রাজনীতিতে নতুন হাওয়া বইছে। বাংলাদেশের নির্বাচনী ইতিহাসে খুব সম্ভবত এই প্রথম কোনো রাজনৈতিক দল তাদের সম্ভাব্য প্রার্থী আনুষ্ঠানিকভাবে ঘোষণা করল নির্বাচনী শিডিউল ঘোষণা করার আগেই।

এর যথেষ্ট যৌক্তিক কারণ আছে।

হাসিনার ফ্যাসিবাদী শাসনের পতনের পর বাংলাদেশ একটি অস্থির অবস্থার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। অর্থনীতির দু–একটি সূচক ছাড়া সবই নিম্নগামী।

পত্রিকার খবর অনুযায়ী সরাসরি বিদেশি বিনিয়োগ বা এফডিআই কমে গেছে গত প্রান্তিকের তুলনায় এই প্রান্তিকে ৬১ শতাংশ।

বেসরকারি বিনিয়োগ প্রবৃদ্ধি ০.

১ শতাংশে নেমে এসেছে যা কোভিড মহামারি চলার সময়ের চেয়েও কম। রপ্তানি প্রবৃদ্ধি ৭ দশমিক ৪৩ শতাংশ কমেছে গত অক্টোবরের তুলনায়।

এ রকম পরিস্থিতিতে দেশের সার্বিক আর্থসামাজিক উন্নয়ন এবং দেশের স্বাভাবিক গতিশীলতা আনার জন্য সুষ্ঠু জাতীয় নির্বাচন আশু প্রয়োজনীয়।

জাতীয় নির্বাচনের প্রয়োজনীয়তা সরকারও খুব ভালোভাবেই উপলব্ধি করতে পারছে।

আরও পড়ুনপ্রার্থী মনোনয়ন রাজনীতির যে ধারাকে তুলে ধরল১০ ডিসেম্বর ২০২৩

১৪ সেপ্টেম্বর ২০২৫ প্রথম আলোতে প্রকাশিত সাক্ষাৎকারে যোগাযোগ উপদেষ্টা মুহাম্মদ ফাওজুল কবীর খান বলেন, সৌদি আরবের ক্রাউন প্রিন্সের সঙ্গে সাক্ষাৎকারে একটি চুক্তি করতে গিয়ে তাঁরা ব্যর্থ হয়েছেন; কারণ নির্বাচিত সরকার প্রয়োজন।

জামায়াতে ইসলামীর আমিরের ভাষ্য অনুযায়ী, দলটি প্রায় এক বছর আগেই তাদের সম্ভাব্য প্রার্থীকে নিজ নিজ এলাকায় জনসংযোগ করতে বলে দিয়েছিল।

জনপরিসরেও এই আলোচনা ছিল—জামায়াতের একক প্রার্থী বিভিন্ন নির্বাচনী এলাকায় জনসংযোগ করছেন।

এ ক্ষেত্রে বিএনপি বেশ পিছিয়ে ছিল। বিএনপি এর আগেও তিনবার সরকার পরিচালনার দায়িত্ব পেয়েছিল।

দেশের সর্ববৃহৎ এবং সমর্থনপুষ্ট দল হিসেবে প্রায় প্রতিটি নির্বাচনী এলাকাতেই বিএনপির একাধিক প্রার্থী আছেন।

আরও পড়ুনবিএনপি নতুন রাজনীতির যে ইঙ্গিত দিচ্ছে২২ অক্টোবর ২০২৫

যেহেতু এবারের নির্বাচনটা একটি বিশেষ পরিস্থিতির মধ্যে হচ্ছে, তাই বিএনপির একাধিক প্রার্থীকে এক কাতারে এনে একক প্রার্থী ঘোষণা করাটা জরুরি ছিল।

তা ছাড়া সাম্প্রতিক সময়ে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে জামায়াতের স্টুডেন্ট উইং শিবিরের অপ্রত্যাশিত বিজয়ও বিএনপিকে এ পথে হাঁটার অনুপ্রেরণা জুগিয়েছে।

কথিত আছে ইসলামী ছাত্রশিবির দীর্ঘদিন ধরে ছাত্রসংসদ নির্বাচনের প্রচার চালাচ্ছিল অনানুষ্ঠানিকভাবে। সে ক্ষেত্রে ছাত্রদল অনেক পিছিয়ে ছিল।

বিএনপি ২৩৭ জন প্রার্থীর তালিকা প্রকাশ করেছে। দলটির মহাসচিব নিজে বলেছেন, প্রয়োজনবোধে স্থায়ী কমিটির অনুমোদন সাপেক্ষে এতে সংযোজন–বিয়োজন হতে পারে। এর একটি প্রতিফলন দেখা গেল প্রার্থী ঘোষণার পরের দিনই।

মাদারীপুর–১ আসনে যাঁকে সম্ভাব্য মনোনয়ন দেওয়া হয়েছিল, তাঁর মনোনয়ন স্থগিত করা হয়েছে।

সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ফ্যাসিস্ট আমলের মন্ত্রীর সঙ্গে তাঁর ছবি এবং কিছু অসামাজিক পোস্টার ভাইরাল হওয়ায় বিএনপি এই সিদ্ধান্ত নিয়েছে বলে বলা হচ্ছে।

আরও পড়ুনবিএনপি কি এখন নতুন বাংলাদেশের জন্য প্রস্তুত০১ সেপ্টেম্বর ২০২৫

বিএনপির প্রার্থী তালিকায় নতুন–পুরোনোর সম্মিলন ঘটেছে। অনেক ত্যাগী নেতা যাঁরা দীর্ঘদিন দলে অবদান রাখতে পারছিলেন না, তাঁদেরও মনোনয়ন দেওয়া হয়েছে।

এ ক্ষেত্রে খুলনা থেকে সাবেক সংসদ সদস্য নজরুল ইসলাম মঞ্জু এবং চাঁদপুর থেকে সাবেক শিক্ষা প্রতিমন্ত্রী এহসানুল হক মিলনের নাম উল্লেখ্য।

আবার দীর্ঘদিন জেল খেটেছেন, শারীরিকভাবে নির্যাতনের শিকার হয়েছেন, এ রকম অনেকে মনোনয়নবঞ্চিত হয়েছেন।

এ ক্ষেত্রে চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডের আসলাম চৌধুরী এবং সাবেক ছাত্রনেতা ও বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব হাবিব উন নবী খান সোহেলের নাম উল্লেখ্য।

বিএনপির মধ্যে সবচেয়ে বেশি মামলার আসামি হাবিব উন নবী খান সোহেল। বেগম খালেদা জিয়াসহ ১০ নারীকে বিএনপি মনোনয়ন দিয়েছে।

জুলাই সনদ যেভাবে স্বাক্ষরিত হয়েছে এবং বিএনপি এই ক্লসটাতে সম্মত হয়েছে, তা হলো মোট আসনের ৫ শতাংশ বা ১৫টি আসনে নারীদের সরাসরি নির্বাচনে অংশগ্রহণের সুযোগ দিতে হবে।

আরও পড়ুনবিএনপি-জামায়াতের চার যুগের বন্ধুত্বের কী হলো১৯ সেপ্টেম্বর ২০২৫

নারী প্রার্থী তালিকায় ব্যারিস্টার রুমিন ফারহানা এবং টক শো, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম এবং তরুণদের মধ্যে জনপ্রিয় মাহমুদা হাবীবাকে দেখা যায়নি।

জুলাই সনদ অনুযায়ী বিএনপিকে আরও কমপক্ষে পাঁচজন নারী প্রার্থীকে সরাসরি নির্বাচনে অংশগ্রহণের সুযোগ দিতে হবে।

বিএনপি ঘোষিত প্রার্থী তালিকায় ১২ জন চিকিৎসক আছেন, আছেন তিনজন প্রকৌশলী।

সুপ্রিম কোর্টের প্রায় ১০ জন আইনজীবী সম্ভাব্য মনোনয়নের তালিকায় ঠাঁই পেয়েছেন। এর মধ্যে সম্প্রতি পদ স্থগিত হওয়া বিশিষ্ট আইনজীবী, মুক্তিযোদ্ধা অ্যাডভোকেট ফজলুর রহমানের নামও আছে।

বিএনপি খুব সচেতনভাবে প্রার্থী তালিকা করেছে, যেন বিতর্কের ঊর্ধ্বে থাকা যায়। এবার বিএনপি একটি নীতি অনুসরণ করার চেষ্টা করেছে, যেন একই পরিবার থেকে একাধিক ব্যক্তি মনোনয়ন না পান।

বিএনপি গত ১৭ বছরে চরম নির্যাতন ও নিষ্পেষণের শিকার হয়েছে। এ রকম অনেক প্রার্থী মনোনয়ন পেয়েছেন, যাঁরা দীর্ঘদিন ফেরারি হয়ে ঘুরে বেরিয়েছেন, দলের দুঃসময়ে দলের পাশে ছিলেন।

আবার মানবাধিকার সংগঠন গড়ে তুলে নিজের ভাইসহ গুমের শিকার পরিবারকে নিয়ে অনবরত যুদ্ধ করে যাওয়া সানজীদা ইসলাম তুলি মনোনয়ন পেয়েছেন।

এআইয়ের অপব্যবহার নির্বাচনী অপরাধ হিসেবে গণ্য হবে। হলফনামায় অসত্য তথ্য দিলে নির্বাচিত হওয়ার পরও ব্যবস্থা নিতে পারবে। নির্বাচনের সাত দিন আগে এবং নির্বাচিত হওয়ার পরেও কেউ ঋণখেলাপি হলে, তাঁর সংসদ সদস্যের পদ বাতিল হবে।

আগামী নির্বাচনে জয়ী হওয়ার জন্য বিএনপির এটি প্রাথমিক এবং সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য পদক্ষেপ। কারণ, একজন প্রার্থীর ইমেজ এবং তার সাংগঠনিক দক্ষতাই নির্বাচনে তার জয়ে বড় নিয়ামক হিসেবে কাজ করে।

নির্বাচন কমিশন থেকে প্রস্তাবিত গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ গেজেট আকারে প্রকাশিত হয়েছে। বেশ কিছু নতুন বিষয় সংযোজিত হয়েছে।

এবার গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ প্রস্তাবনা আকারে দেওয়ার আগে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে এ নিয়ে সভা করেনি নির্বাচন কমিশন।

এ জন্য রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে খেদ আছে। বিশেষ করে আরপিওতে নির্বাচনে জোটবদ্ধ হলে দলগুলোকে নিজের মার্কা নিয়ে নির্বাচন করতে হবে এটা বাধ্যতামূলক করে দেওয়া নিয়ে বিএনপি এবং অপরাপর কিছু রাজনৈতিক দলের আপত্তি ছিল।

খুব তাৎপর্যপূর্ণ অগ্রগতি বললে সেনা, নৌ ও বিমানবাহিনীকে আইনশৃঙ্খলার সংজ্ঞায় অন্তর্ভুক্ত করাটা যুক্তিযুক্ত মনে করি। প্রতিটি নির্বাচনের আগেই রাজনৈতিক দলগুলো থেকে এ দাবি উত্থাপন করা হয়।

আর এবার যেহেতু পুলিশের মানসিক ও শারীরিক কার্যক্রমে যথেষ্ট নিস্পৃহ ভাব পরিলক্ষিত হচ্ছে। তাই নির্বাচন–পূর্ববর্তী, নির্বাচনের দিন এবং নির্বাচনের পরে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের জন্য এই বাহিনীগুলোর সক্রিয় সহায়তা প্রয়োজন।

আদালত কর্তৃক ঘোষিত পলাতক আসামি প্রার্থী হতে পারবেন না। কোনো নির্বাচনী এলাকায় প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীরা সমান ভোট পেলে পুনরায় নির্বাচন হবে।

প্রার্থী আচরণবিধি লঙ্ঘন করলে ছয় মাসের কারাদণ্ড এবং দেড় লাখ টাকা জরিমানা করা হবে।

এআইয়ের অপব্যবহার নির্বাচনী অপরাধ হিসেবে গণ্য হবে। হলফনামায় অসত্য তথ্য দিলে নির্বাচিত হওয়ার পরও ব্যবস্থা নিতে পারবে।

নির্বাচনের সাত দিন আগে এবং নির্বাচিত হওয়ার পরেও কেউ ঋণখেলাপি হলে, তাঁর সংসদ সদস্যের পদ বাতিল হবে।

ভোটারপ্রতি কোনো প্রার্থী ১০ টাকার বেশি খরচ করতে পারবেন না। এবারই প্রথম প্রবাসী ভোটাররা আইটি সাপোর্টেড পোস্টাল ব্যালটে ভোট দিতে পারবেন।

এই গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ অনুযায়ী নির্বাচন কমিশন রাজনৈতিক দল ও প্রার্থীর জন্য আচরণবিধি প্রণয়ন করবে। গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশের যথাযথ প্রয়োগ নির্বাচনকে সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন করার পথে সহায়ক হবে বলে মনে করি।

বিএনপির সম্ভাব্য প্রার্থী ঘোষণা নির্বাচনী হাওয়ায় একধরনের গতিবেগ তৈরি করেছে। এনসিপিও নির্বাচনের ব্যাপারে কিছুটা আন্তরিকতা প্রদর্শন শুরু করেছে।

জামায়াতে ইসলামীও ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচনের বিরুদ্ধে সরাসরি বিরুদ্ধাচরণ করছে না।

সব রাজনৈতিক দলের ঐকান্তিক প্রয়াস এবং নির্বাচন কমিশনের দৃঢ় পদক্ষেপের মাধ্যমে বাংলাদেশ গণতন্ত্রের পথে নবযাত্রা শুরু করবে বলে বিশ্বাস করি।

সালাহউদ্দিন আহমেদ রায়হান নির্বাহী সদস্য, বাংলাদেশ রিসার্চ অ্যানালাইসিস অ্যান্ড ইনফরমেশন নেটওয়ার্ক

* মতামত লেখকের নিজস্ব

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: ন র ব চ ত হওয় র পর ব এনপ র ত হয় ছ অন য য় র জন য প রক শ ন র জন সরক র ইসল ম সদস য দলগ ল

এছাড়াও পড়ুন:

ট্রাম্পের এনএফএল অ্যাডভেঞ্চার: স্টেডিয়ামে শুনলেন দুয়ো

চার দশকের বেশি সময় পর প্রথমবারের মতো মার্কিন প্রেসিডেন্ট হিসেবে ন্যাশনাল ফুটবল লিগের (এনএফএল) নিয়মিত মৌসুমের ম্যাচ দেখতে মাঠে গেছেন ডোনাল্ড ট্রাম্প। রোববার মেরিল্যান্ডের ম্যাচটিতে মুখোমুখি হয় ওয়াশিংটন কমান্ডার্স ও ডেট্রয়েট লায়ন্স। তবে মাঠে গিয়ে খেলা দেখতে যাওয়ার অভিজ্ঞতাটা ট্রাম্পের জন্য সুখকর হয়নি।

খেলার প্রথমার্ধের শেষ দিকে বড় পর্দায় ট্রাম্পকে দেখানো হলে গ্যালারির অনেক দর্শক তাকে উদ্দেশ করে দুয়ো দিতে শুরু করেন। সে সময় তিনি মার্কিন প্রতিনিধি পরিষদের স্পিকার মাইক জনসনের সঙ্গে একটি স্ট্যান্ডে দাঁড়িয়ে ছিলেন। বিরতির সময় স্টেডিয়ামের ঘোষক যখন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের উপস্থিতির কথা জানান, তখনো গ্যালারির একাংশ থেকে একই প্রতিক্রিয়া শোনা যায়।

এর আগে বিমান থেকে নামার পর সাংবাদিকদের ট্রাম্প বলেন, ‘আমি একটু দেরি করে ফেলেছি।’ এরপর তিনি বুলেটপ্রুফ গাড়িতে চড়ে স্টেডিয়ামের পথে রওনা দেন। ট্রাম্প বলেন, ‘খেলাটা দারুণ হবে। সবকিছু ভালোই চলছে। দেশও ভালো আছে।’

আরও পড়ুনশান্তি পুরস্কার নিয়ে আসছে ফিফা, প্রথমবার কি ডোনাল্ড ট্রাম্প পাবেন০৬ নভেম্বর ২০২৫

ট্রাম্প মাঠে পৌঁছানোর আগেই, ম্যাচের প্রথম কোয়ার্টারে লায়ন্সের রিসিভার আমন-রা সেন্ট ব্রাউন টাচডাউন করেন। এরপর তিনি গ্যালারির দিকে ইশারা করে হাত নেড়ে উদযাপন করেন, যা ছিল ‘ট্রাম্প ড্যান্স’-এর আদলে। গত বছর কয়েকজন খেলোয়াড় এই উদ্‌যাপনকে জনপ্রিয় করে তোলেন।

চেনা পোজে ডোনাল্ড ট্রাম্প

সম্পর্কিত নিবন্ধ