জাপান ও ভারতে তৈরি পোশাক রপ্তানি বাড়ছে
Published: 27th, June 2025 GMT
অপ্রচলিত বা নতুন বাজারে বাংলাদেশের তৈরি পোশাক রপ্তানি বাড়ছে। চলতি ২০২৪–২৫ অর্থবছরের প্রথম ১১ মাসে (জুলাই-মে) নতুন বাজারগুলোতে মোট ৬০৪ কোটি মার্কিন ডলারের পোশাক রপ্তানি হয়েছে। এ রপ্তানি গত অর্থবছরের একই সময়ের তুলনায় ৬ দশমিক ৭৯ শতাংশ বেশি।
বাংলাদেশের তৈরি পোশাকের শীর্ষ পাঁচ নতুন রপ্তানি গন্তব্য হচ্ছে জাপান, অস্ট্রেলিয়া, রাশিয়া, ভারত ও দক্ষিণ কোরিয়া। চলতি অর্থবছরে এখন পর্যন্ত এই পাঁচ বাজারের মধ্যে জাপান ও ভারতে তৈরি পোশাকের রপ্তানি বেড়েছে সবচেয়ে বেশি, তা যথাক্রমে ১০ ও ১৭ শতাংশ। অস্ট্রেলিয়ায় রপ্তানি বেড়েছে মাত্র ২ শতাংশ। তবে রাশিয়া ও দক্ষিণ কোরিয়ায় তৈরি পোশাকের রপ্তানি কমেছে।
রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরো (ইপিবি) হালনাগাদ পরিসংখ্যান থেকে জানা যায়, চলতি অর্থবছরের প্রথম ১১ মাসে দেশ থেকে সব মিলিয়ে ৩ হাজার ৬৫৬ কোটি ডলারের তৈরি পোশাক রপ্তানি হয়েছে। এই রপ্তানি এর আগের ২০২৩–২৪ অর্থবছরের একই সময়ের চেয়ে ১০ দশমিক ২০ শতাংশ বেশি। প্রচলিত সব বাজারেই অর্থাৎ ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ), যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য ও কানাডায় রপ্তানি বেড়েছে।
বাংলাদেশের তৈরি পোশাক রপ্তানিতে অপ্রচলিত বাজারগুলোর মধ্যে সবার শীর্ষে জাপান। চলতি অর্থবছরের মে পর্যন্ত ১১ মাসে দেশটিতে ১১২ কোটি ডলারের তৈরি পোশাক রপ্তানি হয়, যা গত অর্থবছরের একই সময়ের চেয়ে ১০ দশমিক ৩২ শতাংশ বেশি। গত ২০২৩-২৪ অর্থবছরে দেশটিতে ১০৯ কোটি ডলারের তৈরি পোশাক রপ্তানি হয়েছিল।
অপ্রচলিত বাজারগুলোর মধ্যে দ্বিতীয় অবস্থানে রয়েছে অস্ট্রেলিয়া। চলতি অর্থবছরে এখন পর্যন্ত দেশটিতে বাংলাদেশের উদ্যোক্তারা ৭৬ কোটি ডলারের তৈরি পোশাক রপ্তানি করেছেন, যা গত অর্থবছরের একই সময়ের তুলনায় ২ শতাংশ বেশি। এ ছাড়া তৃতীয় শীর্ষ অপ্রচলিত বাজার রাশিয়ায় বাংলাদেশ থেকে গত জুলাই-মে সময়ে ৩১ কোটি ডলারের তৈরি পোশাক রপ্তানি হয়েছে, যা গত অর্থবছরের একই সময়ের তুলনায় সাড়ে ৯ শতাংশ কম।
চলতি অর্থবছরের জুলাই-মে সময়ে প্রতিবেশী ভারতে ৬১ কোটি ডলারের তৈরি পোশাক রপ্তানি হয়েছে, যা গত অর্থবছরের একই সময়ের চেয়ে ১৭ দশমিক ৩৫ শতাংশ বেশি। গত অর্থবছরে দেশটিতে ৫৪ কোটি ডলারের তৈরি পোশাক রপ্তানি হয়েছিল। তার আগের অর্থবছরে রপ্তানি হয়েছিল ৬৮ কোটি ডলারের তৈরি পোশাক।
ভারতে শুল্কমুক্ত সুবিধা পেলেও বাজারটিতে তৈরি পোশাক রপ্তানি বাধাগ্রস্ত হওয়ার আশঙ্কা করছেন দেশের রপ্তানিকারকেরা। এর কারণ হলো, গত মাসে স্থলপথে বাংলাদেশ থেকে তৈরি পোশাক আমদানি নিষিদ্ধ করেছে ভারত সরকার। সে অনুযায়ী শুধু ভারতের নব সেবা ও কলকাতা সমুদ্রবন্দর ব্যবহার করে দেশটির আমদানিকারকেরা বাংলাদেশ থেকে তৈরি পোশাক আমদানি করতে পারবেন।
জানতে চাইলে স্প্যারো গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) শোভন ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, ‘সাত দিনের লিড টাইম ও কম পরিবহন খরচে আমরা স্থলবন্দর ব্যবহার করে ভারতে তৈরি পোশাক পাঠাতে পারতাম। বিধিনিষেধ আরোপের পর এখন সমুদ্রপথে রপ্তানি করতে ১৫-২১ দিন সময় লাগবে। মাসে তিনটি জাহাজ চট্টগ্রাম থেকে সরাসরি নব সেবা বন্দরে যায়। বাকি জাহাজ কলম্বো ঘুরে যায়।
শোভন ইসলাম আরও বলেন, বিধিনিষেধের কারণে পশ্চিমা ব্র্যান্ডগুলো ক্রয়াদেশ কমিয়ে দিয়েছে। ভারতের যেসব আমদানিকারক ক্রয়াদেশ দিচ্ছেন না, তাঁরা কারণ হিসেবে ভিসা জটিলতার কথা বলেন। সে দেশে পণ্য পাঠানোর খরচ বেড়েছে। ফলে সামনের দিনে এই বাজারে তৈরি পোশাকের রপ্তানি কমতে পারে।
.উৎস: Prothomalo
এছাড়াও পড়ুন:
প্রবাসী আয় ও বিদেশি ঋণে রিজার্ভ বেড়ে ৩ হাজার কোটি ডলার
আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর বৈধ পথে প্রবাসীদের অর্থ পাঠানো বেড়েছে। এই বাড়তি প্রবাসী আয় বা রেমিট্যান্স দেশে বৈদেশিক মুদ্রাবাজারে স্বস্তি ফিরিয়ে এনেছে। এতে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বা মজুতের ওপর থেকে চাপ কমে আসছে। ১০ মাস ধরে কেন্দ্রীয় ব্যাংক রিজার্ভ থেকে ডলার বিক্রি করছে না। এর ওপর দেশের ব্যাংক ও রাজস্ব খাত সংস্কার, বাজেট সহায়তা ও ঋণ হিসাবে ৫০০ কোটি মার্কিন ডলারের বেশি ঋণ আসছে। এতে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বাড়ছে।
জানা গেছে, আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) চলমান ঋণ কর্মসূচির বকেয়া দুই কিস্তি বাবদ ১৩৪ কোটি ডলার এসেছে, যা ইতিমধ্যে দেশের রিজার্ভে যুক্ত হয়েছে। পাশাপাশি বিশ্বব্যাংকের ৫০ কোটি ডলার ও এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের (এডিবি) ৯০ কোটি ডলার ঋণও দেশের রিজার্ভে যুক্ত হয়েছে।
সব মিলিয়ে গতকাল বৃহস্পতিবার কেন্দ্রীয় ব্যাংকে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বেড়ে ৩০ দশমিক ৫১ বিলিয়ন বা ৩ হাজার ৫১ কোটি মার্কিন ডলারে দাঁড়িয়েছে। তবে আইএমএফের হিসাব পদ্ধতি বিপিএম ৬ মান অনুযায়ী রিজার্ভের পরিমাণ হচ্ছে ২৫ দশমিক ৫১ বিলিয়ন বা ২ হাজার ৫৫১ কোটি ডলার। আর ব্যবহারযোগ্য রিজার্ভের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১৯ দশমিক ৮০ বিলিয়ন বা ১ হাজার ৯৮০ কোটি ডলার।
জানা গেছে, দেশের ঋণ পরিশোধের সক্ষমতা বিবেচনায় আইএমএফ আরও ৯০ কোটি ডলার ঋণ দেবে। এ ছাড়া বিশ্বব্যাংক, এশীয় অবকাঠামো বিনিয়োগ ব্যাংক (এআইআইবি), জাপান ও ওপেক ফান্ড থেকে আরও দেড় শ কোটি ডলারের ঋণ আসবে, যা চলতি মাসের মধ্যেই রিজার্ভের হিসাবে যোগ হবে। তাতে চলতি জুন মাসের শেষে মোট রিজার্ভ বেড়ে ৩২ বিলিয়ন বা ৩ হাজার ২০০ কোটি ডলারে পৌঁছাবে।
* আইএমএফের হিসাব পদ্ধতি বিপিএম ৬ অনুযায়ী রিজার্ভ ২৫.৫১ বিলিয়ন ডলার।* দেশের ব্যবহারযোগ্য রিজার্ভের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১৯.৮০ বিলিয়ন ডলার।
বাংলাদেশ ব্যাংকের শীর্ষ পর্যায়ের দুজন কর্মকর্তা প্রথম আলোকে বলেন, রিজার্ভ স্বাভাবিকভাবে না বেড়ে কিন্তু ঋণের অর্থে বাড়ছে। তবে এসব ঋণ দীর্ঘমেয়াদি ও কম সুদের, যা নিকট ভবিষ্যতে রিজার্ভের ওপর চাপ তৈরি করবে না। এসব অর্থে দেশের বাজেট বাস্তবায়ন এবং ব্যাংক ও রাজস্ব খাতের সংস্কার করা হবে। আর সংস্কার হলে অর্থনীতি চাঙা হবে এবং রপ্তানি আয় ও রাজস্ব আয় দুটোই বাড়বে, যা দেশের অর্থনীতিতে ইতিবাচক প্রভাব ফেলবে। এসব ঋণ দীর্ঘমেয়াদি হওয়ায় পরিশোধে তেমন চাপ তৈরি করবে না।
গত ২০২৩-২৪ অর্থবছরে দেশে প্রবাসী আয় এসেছিল ২৩ দশমিক ৯১ বিলিয়ন ডলার। চলতি ২০২৪-২৫ অর্থবছরে গত সপ্তাহ পর্যন্ত প্রবাসী আয় এসেছে ২৯ দশমিক ৪৬ বিলিয়ন ডলার। অর্থাৎ চলতি অর্থবছরে এখন পর্যন্ত প্রায় ৬ বিলিয়ন ডলার আয় বেশি এসেছে। এদিকে রপ্তানি আয়ে প্রবৃদ্ধি রয়েছে ৯ শতাংশ। ফলে আমদানি ৫ শতাংশের মতো বাড়লেও বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বাড়ছে।
২০২৪ সালের ৩১ জুলাই আওয়ামী লীগ সরকারের শেষ সপ্তাহে বাংলাদেশ ব্যাংকে মোট রিজার্ভ ছিল ২৫ দশমিক ৯২ বিলিয়ন ডলার। তখন বিপিএম-৬ অনুযায়ী রিজার্ভ ছিল ২০ দশমিক ৪৮ বিলিয়ন ডলার।
ব্যাংকাররা বলছেন, অর্থ পাচার কমে আসায় প্রবাসী আয় বেড়েছে। পাশাপাশি অন্তর্বর্তী সরকারকে সমর্থন দিয়ে বিদেশিরা ঋণ সহায়তা দিয়ে যাচ্ছে। এর ফলে রিজার্ভের উল্লম্ফন হচ্ছে।
স্বস্তি ডলারের বাজারেও
তিন বছর ধরে দেশের অর্থনীতিতে চেপে বসা ডলার-সংকট কাটতে শুরু করেছে। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাবে টালমাটাল বিশ্ববাজারের ধাক্কা লেগেছিল দেশের অর্থনীতির প্রতিটি খাতে। জ্বালানি থেকে খাদ্যপণ্য, পরিবহন ব্যয় বৃদ্ধির জেরে বেড়েছিল আমদানি খরচ। ডলারের তীব্র সংকট ও হঠাৎ মূল্যবৃদ্ধি ডেকে এনেছিল মূল্যস্ফীতির অসহনীয় যন্ত্রণা।
ডলারের অস্থির বাজারে এখন অনেকটাই স্বস্তির সুবাতাস বইছে। তাতে ইতিবাচক ধারায় ফিরছে আর্থিক সূচকগুলো। তবে উচ্চ মূল্যস্ফীতির কাঁটা এখনো সরেনি সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রার ওপর থেকে।
দেশে ডলারের সরবরাহ বৃদ্ধি পাওয়ায় প্রবাসী আয়েও ডলারের দাম কমে এসেছে। প্রবাসী এক্সচেঞ্জ হাউস থেকে দেশের ব্যাংকগুলো আগে ১২৩ টাকার বেশি দামে ডলার কিনত। এখন তা কমে ১২২ টাকা ৭০ থেকে ১২২ টাকা ৮০ পয়সায় নেমেছে। ব্যাংকগুলোর ডলার কেনার খরচ খানিক কমে আসায় আমদানিকারকদের এখন ডলার কিনতে বাড়তি দাম দিতে হচ্ছে না। এতে স্বস্তি এসেছে আনুষ্ঠানিক ডলারের বাজারে। এর ফলে আমদানিকারকেরা এখন ১২৩-১২৪ টাকার মধ্যে আমদানি দায় মেটাতে পারছেন।
ব্যাংকাররা বলছেন, গত বছরের আগস্টে আওয়ামী লীগের পতনের পর অর্থ পাচার রোধে অন্তর্বর্তী সরকারের নেওয়া পদক্ষেপ ডলার-সংকট কাটাতে বড় ভূমিকা রেখেছে। নজরদারি বৃদ্ধির ফলে বৈধ পথে প্রবাসী ও রপ্তানি আয়ের প্রবাহ বেড়েছে। এতে আর্থিক হিসাবে ইতিবাচক পরিবর্তন এসেছে।
ডলারের বাজার নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে সমস্যা থাকলেও কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছিল খুব কম। অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর ডলারের বাজার নিয়ে কিছু পদক্ষেপ নেওয়া হয়, যা কার্যকর হয়েছে। এতেই ডলারের বাজারে স্বস্তি নেমে আসে।
ডলারের বাজার পরিস্থিতির উন্নতি হওয়ায় আমদানিতে এখন আর আগের মতো কড়াকড়ি নেই। ফলে আমদানিকারকেরা ব্যাংকে গেলেই ডলার পাচ্ছেন।
জানতে চাইলে অর্থনীতিবিদ মোস্তফা কে মুজেরী প্রথম আলোকে বলেন, ডলারের বাজারে স্বস্তি আসছে, এটা সুখবর। তবে আমদানি উন্মুক্ত করে দিতে হবে, যাতে ব্যবসা-বাণিজ্যে প্রবৃদ্ধি হয়। ঋণ বাড়িয়ে রিজার্ভ বাড়ানোর চেয়ে স্বাভাবিকভাবে বাড়লে সেটা বড় স্বস্তিকর হতো। কারণ, এসব অর্থ সুদসহ শোধ দিতে হবে। তবে এসব ঋণ দীর্ঘমেয়াদি হওয়ায় চাপ কিছুটা কম হবে। সংস্কারের জন্য যে ঋণ নেওয়া হচ্ছে, তা বাস্তবায়িত হলে দেশের জন্য ভালো হবে।