থাইল্যান্ড–মালয়েশিয়া সীমান্তের কাছে নৌকাডুবির ঘটনায় মৃত্যুর সংখ্যা বেড়ে ১১ হয়েছে। ওই নৌকায় প্রায় ৭০ আরোহী ছিলেন, যাঁদের প্রায় সবাই মিয়ানমারের নিপীড়িত রোহিঙ্গা সম্প্রদায়ের।

সেখানে প্রায় ২৩০ যাত্রী বহনকারী আরেকটি নৌকার ঠিক কী হয়েছে, তা নিশ্চিত হওয়া যাচ্ছে না বলে জানিয়েছে মালয়েশিয়া কর্তৃপক্ষ।
মালয়েশিয়ার কোস্টগার্ডের ধারণা, নৌকাটি দেশটির পর্যটন দ্বীপ লঙ্কাবির কাছে ডুবে গেছে। ওই নৌকার ১৩ যাত্রীকে জীবিত উদ্ধার করা হয়েছে, যাঁদের বেশির ভাগই রোহিঙ্গা।

থাইল্যান্ড কর্তৃপক্ষ বলেছে, তারা চারটি মৃতদেহ উদ্ধার করেছে, যার মধ্যে দুই শিশু রয়েছে। এর আগে মালয়েশিয়ান মেরিটাইম এনফোর্সমেন্ট এজেন্সি (আগে কোস্টগার্ড নাম ছিল) সাতটি মৃতদেহ উদ্ধার করেছে।

থাইল্যান্ড কোস্টগার্ডের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, তারা যে চারটি মৃতদেহ উদ্ধার করেছে, তার মধ্যে দুই শিশুর বয়স ১২ ও ১০ বছরের বেশি। অন্য মৃতদেহ দুই নারীর। তাঁদের সঙ্গে শরণার্থী কার্ড পাওয়া গেছে। যেখান থেকে নিহত দুই নারী রোহিঙ্গা বলে নিশ্চিত হওয়া গেছে।

এ বিষয়ে সর্বশেষ তথ্য জানাতে লঙ্কাবি দ্বীপে এক সংবাদ সম্মেলনে মালয়েশিয়ার মেরিটাইম এনফোর্সমেন্ট এজেন্সির পক্ষ থেকে বলা হয়, জীবিত ব্যক্তিদের উদ্ধারে থাইল্যান্ড ও মালয়েশিয়া উভয় দেশই আকাশ থেকে তল্লাশি অভিযান চালাচ্ছে।

এ বছরের জানুয়ারি থেকে নভেম্বরের শুরুর দিক পর্যন্ত ৫ হাজার ১০০–এর বেশি রোহিঙ্গা মিয়ানমার ও বাংলাদেশ থেকে সমুদ্রপথে অন্যান্য দেশে পৌঁছানোর চেষ্টা করেছেন। জাতিসংঘের শরণার্থী সংস্থার তথ্য অনুযায়ী, তাঁদের মধ্যে প্রায় ৬০০ জন মারা গেছেন অথবা নিখোঁজ হয়েছেন।

মালয়েশিয়ার কেদাহ ও পার্লিস রাজ্য মেরিটাইম এনফোর্সমেন্ট এজেন্সির পরিচালক রোমলি মুস্তফা বলেন, ‘থাইল্যান্ডের সংস্থার (কোস্টগার্ড) সঙ্গে আমাদের খুবই ভালো সম্পর্ক রয়েছে। আমাদের মধ্যে যোগাযোগ খুব ভালো এবং তথ্যের আদান–প্রদানও হচ্ছে।’

ঘটনার পর অন্তত সাত দিন ধরে তল্লাশি ও উদ্ধার অভিযান চলবে বলেও জানান মুস্তফা।

নৌকাডুবির পর মালয়েশিয়ান মেরিটাইম এনফোর্সমেন্ট এজেন্সি লংকাউই দ্বীপের কাছে কোথায় কোথায় তল্লাশি অভিযান চালাচ্ছে, তা দেখানো হচ্ছে। ১০ নভেম্বর ২০২৫.

উৎস: Prothomalo

এছাড়াও পড়ুন:

নিজেদের স্বপ্নে থাকুক অন্যের ভাগ

বাংলাদেশের প্রতিটি বড় পরিবর্তনের পেছনে মূল শক্তি হিসেবে কাজ করেছে তারুণ্য। ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে মহান মুক্তিযুদ্ধ, গণতন্ত্র আদায়ের আন্দোলন থেকে প্রযুক্তির বিপ্লব—সব ক্ষেত্রেই কেন্দ্রে ছিল তরুণেরা। 

আজকের তরুণ প্রজন্মও এক নতুন যুদ্ধক্ষেত্রে লড়াই করছে। তবে এবার শত্রু অদৃশ্য। তার নাম বৈষম্য। আমি নিজেও সেই লড়াইয়ের একজন যোদ্ধা। ‘মজার ইশকুল’-এর মাধ্যমে বৈষম্যের বিরুদ্ধে আমার এই লড়াই চলছে। মজার ইশকুল শুধু একটি প্রতিষ্ঠান নয়, একটি আন্দোলন। যার বিশ্বাস—শিক্ষা বিলাসিতা নয়, জন্মগত অধিকার।

বৈষম্যের দেয়ালে তারুণ্যের ধাক্কা

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর সাম্প্রতিক তথ্য বলছে, এখনো দেশের প্রায় ২০ শতাংশ মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে। আর ইউনিসেফের (জাতিসংঘ জরুরি শিশু তহবিল) ২০২৪ সালের প্রতিবেদন বলছে, ৩৪ লাখের বেশি শিশু বাস করছে অভিভাবকহীন, ছিন্নমূল। রাস্তায় প্রতিদিন প্রায় চার লাখ শিশু বিভিন্ন কাজে যুক্ত, যাদের অনেকেই কখনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে যায়নি।

একদিকে শীতাতপনিয়ন্ত্রিত ক্লাসরুমে ল্যাপটপ হাতে শিশু, অন্যদিকে ফুটপাতে খালি পায়ে অবহেলিত শিশু—এই ফারাকই আমাদের সমাজে বৈষম্যের সবচেয়ে দৃশ্যমান চিত্র। 

এই বাস্তবতা প্রতিদিনের। রোজ দেখি, কোনো শিশুর চোখে ক্ষুধা, আবার কারও চোখে স্বপ্ন। তবু জানি, তারুণ্যের শক্তি যদি এই বৈষম্যের দেয়ালে ধাক্কা দেয়, তাহলে তা ভাঙবেই।

দেশে এখন ৩৪ লাখের বেশি শিশু ছিন্নমূল। রাস্তায় প্রতিদিন প্রায় চার লাখ শিশু বিভিন্ন কাজে যুক্ত, যাদের অনেকেই কখনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে যায়নি।

মজার ইশকুল—পথ থেকে শ্রেণিকক্ষে

২০১৩ সালে আমার বয়স ছিল ২১ বছর, পড়ছি অতীশ দীপঙ্কর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে কম্পিউটার সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে। তখনই শুরু করি ‘মজার ইশকুল’। ঢাকার ঐতিহাসিক সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে, খোলা আকাশের নিচে শুরু হয় এই ইশকুলের যাত্রা। লক্ষ্য ছিল পথশিশুমুক্ত বাংলাদেশ গড়ে তোলা। 

এই স্বপ্নের অনুপ্রেরণা এসেছে মুক্তিযুদ্ধের গেরিলাযোদ্ধা শহীদ শাফী ইমাম রুমীর কাছ থেকে। যিনি দেশের স্বাধীনতার জন্য জীবন দিতে দ্বিধা করেননি। রুমী শিখিয়েছেন, দেশপ্রেম মানে শুধু যুদ্ধে অস্ত্র ধরা নয়, মানুষের জীবনে আলো আনার লড়াইও একধরনের মুক্তিযুদ্ধ। 

মাথার ওপর খোলা আকাশ, মাত্র ১৩টি শিশু আর কিছু রংপেনসিল—এই নিয়েই যাত্রা শুরু করেছিল মজার ইশকুল। আজ তা একটি পূর্ণাঙ্গ নেটওয়ার্কে পরিণত হয়েছে; যেখানে শিক্ষা, পুষ্টি, স্বাস্থ্যসেবা ও ডিজিটাল লার্নিং—সব একসঙ্গে চলছে।

প্রায় ১৩ বছরের যাত্রায় মজার ইশকুলের এখন ২৩টি শাখা। নিয়মিত শিক্ষার্থীর সংখ্যা ২ হাজার ৩০০ আর নিবন্ধিত স্বেচ্ছাসেবী ৮ হাজার। 

মজার ইশকুলের সবচেয়ে বড় শক্তি দেশব্যাপী তরুণ স্বেচ্ছাসেবীরা। যাঁরা প্রতিদিন নিজের সময়, শ্রম আর ভালোবাসা দিয়ে পরিবর্তনের এই কাজ এগিয়ে নিচ্ছেন। তাঁদের কেউ পড়ান, কেউ শিশুদের জন্য খাবার রান্না করেন, কেউ-বা শিশুদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করেন—সবাই মিলে এ এক মানবিক পরিবার। তরুণেরাই এই পরিবারের প্রাণশক্তি। 

তাঁদের কাজ প্রমাণ করে দিয়েছে, তারুণ্যের জয় মানে শুধু নিজের ভবিষ্যৎ গড়া নয়, বরং অন্যের জীবনেও আলো ছড়ানো।

মজার ইশকুলের মূল লক্ষ্য খাদ্য, শিক্ষা ও প্রযুক্তিগত দক্ষতার মাধ্যমে শিশুদের এমনভাবে গড়ে তোলা, যেন তারা একদিন নিজের পায়ে দাঁড়িয়ে দেশের উন্নয়নে ভূমিকা রাখতে পারে। এই পরিবর্তনই হবে আমাদের কাছে সত্যিকারের তারুণ্যের জয়; যেখানে মানবিকতা আর উন্নয়ন হাতে হাত রেখে এগিয়ে চলবে।

নীতির সঙ্গে কাজের সংযোগ

নীতিগত পরিবর্তন কীভাবে দীর্ঘ মেয়াদে প্রজন্ম বদলে দিতে পারে, তা করে দেখিয়েছে বিশ্বে শিশু অধিকার আন্দোলনের পথিকৃৎ ‘সেভ দ্য চিলড্রেন’। ১৯১৯ সালে প্রতিষ্ঠিত এই সংস্থা ১৯২৪ সালে বিশ্বের প্রথম শিশু অধিকার ঘোষণাপত্র প্রকাশ করে, যা পরে জাতিসংঘের শিশু অধিকার সনদের ভিত্তি হয়। বর্তমানে ১৯৬টি রাষ্ট্রে এটি আইনগতভাবে কার্যকর।

বাংলাদেশেও ২০১৩ সালের ‘চিলড্রেন অ্যাক্ট’ ও ২০১৭ সালের ‘চাইল্ড ম্যারেজ রেস্ট্রেইন্ট অ্যাক্ট’-এর প্রেক্ষাপটে সেভ দ্য চিলড্রেন শিশু অধিকারভিত্তিক গবেষণা, বাজেট বিশ্লেষণ ও পলিসি অ্যাডভোকেসিতে সক্রিয় ভূমিকা পালন করেছে।

এই ইতিহাসই আমাদের প্রেরণা। আমরা জানি, পথশিশুমুক্ত বাংলাদেশ গঠনের লড়াই কোনো একক সংগঠনের পক্ষে সম্ভব নয়। একটি উন্নত রাষ্ট্রব্যবস্থা গড়ে তুলতে হলে সরকার, নীতিনির্ধারক, উন্নয়ন সংগঠন, করপোরেট খাত এবং তরুণ সমাজ—সবাইকে একই লক্ষ্য ও তথ্যভিত্তিক কাঠামোর ভেতর কাজ করতে হবে। মজার ইশকুল আগামী দশকে নিজেকে সেই নীতি-সহায়ক স্তরে উন্নীত করতে চায়, যেখানে মাঠের অভিজ্ঞতা রাষ্ট্রীয় নীতিতে প্রভাব ফেলবে। 

আমরা চাই শিক্ষা, পুষ্টি, শিশু-সুরক্ষা ও পুনর্বাসন—এই চারটি খাতে আমাদের মাঠের অভিজ্ঞতা সরকার ও উন্নয়ন সংস্থাগুলোর নীতিমালায় প্রতিফলিত হোক। মজার ইশকুল সুশীল সমাজ, সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠান, নীতিনির্ধারক ও আন্তর্জাতিক অংশীদারদের সঙ্গে যৌথভাবে ‘পথশিশুমুক্ত বাংলাদেশ’ গঠনে একটি কার্যকর ‘পলিসি ইকোসিস্টেম’ তৈরি করতে চায়।

আমরা বিশ্বাস করি, যে রাষ্ট্র শিশুদের জন্য নীতি তৈরি করে এবং তা বাস্তবায়নে সাহস দেখায়, সেই রাষ্ট্রই ভবিষ্যতের জন্য টেকসই রাষ্ট্র। মজার ইশকুল সেই বাস্তবতাকে অনুধাবন ও প্রমাণ করাতে চায়।

রাস্তায় শুরু ভবিষ্যতের পথ

মজার ইশকুলের শিক্ষার্থী কুলসুম খাতুন। ২০১৪ সালে সে প্রথম শ্রেণিতে ভর্তি হয়েছিল। সে সময় ক্লাস হতো খোলা আকাশের নিচে। বর্তমানে সে এসএসসি পরীক্ষার প্রস্তুতি নিচ্ছে।

কুলসুম এখন তার পরিবারের সবচেয়ে শিক্ষিত সদস্য। ২০১৭ সালে তার দিনমজুর বাবাকে একটি রিকশার ব্যবস্থা করে দেওয়া হয়। তিনি এখন রিকশা থেকে সিএনজিচালিত অটোরিকশার চালক হয়েছেন; জমি কিনেছেন, ঋণমুক্ত জীবন যাপন করছেন। এটাই টেকসই উন্নয়ন। শিক্ষার আলোয় বদলে গেছে কুলসুমের গোটা পরিবার। আর এসবের কেন্দ্রবিন্দুতে আছে একটাই শক্তি—কুলসুমের পড়াশোনা।

আরেক শিক্ষার্থী মীম প্রায় দৃষ্টিহীন। একসময় মায়ের সঙ্গে ভিক্ষা করত, দিনের আলো আর মাইক্রোস্কোপের সাহায্যে পড়াশোনা করে এখন সে প্রাক্​-প্রাথমিক শ্রেণির শিক্ষক। নিজের উপার্জনে সংসার চালায়, গান গায়, কবিতা লেখে। মীম এখন জীবনের গান গায়। 

কুলসুম আর মীমদের গল্পই প্রমাণ করে, তারুণ্যের জয় মানে সমাজে আলোর দাগ টেনে দেওয়া। তারা প্রমাণ করেছে, যেখানে সুযোগ দেওয়া হয়, সেখানেই সম্ভাবনা জেগে ওঠে।

ভবিষ্যতের বাংলাদেশ

আমরা এমন এক বাংলাদেশ কল্পনা করি, যেখানে কোনো শিশু ক্ষুধার কারণে স্কুল কামাই করবে না, যেখানে শিক্ষা হবে আনন্দের, স্বাস্থ্য হবে অধিকার আর কাজ হবে সম্মানের।

এই পরিবর্তনের দায়িত্ব কেবল বাংলাদেশ সরকারের নয়, বরং তরুণদেরও। কারণ, বৈষম্যের দেয়াল ভাঙার জন্য শুধু নীতি নয়, দরকার অদম্য ইচ্ছাশক্তি, সংগঠন আর ভালোবাসা। তারুণ্যের হাত ধরেই গড়ে উঠবে সেই বাংলাদেশ, যেখানে জন্ম নয়, অধিকার নির্ধারণ করবে ভবিষ্যৎ।

দেশপ্রেম থাকলে আর সঠিক প্রস্তুতি নিতে পারলে বাংলাদেশের তরুণেরা নিজের ভাগ্য যেমন বদলাতে পারে, তেমনি দেশকেও বদলে দিতে পারে। আমরা যদি নিজেদের স্বপ্নে অন্যের ভাগ রাখি, তবে একদিন আমরাই লিখব নতুন ইতিহাস—একটি বৈষম্যহীন, মানবিক বাংলাদেশের। তারুণ্যের জয় মানে নিজের উত্থান নয়, সবার উত্থান নিশ্চিত করা।

আরিয়ান আরিফ, প্রতিষ্ঠাতা ও নির্বাহী পরিচালক, মজার ইশকুল

সম্পর্কিত নিবন্ধ