পেহেলগাম হামলার পর কাশ্মীরে তীর্থযাত্রা ঘিরে নজিরবিহীন নিরাপত্তা
Published: 4th, July 2025 GMT
ভারত শাসিত মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ কাশ্মীরে মাসব্যাপী হিন্দু তীর্থযাত্রা শুরু হয়েছে। গত এপ্রিলে বন্দুকধারীদের হামলায় যেই এলাকায় ২০ জনের বেশি পর্যটক নিহত হয়েছিলেন, সেখান থেকে বৃহস্পতিবার অনেক তীর্থযাত্রী যাত্রা শুরু করেছেন।
ওই হামলার পর ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে চার দিন ধরে পাল্টাপাল্টি হামলা চলে। এই পরিস্থিতিতে পারমাণবিক শক্তিধর চিরবৈরী দুই প্রতিবেশী দেশ নিজেদের মধ্যে পঞ্চমবারের মতো সর্বাত্মক যুদ্ধের দ্বারপ্রান্তে পৌঁছে গিয়েছিল।
গত বছর কাশ্মীরের ওই অমরনাথ তীর্থযাত্রায় অংশ নিয়েছিলেন প্রায় পাঁচ লাখ ভক্ত। এটি একটি পবিত্র বরফ স্তম্ভ, যা পেহেলগাম শহরের ওপরের বন ঘেরা হিমালয় পাহাড়ে একটি গুহায় অবস্থিত। পেহেলগামেই গত ২২ এপ্রিল বন্দুকধারীদের হামলায় ২৬ জন নিহত হয়েছিলেন, যাদের বেশির ভাগই ছিলেন ভারতের অন্যান্য অঞ্চল থেকে আসা হিন্দু পর্যটক।
নয়াদিল্লির দাবি, এপ্রিলের হামলাকারীদের পাকিস্তান পৃষ্ঠপোষকতা দিয়েছিল। কিন্তু ইসলামাবাদ তা জোরালোভাবে অস্বীকার করেছে। দুই দেশই পাল্টাপাল্টি নানা পদক্ষেপ নেয়। উত্তেজনা প্রশমনে ব্যাপক কূটনৈতিক তৎপরতা শুরু হয়।
কিন্তু ৭ মে পাকিস্তানে হামলা চালায় ভারত। পাকিস্তানও তাৎক্ষণিক এ হামলা প্রতিরোধ করে। চার দিনের পাল্টাপাল্টি হামলার পর ১০ মে যুদ্ধবিরতি ঘোষণার মধ্য দিয়ে সংঘর্ষ শেষ হয়। সংঘাতে উভয় পক্ষে ৭০ জনের বেশি মানুষ নিহত হন।
উচ্চপ্রযুক্তির নজরদারি ব্যবস্থাআল জাজিরার সাংবাদিক উমর মেহরাজ জানান, ‘তীর্থযাত্রীরা প্রথমে নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বিগ্ন ছিলেন। তবে, এখন তাঁরা আশ্বস্ত। কারণ বর্তমানে নিরাপত্তা ব্যবস্থা বেশ শক্তিশালী।’ তিনি বলেন, ‘এবারের তীর্থযাত্রা আরও বেশি সতর্কব্যবস্থা ও প্রযুক্তিনির্ভর। প্রায় ৬০০ অতিরিক্ত আধাসামরিক ইউনিট মোতায়েন করা হয়েছে। এটি এ পর্যন্ত সবচেয়ে বেশি নিরাপত্তা-বেষ্টিত যাত্রা।’
উত্তর প্রদেশ থেকে আগত মুনেশ্বর দাস শাস্ত্রী বলেন, ‘কোনো ভয় নেই। আমাদের সেনাবাহিনী পাহারা দিচ্ছে। কেউ আমাদের দিকে চোখ তুলেও তাকাতে পারবে না।’
তীর্থযাত্রা উপলক্ষে ভারত সরকার এবার ৪৫ হাজার সেনা মোতায়েন করেছে, যারা উচ্চপ্রযুক্তির নজরদারি ব্যবস্থার মাধ্যমে পুরো যাত্রাপথ পর্যবেক্ষণ করছেন।
কাশ্মীর পুলিশের প্রধান ভি কে বার্দি বলেন, ‘তীর্থযাত্রা যেন নিরাপদ ও নির্বিঘ্ন হয়, তা নিশ্চিত করতে আমরা বহুস্তরবিশিষ্ট ও সুসংগঠিত নিরাপত্তা ব্যবস্থা গ্রহণ করেছি।’
নিরাপত্তা জোরদারে ক্লোজ সার্কিট ক্যামেরা (সিসিটিভি), চেহারা শনাক্তকরণ যন্ত্র (ফেসিয়াল রিকগনিশন), তল্লাশি চৌকি এবং প্রতি ১০০ মিটার পরপর একটি করে আধাসামরিক ক্যাম্প বসানো হয়েছে।
নিবন্ধন বাধ্যতামূলকতীর্থযাত্রীদের নিবন্ধন বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। তাঁরা সশস্ত্র নিরাপত্তা বহরের সঙ্গে গাড়িতে যাত্রা করেন এবং পরে পায়ে হাঁটে গন্তব্যে পৌঁছান। বনাঞ্চলে সড়ক ঘিরে নির্মাণ করা হয়েছে অস্থায়ী বাংকার। ভক্তদের কাছে রয়েছে রেডিও কার্ড, যা তাদের অবস্থান জানাতে সাহায্য করে।
পাহাড়ি পথ পেরিয়ে পায়ে হেঁটে তীর্থযাত্রীদের গুহায় পৌঁছাতে কয়েক দিন লেগে যায়। শেষ যেখান পর্যন্ত গাড়ি যায়, সেখান থেকে প্রায় ৩০ কিলোমিটার উঁচু পাহাড়ি পথ পাড়ি দিতে হয়। গুহাটি সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে প্রায় ৩ হাজার ৯০০ মিটার (১২ হাজার ৮০০ ফুট) উঁচু, দুর্গম পাহাড়ের চূড়ায় অবস্থিত।
উত্তর প্রদেশ থেকে আসা ২৯ বছর বয়সী উজ্জ্বল যাদব বলেন, ‘এখানে যা কিছু ঘটেছে, তাতে আমি ভয় পাইনি। আমি বাবার (বরফের গঠন) দর্শন পেতেই এসেছি। কড়া নিরাপত্তা ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে, কেউ চাইলেও কিছু করতে পারবে না।’
কেন্দ্রীয় সরকার নিযুক্ত জম্মু-কাশ্মীরে শীর্ষ প্রশাসক মনোজ সিনহা বলেন, ‘মানুষের মধ্যে আস্থা ফিরছে।’ তবে, চলতি বছর তীর্থযাত্রী নিবন্ধন ১০ শতাংশ কমেছে বলে জানিয়েছেন তিনি।
একসময় স্থানীয় কয়েক হাজার ভক্তের অংশগ্রহণে সীমিত ছিল এই তীর্থযাত্রা। কিন্তু ১৯৮৯ সালে কাশ্মীরে সশস্ত্র বিদ্রোহ শুরুর পর থেকে তা ধীরে ধীরে বড় পরিসরে ছড়িয়ে পড়ে। এই বিদ্রোহের পর থেকে ভারত সরকার এই বার্ষিক তীর্থযাত্রাটিকে ব্যাপকভাবে প্রচার করে আসছে। এবারের যাত্রা চলবে ৯ আগস্ট পর্যন্ত।
বিদ্রোহীরা জানিয়েছে, তীর্থযাত্রা তাদের লক্ষ্য নয়। কিন্তু এটি হিন্দু আধিপত্যের প্রতীক হিসেবে ব্যবহৃত হলে, তারা ব্যবস্থা নেওয়ার হুঁশিয়ারি দিয়েছে।
এপ্রিলের হামলাকারীরা এখনো ধরাছোঁয়ার বাইরে রয়ে গেছে। গত ২২ জুন ভারতের জাতীয় তদন্ত সংস্থা জানায়, পেহেলগাম এলাকা থেকে দুজনকে আটক করা হয়েছে, যারা হামলাকারীদের খাবার, আশ্রয় ও অন্যান্য সহায়তা দিয়েছিল।
ভারতীয় পুলিশ তিনজন হামলাকারীর বিরুদ্ধে পরোয়ানা জারি করেছে, যাদের মধ্যে দুজন পাকিস্তানের নাগরিক বলে দাবি করা হয়েছে।
২০১৭ সালে সন্দেহভাজন বিদ্রোহীরা এক তীর্থযাত্রী বাসে হামলা চালিয়ে ১১ জনকে হত্যা করেছিল।
.উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: ব যবস থ
এছাড়াও পড়ুন:
গাজায় ব্যাংক খুলেছে, নেই নগদ অর্থ
ইসরায়েলের আগ্রাসনের শিকার ফিলিস্তিনের গাজা উপত্যকায় যুদ্ধবিরতির ফলে কিছু কিছু ব্যাংক খুলেছে। তবে নগদ অর্থের ঘাটতির কারণে বড় সমস্যায় পড়েছেন গাজাবাসী। নগদ অর্থসংকটের কারণে নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিস কিনতে তাঁদের হিমশিম খেতে হচ্ছে। সার্বিক পরিস্থিতির সুযোগ নিয়ে ব্যবসায়ীরা সবকিছুর দাম বাড়িয়ে দিয়েছেন।
দুই বছর ধরে গাজায় নির্বিচার হামলায় ঘরবাড়ি, স্কুল এবং অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের মতো অনেক ব্যাংক ধ্বংস বা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। গত ১০ অক্টোবর যুদ্ধবিরতি ঘোষণার ছয় দিন পর ১৬ অক্টোবর থেকে কিছু ব্যাংক খোলা শুরু করে। এসব ব্যাংক থেকে অর্থ তুলতে বিপুলসংখ্যক মানুষ ভিড় করেন। কিন্তু দীর্ঘ সময় অপেক্ষার পর তাঁদের বেশির ভাগকে হতাশা নিয়েই বাড়ি ফিরতে হচ্ছে।
যুদ্ধবিরতি কার্যকরের পরও গাজায় ইসরায়েলের সেনাদের হামলায় দুই শতাধিক ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন। এ নিয়ে গাজায় নিহতের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৬৮ হাজার ৫২৭। যুদ্ধবিরতির পরও গাজায় ত্রাণসহ যেকোনো কিছু ঢুকছে ইসরায়েলের নজরদারিতেই।
নগদ অর্থের জন্য মধ্য গাজার নুসেইরাতে ব্যাংক অব প্যালেস্টাইনের বাইরে সারিতে দাঁড়িয়ে ছিলেন ওয়ায়েল আবু ফারেস (৬১)। তিনি বলেন, ব্যাংকে কোনো অর্থ নেই। নগদ অর্থের সঞ্চালন নেই। হতাশার সুরে ছয় সন্তানের এই বাবা বলেন, ব্যাংকে এসে কাগজপত্রের লেনদেন করে চলে যাওয়া ছাড়া কোনো উপায় নেই।
গাজায় খাবার কেনা বা বিভিন্ন পরিষেবার বিল দেওয়ার মতো প্রায় সব দৈনন্দিন লেনদেন নগদ অর্থে করতে হয়। কিন্তু ২০২৩ সালের অক্টোবরে হামলা শুরু হওয়ার পর গাজা অবরুদ্ধ করে রেখেছেন ইসরায়েলি সেনারা। ফলে সেখানে নিত্যপণ্য ও অন্যান্য সরঞ্জামের মতো নগদ অর্থও ঢুকতে পারছে না। যদিও যুদ্ধবিরতির পর এখন কিছু কিছু ত্রাণবাহী ট্রাক ঢুকছে।
গাজাভিত্তিক অর্থনীতিবিদ মোহাম্মদ আবু জাইয়্যাব বার্তা সংস্থা রয়টার্সকে বলেন, ব্যাংক খোলা আছে, শীতাতপ যন্ত্রও চালু আছে। কিন্তু ইলেকট্রনিক লেনদেন ছাড়া মূলত আর কিছুই হচ্ছে না। কারণ, কোনো আমানত নেই। তাই নগদ অর্থ তোলা সম্ভব হচ্ছে না।
আবু জাইয়্যাব বলেন, ব্যাংক যেহেতু নগদ অর্থ দিতে পারছে না, তাই বেতন ক্যাশ করতে মানুষজন কিছু লোভী ব্যবসায়ীর কাছে যাচ্ছেন। তাঁদের ২০ থেকে ৪০ শতাংশ পর্যন্ত বেশি অর্থের বিনিময়ে বেতন ক্যাশ করতে হচ্ছে।
‘আমরা আর পারছি না’
গাজায় একসময় ব্যাংক লেনদেন এক ঘণ্টার কম সময়ের মধ্যে শেষ হয়ে যেত জানিয়ে সাত সন্তানের মা ইমান আল-জাবারি বলেন, ‘এখন ব্যাংকে লেনদেন করতে আপনাকে দুই বা তিন দিন যেতে হয়। একাধিকবার যাতায়াত করতে হয়। পুরোটা সময় দাঁড়িয়ে থাকতে হয়। এত কিছু করে আপনি ৪০০-৫০০ শেকেলের (১২৩-১৫৩ ডলার) মতো তুলতে পারবেন। বর্তমানে অতি উচ্চমূল্যের বাজারে এই অর্থ দিয়ে কী কেনা যায় বলেন? আমরা আর পারছি না।’
নগদ অর্থের ঘাটতি অধিকাংশ গাজাবাসীর জন্য সমস্যা সৃষ্টি করলেও কিছু মানুষ এই সংকটকে জীবিকার উপায় হিসেবে কাজে লাগাচ্ছেন। মানাল আল-সাইদির মতো কেউ কেউ ছেঁড়া-ফাটা ব্যাংক নোট জোড়াতালি দেওয়ার কাজ করছেন। এতে তাঁদের রুটি-রুজি জুটছে। ৪০ বছর বয়সী এই নারী বলেন, ‘কাজ করে আমি দৈনিক ২০-৩০ শেকেল (৬-৯ ডলার) আয় করতে পারি। যা আয় হয়, তা দিয়ে আমি একটি রুটি, অল্প শিম ও ভাজাপোড়াসহ টুকটাক কিছু কিনতে পারি।’
ধ্বংসস্তূপে পরিণত হওয়া গাজায় সবজির দাম আকাশছোঁয়া। মানাল আল-সাইদি বলেন, ‘সবজি বা এ জাতীয় অন্য কিছু কেনার মতো অর্থ আমি আয় করতে পানি না। আমার যা আয় হয়, তা দিয়ে কোনোমতে দিন চলে যায়।’
নগদ অর্থসংকটে জর্জরিত গাজার অনেক মানুষকে ডিম বা চিনির মতো প্রয়োজনীয় জিনিস কেনার জন্যও ব্যাংক অ্যাপের মাধ্যমে ইলেকট্রনিক লেনদেনে ভরসা করতে হচ্ছে। এই সংকটে বিক্রেতারা অতিরিক্ত দাম আদায় করছেন।
নগদ অর্থ কখন ব্যাংকে আসবে ঠিক নেই
গাজায় বর্তমানে ত্রাণ সরবরাহ নজরদারি করছে ইসরায়েলে সেনাবাহিনীর ‘কো-অর্ডিনেটর অব গভর্নমেন্ট অ্যাকটিভিটিজ ইন দ্য টেরিটরিজ (সিওজিএটি)’ নামের একটি শাখা। কখন বা কীভাবে নগদ অর্থ গাজায় প্রবেশের অনুমোদন দেওয়া হবে, তা জানতে তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তারা তাৎক্ষণিকভাবে মন্তব্য করতে রাজি হয়নি।
নগদ অর্থের ঘাটতি গাজাবাসীর সংকটকে নানা দিক থেকে আরও নাজুক করে তুলেছে। তাঁবু, খাবার ও ওষুধ কিনতে অনেকে এরই মধ্যে সব সঞ্চয় শেষ করে ফেলেছেন ও হাতের কাছে যে সম্বল ছিল, তা-ও বিক্রি করে দিয়েছেন। কিছু মানুষ টিকে থাকার জন্য বিনিময় পদ্ধতিতে প্রয়োজনীয় জিনিস সংগ্রহ করছেন।
ফিলিস্তিনি ব্যবসায়ী সামির নামরাউতি (৫৩) জানান, এমন কিছু টাকা হাতে আসছে, যা অতিব্যবহারের ফলে চেনার উপায় নেই। কিন্তু তা সত্ত্বেও তিনি এসব টাকা নিচ্ছেন। নামরাউতির ভাষায়, ‘আমার কাছে নোটের সিরিয়াল নম্বর গুরুত্বপূর্ণ। যতক্ষণ সিরিয়াল নম্বর আছে, ততক্ষণ আমি নোটকে টাকা হিসেবে বিবেচনা করি।’