চট্টগ্রামের ইনডিপেনডেন্ট অ্যাপারেলস যুক্তরাষ্ট্রের এক ক্রেতাপ্রতিষ্ঠানের কাছে ১৫ লাখ ডলারের স্পোর্টসওয়্যার রপ্তানির প্রস্তুতি নিচ্ছিল। তবে আগামী ১ আগস্ট থেকে বাংলাদেশের পণ্যে ৩৫ শতাংশ পাল্টা শুল্ক কার্যকরের ট্রাম্পের ঘোষণার পর সেই ক্রয়াদেশ স্থগিতের কথা জানায় মার্কিন ক্রেতাপ্রতিষ্ঠানটি।

জানতে চাইলে ইনডিপেনডেন্ট অ্যাপারেলসের ব্যবস্থাপনা পরিচালক এস এম আবু তৈয়ব প্রথম আলোকে বলেন, এই ক্রয়াদেশের পোশাক বানানোর জন্য রোববার চীন থেকে কাপড় চট্টগ্রামমুখী জাহাজে ওঠানোর কথা ছিল। বাড়তি শুল্কের বিষয়টি সুরাহা না হওয়া পর্যন্ত এই কাপড়ও জাহাজে না তোলার কথা বলেছে মার্কিন ক্রেতাপ্রতিষ্ঠানটি। কারণ, ১ আগস্টের পরই চালানটি যুক্তরাষ্ট্রে রপ্তানি হওয়ার কথা।

চট্টগ্রামের নাসিরাবাদের ইনডিপেনডেন্ট অ্যাপারেলসের পোশাক রপ্তানির ৮৯ শতাংশের গন্তব্য যুক্তরাষ্ট্র। এই প্রতিষ্ঠানের মতো যুক্তরাষ্ট্রের ওপর নির্ভরশীল রপ্তানিকারকদের অনেকেই মার্কিন ক্রেতাদের কাছ থেকে চলমান ক্রয়াদেশ স্থগিত রাখার নির্দেশনা পেয়েছেন বলে প্রথম আলোকে জানিয়েছেন।

রপ্তানিকারকেরা জানান, বাড়তি শুল্কের বিষয়টি সুরাহা না হওয়া পর্যন্ত মার্কিন ক্রেতারা অপেক্ষা করতে চান। এখন যেসব চালান ২৮ জুলাইয়ের আগে চট্টগ্রাম থেকে জাহাজে তোলা যাবে, সেগুলোর ওপর স্থগিতাদেশ নেই। এরপর যেসব চালান জাহাজে তোলার অপেক্ষায় আছে, মূলত সেগুলো স্থগিতের নির্দেশনা পাচ্ছেন তাঁরা।

মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প গত এপ্রিলে বাংলাদেশসহ ৫৭টি দেশের পণ্যের ওপর বাড়তি শুল্ক আরোপের ঘোষণা দেন। শুরুতে বাংলাদেশের পণ্যের জন্য এই বাড়তি শুল্ক হার ছিল ৩৭ শতাংশ। এর পরপরই শুল্ক কমানো নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে আলোচনা শুরু করে বাংলাদেশ। একপর্যায়ে শুল্কারোপের সিদ্ধান্ত ৯০ দিনের জন্য স্থগিত করে যুক্তরাষ্ট্র। ৯ জুলাই এই স্থগিতাদেশের মেয়াদ শেষ হওয়ার কথা ছিল। তবে তার আগে ৭ জুলাই বাংলাদেশসহ ১৪টি দেশের পণ্যের ওপর নতুন করে বাড়তি শুল্কের ঘোষণা দেন ট্রাম্প। এই দফায় বাংলাদেশি পণ্যের জন্য শুল্কহার নির্ধারণ করা হয় ৩৫ শতাংশ।

এপ্রিলেও ছিল স্থগিতাদেশ

গত ২ এপ্রিল প্রথম দফায় পাল্টা শুল্ক আরোপের পর ক্রয়াদেশের স্থগিতাদেশ দেওয়া শুরু করেছিলেন মার্কিন ক্রেতারা। অবশ্য ৯ এপ্রিল থেকে পাল্টা শুল্ক কার্যকারিতা পিছিয়ে দেওয়ার পর এই স্থগিতাদেশ তুলে নিতে শুরু করেন তাঁরা। তবে বাড়তি ১০ শতাংশ শুল্ক কার্যকর করে ট্রাম্প প্রশাসন। বাড়তি ১০ শতাংশ পাল্টা শুল্কের প্রভাবে গত মে মাসে যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশের রপ্তানি কমেছে।

নতুন করে আসছে স্থগিতাদেশ

দীর্ঘদিন ধরে এদেশীয় প্রতিষ্ঠান প্যাট্রিয়ট ইকো অ্যাপারেল মার্কিন ক্রেতাপ্রতিষ্ঠান ওয়ালমার্টের কাজ করছে। পাল্টা শুল্ক ঘোষণার পর ওয়ালমার্টের এক আমদানিকারক এই প্রতিষ্ঠানের প্রায় ৯ লাখ পিস সাঁতারের পোশাকের ক্রয়াদেশ স্থগিত করে। প্রতি পিস পোশাকের দাম ছিল ১ ডলার ২৫ সেন্ট।

জানতে চাইলে প্রতিষ্ঠানটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক ইকবাল হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, এই কার্যাদেশ স্থগিত হওয়ায় আগস্টে কারখানার ২০ লাইনের মধ্যে ৩ লাইন ফাঁকা থাকার শঙ্কা তৈরি হয়েছে। আসলে বাড়তি ৩৫ শতাংশ শুল্ক দিয়ে মার্কিন ক্রেতারাও দুশ্চিন্তায় পড়ে গেছে।

তৈরি পোশাক খাতের ডিজাইনটেক্স গ্রুপ বছরে ২৪ কোটি ডলারের তৈরি পোশাক রপ্তানি করে। তার মধ্যে ৩৫ শতাংশের গন্তব্য যুক্তরাষ্ট্র। ট্রাম্প নতুন করে পাল্টা শুল্ক ঘোষণার পর ১০ লাখ পিস পোশাকের একটি প্রাথমিক ক্রয়াদেশের ৩০-৪০ শতাংশ স্থগিত করা হয়েছে।

বিষয়টি নিশ্চিত করে ডিজাইনটেক্সের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) খন্দকার রফিকুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, ‘নতুন করে আবার ক্রয়াদেশ স্থগিত হতে শুরু করেছে। আমাদের পাল্টা শুল্ক ভিয়েতনামের কাছাকাছি থাকলেও কোনো সমস্যা ছিল না। তবে আমাদের দর–কষাকষি নিয়ে ক্রেতারা হতাশ।’

স্প্যারো গ্রুপ অব ইন্ডাস্ট্রিজের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) শোভন ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, ক্রেতারা খুবই নেতিবাচক মনোভাব পোষণ করছেন। তাঁরা অভিযোগ করছেন, ‘আমরা ভিয়েতনামের মতো দর–কষাকষি করছি না। ৩৫ শতাংশ শুল্ক দিয়ে ক্রেতারা পণ্য নেবেন না। এ কারণে তাঁরা বিকল্প পরিকল্পনা করছেন।’

চট্টগ্রামের আরডিএম গ্রুপের ৩৫ লাখ ডলারের কয়েকটি চালান আগস্টে রপ্তানি হওয়ার কথা ছিল। বাড়তি শুল্কের কারণে তারাও শঙ্কায় আছেন। জানতে চাইলে আরডিএম গ্রুপের চেয়ারম্যান রাকিবুল আলম চৌধুরী প্রথম আলোকে বলেন, আগস্টে যেসব চালান জাহাজীকরণের সময় রয়েছে, সেগুলো এখন ২৮ জুলাইয়ের মধ্যে জাহাজে তোলার কথা জানিয়েছে ক্রেতাপ্রতিষ্ঠান। এ সময়ের মধ্যে সম্ভব না হলে স্থগিত রাখার কথা বলেছে। যুক্তরাষ্ট্রের লস অ্যাঞ্জেলেস থেকে মুঠোফোনে তিনি বলেন, ‘স্থগিতাদেশের পাশাপাশি আগামী মৌসুমে যে ক্রয়াদেশ পাওয়ার কথা, তা–ও এখন পাচ্ছি না।’

রপ্তানিতে একক দেশ হিসেবে যুক্তরাষ্ট্রের বাজার সবচেয়ে বড়। জাতীয় রাজস্ব বোর্ড বা এনবিআরের হিসাবে, সদ্য বিদায়ী ২০২৪–২৫ অর্থবছরে বাংলাদেশের মোট রপ্তানির ১৯ শতাংশ বা ৮৭৬ কোটি ডলার পণ্যের গন্তব্য ছিল যুক্তরাষ্ট্র। এর মধ্যে বড় অংশই তৈরি পোশাক। তৈরি পোশাক রপ্তানি হয় প্রায় ৭৫৯ কোটি ডলারের।

তৈরি পোশাক ছাড়াও গত অর্থবছর ১১৭ কোটি ডলারের অন্যান্য পণ্য রপ্তানি হয়েছে যুক্তরাষ্ট্রে। তাঁদেরও কেউ কেউ এখন ক্রয়াদেশ স্থগিতের নির্দেশনা পাচ্ছেন বলে প্রথম আলোকে জানিয়েছেন। এ রকমই একটি প্রতিষ্ঠান চট্টগ্রামের কর্ণফুলী উপজেলার মাসুদ অ্যাগ্রো প্রসেসিং ফুড প্রোডাক্টস।

প্রতিষ্ঠানটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক আশরাফ হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, ‘তাদের হিমায়িত ও শুকনো খাদ্যপণ্যের তিনটি চালান আগামী মাসে রপ্তানি হওয়ার কথা ছিল। তবে বাড়তি শুল্কের বিষয়টি মীমাংসা হওয়ার আগে পণ্য রপ্তানি স্থগিত রাখার কথা জানিয়েছে মার্কিন ক্রেতাপ্রতিষ্ঠানটি।’

বাংলাদেশের শুল্ক বেশি

সম্প্রতি মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প নতুন করে দুই দফায় ২১টি দেশের জন্য পাল্টা শুল্ক ঘোষণা করেছেন। ভিয়েতনামের শুল্কহার ২০ শতাংশে নামিয়ে আনার ঘোষণাও দিয়েছেন তিনি। সব মিলিয়ে ২২টি দেশের নতুন শুল্কহার পর্যালোচনা করে দেখা যায়, পোশাক রপ্তানিতে প্রতিযোগী দেশগুলোর তুলনায় বাংলাদেশের ওপর আরোপ করা শুল্কহার বেশি। শুধু কম্বোডিয়ার চেয়ে বাংলাদেশের শুল্কহার ১ শতাংশ কম।

যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে শীর্ষ রপ্তানিকারক ভিয়েতনামের চেয়ে বাংলাদেশের শুল্ক ১৫ শতাংশ বেশি। আর ইন্দোনেশিয়ার চেয়ে ২ শতাংশ ও শ্রীলঙ্কার চেয়েও ৫ শতাংশ বেশি।

সার্বিক বিষয়ে জানতে চাইলে তৈরি পোশাকশিল্পের মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএর সভাপতি মাহমুদ হাসান খান প্রথম আলোকে বলেন, ‘শুল্কহার নিয়ে দুই দেশের মধ্যকার আলোচনা শেষ হয়েছে। আমরা শুনেছি, ৮৫ শতাংশ বিষয়ে উভয় পক্ষ একমত হয়েছে। এখন আমরা ফলাফলের অপেক্ষায়। যদি ঘোষিত পাল্টা শুল্ক হার না কমে, তবে ক্রয়াদেশ স্থগিত ও বাতিলের মতো ঘটনা আরও বাড়বে। এরই মধ্যে এ রকম কিছু ঘটনা আমাদের নজরে এসেছে।’

.

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: য ক তর ষ ট র র প রথম আল ক র জন য ত ন কর র ওপর আগস ট

এছাড়াও পড়ুন:

পাওনা টাকা চাওয়ায় মারধর, বললেন ‘আমি ওয়ার্ড যুবদলের সভাপতি, জানোস?

ফেনীর পরশুরামে দোকানের পাওনা টাকা চাওয়াকে কেন্দ্র করে এক ব্যবসায়ীকে মারধরের অভিযোগ উঠেছে মো. সায়েম নামের এক যুবক ও তার অনুসারীদের বিরুদ্ধে।

শনিবার (১২ জুলাই) দিবাগত রাতে মারধরের একটি ভিডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে। ৫ মিনিট ৪০ সেকেন্ডের ভিডিওতে দেখা যায়, একদল যুবক এক ব্যবসায়ীকে দোকান থেকে টেনে-হিঁচড়ে বের করে বেধড়ক পেটাচ্ছেন। এ সময় একজন বলেন, ‘আমি ওয়ার্ড যুবদলের সভাপতি, জানোস?’

ভুক্তভোগী সুমন জানান, প্রায় এক বছর আগে সায়েম তার দোকান থেকে ৪ হাজার ৯১০ টাকার সদায় নেন। এরপর অনেকবার তাগাদা দেওয়া হলেও বাকি টাকা পরিশোধ করেননি সায়েম। গত ৯ জুলাই সায়েমের সঙ্গে দেখা হলে টাকা ফেরত চান সুমন। এরপর ওই দিন রাতেই সায়েম, তার ভাতিজা ফয়সাল ও আরো কয়েকজন দলবদ্ধ হয়ে সুমনকে দোকান থেকে বের করে মারধর করেন।

আরো পড়ুন:

স্কুলের গেট থেকে ছাত্রকে তুলে নিয়ে মারধর, অস্ত্র উঁচিয়ে শিক্ষকদের হুমকি

নরসিংদীতে চাঁদাবাজির অভিযোগে যুবককে গণধোলাই 

ভিডিওতে দেখা যায়, মারতে মারতে সুমনের গায়ের পোশাক খুলে নেওয়া হয়। এ সময় সুমনকে মাফ চাইতে বাধ্য করা হয় সায়েমের কাছে। আশেপাশের লোকজন ছুটে এলে অভিযুক্তরা চলে যান।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, অভিযুক্ত সায়েম পরশুরাম পৌরসভার দক্ষিণ কোলাপাড়া এলাকার বাসিন্দা। তিনি ৫ নম্বর ওয়ার্ড যুবদলের আহ্বায়ক ছিলেন। দলীয় নিয়ম ভেঙে শীর্ষ নেতাদের ছবি দিয়ে ব্যানার-ফেস্টুন বানানোর অভিযোগে গত ২৫ জুন তাকে পদ থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে পরশুরাম পৌর বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম আহ্বায়ক মিসফাকুস সামাদ রনি বলেন, ‘‘ভিডিওটি দেখেছি। শৃঙ্খলাভঙ্গের জন্য  সায়েমকে আগেই বহিষ্কার করা হয়েছে।’’

পরশুরাম মডেল থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) মো. নুরুল হাকিম বলেন, ‘‘ঘটনাটি গত ৯ তারিখের। সুমন নামের ওই ব্যবসায়ী পাওনা টাকা চাওয়ায় মারধরের ঘটনা ঘটেছে। বিষয়টি বণিক সমিতির মাধ্যমে আপস-মীমাংসা হয়েছে বলে শুনেছি। এ ঘটনায় লিখিত অভিযোগ পেলে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’’

অভিযোগের বিষয়ে জানতে সায়েমের মোবাইলে একাধিকবার যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও সম্ভব হয়নি।

ঢাকা/সাহাব/রাজীব

সম্পর্কিত নিবন্ধ