মহররমে ইবাদতের নামে ছড়ানো ৫টি কুসংস্কার
Published: 4th, July 2025 GMT
মহররমকে কেন্দ্র করে সমাজে রয়েছে অসংখ্য ভুল ধারণা ও কুসংস্কার, যার ফিরিস্তি অনেক দীর্ঘ। অধিক প্রচলিত কয়েকটি কুসংস্কার নিয়ে আলোচনা করা হলো।
১. অলীক বর্ণনামহররমের গুরুত্ব বোঝাতে অনেকে নানা কথা বলেন। যেমন এ মাসে ইউসুফ (আ.) জেল থেকে মুক্তি পেয়েছেন, ইয়াকুব (আ.) চোখের জ্যোতি ফিরে পেয়েছেন, ইউনুস (আ.) মাছের পেট থেকে মুক্তি পেয়েছেন, ইদরিস (আ.
মহররম এলে অনেকে মাছ, শাক ও মিষ্টি–জাতীয় খাবার খান না। এটা সঠিক নয়। ইসলাম অন্যান্য মাসের মতো এ মাসেও কোনো হালাল খাদ্য হারাম করেনি। রাসুলুল্লাহ (সা.) বছরের সব সময় হালাল খাদ্য গ্রহণ করেছেন। কোনো কারণে মহররমে তা বর্জন করেননি। আল্লাহ বলেছেন, ‘মুমিনগণ, আল্লাহ যেসব পবিত্র বস্তু তোমাদের জন্য হালাল করেছেন, তোমরা তা হারাম করো না এবং সীমা লঙ্ঘন করো না। নিশ্চয় আল্লাহ সীমা লঙ্ঘনকারীদের পছন্দ করেন না।’ (সুরা মায়িদা, আয়াত: ৮৭)।
৩. বিয়েশাদিতে কঠোরতাঅনেকে মনে করেন, এ মাসে বিয়ে করলে তা শুদ্ধ হবে না। কারণ, এতে ইমাম হোসাইন (রা.)-কে অপমান করা হয়। অথচ রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর থেকে এ ধরনের কোনো নিষেধাজ্ঞা প্রমাণিত নেই। শায়খ আলবানি (রহ.)-এর মতে, ‘বিয়ের জন্য কোনো নির্দিষ্ট মাস বা সময়ের কথা বলা হয়নি।’ (সহিহুত তারগিব ওয়াত তারহিব, হাদিস: ১৯১৬-এর টীকা)
আরও পড়ুনইসলামে বিয়ে ও পরিবার গঠনের উদ্দেশ্য০৮ নভেম্বর ২০২৪৪. উদ্ভট নামাজের রেওয়াজআশুরার দিনে রোজা পালনের কথা হাদিসে এলেও ওই দিন দিনে বা রাতে কোনো বিশেষ নামাজের বিধানের কথা আসেনি। আশুরার দিন জোহর ও আসরের মধ্যবর্তী সময়ে অথবা রাতে অনেক নামাজ কিংবা নির্দিষ্ট সুরা বহুবার পাঠ করাকে পুণ্যময় ভাবা সঠিক নয়। সরলপ্রাণ মুসলমানদের মন জয় করতে অনেক ওয়ায়েজ কথার অবতারণা করে থাকেন; ইসলামে যার ভিত্তি নেই। (মাওজুআত লি ইবনিল জাওজি: ২/৪৫-৪৬; লাআলি লিশ শায়খ জালালুদ্দিন সুয়ুতি: ২/৫৪; তানজিহ লি ইবনে আররাক: ২/৮৯; আল-ফাওয়াইদ লিশ শাওকানি: ১/৭৩)।
৫. ভিত্তিহীন কেচ্ছাপাঠঅনেকেই এ–সময় ভিত্তিহীন কেচ্ছাপাঠ বা পুঁথির আসর বসান। যেখানে এ–ধরনের নানা বর্ণনা শোনা যায়, যা ইসলামের মূল বর্ণনার সঙ্গে মেলে না। যেমন: উড়িয়া যায় রে জোড়া কবুতর, ফাতেমা কেন্দে কয়—/আজ বুঝি কারবালার আগুন লেগেছে মোর কলিজায়।।মা ফাতেমার কান্দন শুনে আরশ থেকে আল্লাহ কয়—/যাও গো জিব্রিল বাতাস কর মা ফাতেমার কলিজায়,/পুত্রশোকে কলিজা জ্বলে বাতাসে কী ঠান্ডা হয়!
এগুলো সত্য নয়, কেননা, ফাতেমা (রা.) মৃত্যুবরণ করেন ১১ হিজরিতে, আর হুসাইন (রা.) শহিদ হন ৬১ হিজরিতে। দুজনের মাঝে প্রায় ৫০ বছরের ব্যবধান। তাহলে ফাতেমা (রা.) তাঁর সন্তানের জন্য কান্না করেছেন কী করে সঠিক হতে পারে? (আত-তবাকাতুল কুবরা, দারুল কুতুবিল ইলমিয়্যা, বৈরুত : ৮/২৩)।
অনেকে মনে করেন, আশুরা মানে কারবালা; এ কারণেই মহররমের ১০ তারিখের এত গুরুত্ব ও মর্যাদা। এটা সঠিক নয়। কেননা, আশুরার মর্যাদা ও ঐতিহ্য ইসলাম–পূর্ব যুগ থেকেই স্বীকৃত।
আরও পড়ুনআশুরা বিশেষ একটি দিন১৭ জুলাই ২০২৪উৎস: Prothomalo
এছাড়াও পড়ুন:
মহররমে ইতিহাসের গুরুত্বপূর্ণ ঘটনাবলি
মহররম কেবল একটি মাস নয়, বরং ইসলামের ইতিহাসের একটি জীবন্ত অধ্যায়, যেখানে বিষাদ, সংগ্রাম ও আধ্যাত্মিকতার মিশ্রণ রয়েছে। কেবল ১০ মহররম নয়, এই মাসজুড়ে ঘটেছে ইতিহাসের অবিস্মরণীয় ও ব্যথাতুর নানা ঘটনা। আমরা কয়েকটি উল্লেখ করছি।
মহররমের উল্লেখযোগ্য তারিখ ও ঘটনা
২ মহররম: কারবালায় হোসাইন (রা.)-এর প্রবেশ৬৮০ সালে, হিজরি ৬১ সনে হোসাইন ইবন আলী (রা.) কারবালায় প্রবেশ করেন এবং তাঁর শিবির স্থাপন করেন। ইয়াজিদের সেনাবাহিনী তাঁদের ঘিরে ফেলে।
কুফার দিকে যাওয়ার পথে উমাইয়া সৈন্যরা তাঁদের থামান এবং কারবালার মরুভূমিতে শিবির স্থাপন করতে বাধ্য করেন, যেখানে পানি বা কোনো সুরক্ষা দেয়াল ছিল না। এই ঘটনা কারবালার ট্র্যাজেডির সূচনা করে (আল-তাবারি, তারিখ আল-তাবারি, ৫/৩৯১, দারুল কুতুব, ১৯৬৭)।
৭ মহররম: পানি নিষিদ্ধকরণ৬৮০ সালে, হিজরি ৬১ সনে ইয়াজিদের নির্দেশে হোসাইন (রা.)-এর শিবিরের জন্য পানির সরবরাহ বন্ধ করে দেওয়া হয়। এর ফলে হোসাইন (রা.) ও তাঁর সঙ্গীদের মধ্যে তীব্র তৃষ্ণা ও ক্ষুধার সৃষ্টি হয়। (আল-তাবারি, তারিখ আল-তাবারি, ৫/৪০১, দারুল কুতুব, ১৯৬৭)
আরও পড়ুনহিজরি কালপঞ্জি: ইসলামি পরিচয়ের ধারণা২৩ মে ২০২৫৮ মহররম: জয়নুল আবেদীন (রা.)–এর মৃত্যু৯৫ হিজরির এই দিনে ইমাম জয়নুল আবেদীন (রা.) মৃত্যু। কোনো কোনো বর্ণনা মতে উমাইয়া খলিফ ওয়ালিদের নির্দেশে তাকে বিষপানে শহিদ করা হয়। তিনি ছিলেন হোসাইন ইবন আলী (রা.)-এর পুত্র এবং কারবালার ট্র্যাজেডির সাক্ষ্য হয়ে বেঁচে থাকা একমাত্র পুরুষ সদস্য।
৯ মহররম: আলোচনার ব্যর্থতা৬৮০ সালের এই দিনে হোসাইন (রা.) ও উমাইয়া বাহিনীর মধ্যে আলোচনা ভেঙে পড়ে। উমাইয়া নেতা উমার ইবন সাদ বিকেলে নামাজের পর আক্রমণের পরিকল্পনা করেছিলেন, কিন্তু তাঁকে পরের দিন পর্যন্ত অপেক্ষা করতে রাজি করানো হয়। হোসাইন (রা.) ও তাঁর অনুসারীরা সেই রাত ইবাদতে কাটান। (আল-তাবারি, তারিখ আল-তাবারি, ৫/৪১১, দারুল কুতুব, ১৯৬৭)
১০ মহররম: আশুরা ও কারবালার যুদ্ধএ দিন আশুরার দিন। নবীজি (সা.) বলেন, ‘আশুরার দিনের রোজা পূর্ববর্তী এক বছরের পাপের কাফফারা হিসেবে গ্রহণ করা হবে।’ (সহিহ মুসলিম, হাদিস: ১১৬২)
৬৮০ সালে এদিনেই কারবালার যুদ্ধ সংঘটিত হয়। হোসাইন ইবন আলী (রা.), তাঁর ভাই আব্বাস (রা.) এবং তাঁর পরিবারের অধিকাংশ পুরুষ সদস্য উমাইয়া সৈন্যদের হাতে শাহাদাত বরণ করেন। যুদ্ধের শেষে উমাইয়া সৈন্যরা হোসাইন (রা.)-এর শিবিরের নারী ও শিশুদের বন্দী করে দামেস্কে নিয়ে যায়। (আল-তাবারি, তারিখ আল-তাবারি, ৫/৪২৩, দারুল কুতুব, ১৯৬৭)
আরও পড়ুনআশুরা ও কারবালা করুণ ইতিহাসের স্মারক১৭ জুলাই ২০২৪১৬ মহররম: প্রথম কিবলা নির্ধারণ১৬ মহররমে নবীজি (সা.) বাইতুল মুকাদ্দাসকে প্রথম কিবলা হিসেবে নির্ধারণ করেন। পরবর্তীকালে কোরআনের আয়াতের মাধ্যমে কিবলা কাবার দিকে পরিবর্তিত হয়, ‘আমরা তোমার মুখকে আকাশের দিকে বারবার ফিরতে দেখি, তাই আমরা তোমাকে এমন কিবলার দিকে ফিরিয়ে দেব, যা তুমি পছন্দ কর।’ (সুরা বাকারা, আয়াত: ১৪৪)
১৭ মহররম: হস্তির ঘটনা৫৭০ খ্রিষ্টাব্দের এই দিনে মক্কায় ‘হাতিওয়ালাদের’ আগমন ঘটে, যা কোরআনের সুরা ফিলে উল্লেখিত হয়েছে, ‘তুমি কি দেখনি, তোমার রব হাতিওয়ালাদের সঙ্গে কী করেছেন?’
২০ মহররম: বেলাল (রা.)-এর ইন্তেকাল১৭ বা ১৮ হিজরির এই দিন ইসলামের প্রথম মুয়াজ্জিন বেলাল (রা.) ইন্তেকাল করেন। তাঁর আজানের আহ্বান ইসলামের ইতিহাসে চিরস্মরণীয়। (ইবন সাদ, আত-তাবাকাতুল কুবরা, ৩/২৩২, দার সাদির, ১৯৬০)
সূত্র: দ্য ইসলামিক ইনফর্মেশন ডটকম
আরও পড়ুনপবিত্র আশুরা ৬ জুলাই২৬ জুন ২০২৫