৎপরতা থেকে যা হয় রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন বা তার নিয়ন্ত্রিত। তদুপরি সিঙ্গাপুরের উন্নয়ন–দর্শন মোটেও বন্দরের মতো একটি কৌশলগতভাবে গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা ব্যক্তিপুঁজি কিংবা বিদেশি কোম্পানির হাতে ছেড়ে দেওয়ার পক্ষে নয়।

সিঙ্গাপুর বন্দর রাষ্ট্রীয় কর্তৃত্বে পরিচালিত, যে রাষ্ট্রীয় সংস্থা এই বন্দর পরিচালনা করে, সেটির নাম ‘পোর্ট অব সিঙ্গাপুর অথরিটি’ (পিএসএ)। ১৯৯৭ সালে এটিকে অধিকতর বাণিজ্যিকভাবে পরিচালনার জন্য করপোরেটাইজ করা হয়, যাতে এটি স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারে। এরপর ‘মেরিটাইম অ্যান্ড পোর্ট অথরিটি অব সিঙ্গাপুর’ নামে একটি সংস্থা বন্দর কার্যক্রমের একটি বড় অংশের দায়িত্ব গ্রহণ করে।

বন্দর পরিচালনায় এ রকম নানা সংস্কার কর্মসূচি নেওয়া হলেও কোনো কনটেইনার টার্মিনাল ব্যক্তি বা অন্য দেশের কোম্পানির কর্তৃত্বে না দেওয়ার ধারা এখনো অব্যাহত আছে। পোর্টে শ্রমিকদের ইউনিয়নও সক্রিয়। ‘পোর্ট অব সিঙ্গাপুর অথরিটি ইন্টারন্যাশনাল’ বিশ্বব্যাপী বিভিন্ন বন্দরের মালিকানা ও পরিচালনাতেও এখন অংশগ্রহণ করছে।

আরও পড়ুনচট্টগ্রাম বন্দর: ঘরের চাবি কি পরের হাতে তুলে দেওয়া হচ্ছে১২ জুন ২০২৩

আর বাংলাদেশের সরকার যে কোম্পানির কাছে স্বচ্ছতা ছাড়া প্রধান বন্দর ইজারা দিতে উঠেপড়ে লেগেছে, সেই ‘ডিপি ওয়ার্ল্ড’ও রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান। বাংলাদেশের সরকারগুলোর মতো আত্মমর্যাদাবর্জিত তৎপরতা দিয়ে কোনো দেশই পায়ের নিচে শক্ত মাটি তৈরি করতে পারেনি। এটা খুবই ঠিক যে সমুদ্রবন্দর থাকায় বাংলাদেশ অন্য অনেক দেশের চেয়ে সুবিধাজনক অবস্থানে আছে। বাংলাদেশের দক্ষিণ দিক সমুদ্রে উন্মুক্ত এবং এরই দুই প্রান্ত আছে দুটি নদী ও সমুদ্রবন্দর। আন্তর্জাতিক যোগাযোগ ও পরিবহনের বাড়তি সুবিধা ছাড়াও এই সমুদ্র জানা ও অজানা অনেক সম্পদের আধার। বঙ্গোপসাগরে বিপুল পরিমাণ তেল–গ্যাস ও খনিজ সম্পদ আছে বলে আন্তর্জাতিক বিশেষজ্ঞরা নিশ্চিত।

জাতীয় সক্ষমতার বিকাশ না ঘটিয়ে এই বন্দর ও সমুদ্রসীমার সম্পদ বিদেশি কোম্পানিকে দেওয়ার ব্যাপারে দেশের বিভিন্ন সরকারের আগ্রহ যে একই রকম, তা খুব তাৎপর্যপূর্ণ।

কৌশলগত অবস্থানের কারণেই বাংলাদেশের সমুদ্র এখন বহুপক্ষের নজরে। সবচেয়ে তৎপর যুক্তরাষ্ট্র, এ ছাড়া সঙ্গে কিংবা পেছনে আছে চীন ও ভারত। যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দপ্তর ও সেনা, নৌ কর্মকর্তারা, সেই সঙ্গে বহুজাতিক কোম্পানির লবিস্টরা নানা কারণ ও বাহানায় বাংলাদেশে এলেই যে সমুদ্র অঞ্চলে আমাদের ‘নিরাপত্তা বিধানের’ জন্য আগ্রহ দেখাচ্ছেন, সেটিও খুব উদ্বেগজনক। কেননা, বিশ্বের অভিজ্ঞতা দেখায় যে তাদের ‘নিরাপত্তা’ কর্মসূচি বহু দেশের জন্যই দীর্ঘমেয়াদি বিপদ ডেকে এনেছে।

তাই বাংলাদেশের জাতীয় নিরাপত্তা ও অর্থনীতির বিকাশ নিশ্চিত করতে ইজারা কর্মসূচি বাদ দিয়ে কৌশলগতভাবে খুবই গুরুত্বপূর্ণ জাতীয় প্রতিষ্ঠান হিসেবে চট্টগ্রাম ও মোংলা সমুদ্রবন্দরকে বিকশিত করা এবং এর জাতীয় সক্ষমতা বৃদ্ধি একমাত্র করণীয়। জানি যে লুম্পেন ও কমিশনভোগী দৃষ্টিভঙ্গি এই পথে যেতে চাইবে না। জনগণেরই এই পথ তৈরি করতে হবে।

আনু মুহাম্মদ শিক্ষক, লেখক এবং ত্রৈমাসিক জার্নাল সর্বজনকথার সম্পাদক

মতামত লেখকের নিজস্ব

সম্পর্কিত নিবন্ধ