এক সপ্তাহের ব্যবধানে বাজারে খুচরা পর্যায়ে পেঁয়াজের দাম কেজিতে ২০ থেকে ২৫ টাকা বেড়েছে। খুচরা পর্যায়ে এখন দেশি পেঁয়াজ ধরনভেদে ৭৫ থেকে সর্বোচ্চ ৯০ টাকা কেজি দরে বিক্রি হচ্ছে। পাড়া–মহল্লার দোকানে অবশ্য ৮৫ টাকার নিচে কোনো পেঁয়াজ নেই।
ক্রেতারা বলছেন, একলাফে ২০–২৫ টাকা মূল্যবৃদ্ধি স্বাভাবিক ঘটনা নয়। আর বিক্রেতারা জানান, উৎপাদনস্থলেই পেঁয়াজের দাম বেড়ে গেছে। কারণ, কৃষকদের নিজেদের কাছে থাকা অনেক পেঁয়াজ নষ্ট হয়ে গেছে। এখন মূল্যবৃদ্ধি ঠেকাতে বিদেশ থেকে পেঁয়াজ আমদানি করা প্রয়োজন। কিন্তু আমদানির অনুমতি না থাকায় সেটি সম্ভব হচ্ছে না। কৃষকেরা লোকসানে পড়তে পারেন ভেবে সরকারও পেঁয়াজ আমদানির অনুমতি দিচ্ছে না।
বাজারে এখন মূলত দেশি পেঁয়াজই বিক্রি হয়। এক সপ্তাহ আগেও খুচরা পর্যায়ে মানভেদে প্রতি কেজি পেঁয়াজ কেনা যেত ৫৫ থেকে ৬৫ টাকায়। এরপরই হঠাৎ পেঁয়াজের দাম কেজিতে ১৫ থেকে ২০ টাকা পর্যন্ত বেড়ে যায়। গতকাল রোববার রাজধানীর বিভিন্ন বাজারে ধরনভেদে প্রতি কেজি পেঁয়াজ ৭৫ থেকে ৯০ টাকায় বিক্রি হয়েছে।
পেঁয়াজের মূল্যবৃদ্ধির বিষয়টি আমাদের নজরে এসেছে। এখন আমদানির অনুমোদন দিলে কৃষকেরা আবার লোকসানে পড়ে যাবেন কি না, সেটিও পর্যালোচনা করতে হবে। আমরা ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে বিষয়টি জানিয়েছি। কৃষি ও বাণিজ্য মন্ত্রণালয় চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেবে। মো.ছাইফুল আলম, মহাপরিচালক, কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর
রাজধানীর মোহাম্মদপুর কৃষি মার্কেট, টাউনহল বাজার, হাতিরপুল বাজার, তেজগাঁওয়ের কলমিলতা বাজার ও কারওয়ান বাজার ঘুরে পেঁয়াজের দরদামের খোঁজ নেন এই প্রতিবেদক। এতে দেখা যায়, খুচরা দোকানে পাবনার পেঁয়াজ বিক্রি হচ্ছে সর্বোচ্চ ৮৫ থেকে ৯০ টাকা দামে। আর ফরিদপুর ও মানিকগঞ্জের পেঁয়াজের ১০ টাকা কমে; অর্থাৎ ৭৫ থেকে ৮০ টাকা কেজি দরে বিক্রি হয়।
গত বছর এই সময়ে অবশ্য পেঁয়াজের দাম আরও বেশি ছিল। সরকারি সংস্থা ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) তথ্য অনুসারে, গত বছর এই সময়ে এক কেজি পেঁয়াজ ১১০ থেকে ১২০ টাকা কেজি দরে বিক্রি হয়েছিল। তখন আমদানি করা পেঁয়াজের কেজি ছিল ১০০ থেকে ১১০ টাকা। তবে এ বছর পেঁয়াজের উৎপাদন বেড়েছে। ফলে এখনো আমদানির প্রয়োজন হয়নি।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্য অনুসারে, সর্বশেষ মৌসুম; অর্থাৎ ২০২৪–২৫ অর্থবছরে দেশে ৪৪ লাখ ৪৮ হাজার টন পেঁয়াজ উৎপাদন হয়। এর আগের বছর পেঁয়াজ উৎপাদন হয়েছিল ৩৯ লাখ ১১ হাজার টন; অর্থাৎ গত বছর প্রায় ৫ লাখ ৩৭ হাজার টন বেশি পেঁয়াজ উৎপাদন হয়েছে। তারপরও বাজারে পেঁয়াজের দাম বাড়ছে।
কৃষকের ঘরে পচেছে পেঁয়াজ
পেঁয়াজচাষিরা জানান, চলতি বছর তাঁদের ঘরে মজুত করে রাখা অনেক পেঁয়াজ নষ্ট হয়ে গেছে। এতে বাজারে পেঁয়াজের সরবরাহ কমেছে। এই সুযোগে ব্যবসায়ী ও মজুতদারেরা দাম বাড়িয়েছেন। দেশে পেঁয়াজের অন্যতম উৎপাদনস্থল পাবনার সাঁথিয়া উপজেলার বোয়াইলমারী হাটে গতকাল রোববার প্রতি মণ পেঁয়াজ ২ হাজার ৫০০ থেকে ২ হাজার ৭০০ টাকায় (পাইকারি) বিক্রি হয়েছে, যা এক সপ্তাহ আগে ছিল ২ হাজার থেকে ২ হাজার ২০০ টাকা; অর্থাৎ পাইকারিতে প্রতি মণে ৫০০–৭০০ টাকা আর কেজিতে সাড়ে ১২–সাড়ে ১৭ টাকা দাম বেড়েছে।
বোয়াইলমারী হাটের আড়তদার ও পেঁয়াজচাষি রাজা হোসেন বলেন, গত বছর ভালো দাম পাওয়ায় এ বছর অনেকেই মাঠ থেকে অপরিপক্ব পেঁয়াজ তুলেছেন। সঠিকভাবে পেঁয়াজ সংরক্ষণ করতে পারেননি অনেকে। এ ছাড়া সাম্প্রতিক বৃষ্টির কারণেও অনেক পেঁয়াজ নষ্ট হয়েছে।
সাঁথিয়ার আরেক পেঁয়াজচাষি রতন পাল বলেন, ‘চলতি বছর আমি প্রায় ৪০০ মণ পেঁয়াজ মজুত রেখেছিলাম। এর অর্ধেকই পচে গেছে। এখন বাড়তি দামে পেঁয়াজ বিক্রি করেও আমাদের তেমন লাভ হচ্ছে না। এ অবস্থায় পেঁয়াজ আমদানি হলে আমাদের বড় লোকসান হবে।’
আমদানির অনুমতি নেই
সাধারণত দেশি পেঁয়াজের সরবরাহ কমলে বা দাম হঠাৎ বেড়ে গেলে ঘাটতি পূরণ হয় আমদানি করা পেয়াঁজ দিয়ে। কিন্তু বর্তমানে পেঁয়াজ আমদানি বন্ধ রয়েছে। এ কারণে দাম কমছে না।
রাজধানীর শ্যামবাজারের পাইকারি পেঁয়াজ ব্যবসায়ী ও আমদানিকারক আবদুল মাজেদ বলেন, অনুমতি না থাকায় দেশে এখন পেঁয়াজ আমদানি করা যাচ্ছে না। ভারতে বর্তমানে প্রতি কেজি পেঁয়াজের দাম ২০ রুপির কাছাকাছি। ফলে ওই পেঁয়াজ আমদানি করা গেলে দেশেও পেঁয়াজের দাম কমত। শিগগিরই আমদানির অনুমতি না পেলে সামনে পেঁয়াজের দাম আরও বাড়বে।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উদ্ভিদ সঙ্গনিরোধ উইংয়ের এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করে প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমাদের তথ্য অনুযায়ী, দেশে পেঁয়াজের পর্যাপ্ত মজুত রয়েছে। বাজারে পেঁয়াজের সরবরাহেও কোথাও ঘাটতি দেখা যায়নি। তারপরও দাম বেড়েছে। আমরা মনে করছি, এই মূল্যবৃদ্ধির পেছনে বৃষ্টি ও মজুতদারির প্রভাব থাকতে পারে। আমরা পেঁয়াজের সরবরাহ পরিস্থিতি নজরে রেখেছি। প্রয়োজন হলে আমদানির অনুমতি দেওয়া হবে।’
এ বিষয়ে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক মো. ছাইফুল আলম প্রথম আলোকে বলেন, ‘পেঁয়াজের মূল্যবৃদ্ধির বিষয়টি আমাদের নজরে এসেছে। এখন আমদানির অনুমোদন দিলে কৃষকেরা আবার লোকসানে পড়ে যাবেন কি না, সেটিও পর্যালোচনা করতে হবে। আমরা ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে বিষয়টি জানিয়েছি। এ নিয়ে (আমদানি) কৃষি ও বাণিজ্য মন্ত্রণালয় চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেবে।
এদিকে বাজারে হঠাৎ করে পেঁয়াজের দাম বাড়ায় ক্ষোভ জানিয়েছেন ভোক্তারা। রাজধানীর মোহাম্মদপুরের বাসিন্দা সাজেদুল ইসলাম বলেন, ‘মাত্র পাঁচ–ছয় দিনের ব্যবধানে পেঁয়াজের দাম কেজিতে ২০ টাকার বেশি বেড়েছে। এটি তো স্বাভাবিক কোনো বিষয় নয়। বাজারে চাল, সবজি, মাছসহ অন্যান্য পণ্যের দামও চড়া। এ অবস্থা আমাদের কষ্ট আরও বাড়িয়ে দিয়েছে।’
[প্রতিবেদনটি তৈরিতে সহায়তা করেছেন প্রতিনিধি, বেড়া, পাবনা]
উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: য় জ র সরবর হ য় জ আমদ ন গত বছর আম দ র অর থ ৎ ব ষয়ট
এছাড়াও পড়ুন:
চলতি অর্থবছরে ৫% জিডিপি প্রবৃদ্ধির পূর্বাভাস এডিবির; ৪ কারণে চাপে প্রবৃদ্ধি
চলতি অর্থবছর মোট দেশজ উৎপাদন (জিডিপি) কিছুটা বাড়বে বলে পূর্বাভাস দিয়েছে এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি)। এডিবির পূর্বাভাস অনুসারে, ২০২৫-২৬ অর্থবছরে জিডিপি প্রবৃদ্ধি ৫ শতাংশ হতে পারে। গত অর্থবছরের জন্য জিডিপি প্রবৃদ্ধির প্রাক্কলন হলো ৪ শতাংশ।
এডিবি আরও বলেছে, তৈরি পোশাক রপ্তানি স্থিতিশীল থাকলেও রাজনৈতিক পরিবর্তন, ঘন ঘন বন্যা, শিল্প খাতে শ্রমিক অস্থিরতা এবং বিরাজমান উচ্চ মূল্যস্ফীতি কারণে দেশের অভ্যন্তরীণ চাহিদা দুর্বল হয়ে পড়েছে। এই চার কারণে প্রভাব পড়ছে সামগ্রিক প্রবৃদ্ধিতে।
আজ মঙ্গলবার এডিবি এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট আউটলুক (এডিও) সেপ্টেম্বর সংস্করণ প্রকাশ করেছে। প্রতিবেদনে বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধি সম্পর্কে এমন পূর্বাভাস দেওয়া হয়েছে।
এডিবি আরও বলেছে, চলতি অর্থবছরে ভোগ্যব্যয় বাড়বে। কারণ, রেমিট্যান্সের প্রবৃদ্ধি পাবে। এ ছাড়া আসন্ন নির্বাচনসংক্রান্ত নানা ধরনের খরচের কারণেও ভোগব্যয় বাড়াবে।
বাংলাদেশে এডিবির কান্ট্রি ডিরেক্টর হো ইউন জিয়ং বলেন, ‘ভবিষ্যৎ প্রবৃদ্ধিনির্ভর করবে ব্যবসায়িক পরিবেশ উন্নয়নের মাধ্যমে প্রতিযোগিতা বাড়ানো, বিনিয়োগ আকৃষ্ট করা এবং নির্ভরযোগ্য জ্বালানি সরবরাহ নিশ্চিত করার ওপর। তিনি আরও বলেন, বাংলাদেশের বাণিজ্যে মার্কিন শুল্কের প্রভাব এখনো স্পষ্ট নয়। দেশের ব্যাংক খাতের দুর্বলতা অব্যাহত রয়েছে। এসব চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করা টেকসই প্রবৃদ্ধি অর্জনের জন্য জরুরি।
এডিবির প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, ২০২৬ অর্থবছরের জন্য কিছু ঝুঁকি রয়ে গেছে। আন্তর্জাতিক বাণিজ্যসংক্রান্ত অনিশ্চয়তা, ব্যাংক খাতের দুর্বলতা এবং নীতি বাস্তবায়নের অনাগ্রহ প্রবৃদ্ধির অগ্রগতিতে বাধা হতে পারে। এ জন্য সঠিক সামষ্টিক অর্থনৈতিক নীতি বজায় রাখা এবং কাঠামোগত সংস্কার দ্রুততর করার ওপর গুরুত্বারোপ করা হয়েছে প্রতিবেদনে।
প্রতিবেদনে জানানো হয়, ২০২৩-২৪ অর্থবছরে সার্বিক মূল্যস্ফীতি ছিল ৯ দশমিক ৭ শতাংশ। গত অর্থবছরের তা বেড়ে দাঁড়ায় ১০ শতাংশ। এর পেছনে রয়েছে পাইকারি বাজারে সীমিত প্রতিযোগিতা, বাজার তথ্যের ঘাটতি, সরবরাহ শৃঙ্খলে বাধা এবং টাকার অবমূল্যায়ন।
এডিবি বলছে, চলতি অর্থবছরে প্রবৃদ্ধির মূল চালিকাশক্তি হবে ভোগব্যয়, যা শক্তিশালী রেমিট্যান্স প্রবাহ ও নির্বাচন-সংশ্লিষ্ট ব্যয়ের কারণে বাড়বে। তবে সংকোচনমূলক মুদ্রানীতি ও রাজস্বনীতি এবং বিনিয়োগকারীদের সতর্ক মনোভাব বিনিয়োগকে মন্থর করতে পারে। এ ছাড়া যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশের রপ্তানির ওপর ২০ শতাংশ শুল্ক আরোপ এবং ইউরোপীয় ইউনিয়নে প্রতিযোগিতা বাড়ায় রপ্তানি খাত এবং এর প্রবৃদ্ধি চাপ বাড়াবে। ফলে প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে রপ্তানিকারকদের মূল্য কমাতে হতে পারে।