সংবিধিবদ্ধ প্রতিষ্ঠানে নিয়োগ প্রসঙ্গে আলোচনা হয়েছে, ঐকমত্য হয়নি: আলী রিয়াজ
Published: 29th, June 2025 GMT
সংস্কার প্রশ্নে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনায় জাতীয় ঐকমত্য কমিশন ইতিপূর্বে সংবিধিবদ্ধ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে নিয়োগের জন্য জাতীয় সাংবিধানিক কাউন্সিল (এনসিসি) গঠনের প্রস্তাব দিয়েছিল। এ প্রস্তাবে ঐকমত্য না হওয়ায় এনসিসির পরিবর্তে একটি নিয়োগ কমিটি গঠনের প্রস্তাব দেয় কমিশন। কিন্তু আলোচনায় এই কমিটির গঠনের পক্ষেও ঐকমত্য হয়নি।
আজ রোববার রাজধানীর ফরেন সার্ভিস একাডেমির দোয়েল হলে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে দ্বিতীয় পর্যায়ের সপ্তম দিনের আলোচনা অনুষ্ঠিত হয়। আলোচনা শেষে সাংবাদিকদের উদ্দেশে ঐকমত্য কমিশনের সহসভাপতি অধ্যাপক আলী রিয়াজ এ কথা বলেন।
আজকের আলোচনায় নতুন কোনো বিষয় রাখা হয়নি। আগের কয়েকটি বিষয়ে অসমাপ্ত আলোচনা নিয়ে আবার আলোচনা হয়। এর মধ্যে ছিল সাংবিধানিক ও সংবিধিবদ্ধ প্রতিষ্ঠানের নিয়োগ কমিটি, দ্বিকক্ষবিশিষ্ট সংসদ, উচ্চকক্ষের নির্বাচনপ্রক্রিয়া ও উচ্চকক্ষের দায়িত্ব ও ভূমিকা।
ঐকমত্য কমিশন সংবিধিবদ্ধ প্রতিষ্ঠানে নিয়োগের জন্য কমিটি গঠনের প্রস্তাবটিকে রাজনৈতিক দলগুলোকে পুনর্বিবেচনার আহ্বান জানায়। অধ্যাপক আলী রিয়াজ বলেন, ‘সংবিধিবদ্ধ প্রতিষ্ঠানে নিয়োগ সম্পন্ন করতে এনসিসির পরিবর্তে নিয়োগ কমিটির প্রস্তাবকে অধিকাংশ দল স্বাগত জানিয়েছে। কিন্তু এখনো যেসব রাজনৈতিক দল একমত হয়নি, প্রস্তাবটিতে কয়েকটি সংশোধনের পর তাদের আমরা বিষয়টি পুনর্বিবেচনার জন্য অনুরোধ জানিয়েছি। আমরা আশা করছি, তারা পুনর্বিবেচনা করবে। আমরা আশা করছি, পরবর্তী আলোচনায় বিষয়টি নিষ্পত্তি হবে।’
অধিকাংশ দল দ্বিকক্ষবিশিষ্ট সংসদের পক্ষে একমত জানিয়ে অধ্যাপক আলী রিয়াজ বলেন, ‘উচ্চকক্ষ গঠনের বিষয়ে অনেকগুলো দল সংখ্যানুপাতিক পদ্ধতির কথা বলেছে। আবার কিছু দল সংখ্যানুপাতিক পদ্ধতির স্পষ্ট বিরোধিতা করেছে। কিন্তু আমরা চেষ্টা করছি, জুলাইয়ের মধ্যে আলোচনা সম্পন্ন করে জুলাই সনদ ঘোষণা করতে।’
রাজনৈতিক দলগুলো ঐকমত্যের আলোচনায় আরেকটু অগ্রসর হবে বলে অধ্যাপক আলী রিয়াজ আশা প্রকাশ করেন। তিনি বলেন, জবাবদিহিমূলক রাষ্ট্রকাঠামো তৈরির ক্ষেত্রে তারা ভূমিকা রাখবে।
.উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: র প রস ত ব গঠন র প ঐকমত য
এছাড়াও পড়ুন:
বাংলাদেশের ‘তরুণকম্পের’ সম্ভাবনা ও ঝুঁকি
গত এক বছরে এশিয়া ও আফ্রিকার বিভিন্ন দেশে একের পর এক বৈপ্লবিক আন্দোলন ও রাজনৈতিক ঝাঁকুনি দেওয়ার ঘটনা ঘটেছে। তরুণেরা রাস্তায় নেমে জবাবদিহিমূলক সরকার, ন্যায়ভিত্তিক সমাজ ও কর্মসংস্থানের দাবিতে বিক্ষোভ করেছেন। মানবাধিকারকর্মী বিনাইফার নওরোজি এই তরঙ্গকে যথার্থভাবে ‘ইয়ুথকোয়েক’ বা ‘তরুণকম্প’ বলে অভিহিত করেছেন।
সবচেয়ে নাটকীয় পরিবর্তন ঘটেছে বাংলাদেশে। সেখানে সরকারি চাকরির কোটাব্যবস্থার রাজনীতিকীকরণ নিয়ে সৃষ্ট ক্ষোভ ধীরে ধীরে সারা দেশে ছড়িয়ে পড়ে শেষ পর্যন্ত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কর্তৃত্ববাদী সরকার উৎখাতের আন্দোলনে রূপ নেয় এবং এর মধ্য দিয়ে এশিয়ার ‘আয়রন লেডি’র পতন ঘটে।
আরও পড়ুনগণ-অভ্যুত্থানে অংশ নেওয়া দলও কি স্বৈরাচারী হয়ে উঠতে পারে০৮ আগস্ট ২০২৫কেউ কেউ হাসিনার পতনকে কর্তৃত্ববাদের বিরুদ্ধে জনতার সাহসী সংগ্রামের বিজয় হিসেবে উদ্যাপন করেছেন। কিন্তু বহু আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষক এটিকে অশান্তি ও অনিশ্চয়তায় ভরা এক নতুন সময়ের সূচনা হিসেবে আখ্যা দিয়েছেন। কেউ কেউ আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন, এতে ইসলামপন্থী সহিংসতা ও ভূরাজনৈতিক উত্তেজনা বাড়তে পারে।
আবার অন্যদের মতে, এই বিদ্রোহ মূলত আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) চাপানো উদারনৈতিক অর্থনৈতিক সংস্কারের প্রতি জনসাধারণের ক্ষোভ থেকে উঠে এসেছে। অর্থনীতিবিদ জেফরি স্যাকস আরও এক ধাপ এগিয়ে এই গণ-অভ্যুত্থানকে যুক্তরাষ্ট্র-সমর্থিত সরকার পরিবর্তনের অভিযান বলে আখ্যা দিয়েছেন।
কিন্তু এসব ব্যাখ্যা–বিশ্লেষণে ক্ষমতার একেবারে তলানি থেকে উঠে আসা তরুণদের নেতৃত্বে হওয়া বিপ্লবের বিরাট সম্ভাবনাকে উপেক্ষা করা হয়েছে। হাসিনার পতনের পর গত এক বছরে বৈশ্বিক বড় ধরনের চ্যালেঞ্জের মুখেও বাংলাদেশের তরুণদের আন্দোলন আরও শক্তিশালী হয়েছে। ফলে দুর্নীতি ও গণতন্ত্রবিরোধী কর্মকাণ্ডের বিরুদ্ধে শুরু হওয়া রাজপথের আন্দোলন এখন বিস্তৃত হয়ে কাঠামোগত সংস্কারের বৃহৎ আন্দোলনে পরিণত হয়েছে।
গত একটি বছর আমাদের দেখিয়েছে, বিভিন্ন শ্রেণি থেকে আসা প্রযুক্তি-সচেতন এই তরুণদের ঐক্যবদ্ধ আন্দোলন যুগ যুগ ধরে গেড়ে থাকা পিতৃতান্ত্রিক রাজনীতি থেকে বেরিয়ে সামনে এগিয়ে যেতে পারে। তবে আশঙ্কার কথা হলো, আমাদের এই আশাবাদ স্থায়ী না-ও হতে পারে। সবচেয়ে ভয়ের কথা হলো, সমাজে বড় ধরনের বিভেদ থাকায় বাংলাদেশের এই অভ্যুত্থান আরব বসন্তের মতো অল্প সময়ের মধ্যে শেষ হয়ে যেতে পারে।অভ্যুত্থান-পরবর্তী এক বছরে তরুণ কর্মীরা অন্তর্বর্তী সরকারকে টিকিয়ে রাখতে শুধু সহায়তাই করেননি, বরং তাঁরা নির্বাচনী গণতন্ত্রে রূপান্তরের ভিত্তিও তৈরি করেছেন। সামনের পথ এখনো যদিও চ্যালেঞ্জে ভরা, তবু পাঁচটি গুরুত্বপূর্ণ অগ্রগতি আশা জাগাচ্ছে।
প্রথমত, তরুণদের আন্দোলন নতুন নাগরিক সমাজের প্ল্যাটফর্ম তৈরিতে ভূমিকা রেখেছে। এটি অরাজনৈতিক গণ্যমান্য ও জ্ঞানীগুণী ব্যক্তিদের গুরুত্বপূর্ণ জন-আলোচনায় অংশ নিতে উৎসাহিত করেছে। ২০২৪ সালের আগস্ট থেকে নতুন তৃণমূল উদ্যোগ ও পেশাদারির সঙ্গে পরিচালিত বেসরকারি সংস্থা (এনজিও) নাগরিক সম্পৃক্ততায় নতুন ঢেউ তুলেছে। এর ফলে বৈষম্য মোকাবিলা, কাঠামোগত অসাম্য দূর করা এবং নির্বাচনের আগে জরুরি সংস্কার এগিয়ে নেওয়া নিয়ে স্থানীয় পর্যায়েও আলোচনার পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছে।
দ্বিতীয়ত, তরুণদের এই আন্দোলন উল্লেখযোগ্য মাত্রায় প্রাতিষ্ঠানিক সাফল্য অর্জন করেছে। তরুণ সংগঠকেরা নোবেলজয়ী মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকারের জন্য সমর্থন সংগঠিত করেছেন। এর ফলে তাঁর দায়িত্বকাল বাড়ানো সম্ভব হয়েছে এবং তাঁর নির্বাচনী রোডম্যাপের জন্য দেশি ও আন্তর্জাতিক সমর্থন নিশ্চিত হয়েছে। তাঁরা বড় রাজনৈতিক দলগুলোকে একটি জাতীয় ঐকমত্য কমিশন গঠনের পক্ষে দাঁড়াতে চাপ দিয়েছেন। এই কমিশন সংবিধান, বিচারব্যবস্থা, নির্বাচনব্যবস্থা, জনপ্রশাসন ও দুর্নীতি দমন—এই পাঁচ ক্ষেত্রে সংস্কার আলোচনাকে এগিয়ে নেবে।
তৃতীয়ত, প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কারের দাবি তোলার পাশাপাশি তরুণ কর্মীরা বাংলাদেশের প্রথম ছাত্রসমাজের নেতৃত্বাধীন রাজনৈতিক দল ন্যাশনাল সিটিজেন পার্টি (এনসিপি) গঠন করে সরাসরি রাজনীতিতে প্রবেশ করেছে। আনুষ্ঠানিকভাবে নিবন্ধিত হতে পারলে দলটি ২০২৬ সালের শুরুতে অনুষ্ঠেয় নির্বাচনে তরুণ ভোটারদের জন্য ঐতিহ্যবাহী দলগুলোর বিকল্প হিসেবে নিজেদের তুলে ধরবে।
চতুর্থত, বাংলাদেশের তরুণেরা রাস্তায় আন্দোলনের শক্তিকে কাজে লাগিয়ে দেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতি বদলানোর চেষ্টা করছেন। তাঁরা ভোটের বয়স ১৮ থেকে কমিয়ে ১৬ করার দাবি তুলছেন এবং অস্বচ্ছ বা বেআইনি রাজনৈতিক অনুদানের বদলে স্বচ্ছ, জনগণের অর্থায়নে নির্বাচনী তহবিল গঠনের পক্ষে কথা বলছেন।
সবশেষে দেশের বড় বড় নেতার সঙ্গে যুক্ত হয়ে তরুণ ও নাগরিক সংগঠনগুলো অনেক বড় সাফল্য পেয়েছে। তারা সব প্রধান রাজনৈতিক দলকে একত্র করে ১৬৬টি সংস্কার নিয়ে আলোচনা করেছে। কয়েক মাস ধরে আলোচনা চালানোর পর জাতীয় ঐকমত্য কমিশন ‘জুলাই সনদ’ শীর্ষক একটি গুরুত্বপূর্ণ ঘোষণা দেবে বলে আশা করা হচ্ছে।
২০২৪ এর ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থান মানুষের কথা বলার পরিবেশ তৈরি করে দিয়েছে