বাংলাদেশ থেকে স্থলপথে নতুন করে ৯ ধরনের পণ্য আমদানি নিষিদ্ধ করেছে ভারত। শুক্রবার এক বিজ্ঞপ্তিতে এই নিষেধাজ্ঞা দেওয়ার পর তা কার্যকর হয়েছে। তৃতীয় দফায় ভারতের এই নিষেধাজ্ঞা বাংলাদেশের রপ্তানিকারকদের দুশ্চিন্তায় ফেলছে।
ভারতের ব্যবসায়ীদের বাংলাদেশ থেকে এই ৯ পণ্য আমদানির জন্য সমুদ্রপথে একটি পথ খোলা রেখেছে দেশটি। বিজ্ঞপ্তি অনুযায়ী, সমুদ্রপথে মুম্বাইয়ের নভোসেবা বন্দর দিয়ে এসব বাংলাদেশি পণ্য ভারতে নেওয়া যাবে। তবে সমুদ্রপথে বাংলাদেশ থেকে ভারতে এসব পণ্যের মোট রপ্তানির ১ শতাংশ রপ্তানি হয়। ফলে নিষেধাজ্ঞার মাধ্যমে মূলত এসব পণ্য রপ্তানির সহজ পথটি বন্ধ করে দিল ভারত।
ভারতের বিধিনিষেধের তালিকায় থাকা ৯ পণ্যের মধ্যে রয়েছে ফ্ল্যাক্স সুতার বর্জ্য, কাঁচা পাট, পাটের রোল, ফ্ল্যাক্স সুতা, পাটের সুতা, ফুড গ্রেড সুতা, লিনেন কাপড়, লিনেন ও তুলার সুতা মিশ্রিত কাপড় এবং কম প্রক্রিয়াজাত বোনা কাপড়। নিষেধাজ্ঞার তালিকায় মূলত কাঁচা পাট ও প্রক্রিয়াজাত পাটপণ্যই বেশি।
জাতীয় রাজস্ব বোর্ড বা এনবিআরের হিসাবে, গত ২০২৩-২৪ অর্থবছর বাংলাদেশ থেকে এই ৯ পণ্য বিশ্বের ৮৮টি দেশে রপ্তানি হয়। রপ্তানির পরিমাণ ছিল ৬৬ কোটি ডলার বা ৭ হাজার ২৮৩ কোটি টাকা। তুরস্কের পর এই ৯ পণ্য রপ্তানির দ্বিতীয় শীর্ষ গন্তব্য ভারত। ভারতে গত অর্থবছরে এই ৯ পণ্য রপ্তানি হয়েছে প্রায় ১৫ কোটি ডলারের, যা ওই ৯ পণ্যের মোট রপ্তানির প্রায় ২৩ শতাংশ।
এ নিয়ে বাংলাদেশ থেকে পণ্য আমদানিতে তিন মাসে তিন দফায় অশুল্ক বাধা আরোপ করল ভারত। এর আগে গত ১৭ মে প্রথম দফায় বাংলাদেশ থেকে স্থলবন্দর দিয়ে তৈরি পোশাক, প্রক্রিয়াজাত খাদ্য, প্লাস্টিক, কাঠের আসবাব, সুতা ও সুতার উপজাত, ফল ও ফলের স্বাদযুক্ত পানীয়, কোমল পানীয় প্রভৃতি পণ্য আমদানিতে বিধিনিষেধ দিয়েছিল ভারত। এরপর গত ৯ এপ্রিল দ্বিতীয় দফায় ভারতের কলকাতা বিমানবন্দর ব্যবহার করে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে বাংলাদেশের পণ্য রপ্তানির সুবিধা প্রত্যাহার করে নেয় দেশটি।
রাজনৈতিক কারণে নেওয়া ভারতের এমন সিদ্ধান্তের কারণে দেশটিতে বাংলাদেশের কাঁচা পাট, পাট সুতা, পাটপণ্যসহ ৯ ধরনের পণ্য রপ্তানি বাধাগ্রস্ত হবে। তবে পাট রপ্তানি কতটা ক্ষতিগ্রস্ত হবে, সেটি বিশ্লেষণের জন্য বিজেএসএ ৩০ জুন বৈঠকে করবেতাপস প্রামাণিক, সভাপতি, বিজেএসএভারতে কত রপ্তানি, কতটা প্রভাব পড়বে
এনবিআরের হিসাবে, ২০২৩-২৪ অর্থবছরে বাংলাদেশ থেকে ভারতে প্রায় ১৫৯ কোটি ডলারে পণ্য রপ্তানি হয়েছে। এর মধ্যে গত শুক্রবার যেসব পণ্য রপ্তানিতে বিধিনিষেধ দেওয়া হয়েছে, সেগুলোর রপ্তানির পরিমাণ ছিল প্রায় ১৫ কোটি ডলার, যা ভারতে মোট রপ্তানির ৯ শতাংশ।
এর আগে ১৭ মে যে বিধিনিষেধ আরোপ করা হয়েছিল, তাতে প্রায় ৫০ কোটি ডলারের পণ্য রপ্তানি বাধাগ্রস্ত হয়েছিল, যা মোট রপ্তানির ৩১ শতাংশ। অর্থাৎ সব মিলিয়ে বাংলাদেশ থেকে ভারতে মোট রপ্তানির ৪০ শতাংশ পণ্য নিষেধাজ্ঞার কারণে বাধার মুখে পড়েছে। এর বাইরে কলকাতা বিমানবন্দর ব্যবহার করে ভারত থেকে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে বাংলাদেশের পণ্য রপ্তানির যে সুবিধা প্রত্যাহার করেছিল, তাতে আকাশপথে বিশ্বের অন্য দেশে বাংলাদেশের রপ্তানি বাধাগ্রস্ত হয়।
ক্ষতিগ্রস্ত হবে ১১৭ রপ্তানিকারক
ভারতের নতুন বিধিনিষেধ আরোপ করার আগে বাংলাদেশের ১১৭টি প্রতিষ্ঠান স্থলপথ ব্যবহার করে দেশটিতে পণ্য রপ্তানি করে আসছিল। এসব প্রতিষ্ঠান এখন ক্ষতিগ্রস্ত হবে। সম্ভাব্য ক্ষতিগ্রস্ত প্রতিষ্ঠানের তালিকায় শীর্ষে রয়েছে নারায়ণগঞ্জের পপুলার জুট এক্সচেঞ্জ। মোট ১১৭টি প্রতিষ্ঠানের মধ্যে এটি ভারতে সবচেয়ে বেশি পণ্য রপ্তানি করেছে, যার পরিমাণ ১ কোটি ১৬ লাখ ডলার।
পপুলার জুট এক্সচেঞ্জ সব মিলিয়ে গত অর্থবছরে বিভিন্ন দেশে ২ কোটি ৩২ লাখ ডলারের পণ্য রপ্তানি করেছে। এর মধ্যেই ভারতে রপ্তানি করে তাদের মোট রপ্তানির ৫০ শতাংশ।
নতুন করে ভারত যে ৯ ধরনের পণ্য রপ্তানিতে বিধিনিষেধ দিয়েছে, সেসব পণ্য রপ্তানির শীর্ষ তালিকায় দ্বিতীয় অবস্থানে রয়েছে নরসিংদীর জনতা জুট মিলস। গত অর্থবছরে প্রতিষ্ঠানটি ভারতে ১ কোটি ৩ লাখ ডলারের পণ্য রপ্তানি করে, যা তাদের মোট রপ্তানির ১৩ শতাংশ।
জনতা জুট মিলস আকিজ বশির গ্রুপের প্রতিষ্ঠান। এই গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ছিলেন বাণিজ্য উপদেষ্টা শেখ বশির উদ্দীন।
একাধিক রপ্তানিকারকের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, নতুন বিধিনিষেধের কারণে সম্ভাব্য ক্ষতিগ্রস্ত প্রতিষ্ঠানের তালিকায় পাট রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠানগুলোই বেশি।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে বাংলাদেশ জুট স্পিনার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিজেএসএ) সভাপতি তাপস প্রামাণিক প্রথম আলোকে বলেন, রাজনৈতিক কারণে নেওয়া ভারতের এমন সিদ্ধান্তের কারণে দেশটিতে বাংলাদেশের কাঁচা পাট, পাট সুতা, পাটপণ্যসহ ৯ ধরনের পণ্য রপ্তানি বাধাগ্রস্ত হবে। তবে পাট রপ্তানি কতটা ক্ষতিগ্রস্ত হবে, সেটি বিশ্লেষণের জন্য বিজেএসএ ৩০ জুন বৈঠক করবে। এরপর সরকারের করণীয় ঠিক করার অনুরোধ জানিয়ে যোগাযোগ করা হবে বস্ত্র ও পাট মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে।
স্থলপথ বন্ধ হলেও সমুদ্রপথ খোলা আছে—এ বিষয়ে জানতে চাইলে তাপস প্রামাণিক বলেন, ‘তা আছে। তবে জাহাজে করে মুম্বাইয়ের নভোসেবা বন্দর ঘুরে যদি পণ্য নিয়ে যেতে হয় পশ্চিমবঙ্গে, তাহলে ব্যাপারটা কেমন দাঁড়াবে, সেটি সহজেই অনুমেয়। তবে আমি মনে করি, সরকারের পক্ষ থেকে এ বিষয়ে ভারতের সঙ্গে কথা বলা ও আপত্তি জানানো উচিত।’
.উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: ব ধ গ রস ত হ র কর
এছাড়াও পড়ুন:
চলতি অর্থবছরে ৫% জিডিপি প্রবৃদ্ধির পূর্বাভাস এডিবির; ৪ কারণে চাপে প্রবৃদ্ধি
চলতি অর্থবছর মোট দেশজ উৎপাদন (জিডিপি) কিছুটা বাড়বে বলে পূর্বাভাস দিয়েছে এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি)। এডিবির পূর্বাভাস অনুসারে, ২০২৫-২৬ অর্থবছরে জিডিপি প্রবৃদ্ধি ৫ শতাংশ হতে পারে। গত অর্থবছরের জন্য জিডিপি প্রবৃদ্ধির প্রাক্কলন হলো ৪ শতাংশ।
এডিবি আরও বলেছে, তৈরি পোশাক রপ্তানি স্থিতিশীল থাকলেও রাজনৈতিক পরিবর্তন, ঘন ঘন বন্যা, শিল্প খাতে শ্রমিক অস্থিরতা এবং বিরাজমান উচ্চ মূল্যস্ফীতি কারণে দেশের অভ্যন্তরীণ চাহিদা দুর্বল হয়ে পড়েছে। এই চার কারণে প্রভাব পড়ছে সামগ্রিক প্রবৃদ্ধিতে।
আজ মঙ্গলবার এডিবি এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট আউটলুক (এডিও) সেপ্টেম্বর সংস্করণ প্রকাশ করেছে। প্রতিবেদনে বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধি সম্পর্কে এমন পূর্বাভাস দেওয়া হয়েছে।
এডিবি আরও বলেছে, চলতি অর্থবছরে ভোগ্যব্যয় বাড়বে। কারণ, রেমিট্যান্সের প্রবৃদ্ধি পাবে। এ ছাড়া আসন্ন নির্বাচনসংক্রান্ত নানা ধরনের খরচের কারণেও ভোগব্যয় বাড়াবে।
বাংলাদেশে এডিবির কান্ট্রি ডিরেক্টর হো ইউন জিয়ং বলেন, ‘ভবিষ্যৎ প্রবৃদ্ধিনির্ভর করবে ব্যবসায়িক পরিবেশ উন্নয়নের মাধ্যমে প্রতিযোগিতা বাড়ানো, বিনিয়োগ আকৃষ্ট করা এবং নির্ভরযোগ্য জ্বালানি সরবরাহ নিশ্চিত করার ওপর। তিনি আরও বলেন, বাংলাদেশের বাণিজ্যে মার্কিন শুল্কের প্রভাব এখনো স্পষ্ট নয়। দেশের ব্যাংক খাতের দুর্বলতা অব্যাহত রয়েছে। এসব চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করা টেকসই প্রবৃদ্ধি অর্জনের জন্য জরুরি।
এডিবির প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, ২০২৬ অর্থবছরের জন্য কিছু ঝুঁকি রয়ে গেছে। আন্তর্জাতিক বাণিজ্যসংক্রান্ত অনিশ্চয়তা, ব্যাংক খাতের দুর্বলতা এবং নীতি বাস্তবায়নের অনাগ্রহ প্রবৃদ্ধির অগ্রগতিতে বাধা হতে পারে। এ জন্য সঠিক সামষ্টিক অর্থনৈতিক নীতি বজায় রাখা এবং কাঠামোগত সংস্কার দ্রুততর করার ওপর গুরুত্বারোপ করা হয়েছে প্রতিবেদনে।
প্রতিবেদনে জানানো হয়, ২০২৩-২৪ অর্থবছরে সার্বিক মূল্যস্ফীতি ছিল ৯ দশমিক ৭ শতাংশ। গত অর্থবছরের তা বেড়ে দাঁড়ায় ১০ শতাংশ। এর পেছনে রয়েছে পাইকারি বাজারে সীমিত প্রতিযোগিতা, বাজার তথ্যের ঘাটতি, সরবরাহ শৃঙ্খলে বাধা এবং টাকার অবমূল্যায়ন।
এডিবি বলছে, চলতি অর্থবছরে প্রবৃদ্ধির মূল চালিকাশক্তি হবে ভোগব্যয়, যা শক্তিশালী রেমিট্যান্স প্রবাহ ও নির্বাচন-সংশ্লিষ্ট ব্যয়ের কারণে বাড়বে। তবে সংকোচনমূলক মুদ্রানীতি ও রাজস্বনীতি এবং বিনিয়োগকারীদের সতর্ক মনোভাব বিনিয়োগকে মন্থর করতে পারে। এ ছাড়া যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশের রপ্তানির ওপর ২০ শতাংশ শুল্ক আরোপ এবং ইউরোপীয় ইউনিয়নে প্রতিযোগিতা বাড়ায় রপ্তানি খাত এবং এর প্রবৃদ্ধি চাপ বাড়াবে। ফলে প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে রপ্তানিকারকদের মূল্য কমাতে হতে পারে।