অনড় অবস্থান নয়, নমনীয়তাই রাজনৈতিক দূরদৃষ্টি
Published: 28th, June 2025 GMT
গত ১৬ জুন পর্যন্ত দেশের রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে আলোচনার কেন্দ্রে ছিল প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস ও বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের মধ্যে যে সমঝোতামূলক ও ইতিবাচক আলোচনা হয়েছে, তার পক্ষে ও বিপক্ষে। দেশবাসী অধ্যাপক ড. ইউনূস ও তারেক রহমানের মধ্যকার আলোচনাকে ইতিবাচক বলে মনে করে। অধিকাংশ রাজনৈতিক দলও তা মনে করে, কেবল বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী ও জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) বলেছে অন্তর্বর্তী সরকার বিএনপিকে বেশি গুরুত্ব দিয়েছে। সাদা চোখে এটাই মনে হবে যে সরকার বিএনপিকে বেশি গুরুত্ব দিয়েছে। কিন্তু মূল সিদ্ধান্ত হচ্ছে একটি গ্রহণযোগ্য নিরপেক্ষ, কারচুপিহীন নির্বাচন সম্পন্ন করার পর নির্বাচিত দলের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করা। সেই বিবেচনায় সরকার ঠিক পথেই চলছে।
নির্বাচনের সঙ্গে সংস্কারের কোনো রকম দ্বন্দ্ব নেই। তবে, এ নিয়ে মত-পথ ইত্যাদি নিয়ে তর্ক আছে। এই তর্ক চলতেই থাকবে।
কারণ, তর্ক হচ্ছে মত আদান-প্রদানের মাধ্যম। একে বলা উচিত তর্ক হচ্ছে ভুলত্রুটি সংস্কারের নৌপথ।
২.
সংস্কার ও নির্বাচন বিষয়ে দেশের প্রজ্ঞাবান বুদ্ধিজীবী, বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি, অধ্যাপক, থিঙ্কট্যাঙ্কের চিন্তক, রাষ্ট্র ও গণতন্ত্র নিয়ে ভাবুক রাজনৈতিক ব্যক্তি তাদের অভিমত তুলে ধরেছেন গত ৪ জুন এক গোলটেবিল বৈঠকে। শিরোনাম ছিল গণতন্ত্রের পূর্ণাঙ্গ যাত্রা : জরুরি সংস্কার, জাতীয় সংসদ নির্বাচন এবং সুশাসন। জাতীয় প্রেস ক্লাবের তফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়া মিলনায়তনে অনুষ্ঠিত গোল টেবিল বৈঠকটিকে আমি বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে দেখতে চাই। কেননা, যারা সেদিন আলোচনায় অংশ নিয়েছেন, তারা কেবল জাতির ক্রান্তিলগ্নেই ভূমিকা রাখেন না, যে কোনো বিতর্কে তাদের অভিমত জাতিকে পথ দেখায়।
আলোচকরা বলেছেন নির্বাচন ছাড়া গণতন্ত্র পূর্ণতা পায় না। সংস্কার হচ্ছে প্রবহমান নদীর মতো। একটি জাতির ইচ্ছা, যাকে আমরা বলছি জনআকাঙ্ক্ষা, তা ধাপে ধাপে পরিপূর্ণতার দিকে যায়। আজকে আমাদের গণতন্ত্র যেখানে এসেছে, তাকে শীলিত ও পরিশীলিত করতে হলে আগে জনগণের ম্যান্ডেট নেওয়া প্রয়োজন। কারণ তাদের জন্যই ওই সংস্কারের চিন্তা। বিদ্যমান সংবিধানের বেশ কিছু অগণতান্ত্রিক বিষয় রয়েছে, যা সংস্কৃত না হলে, জনগণের জন্য উপকার বা কল্যাণ করা যাবে না। বিশেষ করে ৭০ অনুচ্ছেদের সংস্কার তার অন্যতম। ফ্লোর ক্রসিংসহ জনগণের অধিকারের পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়ন সম্ভব নয় যদি উত্থাপিত সংস্কার করা না যায়। সেই ম্যান্ডেট পাওয়া জনগণের প্রতিনিধিরাই সংস্কার কাজ এগিয়ে নিয়ে যাবে– এটাকে প্রাথমিক ধারণা বলে মনে হলেও গণতন্ত্রে এই ব্যবস্থাই ইউনিভার্সাল বা বৈশ্বিকভাবে ব্যবহৃত।
আলোচকদের মধ্যে সংস্কার নিয়ে এ রকম ধারণার মূল কারণ হচ্ছে শাসন ব্যবস্থায় যেন কোনো ছিদ্রপথেই শাসকগোষ্ঠীর স্বৈরাচার হয়ে ওঠার সুযোগ না থাকে। সুশাসন কায়েম করতে হলে স্থানীয় সরকার থেকে শুরু করে সব ক্ষেত্রেই সংস্কার অব্যাহত রাখতে হবে। এই সরকারের পক্ষে তো দীর্ঘকাল ক্ষমতায় থাকা সম্ভব নয়। তাই জরুরি সংস্কারগুলো সম্পন্ন করে নির্বাচন দেওয়াটাই হবে যথাযথ কাজ।
অধ্যাপক ইউনূস সব সময়ই বলে আসছেন, তিনি নির্বাচন দেবেন যৌক্তিক সময়ে। তাঁর সেই যৌক্তিক সময়, তিনি যেমন বলেছিলেন, ২০২৫ সালের ডিসেম্বর থেকে ২৬ সালের জুনের মধ্যে। কিন্তু রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে এ নিয়ে সন্দেহ ও আগ্রহের তীব্রতা আমরা লক্ষ্য করেছি। কোনো দল নির্বাচন চায় এ বছরের ডিসেম্বরে। এটা বিএনপির চাওয়া। জামায়াত ও এনসিপি চায় আগে স্থানীয় সরকার নির্বাচন চায়। আবার বিএনপি বলেছে, স্থানীয় সরকারের নির্বাচন হলে রাজনৈতিক পরিস্থিতি ঘোলাটে হতে পারে, যা জাতীয় নির্বাচনকে ব্যাহত করতে পারে। বরং জাতীয় নির্বাচনই আগে করতে অন্তর্বর্তী সরকারের চলমান সংস্কার কাজ নির্বাচিত সরকার সংসদে বসে সম্পন্ন করতে পারে, যা যৌক্তিক। গণতন্ত্র ও পার্লামেন্টের মধ্যে একটি সেতু আছে, যা দেশের মানুষকেই কেবল মানসিকভাবে ঐক্যবদ্ধ করে না, নৈতিকভাবেই তাদের ওই মানসিকতায় এনে দাঁড় করায়।
লন্ডনে ড. ইউনূসের সঙ্গে তারেক রহমানের মধ্যে যে বৈঠক হয়েছে, তা মূলত রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যকার ভুল বোঝাবুঝির অবসানই কেবল করেনি, নির্বাচনের তারিখ পরিবর্তনের মতো গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্তও নেওয়া সম্ভব হয়েছে। প্রধান উপদেষ্টা তাঁর ঘোষিত মাস এপ্রিল থেকে এগিয়ে এসেছেন রোজার আগে নির্বাচন করার নতুন সিদ্ধান্তে। আবার বিএনপিও ২৫-এর ডিসেম্বর থেকে পেছনে সরে এসেছে রোজার আগে নির্বাচনের সিদ্ধান্তের নতুন দিগন্তু উন্মোচন করেছে। এই যে ফ্লেক্সিবিলিটি বা নমনীয়তা, রাজনীতিকে অনড় না করে দেশ ও গণমানুষের প্রতি দায়বদ্ধত থাকা, তাদের ইচ্ছার প্রতি সম্মান ও অধিকারকে মূল্যায়ন করা, তাকে আমি রাজনৈতিক দূরদৃষ্টিরই নমুনা হিসেবে চিত্রিত করব। রাজনীতি তার সৌন্দর্য় নির্মাণ করে এইভাবে, গণতন্ত্র ও গণতান্ত্রিক বোধের উন্মেষ ঘটিয়ে।
এই সমঝোতাই নতুন একটি নির্বাচনী হাওয়া বইয়ে দিয়েছে দেশে। কেবল নাখোশ হয়েছে জামায়াত আর এনসিপি। তারা বলেছেন, এতে করে বিএনপিকে বেশি গুরুত্ব দিয়েছে বর্তমান সরকার। সেটা হওয়ারই কথা। রাজনৈতিক দলের আকার ও আদর্শের ভিত্তিতেই জনগণের মধ্যে সমর্থক নির্ণীত হয়। জামায়াত ও এনসিপি কি করে এটা কামনা করে যে তাদের প্রতি বৈষম্য হয়েছে। জামায়াতের মনে রাখা উচিত যে, অতীতের নির্বাচনে তারা কতটা আসন পেয়েছিল। বিএনপির সঙ্গে জোটের পর তারা পেয়েছিল সর্বোচ্চ সংখ্যক আসন। তারা এককভাবে যখন নির্বাচন করেছে, তখন তাদের বিজয় কয়টা আসনে হয়েছিল, সেটা স্মরণ রাখতে হবে। এবার তাদের প্রতি সাধারণ মানুষের মধ্যে একটি ইতিবাচক দৃষ্টির জন্ম হয়েছে। সহানুভূতি পাওয়া আর ভোট পাওয়া ভিন্ন বিষয়। আর যদি তারা ভেবে থাকেন আওয়ামীরা জামায়াতকে ভোট দিয়ে জিতিয়ে আনবে, তাহলে বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসের গতিপথ পাল্টে গেছে বলে ধরে নেওয়া হবে। এনসিপির ব্যাপারে তেমন কিছু বলার সময় এখনও হয়নি। তারা নির্বাচনী মাঠে পরীক্ষিত দল নয়।
আসলে বিএনপিকে বেশি গুরুত্ব দেওয়ার বিষয় প্রধান নয়, এখানে মূল সংকট অন্য জায়গায় নিহিত ছিল। কারণ নির্বাচন নিয়ে যে সব ক্যাওয়াস ও দর কষাকষি হচ্ছিল, তার রাশ টেনে ধরেছেন প্রধান উপদেষ্টা ড. ইউনূস। আর তারেক রহমান তাতে সায় দিয়েছেন। এটি হচ্ছে অন্যতম দিক। দ্বিতীয় দিকটি হচ্ছে, বিএনপিকে গুরুত্ব দেওয়ার পেছনে রয়েছে রাজনৈতিক কমিটমেন্টের বিবেচনা। এটা মনে রাখতে হবে, বাকশাল-উত্তর বাংলাদেশে বহুদলীয় গণতন্ত্রের সূচনা করেছিলেন বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমান। আর খালেদা জিয়ার হাতে দেশে সংসদীয় গণতন্ত্রের দ্বার উন্মুক্ত হয়েছিল। তিনি যে গণতন্ত্র এবং মতপ্রকাশের স্বাধীনতাকেই মূল্যায়ন করেছিলেন সুশাসনের লক্ষ্যে, তা প্রমাণিত সত্য।
তারপরও, আমাদের নতুন করে গণতান্ত্রিক শাসন কায়েমের জন্য সংগ্রাম করতে হয়েছে। জীবন দিয়ে শেখ হাসিনার সরকারকে বিদায় করতে হয়েছে। সেখানে দেশের সচেতন রাজনৈতিক দলগুলোর (হাসিনার অনুগত বা গৃহপালিত বিরোধী দলগুলো ছাড়া, তার বশংবদ আমলাতন্ত্র ও কতিপয় বুদ্ধিজীবি ছাড়া) অবদান অবশ্যই স্বীকার করতে হবে। যারা জান দিয়ে, প্রাণ দিয়ে নতুন রক্তাক্ত ইতিহাস রচনা করেছে, তাদের প্রতি সরকারের মানবিক ও নৈতিক সমর্থন থাকতে হবে, যা পরবর্তী নির্বাচিত সরকার পরিবহন করবে। বহুদলীয় গণতন্ত্রের সৌন্দর্য় এখানে যে, তার উয়িংসগুলোর শক্তিশালী ভূমিকা সুশাসনকে অর্থবহ করে তোলে।
ড. মাহবুব হাসান: কবি ও সাংবাদিক
উৎস: Samakal
কীওয়ার্ড: র জন ত ত র ক রহম ন গণতন ত র র র জন ত ক দ ন য় সরক র ব এনপ র সরক র র ব এনপ ক র ব এনপ জনগণ র এনস প ইউন স
এছাড়াও পড়ুন:
মামদানির জয় থেকে ডেমোক্র্যাটরা কি শিক্ষা নেবেন
ডেমোক্রেটিক পার্টি এখন একটা গুরুত্বপূর্ণ মোড়ে এসে দাঁড়িয়েছে। এখন তাদের একটি গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নিতেই হবে। পার্টি চাইলে আগের মতোই এমন সব নীতি চালিয়ে যেতে পারে, যেসব নীতি বস্তাপচা ও পক্ষপাতদুষ্ট অর্থনৈতিক-রাজনৈতিক ব্যবস্থাকে আঁকড়ে বসে আছে। চাইলে তারা যুক্তরাষ্ট্রের সেই ৬০ শতাংশ মানুষের কষ্টকে কোনো রকম পাত্তা না দিয়েও চলতে পারে, জীবন চালাতে হিমশিম খাওয়া যে মানুষগুলো সপ্তাহ শেষে বেতন পাওয়ার পরের দিনই পরবর্তী বেতনের জন্য দিন গোনে।
ডেমোক্র্যাটরা চাইলে সেই তরুণ প্রজন্মের স্বপ্নকে অবহেলা করতে পারেন, যে প্রজন্ম সম্ভবত তাদের মা-বাবার চেয়েও খারাপ সময়ের মুখোমুখি হবে। তাঁরা চাইলে কোটি কোটি ডলার চাঁদা দেওয়া ধনকুবের আর বাস্তবতা না-জানা সেই পরামর্শকদের ওপর নির্ভর করে চলতে পারেন, যাঁরা লাখ লাখ ডলার খরচ করে দলের প্রচারে একঘেয়ে, ক্লিশে ও সাধারণ মানুষের কাছে গুরুত্বহীন ৩০ সেকেন্ডের বিজ্ঞাপন বানান।
ডেমোক্র্যাটরা চাইলে সেই ভয়াবহ বাস্তবতাকেও এড়িয়ে যেতে পারেন, যে বাস্তবতায় যুক্তরাষ্ট্রের কোটি কোটি নাগরিক গণতন্ত্র থেকে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছে। কারণ, তারা অনুভব করে না যে সরকার তাদের জীবনযন্ত্রণা বোঝে বা কোনো সমাধান দিতে চায়। অথবা ডেমোক্র্যাটরা চাইলে জোহরান মামদানির মঙ্গলবারের বিজয় থেকে একটি শিক্ষা নিতে পারেন। সেই শিক্ষা হলো, মানুষের মুখোমুখি হয়ে প্রকৃত অর্থনৈতিক ও নৈতিক সংকটগুলো সাহস করে তুলে ধরতে হবে। সেই সঙ্গে ধনিক শ্রেণির লোভ ও ক্ষমতার বিরুদ্ধে দাঁড়াতে হবে এবং এমন একটি কর্মসূচির পক্ষে লড়তে হবে, যা সাধারণ খেটে খাওয়া মানুষের জীবনকে উন্নত করতে পারে।
মোদ্দাকথা, ডেমোক্রেটিক পার্টির সামনে এখন দুটি রাস্তা। একটি হলো পুরোনো ভুল পথে চলতে থাকা; আরেকটি হলো, সাধারণ মানুষের পাশে দাঁড়িয়ে নতুন কিছু করা। অনেকে বলছেন, মামদানির বিজয় কেবল তাঁর ব্যক্তিত্ব আর ক্যারিশমার ফল। হ্যাঁ, নিশ্চয়ই তিনি এক চমৎকার প্রার্থীর উদাহরণ। কিন্তু শুধু ভালো প্রার্থী থাকলেই এমন বিজয় আসে না। জয়ের পেছনে থাকতে হয় অসাধারণ এক তৃণমূল আন্দোলন। হাজার হাজার মানুষ যদি আগ্রহ নিয়ে দরজায় দরজায় গিয়ে তাঁর পক্ষে প্রচার না করত, তবে এমন জয় সম্ভব হতো না।
বর্তমান ডেমোক্রেটিক পার্টির নেতারা মামদানির নির্বাচনী প্রচারণা থেকে শিক্ষা নেবেন কি না, সেটা নিয়ে সন্দেহ আছে। সম্ভবত নেবেন না। কারণ, তাঁদের অনেকেই এমন অবস্থায় আছেন, যেখানে তাঁরা নিজেরাই সেই ডুবতে থাকা জাহাজ ‘টাইটানিক’-এর ক্যাপ্টেন হয়ে থাকতে চান; কিন্তু দিক পরিবর্তন করতে চান না।আর এই আন্দোলন গড়ে ওঠে তখনই, যখন এর পেছনে থাকে এমন একটি অর্থনৈতিক কর্মসূচি, যা সাধারণ মানুষের প্রয়োজন আর কষ্টের কথা বলে। নিউইয়র্কের মানুষ এবং গোটা আমেরিকান জনতা জানে, এই পৃথিবীর সবচেয়ে ধনী দেশ হিসেবে পরিচিত একটি দেশে কারও জন্য শুধু খাওয়া, ঘরভাড়া দেওয়া বা ডাক্তার খরচ মেটাতে যুদ্ধ করার মতো কষ্ট করা উচিত নয়।
ডেমোক্রেটিক পার্টির পেইড কনসালট্যান্টরা হয়তো জানেনই না, এই সাধারণ মানুষগুলো আসলে কী চায়, তারা কোথায় থাকে। মামদানির ‘চরমপন্থী’ বা ‘অবাস্তব’ অর্থনৈতিক নীতির সমালোচনা হচ্ছে ঠিকই; কিন্তু তৃণমূল মানুষ জানে, এই নীতিগুলো আসলে তাদেরই কথা বলছে।
আজকের দুনিয়ায় যেখানে ধনী আর সাধারণ মানুষের মধ্যে আয় ও সম্পদের পার্থক্য ভয়াবহ রকম বেড়ে গেছে, সেখানে ধনী ব্যক্তি আর বড় করপোরেশনগুলোর উচিত তাদের ন্যায্য পরিমাণ কর দেওয়া। মামদানির মতো নেতাদের দাবি এটিই। যখন অনেক নিউইয়র্কবাসী আর সস্তায় ভাড়া বাসা খুঁজে পাচ্ছে না, তখন ভাড়া না বাড়ানোর জন্য একটি স্থগিতাদেশ দরকার—এটিও মামদানির দাবি। যখন একজন শ্রমিকের প্রতিদিন কর্মস্থলে যাওয়া-আসার পেছনে বেতনের একটি বড় অংশ চলে যায়, তখন গণপরিবহন বিনা মূল্যের হওয়া উচিত। এটিও মামদানির ভাবনা।
আরও পড়ুনজোহরান মামদানি যেভাবে ইতিহাস বদলে দেওয়ার পথে২৬ জুন ২০২৫যখন অনেক নিম্নবিত্ত ও খেটে খাওয়া পরিবার ভালো খাবার কিনতে পারছে না; তাদের জন্য সরকার পরিচালিত পাড়াভিত্তিক মুদিদোকান প্রতিষ্ঠা করা দরকার। এই দাবিও এসেছে তাঁর পক্ষ থেকে। এসব দাবি শুনে অনেকেই বলবে ‘চরমপন্থী’। কিন্তু আসলে এগুলো খুবই সাধারণ মানুষের বাস্তব চাহিদা। হ্যাঁ, ধনীরা বা বড় দাতারা বা রিয়েল এস্টেট ব্যবসায়ীরা হয়তো এসব চান না। কিন্তু সাধারণ খেটে খাওয়া মানুষ ঠিক এই জিনিসগুলোই চায়। তাই হয়তো এখন সময় এসেছে এই মানুষগুলোর কথা শোনার।
মামদানির জয় কোনো তারকাখ্যাতির জন্য হয়নি। এটি হয়েছে সাধারণ মানুষের শক্তিতে। এই আন্দোলন মানুষকে আবার মনে করিয়ে দিয়েছে, গণতন্ত্র মানে কেবল ভোট নয়, বরং নিজের জীবনে যেসব সিদ্ধান্ত প্রভাব ফেলে, সেগুলো নিয়ে কথা বলার অধিকার দাবি করাও গণতন্ত্র। গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে, মামদানি সেই নৈতিক প্রশ্ন থেকে পালিয়ে যাননি, যা শুধু নিউইয়র্ক নয়, যুক্তরাষ্ট্রজুড়ে কোটি মানুষের মনে আঘাত দিচ্ছে। সেটি হলো ইসরায়েলের চরমপন্থী নেতানিয়াহুর সরকারের গণহত্যামূলক কর্মকাণ্ডে যুক্তরাষ্ট্র যেন সামরিক সহায়তা না দেয়। গাজার শিশুদের অনাহারে মারা যাওয়া কেউ চোখ বন্ধ করে মেনে নিতে পারে না।
মামদানি জানেন, আসলেই, ইহুদিবিদ্বেষ (অ্যান্টিসেমিটিজম) একটি জঘন্য ও বিপজ্জনক চিন্তাধারা। কিন্তু নেতানিয়াহুর মতো একজন নেতার অমানবিক নীতির সমালোচনা করা মানেই ইহুদিবিদ্বেষ নয়। মামদানির নির্বাচনী লড়াই আমাদের শেখায়, শুধু ট্রাম্পের বা তাঁর ধ্বংসাত্মক নীতির সমালোচনা করলেই চলবে না; আমাদের দরকার একটি ইতিবাচক ভবিষ্যৎ চিন্তা। দরকার এ প্রশ্নের জবাব—এই পরিস্থিতি কেন হলো, কেন আজ অধিকাংশ আমেরিকান পিছিয়ে পড়ছে?
বর্তমান ডেমোক্রেটিক পার্টির নেতারা মামদানির নির্বাচনী প্রচারণা থেকে শিক্ষা নেবেন কি না, সেটা নিয়ে সন্দেহ আছে। সম্ভবত নেবেন না। কারণ, তাঁদের অনেকেই এমন অবস্থায় আছেন, যেখানে তাঁরা নিজেরাই সেই ডুবতে থাকা জাহাজ ‘টাইটানিক’-এর ক্যাপ্টেন হয়ে থাকতে চান; কিন্তু দিক পরিবর্তন করতে চান না। তবে তাঁরা কী ভাবছেন, সেটা এখন খুব একটা গুরুত্বপূর্ণও নয়। কারণ, মামদানির বিরুদ্ধে এই ‘সিস্টেম’-এর পক্ষ থেকে সবকিছুই মাঠে নামানো হয়েছিল। মিলিয়ন মিলিয়ন ডলারের সুপার প্যাক অর্থায়ন, নামীদামি মানুষের সমর্থন, পক্ষপাতদুষ্ট গণমাধ্যম—সব নামানো হয়েছিল। তবু তাঁরা মামদানিকে হারাতে পারেননি।
● বার্নি স্যান্ডার্স মার্কিন সিনেটর এবং সিনেটে স্বাস্থ্য, শিক্ষা, শ্রম ও পেনশন-সংক্রান্ত কমিটির প্রধান সদস্যদের একজন
দ্য গার্ডিয়ান থেকে নেওয়া, অনুবাদ: সারফুদ্দিন আহমেদ