বিশ্ববাজারে চালের দাম আট বছরে সর্বনিম্ন, দেশের বাজারে বাড়তি
Published: 10th, August 2025 GMT
বিশ্ববাজারে চালের দাম গত আট বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন পর্যায়ে নেমে গেছে—এই ঘটনা এশিয়ার অনেক কৃষকের জন্য বড় ধাক্কা। রেকর্ড উৎপাদন ও ভারতের রপ্তানি নিষেধাজ্ঞা তুলে নেওয়ায় বাজারে সরবরাহ বেড়ে গেছে। তাতেই কমেছে চালের দাম।
থাইল্যান্ডের ৫ শতাংশ ভাঙা সাদা চালের রপ্তানি মূল্য বিশ্ববাজারের মানদণ্ড হিসেবে পরিচিত। এই চালের দাম সম্প্রতি টনপ্রতি ৩৭২ দশমিক ৫০ ডলারে নেমে গেছে। গত বছরের শেষ ভাগের তুলনায় এই দাম ২৬ শতাংশ কম। সেই সঙ্গে ২০১৭ সালের পর সর্বনিম্ন। কিন্তু বিশ্ববাজারে চালের দাম কমলেও দেশের বাজারে তার প্রভাব নেই।
চালের দামের এই পতন শুরু হয় ২০২৪ সালের সেপ্টেম্বরে। বিশ্বের সর্ববৃহৎ চাল রপ্তানিকারক দেশ ভারত ধাপে ধাপে রপ্তানি নিষেধাজ্ঞা তুলে নিতে শুরু করে তখন। এই ঘটনা চালের বাজারে বড় প্রভাব ফেলে। জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার তথ্য অনুযায়ী, এ বছর সব ধরনের চালের মূল্যসূচক ১৩ শতাংশ কমেছে। খবর ফাইন্যান্সিয়াল টাইমস (এফটি)
ভারতের তেলেঙ্গানা স্টেট অ্যাগ্রিকালচারাল ইউনিভার্সিটির অধীন সেন্টার ফর সাসটেইনেবল অ্যাগ্রিকালচার অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজের পরিচালক সমরেন্দ্র মোহান্তি এফটিকে বলেন, বিষয়টি খুবই সহজ–সরল—বাজারে অতিরিক্ত সরবরাহ। গত বছর ভারতে চাল উৎপাদনের রেকর্ড হয়েছে। এ বছরও আবারও রেকর্ড ফলন হবে।
অথচ ২০২৪ সালের শুরুতে এর উল্টো চিত্র দেখা গেছে। তখন ভারত একের পর এক রপ্তানি সীমাবদ্ধতা জারি করলে ২০০৮ সালের পর চালের দাম সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৌঁছায়। বিশ্বজুড়ে ভোক্তাদের মধ্যে আতঙ্ক সৃষ্টি হয়। মানুষের মধ্যে মজুতের প্রবণতা তৈরি হয়। অন্যান্য উৎপাদক দেশেও সুরক্ষাবাদী পদক্ষেপ নেওয়া হয়।
রাবোব্যাঙ্কের সিনিয়র বিশ্লেষক অস্কার ত্যাজক্রা বলেন, ২০২৩-২৪ মৌসুমে রেকর্ড উৎপাদনের পর ভারতের সরকারি গুদাম পূর্ণ হয়ে যাওয়ায় বছরের শেষ দিকে রপ্তানি নীতিতে পরিবর্তন আনে ভারত। তখন থেকে রাশ আলগা শুরু করে। এটাই চালের দাম কমে যাওয়ার প্রধান কারণ। তার সঙ্গে থাইল্যান্ড ও ভিয়েতনামের উৎপাদন বৃদ্ধি পাওয়ায় বিপণন মৌসুমে বিশ্বের চাল উৎপাদন রেকর্ড পর্যায়ে ওঠে।
সেই সঙ্গে দাম কমার ক্ষেত্রে বাজারের আরেকটি অমোঘ নিয়ম হলো, চাহিদা কমে যাওয়া। চালের বড় ক্রেতা ইন্দোনেশিয়া গত বছর আগাম আমদানি করে রেখেছে। ২০২৫ সালে তারা বাজার থেকে চাল কেনেনি। ফিলিপাইনও প্রধান ফসল কাটার সময় অভ্যন্তরীণ দাম রক্ষা করতে অক্টোবর পর্যন্ত চাল আমদানি বন্ধ রেখেছে। মোহান্তি বলেন, ইন্দোনেশিয়া নেই, ফিলিপাইন নেই—এ মুহূর্তে সাদা চালের ক্রেতা নেই।
এফটির সংবাদে বলা হয়েছে, ভারতের এই অস্বাভাবিক সরবরাহ কৃষিক্ষেত্রে অগ্রগতির ফল। দেশের প্রধান ধান উৎপাদন অঞ্চলের প্রায় সবখানেই এখন সেচব্যবস্থা রয়েছে। ফলে খরা ও অনিশ্চিত মৌসুমি বৃষ্টির সময় চালের উৎপাদন সুরক্ষিত থাকছে।
বিশ্লেষকেরা বলেন, ভারত মূলত মৌসুমি বৃষ্টির ওপর নির্ভরশীলতা থেকে বেরিয়ে এসেছে। ফলে দেশটির চাল উৎপাদন সুরক্ষিত হয়েছে। কৃষকেরা এখন প্রায় প্রতি মৌসুমে নতুন বীজ নিচ্ছেন। এতে ফলন বাড়ছে। এ ছাড়া ন্যূনতম সহায়তা মূল্য(এমএসপি) ও রাজ্যভিত্তিক বোনাসে উৎসাহিত হয়ে চাষিরাও ধান উৎপাদনে আগ্রহী হচ্ছেন। অর্থাৎ ধান চালের পরিসর ও উৎপাদন বাড়ছে। কৃষকেরা জানেন, ধানই সবচেয়ে লাভজনক ফসল—এমএসপি আছে, বোনাস আছে, ঝুঁকিও কম। এসব কারণে ভারতে চাল উৎপাদন বেড়েছে।
কিন্তু এশিয়ার অনেক দেশে কৃষকের এ ধরনের সুরক্ষা নেই। তাই দাম কমে গেলে তাঁদের আয়ে বড় ধরনের প্রভাব ফেলে। ফলে চাষের উচ্চ ব্যয় ও মূল্যস্ফীতির চাপের সঙ্গে যুক্ত হয়ে আরও কঠিন পরিস্থিতি তৈরি হচ্ছে।
ভোক্তাদের জন্য এই দাম কমে যাওয়া স্বস্তির খবর। যেসব দেশ চাল আমদানির ওপর নির্ভরশীল, সেসব দেশে এই দাম কমে যাওয়া খাদ্যপণ্যের সামগ্রিক মূল্যস্ফীতি ও পারিবারিক বাজেটের চাপ কমাতে সাহায্য করবে। চলতি বছর এখন পর্যন্ত চালের দাম অনেকটা কমেছে ঠিক। কিন্তু এটাই শেষ নয়; চালের দাম আরও ১০ শতাংশ পর্যন্ত কমার সম্ভাবনা আছে বলে মনে করেন বিশ্লেষকেরা। বাজারে ক্রেতা নেই, এটাই মূল কারণ।
মোহান্তির হিসাব অনুযায়ী, চলতি বছরের মে মাসে ভারত সরকারের গুদামে প্রায় ছয় কোটি টন চাল মজুত ছিল—সাম্প্রতিক কয়েক বছরের গড় মজুতের চেয়ে প্রায় দেড় কোটি টন বেশি। নতুন ফসল আসার আগে জায়গা খালি করতে নয়াদিল্লি দেশীয় বাজারে ও এমনকি ইথানল উৎপাদনের জন্য চাল বিক্রি করছে।
মোহান্তি আরও বলেন, ‘চালের দাম হ্রাসের চক্রে প্রবেশ করেছি আমরা। এখন যুদ্ধ বা অন্য কোনো বড় ধাক্কা না লাগলে আগামী দুই বছরের মধ্যে এই ধারা বদলাবে বলে মনে হয় না।’
দেশে কমছে না চালের দামএদিকে বিশ্ববাজারে চালের দাম কমলেও দেশের বাজারে বেশ অনেক দিন ধরেই চালের দাম বাড়তি। জুলাই মাসে বাজারে সব ধরনের চালের দাম কেজিতে ৫-৬ টাকা বেড়েছে। এমনকি চালের ভরা মৌসুমেও দেশের বাজারে দাম বেড়েছে।
প্রথম আলোর সংবাদে বলা হয়েছে, গত এক বছরে ১৩ লাখ মেট্রিক টনের মতো চাল আমদানি হয়েছে। গত বোরো মৌসুমে ফলনও ভালো হয়েছে। কিন্তু তাতে চালের দাম কমেনি, বরং বাড়ছে।
বিশ্লেষকেরা বলেন, চাল উৎপাদনে দেশ স্বয়ংসম্পূর্ণ নয়। সে ক্ষেত্রে ঠিক সময় আমদানি করতে হবে, যেন চাহিদাজনিত চাপ চালের বাজারে আলাদা সংকট সৃষ্টি করতে না পারে। সরবরাহ ঠিক থাকলে বাজারে কারসাজির সুযোগ কমে যায়। কিন্তু বাংলাদেশে চাল আমদানি সাধারণত নিষিদ্ধ থাকে। সরকার বিশেষ অনুমতি দিয়ে চাল আমদানি করে। সময়মতো আমদানি না হলে বাজারে কারসাজির সুযোগ সৃষ্টি হয় বলে জানা যায়।
চাল দেশের মানুষের প্রধান খাদ্যশস্য। চালের দাম বাড়লে মূল্যস্ফীতির ওপর সবচেয়ে বেশি প্রভাব পড়ে। দরিদ্র পরিবারে ব্যয়ের বড় খাত হলো চাল। সে কারণে চালের দাম নিয়ন্ত্রণে রাখা গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করেন বিশ্লেষকেরা।
.উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: চ ল র দ ম কম ব শ বব জ র চ ল আমদ ন সরবর হ স রক ষ র কর ড বছর র ধরন র
এছাড়াও পড়ুন:
স্বস্তিতে বিদ্যুৎ, সংকটে গ্যাস সরবরাহ
বিদ্যুৎ-জ্বালানি খাত নিয়ে দুর্নীতি-অনিয়মের বিস্তর অভিযোগ ছিল গত সরকারের সময়ে। শ্বেতপত্র প্রণয়ন কমিটির প্রতিবেদন বলছে, বিদ্যুৎ উৎপাদন খাতে অন্তত ৬০০ কোটি ডলার নয়ছয় হয়েছে। এ দুর্নীতির বিরুদ্ধে তেমন কোনো ব্যবস্থা নিতে দেখা যায়নি এক বছরে। আদানি, রামপালসহ বিতর্কিত বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর চুক্তি বাতিল বা সংশোধনে কমিটি করা হয়েছে।
বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতে খরচ কমিয়ে সাশ্রয়ে জোর দিয়েছে অন্তর্বর্তী সরকারের বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়। ইতিমধ্যে কিছু ক্ষেত্রে সাশ্রয় করেছে তারা। তারপরও বিদ্যুৎ-গ্যাস খাতে ইতিহাসের সর্বোচ্চ ভর্তুকি গেছে গত অর্থবছরে (২০২৪-২৫)। গ্রীষ্মে সর্বোচ্চ বিদ্যুৎ উৎপাদন করা হয়েছে। এবার লোডশেডিং করতে হয়নি। চাহিদাও কিছুটা কম ছিল। বিদ্যুৎ খাত অনেকটা স্বস্তিতে ছিল। তবে টানা সংকট ছিল গ্যাস সরবরাহে। শিল্পে নতুন সংযোগ বন্ধ আছে আট মাস ধরে।
গত সরকারের সময় বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাত সবচেয়ে বেশি ভুগেছে বকেয়া বিল পরিশোধের চাপে। এতে সরবরাহ ধরে রাখতে পারেনি। টানা তিন বছর লোডশেডিং করতে হয়েছে। অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর বকেয়া পরিশোধের উদ্যোগ নেয়। শুরুতেই জ্বালানি তেল আমদানির বিদেশি কোম্পানির ৫০ কোটি ডলারের বকেয়া শোধ করা হয়। গ্যাস খাতে ৭৫ কোটি ডলার বকেয়া রেখে গেছে আওয়ামী লীগ সরকার। গত এপ্রিলে সব বকেয়া শোধ করেছে অন্তর্বর্তী সরকার। বিদ্যুৎ খাতের বকেয়াও অনেকটা শোধ করা হয়েছে।
বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতের সমস্যা এক বছরে সমাধানের মতো নয়। গ্রীষ্মে বিদ্যুৎ সরবরাহ নিশ্চিত করা হয়েছে। চাইলেই চট করে গ্যাস সমস্যার সমাধান সম্ভব নয়।মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান উপদেষ্টা, বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদবিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতবিশেষজ্ঞরা বলছেন, বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতে সবচেয়ে বেশি আপত্তি ছিল বিদ্যুৎ ও জ্বালানির দ্রুত সরবরাহ বৃদ্ধি (বিশেষ বিধান) আইন-২০১০ নিয়ে। এ আইনে বলা হয়, এর অধীন নেওয়া কোনো সিদ্ধান্ত নিয়ে আদালতে যাওয়া যাবে না। এটি দায়মুক্তি আইন হিসেবে পরিচিত। বিগত সরকার এ আইনের মেয়াদ বারবার বাড়িয়ে দরপত্র ছাড়া একের পর এক চুক্তি করেছে। এসব চুক্তি বাতিলের দাবি ছিল। অন্তর্বর্তী সরকার গত ২৮ নভেম্বর অধ্যাদেশ জারির মাধ্যমে আইনটি রহিত করেছে। তবে এ আইনের অধীন করা সব চুক্তি বলবৎ রেখেছে। বিদ্যুৎ খাতে সবচেয়ে বেশি আপত্তি বিদ্যুৎকেন্দ্রের ভাড়া নিয়ে, যা ক্যাপাসিটি চার্জ হিসেবে পরিচিত। এক বছরে কোনো বিদ্যুৎকেন্দ্রের ভাড়া কমানোর দৃষ্টান্ত নেই।
অবশ্য বিশেষ আইনের অধীন বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতে গত সরকারের করা চুক্তিগুলো পর্যালোচনায় ৫ সেপ্টেম্বর একটি কমিটি করে দেয় অন্তর্বর্তী সরকার। কমিটি এখনো কাজ করছে। তাদের পরামর্শে বিদ্যুৎকেন্দ্রের ট্যারিফ (বিদ্যুতের দাম) পর্যালোচনায় আরেকটি কমিটি করা হয়েছে গত ২১ জানুয়ারি। এখন পর্যন্ত কোনো বিদ্যুৎকেন্দ্রের ট্যারিফ কমানোর সমঝোতা হয়নি।
বিশেষ ক্ষমতা আইনের অধীন ৩৭টি সৌরবিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণে সম্মতিপত্র দিয়েছিল গত সরকার। এগুলো বাতিল করে দিয়েছে অন্তর্বর্তী সরকার। নতুন একটি এলএনজি টার্মিনাল নির্মাণে সামিটের সঙ্গে চুক্তি করে গিয়েছিল গত সরকার। এটিও বাতিল করা হয়েছে। আরেকটি টার্মিনাল নির্মাণে মার্কিন কোম্পানি এক্সিলারেট এনার্জির সঙ্গে টার্ম শিট সই হয়েছিল, সেটিও বাতিল করা হয়েছে। এস আলম গ্রুপের বিনিয়োগে জ্বালানি তেল পরিশোধনের প্রকল্প বাস্তবায়নের সিদ্ধান্ত দিয়েছিল আওয়ামী লীগ সরকার, এটিও বাতিল করা হয়েছে।
বিদ্যুৎ ও জ্বালানি পণ্যের দাম নির্ধারণের ক্ষমতা নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশনের (বিইআরসি)। বিগত সরকার আইন সংশোধন করে দাম নির্ধারণের ক্ষমতা মন্ত্রণালয়ের হাতে নেয়। এরপর কয়েক দফায় বিদ্যুৎ ও গ্যাসের দাম বাড়ায় নির্বাহী আদেশে। অন্তর্বর্তী সরকার দাম নির্ধারণের ক্ষমতা বিইআরসির হাতে ফিরিয়ে দিয়েছে। এরপর শিল্পে গ্যাসের দাম এক দফা বাড়ানো হয়। বিদ্যুতের দাম বাড়ানো হয়নি। তবে জ্বালানি তেলের দাম নির্ধারণের ক্ষমতা এখনো জ্বালানি বিভাগের হাতে রয়ে গেছে। প্রতি মাসে দাম সমন্বয় করা হচ্ছে।
গ্যাস নিয়ে সংকটগ্যাসের সরবরাহ নিয়ে বিপাকে আছে সরকার। দেশি গ্যাসের উৎপাদন টানা কমছে। নতুন নতুন কূপ খনন করে উৎপাদন ধরে রাখার চেষ্টা করা হচ্ছে। একই সঙ্গে সরবরাহ বাড়াতে এলএনজি আমদানি বাড়ানো হচ্ছে। তবু চাহিদামতো গ্যাস সরবরাহ করা যাচ্ছে না। নতুন গ্যাস আবিষ্কারে গতিশীল কোনো কার্যক্রম নেই। গত দেড় দশকেও সমুদ্রে গ্যাস আবিষ্কার করা যায়নি। অন্তর্বর্তী সরকারের সময় সমুদ্রে তেল গ্যাস অনুসন্ধানের সবশেষ দরপত্রে কোনো কোম্পানি অংশ নেয়নি। সমুদ্রে অনুসন্ধানে থাকা একমাত্র কোম্পানি ভারতের ওএনজিসি চলে যাচ্ছে। তার মানে আগামী কয়েক বছরেও সমুদ্রে গ্যাসের সম্ভাবনা নেই। দরপত্র আহ্বান করতে নতুন উৎপাদন অংশীদারত্ব চুক্তি (পিএসসি) করা হচ্ছে। স্থলভাগেও গ্যাস অনুসন্ধানে একটি পিএসসি তৈরি করা হচ্ছে।
বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ উপদেষ্টা মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান প্রথম আলোকে বলেন, বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতের সমস্যা এক বছরে সমাধানের মতো নয়। গ্রীষ্মে বিদ্যুৎ সরবরাহ নিশ্চিত করা হয়েছে। কিন্তু চাইলেই চট করে গ্যাস সমস্যার সমাধান সম্ভব নয়। প্রয়োজনীয় অবকাঠামো গড়তেও অন্তত তিন বছর সময় দরকার। তবু সর্বোচ্চ এলএনজি আমদানি করে শিল্পে গ্যাসের চাহিদা মেটানো হয়েছে। গ্যাস অনুসন্ধান ও উৎপাদনে জোর দেওয়া হয়েছে।
বিদ্যুৎকেন্দ্রের ভাড়া, দুর্নীতির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ, বির্তকিত বিদ্যুৎকেন্দ্রের চুক্তি বাতিল বা সংশোধন, আদানির সঙ্গে বিরোধ—এসব বিষয়ে ফাওজুল কবির খান বলেন, এসব বিষয়ে অগ্রগতি আছে। কমিটি কাজ করছে। চুক্তি সংশোধন করে বিদ্যুতের দাম কমাতে আলোচনা চলছে। আদানির সঙ্গেও আলোচনায় অগ্রগতি আছে। চূড়ান্ত ফল না আসায় প্রকাশ্যে দেখা যাচ্ছে না। তবে ভেতরে–ভেতরে অনেক কাজ চলছে। একটু সময় লাগবে।
খরচ কমিয়ে সাশ্রয়ে নজরবিদ্যুৎ খাতে ভর্তুকি কমাতে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) চাপ আছে। গত সরকার তাই দফায় দফায় দাম বাড়িয়েছিল। খরচ কমাতে সাশ্রয়ে নজর দিয়েছে অন্তর্বর্তী সরকার। সরকারের এক বছরের সাফল্য নিয়ে বিদ্যুৎ বিভাগ ও জ্বালানি বিভাগ আলাদা করে প্রতিবেদন তৈরি করেছে। এতে খরচ কমানোর তথ্য তুলে ধরা হয়েছে। আমদানি ও কেনাকাটার প্রক্রিয়ায় পরিবর্তন এনে প্রতিযোগিতা বাড়িয়ে ইতিমধ্যে বিভিন্ন খাতে খরচ কমানো হয়েছে।
জ্বালানি বিভাগ বলছে, বিশেষ বিধান বাতিল করে প্রতিযোগিতা বাড়িয়ে এলএনজি কেনায় ৩০২ কোটি টাকা সাশ্রয় হয়েছে। চলতি অর্থবছরে আরও ব্যাপক সাশ্রয় হবে বলে আশা করা হচ্ছে। জ্বালানি তেল আমদানিতে আগের বছরের চেয়ে ২০২৪-২৫ অর্থবছরে সাত হাজার কোটি টাকা সাশ্রয় করা হয়েছে। কাফকো সার কারখানা ও লাফার্জ সিমেন্টের সঙ্গে নতুন করে গ্যাস বিক্রয় চুক্তি করায় বছরে এক হাজার কোটি টাকা বাড়তি রাজস্ব আয় হবে। সিস্টেম লস কমানোয় ২১৮ কোটি টাকা রাজস্ব আয় বেড়েছে। শিল্প খাতে গ্যাসের দাম বাড়ানোয় ৯৮ কোটি টাকা রাজস্ব আয় বাড়বে।
সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, এটা ঠিক, সরকারের উদ্যোগে প্রতিযোগিতা বাড়ায় খরচ কমেছে অনেক ক্ষেত্রে। তবে খরচ কমাতে বৈশ্বিক পরিস্থিতিও ভূমিকা রেখেছে। আগের বছরের তুলনায় বিশ্ববাজারে জ্বালানি তেল ও এলএনজির দাম কম ছিল গত এক বছর। এ ছাড়া গত বছর বিশ্বে জ্বালানি পরিবহনের জাহাজভাড়া কমেছে।
জ্বালানি বিভাগ বলছে, দেশি গ্যাস উৎপাদন বাড়াতে ১৫০টি কূপ সংস্কার ও খননের পরিকল্পনা বাস্তবায়নে নতুন তিনটি রিগ কিনে বাপেক্সের সক্ষমতা বাড়ানোর উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। ইতিমধ্যে ১৯টি কূপের কাজ শেষে দিনে ৮ কোটি ঘনফুটের বেশি গ্যাস গ্রিডে যুক্ত হয়েছে। এ ছাড়া গ্যাস খাতের ১০টি প্রকল্পের খরচ কমিয়ে ৩২৮ কোটি টাকা সাশ্রয় খরচ করা হয়েছে।
বিদ্যুৎ বিভাগের প্রতিবেদন বলছে, বেসরকারি বিদ্যুৎকেন্দ্রের জ্বালানি তেল আমদানির সার্ভিস চার্জ ৪ শতাংশ কমানোয় ৪৭০ কোটি টাকা সাশ্রয় হবে। প্রতি জাহাজে ১৫ হাজার টনের বদলে ২০ হাজার টন তেল আমদানি নির্ধারণ করায় ৩৫৪ কোটি টাকা সাশ্রয় হবে। মাতারবাড়ী বিদ্যুৎকেন্দ্রের প্রতি ইউনিটের দাম ৮ টাকা ৪৫ পয়সা নির্ধারণ করায় বছরে আড়াই হাজার কোটি টাকা সাশ্রয় হবে। অন্যান্য বিদ্যুৎকেন্দ্রের ট্যারিফ কমানোর উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। সরকারি বিদ্যুৎকেন্দ্রের ট্যারিফ কমিয়ে ২ হাজার ৬৩০ কোটি টাকা সাশ্রয়ের পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া স্থাপনা ভাড়া, বিলম্ব মাশুল (জরিমানা) আদায়সহ বিভিন্ন কার্যক্রমের মাধ্যমে ৯ হাজার ২১০ কোটি টাকা রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা নেওয়া হয়েছে।
সাশ্রয়ের মধ্যেই বেড়েছে ভর্তুকিপেট্রোবাংলা বলছে, এলএনজি আমদানি শুরুর পর থেকে লোকসান শুরু হয় সংস্থাটির। প্রতিবছর সরকারের কাছ থেকে ভর্তুকি নিচ্ছে পেট্রোবাংলা। ২০১৮-১৯ সালে এলএনজি আমদানি শুরু হয়। ওই বছর ভর্তুকি ছিল ২ হাজার ৫০০ কোটি টাকা। এরপর এলএনজি আমদানি বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে ভর্তুকিও বাড়তে থাকে। গত অর্থবছরে তারা ভর্তুকি নিয়েছে ৮ হাজার ৯০০ কোটি টাকা। এর আগের অর্থবছরে ভর্তুকি ছিল ৬ হাজার কোটি টাকা।
বিদ্যুৎ খাতে গত অর্থবছরে ভর্তুকি বরাদ্দ ছিল ৪৭ হাজার কোটি টাকা। তারা নিয়েছে ৬২ হাজার কোটি টাকা। তবে বিদ্যুৎ বিভাগ বলছে, এটি চলতি অর্থবছরে (২০২৫-২৬) কমে আসবে। তাই ৩৭ হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ করা হয়েছে বাজেটে। যদিও গত অর্থবছরে ১০ শতাংশ খরচ কমিয়ে ১১ হাজার ৪৪৪ কোটি টাকা সাশ্রয়ের লক্ষ্যমাত্রা নেওয়া হয়েছিল। গত বছরের আগস্ট থেকে গত মে পর্যন্ত দেড় হাজার কোটি টাকা সাশ্রয় করা গেছে। মেয়াদ শেষে ১০টি বেসরকারি বিদ্যুৎকেন্দ্র বন্ধ করায় ৫২৫ কোটি টাকা সাশ্রয় হয়েছে।
বিদ্যুৎ বিভাগ বলছে, গ্রীষ্মে পরিকল্পনা নিয়ে লোডশেডিংমুক্ত রাখা হয়েছে। বিদ্যুৎকেন্দ্রের অভ্যন্তরীণ বকেয়া ১ হাজার ৭২৮ কোটি টাকা পরিশোধ করা হয়েছে। বৈদেশিক বকেয়া শোধ করা হয়েছে ১৫ কোটি ২৬ লাখ ডলার। আদানির বকেয়া ৭ হাজার ৯৩৪ কোটি টাকা থেকে ২ হাজার ৩৬৩ কোটি টাকায় নামিয়ে আনা হয়েছে। নবায়নযোগ্য জ্বালানি নীতিমালা প্রকাশ করা হয়েছে।
আগামী ডিসেম্বরের মধ্যে সারা দেশের সরকারি ভবনের ছাদে সোলার প্যানেল বসিয়ে এক থেকে তিন হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন করার লক্ষ্যমাত্রা নেওয়া হয়েছে। চারটি ধাপে উন্মুক্ত দরপত্রের মাধ্যমে ৫৫টি স্থানে ৫ হাজার ২৩৮ মেগাওয়াট সৌরবিদ্যুৎ উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা নেওয়া হয়েছে।
তবে সরকারের এক বছরের অগ্রগতি নিয়ে অসন্তোষ প্রকাশ করেছেন ভোক্তা অধিকার সংগঠন কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) জ্বালানি উপদেষ্টা এম শামসুল আলম। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ভোক্তাদের পক্ষ থেকে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতে করণীয় স্পষ্টভাবে সরকারের নজরে আনা হয়েছে; কিন্তু সরকার তার ধারেকাছেও যায়নি। আগের সরকারের আমলে লুণ্ঠনের যে ক্ষেত্র তৈরি হয়েছে, তার সুরক্ষা দিচ্ছে অন্তর্বর্তী সরকার। জ্বালানি খাত সংস্কারে সুপারিশ, দুর্নীতির অভিযোগ নিয়ে কিছুই করেনি সরকার।