বিশ্ববাজারে চালের দাম আট বছরে সর্বনিম্ন, দেশের বাজারে বাড়তি
Published: 10th, August 2025 GMT
বিশ্ববাজারে চালের দাম গত আট বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন পর্যায়ে নেমে গেছে—এই ঘটনা এশিয়ার অনেক কৃষকের জন্য বড় ধাক্কা। রেকর্ড উৎপাদন ও ভারতের রপ্তানি নিষেধাজ্ঞা তুলে নেওয়ায় বাজারে সরবরাহ বেড়ে গেছে। তাতেই কমেছে চালের দাম।
থাইল্যান্ডের ৫ শতাংশ ভাঙা সাদা চালের রপ্তানি মূল্য বিশ্ববাজারের মানদণ্ড হিসেবে পরিচিত। এই চালের দাম সম্প্রতি টনপ্রতি ৩৭২ দশমিক ৫০ ডলারে নেমে গেছে। গত বছরের শেষ ভাগের তুলনায় এই দাম ২৬ শতাংশ কম। সেই সঙ্গে ২০১৭ সালের পর সর্বনিম্ন। কিন্তু বিশ্ববাজারে চালের দাম কমলেও দেশের বাজারে তার প্রভাব নেই।
চালের দামের এই পতন শুরু হয় ২০২৪ সালের সেপ্টেম্বরে। বিশ্বের সর্ববৃহৎ চাল রপ্তানিকারক দেশ ভারত ধাপে ধাপে রপ্তানি নিষেধাজ্ঞা তুলে নিতে শুরু করে তখন। এই ঘটনা চালের বাজারে বড় প্রভাব ফেলে। জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার তথ্য অনুযায়ী, এ বছর সব ধরনের চালের মূল্যসূচক ১৩ শতাংশ কমেছে। খবর ফাইন্যান্সিয়াল টাইমস (এফটি)
ভারতের তেলেঙ্গানা স্টেট অ্যাগ্রিকালচারাল ইউনিভার্সিটির অধীন সেন্টার ফর সাসটেইনেবল অ্যাগ্রিকালচার অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজের পরিচালক সমরেন্দ্র মোহান্তি এফটিকে বলেন, বিষয়টি খুবই সহজ–সরল—বাজারে অতিরিক্ত সরবরাহ। গত বছর ভারতে চাল উৎপাদনের রেকর্ড হয়েছে। এ বছরও আবারও রেকর্ড ফলন হবে।
অথচ ২০২৪ সালের শুরুতে এর উল্টো চিত্র দেখা গেছে। তখন ভারত একের পর এক রপ্তানি সীমাবদ্ধতা জারি করলে ২০০৮ সালের পর চালের দাম সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৌঁছায়। বিশ্বজুড়ে ভোক্তাদের মধ্যে আতঙ্ক সৃষ্টি হয়। মানুষের মধ্যে মজুতের প্রবণতা তৈরি হয়। অন্যান্য উৎপাদক দেশেও সুরক্ষাবাদী পদক্ষেপ নেওয়া হয়।
রাবোব্যাঙ্কের সিনিয়র বিশ্লেষক অস্কার ত্যাজক্রা বলেন, ২০২৩-২৪ মৌসুমে রেকর্ড উৎপাদনের পর ভারতের সরকারি গুদাম পূর্ণ হয়ে যাওয়ায় বছরের শেষ দিকে রপ্তানি নীতিতে পরিবর্তন আনে ভারত। তখন থেকে রাশ আলগা শুরু করে। এটাই চালের দাম কমে যাওয়ার প্রধান কারণ। তার সঙ্গে থাইল্যান্ড ও ভিয়েতনামের উৎপাদন বৃদ্ধি পাওয়ায় বিপণন মৌসুমে বিশ্বের চাল উৎপাদন রেকর্ড পর্যায়ে ওঠে।
সেই সঙ্গে দাম কমার ক্ষেত্রে বাজারের আরেকটি অমোঘ নিয়ম হলো, চাহিদা কমে যাওয়া। চালের বড় ক্রেতা ইন্দোনেশিয়া গত বছর আগাম আমদানি করে রেখেছে। ২০২৫ সালে তারা বাজার থেকে চাল কেনেনি। ফিলিপাইনও প্রধান ফসল কাটার সময় অভ্যন্তরীণ দাম রক্ষা করতে অক্টোবর পর্যন্ত চাল আমদানি বন্ধ রেখেছে। মোহান্তি বলেন, ইন্দোনেশিয়া নেই, ফিলিপাইন নেই—এ মুহূর্তে সাদা চালের ক্রেতা নেই।
এফটির সংবাদে বলা হয়েছে, ভারতের এই অস্বাভাবিক সরবরাহ কৃষিক্ষেত্রে অগ্রগতির ফল। দেশের প্রধান ধান উৎপাদন অঞ্চলের প্রায় সবখানেই এখন সেচব্যবস্থা রয়েছে। ফলে খরা ও অনিশ্চিত মৌসুমি বৃষ্টির সময় চালের উৎপাদন সুরক্ষিত থাকছে।
বিশ্লেষকেরা বলেন, ভারত মূলত মৌসুমি বৃষ্টির ওপর নির্ভরশীলতা থেকে বেরিয়ে এসেছে। ফলে দেশটির চাল উৎপাদন সুরক্ষিত হয়েছে। কৃষকেরা এখন প্রায় প্রতি মৌসুমে নতুন বীজ নিচ্ছেন। এতে ফলন বাড়ছে। এ ছাড়া ন্যূনতম সহায়তা মূল্য(এমএসপি) ও রাজ্যভিত্তিক বোনাসে উৎসাহিত হয়ে চাষিরাও ধান উৎপাদনে আগ্রহী হচ্ছেন। অর্থাৎ ধান চালের পরিসর ও উৎপাদন বাড়ছে। কৃষকেরা জানেন, ধানই সবচেয়ে লাভজনক ফসল—এমএসপি আছে, বোনাস আছে, ঝুঁকিও কম। এসব কারণে ভারতে চাল উৎপাদন বেড়েছে।
কিন্তু এশিয়ার অনেক দেশে কৃষকের এ ধরনের সুরক্ষা নেই। তাই দাম কমে গেলে তাঁদের আয়ে বড় ধরনের প্রভাব ফেলে। ফলে চাষের উচ্চ ব্যয় ও মূল্যস্ফীতির চাপের সঙ্গে যুক্ত হয়ে আরও কঠিন পরিস্থিতি তৈরি হচ্ছে।
ভোক্তাদের জন্য এই দাম কমে যাওয়া স্বস্তির খবর। যেসব দেশ চাল আমদানির ওপর নির্ভরশীল, সেসব দেশে এই দাম কমে যাওয়া খাদ্যপণ্যের সামগ্রিক মূল্যস্ফীতি ও পারিবারিক বাজেটের চাপ কমাতে সাহায্য করবে। চলতি বছর এখন পর্যন্ত চালের দাম অনেকটা কমেছে ঠিক। কিন্তু এটাই শেষ নয়; চালের দাম আরও ১০ শতাংশ পর্যন্ত কমার সম্ভাবনা আছে বলে মনে করেন বিশ্লেষকেরা। বাজারে ক্রেতা নেই, এটাই মূল কারণ।
মোহান্তির হিসাব অনুযায়ী, চলতি বছরের মে মাসে ভারত সরকারের গুদামে প্রায় ছয় কোটি টন চাল মজুত ছিল—সাম্প্রতিক কয়েক বছরের গড় মজুতের চেয়ে প্রায় দেড় কোটি টন বেশি। নতুন ফসল আসার আগে জায়গা খালি করতে নয়াদিল্লি দেশীয় বাজারে ও এমনকি ইথানল উৎপাদনের জন্য চাল বিক্রি করছে।
মোহান্তি আরও বলেন, ‘চালের দাম হ্রাসের চক্রে প্রবেশ করেছি আমরা। এখন যুদ্ধ বা অন্য কোনো বড় ধাক্কা না লাগলে আগামী দুই বছরের মধ্যে এই ধারা বদলাবে বলে মনে হয় না।’
দেশে কমছে না চালের দামএদিকে বিশ্ববাজারে চালের দাম কমলেও দেশের বাজারে বেশ অনেক দিন ধরেই চালের দাম বাড়তি। জুলাই মাসে বাজারে সব ধরনের চালের দাম কেজিতে ৫-৬ টাকা বেড়েছে। এমনকি চালের ভরা মৌসুমেও দেশের বাজারে দাম বেড়েছে।
প্রথম আলোর সংবাদে বলা হয়েছে, গত এক বছরে ১৩ লাখ মেট্রিক টনের মতো চাল আমদানি হয়েছে। গত বোরো মৌসুমে ফলনও ভালো হয়েছে। কিন্তু তাতে চালের দাম কমেনি, বরং বাড়ছে।
বিশ্লেষকেরা বলেন, চাল উৎপাদনে দেশ স্বয়ংসম্পূর্ণ নয়। সে ক্ষেত্রে ঠিক সময় আমদানি করতে হবে, যেন চাহিদাজনিত চাপ চালের বাজারে আলাদা সংকট সৃষ্টি করতে না পারে। সরবরাহ ঠিক থাকলে বাজারে কারসাজির সুযোগ কমে যায়। কিন্তু বাংলাদেশে চাল আমদানি সাধারণত নিষিদ্ধ থাকে। সরকার বিশেষ অনুমতি দিয়ে চাল আমদানি করে। সময়মতো আমদানি না হলে বাজারে কারসাজির সুযোগ সৃষ্টি হয় বলে জানা যায়।
চাল দেশের মানুষের প্রধান খাদ্যশস্য। চালের দাম বাড়লে মূল্যস্ফীতির ওপর সবচেয়ে বেশি প্রভাব পড়ে। দরিদ্র পরিবারে ব্যয়ের বড় খাত হলো চাল। সে কারণে চালের দাম নিয়ন্ত্রণে রাখা গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করেন বিশ্লেষকেরা।
.উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: চ ল র দ ম কম ব শ বব জ র চ ল আমদ ন সরবর হ স রক ষ র কর ড বছর র ধরন র
এছাড়াও পড়ুন:
চলতি অর্থবছরে ৫% জিডিপি প্রবৃদ্ধির পূর্বাভাস এডিবির; ৪ কারণে চাপে প্রবৃদ্ধি
চলতি অর্থবছর মোট দেশজ উৎপাদন (জিডিপি) কিছুটা বাড়বে বলে পূর্বাভাস দিয়েছে এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি)। এডিবির পূর্বাভাস অনুসারে, ২০২৫-২৬ অর্থবছরে জিডিপি প্রবৃদ্ধি ৫ শতাংশ হতে পারে। গত অর্থবছরের জন্য জিডিপি প্রবৃদ্ধির প্রাক্কলন হলো ৪ শতাংশ।
এডিবি আরও বলেছে, তৈরি পোশাক রপ্তানি স্থিতিশীল থাকলেও রাজনৈতিক পরিবর্তন, ঘন ঘন বন্যা, শিল্প খাতে শ্রমিক অস্থিরতা এবং বিরাজমান উচ্চ মূল্যস্ফীতি কারণে দেশের অভ্যন্তরীণ চাহিদা দুর্বল হয়ে পড়েছে। এই চার কারণে প্রভাব পড়ছে সামগ্রিক প্রবৃদ্ধিতে।
আজ মঙ্গলবার এডিবি এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট আউটলুক (এডিও) সেপ্টেম্বর সংস্করণ প্রকাশ করেছে। প্রতিবেদনে বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধি সম্পর্কে এমন পূর্বাভাস দেওয়া হয়েছে।
এডিবি আরও বলেছে, চলতি অর্থবছরে ভোগ্যব্যয় বাড়বে। কারণ, রেমিট্যান্সের প্রবৃদ্ধি পাবে। এ ছাড়া আসন্ন নির্বাচনসংক্রান্ত নানা ধরনের খরচের কারণেও ভোগব্যয় বাড়াবে।
বাংলাদেশে এডিবির কান্ট্রি ডিরেক্টর হো ইউন জিয়ং বলেন, ‘ভবিষ্যৎ প্রবৃদ্ধিনির্ভর করবে ব্যবসায়িক পরিবেশ উন্নয়নের মাধ্যমে প্রতিযোগিতা বাড়ানো, বিনিয়োগ আকৃষ্ট করা এবং নির্ভরযোগ্য জ্বালানি সরবরাহ নিশ্চিত করার ওপর। তিনি আরও বলেন, বাংলাদেশের বাণিজ্যে মার্কিন শুল্কের প্রভাব এখনো স্পষ্ট নয়। দেশের ব্যাংক খাতের দুর্বলতা অব্যাহত রয়েছে। এসব চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করা টেকসই প্রবৃদ্ধি অর্জনের জন্য জরুরি।
এডিবির প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, ২০২৬ অর্থবছরের জন্য কিছু ঝুঁকি রয়ে গেছে। আন্তর্জাতিক বাণিজ্যসংক্রান্ত অনিশ্চয়তা, ব্যাংক খাতের দুর্বলতা এবং নীতি বাস্তবায়নের অনাগ্রহ প্রবৃদ্ধির অগ্রগতিতে বাধা হতে পারে। এ জন্য সঠিক সামষ্টিক অর্থনৈতিক নীতি বজায় রাখা এবং কাঠামোগত সংস্কার দ্রুততর করার ওপর গুরুত্বারোপ করা হয়েছে প্রতিবেদনে।
প্রতিবেদনে জানানো হয়, ২০২৩-২৪ অর্থবছরে সার্বিক মূল্যস্ফীতি ছিল ৯ দশমিক ৭ শতাংশ। গত অর্থবছরের তা বেড়ে দাঁড়ায় ১০ শতাংশ। এর পেছনে রয়েছে পাইকারি বাজারে সীমিত প্রতিযোগিতা, বাজার তথ্যের ঘাটতি, সরবরাহ শৃঙ্খলে বাধা এবং টাকার অবমূল্যায়ন।
এডিবি বলছে, চলতি অর্থবছরে প্রবৃদ্ধির মূল চালিকাশক্তি হবে ভোগব্যয়, যা শক্তিশালী রেমিট্যান্স প্রবাহ ও নির্বাচন-সংশ্লিষ্ট ব্যয়ের কারণে বাড়বে। তবে সংকোচনমূলক মুদ্রানীতি ও রাজস্বনীতি এবং বিনিয়োগকারীদের সতর্ক মনোভাব বিনিয়োগকে মন্থর করতে পারে। এ ছাড়া যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশের রপ্তানির ওপর ২০ শতাংশ শুল্ক আরোপ এবং ইউরোপীয় ইউনিয়নে প্রতিযোগিতা বাড়ায় রপ্তানি খাত এবং এর প্রবৃদ্ধি চাপ বাড়াবে। ফলে প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে রপ্তানিকারকদের মূল্য কমাতে হতে পারে।