ধারদেনা করে শুরু, এখন তিনি কোটিপতি পোনাচাষি
Published: 12th, August 2025 GMT
একসময় পাবনার বেড়া উপজেলার হাটুরিয়া-নাকালিয়া ইউনিয়নের জগন্নাথপুর পূর্ব পাড়ার আবদুর রশিদের জীবন ছিল অভাবে ভরা। কখনো অন্যের জমিতে কাজ করে, কখনো ফেরি করে মাছ বিক্রি করে দিন চলত তাঁর। সেই অবস্থা থেকে এখন কয়েক কোটি টাকার সম্পদের মালিক আবদুর রশিদ।
আবদুর রশিদ জানান, নব্বইয়ের দশকে বাংলাদেশ টেলিভিশনে (বিটিভি) মাছ চাষের একটি বিজ্ঞাপন দেখে তাঁর উদ্যোক্তা হওয়ার স্বপ্নের শুরু। ওই বিজ্ঞাপনে অনুপ্রাণিত হয়ে গরু বিক্রি ও ধার–দেনা করে সাত হাজার টাকা জোগাড় করেন। সেই টাকায় শুরু করেন মাছের পোনা উৎপাদন। এরপর আর তাঁকে পেছন ফিরে তাকাতে হয়নি। এখন তিনি এলাকার পোনাচাষিদের কাছে অনুপ্রেরণা। তবে তাঁর এই ব্যবসার প্রসার ঘটে ২০০৭ সালের পর থেকে।
আবদুর রশীদ জানান, বিয়ের এক বছরের মাথায় সন্তান জন্ম নেয়। কিন্তু সেই সময় সন্তানের দুধ কেনার আর্থিক সামর্থ্যও ছিল না তাঁর। একমাত্র সম্বল ছিল একটি ছাপড়া টিনের ঘর। তখন বিটিভিতে রেণু পোনা চাষের বিজ্ঞাপন তাঁকে নতুন স্বপ্ন দেখায়। তিনি তখন এলাকার একজনের কাছ থেকে ৮ শতাংশ জমির একটি পুকুর ইজারা নেন দেড় হাজার টাকায়। এরপর বাবার কাছ থেকে গরু বিক্রি ও ধার–দেনা করে কয়েক হাজার টাকা নিয়ে ওই পুকুরে ডিমপোনা ছাড়েন। তাতে মাত্র পাঁচ মাসেই প্রায় ২০ হাজার টাকার মতো লাভ হয় তাঁর।
প্রথম বছরের লাভের টাকা দিয়ে আরও তিনটি পুকুর ইজারা নিয়ে পোনা চাষ শুরু করেন রশিদ। তাতে মাস ছয়েক পর তিনি সব খরচ বাদ দিয়ে লাভ করেন ৫৫ হাজার টাকা। স্থানীয় উন্নয়ন সংস্থা প্রোগ্রামস ফর পিপলস ডেভেলপমেন্টের (পিপিডি) পরামর্শে ও সহযোগিতায় এভাবেই তিনি ধাপে ধাপে পোনা চাষের খামার বা পুকুরের আওতা বাড়ান। এখন তাঁর নিজস্ব মালিকানায় আছে তিনটি পুকুর। আর ইজারা নিয়েছেন আরও ২২টি পুকুর। নিজের ও ইজারায় নেওয়া মোট ২৫টি পুকুরে বছরে পাঁচ থেকে সাত ধাপে ৪০০ থেকে ৪৫০ কেজি কার্প জাতীয় মাছের ডিমপোনা ছাড়েন তিনি। প্রতি কেজি ডিমপোনার দাম পড়ে প্রায় ৫ হাজার টাকা। এক মাসেই এসব পোনা এক থেকে দেড় ইঞ্চি আকারের হয়। তখন থেকেই শুরু হয় বিক্রি। পাবনা ও সিরাজগঞ্জ অঞ্চলের খামারিরা আবদুর রশিদের কাছ থেকে সারা বছরজুড়ে পোনা কেনেন।
আবদুর রশিদ জানান, প্রায় ১০ বছর ধরে তিনি বছরে প্রায় ৫০ লাখ টাকার পোনা বিক্রি করেন। সব খরচ বাদ দিয়ে তাতে বছরে তাঁর লাভ থাকে ২৫ লাখ টাকার মতো। সেই অর্থে সংসার খরচ মিটিয়ে প্রতিবছর কিছু কিছু জমি কেনেন। এখন তাঁর মোট সম্পদের পরিমাণ কয়েক কোটি টাকার। একসময়ের ছাপড়া টিনের ঘরের মালিক আবদুর রশিদ তিন বিঘা জমির ওপর গড়ে তুলেছেন বাড়ি। আর কৃষিজমি আছে পাঁচ বিঘা। নিজের পাঁচ সন্তান এখন তাঁর এই পোনা ব্যবসার সঙ্গে যুক্ত বলে জানান আবদুর রশিদ নিজেই।
সম্প্রতি কথা হয় আবদুর রশিদের দুই ছেলে নাজমুল হোসেন ও সেলিম হোসেনের সঙ্গে। তাঁরা বলেন, এখন আমরাও খামারের কাজের সঙ্গে যুক্ত হয়েছি। পোনা চাষ আমাদের পরিবারের ভাগ্য বদলে দিয়েছে।
আর আবদুর রশিদ বলেন, ‘খালি হাতে শুরু করিছিলাম। পরিশ্রম বৃথা যায়নি। মাছের পোনা চাষে পরামর্শ নেওয়ার জন্য এখন এলাকার অনেকেই আমার কাছে আসেন। আমি তাঁদের সাধ্যমতো সহায়তা করার চেষ্টা করি। পোনা বিক্রি করে এখন আমার প্রতিবছর ভালো লাভ হয়। সেই লাভের টাকায় জমি কিনি।’
আবদুর রশিদ সম্পর্কে জানতে চাইলে স্থানীয় উন্নয়ন সংস্থা পিপিডির মৎস্য কর্মকর্তা সেকেন্দার আলী বলেন, ‘একটি ছোট পুকুর দিয়ে পোনা চাষ শুরু করেছিলেন। এখন ২৫টি পুকুরে চাষ করেন। শুরু থেকেই আমরা তাঁকে এই কাজে পরামর্শ দিয়েছি। নানা প্রশিক্ষণেও অংশ নিয়েছেন। এখন তিনি এলাকার একজন সফল উদ্যোক্তা। স্থানীয়ভাবে অনেকেই তাঁর দেখানো পথে পোনা চাষে এগিয়ে এসেছেন।’
.উৎস: Prothomalo
এছাড়াও পড়ুন:
ভারতের বিষ্ণোই গ্যাংকে কেন কানাডায় ‘সন্ত্রাসী সংগঠন’ ঘোষণা করা হলো
ভারতের সংঘবদ্ধ অপরাধে জড়িত কুখ্যাত বিষ্ণোই গ্যাংকে আনুষ্ঠানিকভাবে ‘সন্ত্রাসী সংগঠন’ ঘোষণা করেছে কানাডা। গত সোমবার দেশটির জননিরাপত্তামন্ত্রী গ্যারি আনন্দাসাঙ্গারি এ ঘোষণা দেন।
এই ঘোষণার ফলে দেশটির কর্তৃপক্ষ এখন বিষ্ণোই গ্যাংয়ের সম্পদ জব্দ, তহবিল বন্ধ এবং সদস্যদের বিরুদ্ধে ‘সন্ত্রাসবিরোধী’ আইনের আওতায় মামলা চালাতে পারবে। ঘোষণায় গ্যারি আনন্দাসাঙ্গারি বলেছেন, বিষ্ণোই গ্যাং কানাডায় ভারতীয় প্রবাসী সম্প্রদায়ের মধ্যে ভীতি ছড়িয়েছে এবং সহিংসতার মাধ্যমে আতঙ্কের পরিবেশ তৈরি করেছে।
আনন্দাসাঙ্গারি বলেন, ‘বিষ্ণোই গ্যাং নির্দিষ্ট সম্প্রদায়কে সন্ত্রাস, সহিংসতা আর ভয়ভীতি প্রদর্শনের লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত করেছে। এ গোষ্ঠীকে অপরাধী সন্ত্রাসী হিসেবে তালিকাভুক্ত করায় আমরা আরও কার্যকর হাতিয়ার পাচ্ছি, যা দিয়ে তাদের অপরাধ বন্ধ করা সম্ভব হবে।’
অটোয়া জোর দিয়ে বলছে, কানাডায় সহিংসতা ও সন্ত্রাসী কার্যকলাপের কোনো স্থান নেই, বিশেষ করে যখন তা নির্দিষ্ট সম্প্রদায়কে লক্ষ্য করে আতঙ্কের পরিবেশ তৈরি করে।
ভারতের কুখ্যাত গ্যাংস্টার লরেন্স বিষ্ণোইর নেতৃত্বে পরিচালিত হয় এই বিষ্ণোই গ্যাং। কানাডার কর্মকর্তারা এই গ্যাংকে একটি আন্তদেশীয় অপরাধ চক্র হিসেবে বর্ণনা করেছেন। গ্যাংটির কার্যক্রম মূলত ভারতে হলেও কানাডায় তাদের উপস্থিতি আছে।
৩২ বছর বয়সী লরেন্স বিষ্ণোই এক দশক ধরে ভারতের কারাগারে আছেন। তবে অভিযোগ আছে, সেখান থেকেই তিনি শত শত সদস্যের নেটওয়ার্ক পরিচালনা করছেন। গ্যাংটির সদস্যরা মাদক পাচার, অস্ত্র চোরাচালান, চাঁদাবাজি ও নিশানাভিত্তিক হত্যাকাণ্ডে জড়িত।
কানাডার পুলিশ এর আগে অভিযোগ করেছিল, ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থাগুলো খালিস্তান আন্দোলনের সমর্থকদের হত্যাকাণ্ড ও সহিংস ভয়ভীতি দেখানোর জন্য বিষ্ণোইয়ের সহযোগীদের ব্যবহার করেছে। খালিস্তান আন্দোলন ভারতের পাঞ্জাব রাজ্যে শিখ সংখ্যালঘুদের জন্য একটি স্বাধীন রাষ্ট্র গঠনের দাবি করে আসছে।
ভারত অবশ্য এসব অভিযোগ উড়িয়ে দিয়েছে। নয়াদিল্লি বলছে, অটোয়া কোনো প্রমাণ দিচ্ছে না এবং বিষ্ণোই-সংশ্লিষ্ট অভিযুক্তদের প্রত্যর্পণের অনুরোধগুলো উপেক্ষা করছে।
কানাডার সরকার বলছে, ‘সন্ত্রাসী’ তালিকাভুক্ত করার ফলে গ্যাংয়ের সম্পদ ও অর্থ জব্দ করা ছাড়াও আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলো তাদের নিয়োগ, অর্থায়ন ও আন্তর্জাতিক ভ্রমণ কার্যক্রম ব্যাহত করার সুযোগ পাবে।
কানাডার বিরোধী দল এবং আলবার্টা ও ব্রিটিশ কলাম্বিয়ার প্রাদেশিক সরকার বিষ্ণোই গ্যাংয়ের বিরুদ্ধে কঠোর পদক্ষেপ নেওয়ার দাবি জানাচ্ছিল। এ নিয়ে অটোয়ার ওপর রাজনৈতিক চাপও বাড়ছিল। কানাডায় বর্তমানে ৭ লাখ ৭০ হাজারের বেশি শিখ বসবাস করে, যা দেশটির মোট জনসংখ্যার প্রায় ২ শতাংশ।
‘ভারতের প্রতি কড়া বার্তা’
কানাডা ও ভারতের মধ্যে বিস্তৃত কূটনৈতিক টানাপোড়েনের প্রেক্ষাপটে বিষ্ণোই গ্যাংয়ের কুখ্যাতি বেড়ে যায়। ২০২৩ সালের জুনে ভ্যাঙ্কুভারের কাছে গুরুদুয়ারার বাইরে খালিস্তান আন্দোলনের কর্মী শিখ সম্প্রদায়ের হরদীপ সিং নিজ্জরকে হত্যার পর থেকে কানাডা-ভারতের কূটনৈতিক টানাপোড়েন আরও তীব্র হয়।
কানাডার অভিযোগ, ভারতীয় কর্মকর্তারা বিদেশে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সরকারের সমালোচকদের চুপ করাতে ‘লরেন্স বিষ্ণোইয়ের মতো অপরাধী সংগঠনকে’ ব্যবহার করছে। ভারত অবশ্য এ অভিযোগও প্রত্যাখ্যান করেছে।
নয়াদিল্লি বলছে, তারা বিষ্ণোই গ্যাংয়ের সদস্যদের বিষয়ে দুই ডজনের বেশি প্রত্যর্পণের অনুরোধ করেছে। কিন্তু অটোয়া তা উপেক্ষা করেছে এবং এখনো ভারতে অপরাধে অভিযুক্ত ব্যক্তিদের আশ্রয় দিয়ে যাচ্ছে।
তীব্র অচলাবস্থার মধ্যেও গত সপ্তাহে কানাডার প্রধানমন্ত্রী মার্ক কার্নির জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা নাতালি দ্রুইন বলেছেন, ভারতীয় কর্মকর্তারা চলমান তদন্তে সহযোগিতা করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন এবং সীমান্তপারের দমননীতি থেকে বিরত থাকতে সম্মত হয়েছেন।
লরেন্স বিষ্ণোই কে
দ্য ইকোনমিক টাইমসের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছিল, ১৯৯৩ সালে ভারতের পাঞ্জাব রাজ্যে লরেন্স বিষ্ণোইয়ের জন্ম। ২০১০ সাল পর্যন্ত তাঁর জীবন কেটেছে রাজ্যের আবোহার শহরে। এরপর তিনি ডিএভি কলেজে ভর্তি হতে চণ্ডিগড়ে পাড়ি জমান। ২০১১ সালে যোগ দেন পাঞ্জাব ইউনিভার্সিটি ক্যাম্পাস স্টুডেন্টস কাউন্সিলে। সেখানে তাঁর পরিচয় হয় ‘গ্যাংস্টার’ গোল্ডি ব্রারের সঙ্গে। এরপর ধীরে ধীরে অপরাধে জড়িয়ে পড়েন তিনি।
বিষ্ণোইয়ের বিরুদ্ধে দুই ডজনের বেশি ফৌজদারি মামলা রয়েছে। রয়েছে হত্যা ও চাঁদাবাজির অভিযোগ। যদিও এসব অভিযোগের কোনোটাই স্বীকার করেননি তিনি। ভারতজুড়ে তাঁর গ্যাংয়ে ৭০০ বন্দুকধারী রয়েছে বলে ধারণা করা হয়। নিজের গ্যাংয়ের এই সদস্যদের মাধ্যমে কারাগারে বসেও বাইরের অপরাধজগৎ নিয়ন্ত্রণ করেন তিনি।
২০১০ থেকে ২০১২ সালের মধ্যে চণ্ডীগড়ে অপরাধ কর্মকাণ্ড শুরু করেন বিষ্ণোই। ২০১৩ সাল নাগাদ তিনি ত্রাস সৃষ্টিকারী এক চরিত্রে পরিণত হন। কয়েকটি হত্যার ঘটনার সঙ্গে তাঁর নাম জড়িয়ে পড়ে। পরে তাঁর গ্যাং মদ বেচাকেনা ও অস্ত্র চোরাচালানে অর্থ লগ্নি করা শুরু করেন। হত্যাকারীসহ ভয়ংকর সব অপরাধীকেও আশ্রয় ও সুরক্ষা দিয়ে আসছেন তাঁরা।
কারাগারে বিষ্ণোই
২০১৪ সালে রাজস্থান পুলিশের সঙ্গে বন্দুকযুদ্ধ হয় লরেন্স বিষ্ণোইয়ের। এরপর তিনি কারাবন্দী হন। সেখান থেকেই আরও সংঘবদ্ধভাবে অপরাধজগৎ নিয়ন্ত্রণ করছেন তিনি। কারাগারে থাকাকালে জস্বিন্দর সিং ওরফে রকি নামের আরেক অপরাধীর সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা বাড়ে তাঁর। ২০১৬ সালে হত্যাকাণ্ডের শিকার হন রকি।
বন্দী অবস্থায়ও লরেন্স বিষ্ণোইয়ের প্রভাব–প্রতিপত্তি বেড়েই চলেছিল। রাজস্থানের ভরতপুর জেলায় যে কারাগারে তিনি বন্দী ছিলেন, সেখানকার কর্মকর্তাদের হাত করে নানা কার্যসিদ্ধি করতেন। ২০২১ সালে তাঁকে সেখান থেকে দিল্লির তিহার কারাগারে সরিয়ে নেওয়া হয়। এই কারাগারের কর্মকর্তাদের ভাষ্যমতে, আইপি কলের মাধ্যমে গ্যাংয়ের সদস্যদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখতেন বিষ্ণোই।