দেশের ৭১ ভাগ লোক পিআর পদ্ধতিতে নির্বাচন চায়: তাহের
Published: 17th, August 2025 GMT
“দেশের ৭১ ভাগ লোক পিআর পদ্ধতিতে নির্বাচন চায়। দেশের জনগণ জুলাই ঘোষণা ও সনদের আইনি ভিত্তি এবং জুলাই সনদের ভিত্তিতেই নির্বাচন চায়।”
জামায়াতে ইসলামীর উদ্যোগে রবিবার (১৭ আগস্ট) বিকেলে রাজধানীর রমনায় ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশন মিলনায়তনে ‘জুলাই ঘোষণা এবং জুলাই সনদের আইনি ভিত্তি প্রদান ও আমাদের করণীয়’ শীর্ষক জাতীয় সেমিনারে দলটির নায়েবে আমির সাবেক এমপি ডা.
তিনি বলেন, “বিগত ৫৪ বছরে নেতাদের ব্যর্থতার কারণেই ফ্যাসিবাদীরা ক্ষমতায় এসেছিল। জনগণের আন্দোলনের কারণে ফ্যাসিবাদী সরকার দেশ ছেড়ে পালিয়ে গেছে। সন্ত্রাস, চাঁদাবাজ, দুর্নীতিমুক্ত বাংলাদেশ গড়তে হলে জুলাই সনদ ও ঘোষণাকে আইনি মর্যাদা দিতে হবে।পিআর পদ্ধতিতে নির্বাচন না হলে ফ্যাসিবাদ আবার ফিরে আসবে।”
আরো পড়ুন:
‘দেশের পাচারকৃত অর্থ দিয়ে ৪টি বাজেট করা যাবে’
চবিতে ছাত্রশিবিরের নবীনবরণ, অংশ নেন আড়াই হাজার শিক্ষার্থী
জুলাই বিপ্লবের পর জনগণ যাদের ক্ষমতায় বসিয়েছিল তারাও আজ ফ্যাসিবাদের সাথে আপস করছে জানিয়ে তাহের বলেন, “দেশকে ফ্যাসিবাদের কবল মুক্ত করতে হলে অবাধ, সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন দিতে হবে। যারা তড়িঘড়ি করে নির্বাচন চায় তারা অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন চায় না। প্রধান উপদেষ্টা ক্ষমতায় এসে বলেছিলেন, আগে সংস্কার ও বিচার তারপর নির্বাচন। আমরাও তাই বলতেছি। কিন্তু সংস্কার, বিচার না করেই এবং জুলাই ঘোষণা ও সনদ বাস্তবায়ন না করেই যারা নির্বাচন চায় তারা মূলত ফ্যাসিবাদ কায়েম করতে চায়।”
প্রধান উপদেষ্টার উদ্দেশে তিনি বলেন, “আপনি রাজনৈতিক দলগুলোর সাথে সংলাপ করেন, গোলটেবিল বৈঠক করেন; তারপর দেখেন জনগণ কী চায়। জুলাই সনদ ও ঘোষণা রাষ্ট্রপতির ঘোষণার মাধ্যমেই আইনি ভিত্তি প্রদান করা সম্ভব।”
জনগণের দাবি আদায় করার জন্য তিনি সব ইসলামপন্থী ও গণতান্ত্রিক দলগুলোকে ঐক্যবদ্ধভাবে আন্দোলন করার আহ্বান জানান।
সৈয়দ আব্দুল্লাহ মো. তাহেরের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত এ সেমিনারে ‘জুলাই ঘোষণা এবং জুলাই সনদের আইনি ভিত্তি প্রদান ও আমাদের করণীয়’ শীর্ষক বিষয়ের ওপর মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের আইনজীবী অ্যাডভোকেট মোহাম্মাদ শিশির মনির।
সেমিনারে আলোচ্য বিষয়ের ওপর বক্তব্য রাখেন জামায়াতে ইসলামীর সেক্রেটারি জেনারেল সাবেক এমপি অধ্যাপক মিয়া গোলাম পরওয়ার, খেলাফত মজলিসের মহাসচিব ড. আহমদ আবদুল কাদের, ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের প্রেসিডিয়াম সদস্য মাওলানা আশরাফ আলী আকন, জাতীয় নাগরিক পার্টির সদস্য সচিব আখতার হোসেন, বাংলাদেশ খেলাফত মজলিসের মহাসচিব মাওলানা জালাল উদ্দিন, এলডিপির প্রেসিডিয়াম সদস্য ড. নিয়ামুল বশির, গণঅধিকার পরিষদের সহ-সভাপতি ও মুখপাত্র ফারুক হাসান, জামায়াতে ইসলামীর সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল মাওলানা এটিএম মাছুম, মাওলানা রফিকুল ইসলাম খান ও ড. হামিদুর রহমান আযাদ (সাবেক এমপি), বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের সাবেক রেজিস্ট্রার, সাবেক জেলা জজ ইকতেদার আহমেদ, কেন্দ্রীয় নির্বাহী পরিষদ সদস্য, কেন্দ্রীয় প্রচার ও মিডিয়া বিভাগের সেক্রেটারি মতিউর রহমান আকন্দ, ঢাকা মহানগরী দক্ষিণের আমির নূরুল ইসলাম বুলবুল, ঢাকা মহানগরী উত্তরের আমির মো. সেলিম উদ্দিন, ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) হাসান নাসির ও ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) এটিএম জিয়াউল হাসান, জাতীয় সংস্কার জোটের আহ্বায়ক মেজর (অব.) আমিন আহমদ আফসারী, ইসলামী কানুন বাস্তবায়ন কমিটির আমির মাওলানা আবু তাহের জিহাদী, জামায়াতের কেন্দ্রীয় কর্মপরিষদ সদস্য, বাংলাদেশ লইয়ার্স কাউন্সিলের সভাপতি জসিম উদ্দিন সরকার, বাংলাদেশ আদর্শ শিক্ষক ফেডারেশনের সভাপতি প্রফেসর ড. কোরবান আলী, জাতীয় প্রেসক্লাবের সেক্রেটারি আইয়ুব ভূঁইয়া, বাংলাদেশ খেলাফত আন্দোলনের মহাসচিব মুফতি মাওলানা ফখরুল ইসলাম, ন্যাশনাল ডক্টর্স ফোরামের সভাপতি অধ্যাপক ডা. নজরুল ইসলাম, বাংলাদেশ শ্রমজীবী পার্টির সভাপতি ও প্রেসিডিয়াম মেম্বার জাতীয় সংস্কার জোট লায়ন আবদুল কাদের হেলালী, জাগপার সহ-সভাপতি ও মুখপাত্র ইঞ্জিনিয়ার রাশেদ প্রধান, বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবিরের সেক্রেটারি জেনারেল নুরুল ইসলাম সাদ্দাম, কর্নেল (অব.) অধ্যাপক ডা. জেহাদ খান, ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়নের সভাপতি শহিদুল ইসলাম প্রমুখ।
জামায়াত নেতাদের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল মাওলানা আবদুল হালিম ও মাওলানা মুহাম্মাদ শাহজাহান, কেন্দ্রীয় নির্বাহী পরিষদ সদস্য আবদুর রব, কেন্দ্রীয় কর্মপরিষদ সদস্য অধ্যাপক আহসান উল্লাহ ও ড. খলিলুর রহমান মাদানী ও ড. হেলাল উদ্দিন।
অনুষ্ঠানটি যৌথভাবে সঞ্চালনা করেন সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল, কেন্দ্রীয় প্রচার ও মিডিয়া বিভাগের প্রধান এহসানুল মাহবুব জুবায়ের, কেন্দ্রীয় কর্মপরিষদ সদস্য, ঢাকা মহানগরী দক্ষিণের সেক্রেটারি ড. শফিকুল ইসলাম মাসুদ এবং কেন্দ্রীয় কর্মপরিষদ সদস্য, ঢাকা মহানগরী উত্তরের সেক্রেটারি ড. রেজাউল করিম।
অন্যান্য দলের নেতাদের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন বিডিপির চেয়ারম্যান আনোয়ারুল হক চান, খেলাফত মজলিসের নায়েবে আমির মাওলানা আহমদ আলী কাসেমী, বাংলাদেশ খেলাফত আন্দোলনের নায়েবে আমির মাওলানা আবুল কাসেম হাসেমী, এনডিপির চেয়ারম্যান ক্বারী আবু তাহের, জনতার অধিকার পার্টির চেয়ারম্যান তরিকুল ইসলাম, বাংলাদেশ জনজোটের চেয়ারম্যান মুজাম্মেল মিয়াজী।
জামায়াতের সেক্রেটারি জেনারেল অধ্যাপক মিয়া গোলাম পরওয়ার বলেন, “জুলাই ঘোষণা অসম্পূর্ণ। রাজনৈতিক দল এবং জনগণের দাবি অনুযায়ী জুলাই ঘোষণাকে পূর্ণাঙ্গতা দান করতে হবে এবং জুলাই সনদকে আইনি ভিত্তি দিতে হবে। জুলাই ঘোষণা ও সনদকে আইনি ভিত্তি দেওয়া না হলে পরবর্তীতে যে সরকার আসবে তারা তা মানবে না। ইতোমধ্যেই একটি দলের নেতা বলেছেন, তারা ক্ষমতায় গেলে সবকিছু মুছে ফেলবেন।”
তিনি বলেন, “দেশের অধিকাংশ দল পিআর পদ্ধতিতে নির্বাচন চায়। এই পদ্ধতি ছাড়া নির্বাচন অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ হবে না। যারা বলেন জনগণ পিআর বুঝে না তারা সঠিক কথা বলছেন না। আমরা আইন সভার দুকক্ষেই পিআর পদ্ধতিতে নির্বাচন চাই। আমরা সব ইসলামী ও গণতান্ত্রিক দলগুলোকে নিয়েই একটি মানবিক বাংলাদেশ গড়তে চাই। অবাধ এবং সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য আগে মাঠ সমতল করতে হবে। তারপর নির্বাচন দিতে হবে। তা না হলে জনগণের প্রত্যাশা পূরণ হবে না।”
বাংলাদেশ খেলাফত মজলিসের মহাসচিব অধ্যাপক ড. আহমদ আব্দুল কাদের বলেন, “গত ৫ আগস্ট প্রধান উপদেষ্টা জাতির সামনে যে জুলাই ঘোষণা পেশ করেছেন তা জনগণকে হতাশ করেছে। এই ঘোষণায় ১৮ সাল থেকে কোটাবিরোধী যে আন্দোলন হয়েছে তার কোন উল্লেখ নেই, বিডিআর হত্যা ও শাপলা চত্বরে গণহত্যার ঘটনা উল্লেখ করা হয়নি। অতএব প্রধান উপদেষ্টা যে জুলাই ঘোষণা পেশ করেছেন তা সংশোধন করে রাষ্ট্রপতির ঘোষণার মাধ্যমে আইনি মর্যাদা দিতে হবে।”
ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের প্রেসিডিয়াম সদস্য আশরাফ আলী আকন বলেন, “বাংলাদেশের আকাশে চাঁদাবাজ, দখলদার, সন্ত্রাসী, ক্ষুধার্ত শকুনের আনাগোনা দেখা দিচ্ছে। বর্তমান সরকার নিরপেক্ষ নয়। এই সরকার একটি দলের দিকে তাকিয়ে কথা বলেন। গত ৫৪ বছরেও ভোট ডাকাতি বন্ধ হয়নি, ভোট ডাকাতি ও সন্ত্রাস বন্ধ করতে হলে পিআর পদ্ধতি চালু করতে হবে। পিআর পদ্ধতি না হলে নির্বাচন নিরপেক্ষ হবে না। আমরা সবাই ঐক্যবদ্ধ থাকলে সরকার আমাদের দাবি মানতে বাধ্য হবে।”
জাতীয় নাগরিক পার্টির সদস্য সচিব আকতার হোসেন বলেন, “জুলাই সনদ বাস্তবায়নে দীর্ঘসূত্রিতা দেখা যাচ্ছে। বিএনপি ৯১ সালে ক্ষমতায় গিয়ে তিন জোটের রূপরেখা বাস্তবায়ন করেনি। ৯৬ সালে একতরফা নির্বাচন করেছিল। প্রধান উপদেষ্টা যে জুলাই ঘোষণা পেশ করেছেন তা আশাব্যঞ্জক নয়। জুলাই সনদকে আইনি ভিত্তি দিতে হবে। জনগণের প্রত্যাশা পূরণ করতে হলে বর্তমান সংবিধান পরিবর্তন করতে হবে এবং নতুন সংবিধান প্রণয়ন করতে হবে। পুরনো সংবিধান রেখে ফ্যাসিবাদ ঠেকানো যাবে না।”
বাংলাদেশ খেলাফত মজলিসের মহাসচিব মাওলানা জালাল উদ্দিন বলেন, “গত জুলাই বিপ্লবে এক হাজার ৬০০ লোক শহীদ হয়েছেন, ২০ হাজারের অধিক লোক আহত হয়েছেন। প্রধান উপদেষ্টা যে জুলাই ঘোষণা পেশ করেছেন তাতে জনগণের প্রত্যাশা পাশ কাটিয়ে যাওয়া হয়েছে। একটি দলের পরামর্শে চলছে বর্তমান সরকার। জুলাই সনদের আইনি ভিত্তি দেওয়া না হলে বিপ্লব ছিনতাই হয়ে যাবে। ৭১ সালের বিজয় একটি দেশ ছিনতাই করে নিয়ে গেছে। এই জুলাই বিপ্লব যদি ছিনতাই হয়ে যায় তাহলে জনগণ ক্ষমা করবে না।”
ঢাকা/নঈমুদ্দীন/এসবি
উৎস: Risingbd
কীওয়ার্ড: চ কর চ কর প শ কর ছ ন ত জ ল ই সনদ র সনদ র আইন র ল ইসল ম ক ষমত য় জনগণ র উদ দ ন আম র ম সরক র
এছাড়াও পড়ুন:
জুলাই সনদের খসড়া দলগুলোর কাছে
রাজনৈতিক দলগুলোর কাছে জুলাই জাতীয় সনদের সমন্বিত খসড়া পাঠিয়েছে জাতীয় ঐকমত্য কমিশন। তাতে বলা হয়েছে, বিদ্যমান সংবিধান বা অন্য কোনো আইনে ভিন্নতর কিছু থাকলে সে ক্ষেত্রে এই সনদের বিধান/প্রস্তাব/সুপারিশ প্রাধান্য পাবে। সনদের বৈধতা, প্রয়োজনীয়তা কিংবা জারির কর্তৃত্ব সম্পর্কে কোনো আদালতে প্রশ্ন তোলা যাবে না।
গতকাল শনিবার সন্ধ্যায় দলগুলোর কাছে সমন্বিত খসড়া পাঠানো হয়। এতে সনদ বাস্তবায়নের অঙ্গীকারনামা রয়েছে। যদিও বাস্তবায়ন পদ্ধতি সম্পর্কে বলা হয়নি। জুলাই সনদকে আইনি ভিত্তি দেওয়া এবং বাস্তবায়নের পদ্ধতি কী হতে পারে, তা নিয়ে বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে আলোচনা চালিয়ে যাচ্ছে ঐকমত্য কমিশন। আগামী সপ্তাহে বাস্তবায়নের পদ্ধতি নিয়ে দলগুলোর সঙ্গে আলোচনার পরিকল্পনা রয়েছে কমিশনের। বাস্তবায়নের পদ্ধতি চূড়ান্ত হওয়ার পর সব দল সই করার মধ্য দিয়ে জুলাই জাতীয় সনদ চূড়ান্ত রূপ পাবে।
খসড়ায় জুলাই জাতীয় সনদকে ‘নতুন রাজনৈতিক বন্দোবস্তের দলিল’ হিসেবে আখ্যা দেওয়া হয়েছে। মোটাদাগে, সনদের খসড়ায় তিনটি ভাগ আছে। প্রথম অংশে আছে এই সনদের পটভূমি। দ্বিতীয় অংশে আছে ছয়টি সংস্কার কমিশনের যেসব প্রস্তাবে ঐকমত্য ও সিদ্ধান্ত হয়েছে, এমন ৮৪টি প্রস্তাব। এর মধ্যে কোন প্রস্তাবে কতটি দল একমত হয়েছে এবং কোন কোন দলের ভিন্নমত আছে, তা উল্লেখ করা হয়েছে। আর তৃতীয় অংশে আছে সনদ বাস্তবায়নের আট দফা অঙ্গীকারনামা।
গণ-অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে ক্ষমতায় আসা অন্তর্বর্তী সরকার রাষ্ট্রের বিভিন্ন ক্ষেত্রে সংস্কার আনার উদ্যোগ নেয়। ইতিমধ্যে প্রথম ধাপে গঠন করা ছয়টি সংস্কার কমিশনের (সংবিধান, নির্বাচনব্যবস্থা, জনপ্রশাসন, দুর্নীতি দমন কমিশন, পুলিশ ও বিচার বিভাগ সংস্কার কমিশন) ৮৪টি সংস্কার প্রস্তাব নিয়ে রাজনৈতিক ঐকমত্য ও সিদ্ধান্ত হয়েছে। এই সংস্কার প্রস্তাবগুলো নিয়ে তৈরি করা হচ্ছে ‘জুলাই জাতীয় সনদ’।
গত ২৯ জুলাই দলগুলোকে জুলাই সনদের একটি খসড়া দিয়েছিল জাতীয় ঐকমত্য কমিশন। খসড়া নিয়ে দলগুলো মতামতও দিয়েছিল। তার ভিত্তিতে সমন্বিত খসড়া তৈরি করা হয়েছে। জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সহসভাপতি অধ্যাপক আলী রীয়াজ গতকাল প্রথম আলোকে বলেন, সমন্বিত খসড়া দলগুলোর কাছে পাঠানো হয়েছে। কমিশন আশা করছে, খসড়ায় ভাষাগত বা শব্দগত ত্রুটি নিয়ে কোনো পরামর্শ থাকলে দলগুলো আগামী দু–এক দিনের মধ্যে তা কমিশনকে জানাবে। এ জন্য কমিশন অপেক্ষা করবে। আর বাস্তবায়নের পদ্ধতি নিয়ে বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে আলোচনা অব্যাহত আছে। সেটা চলবে। আগামী সপ্তাহে দলগুলোর সঙ্গে এ বিষয়ে আলোচনা শুরু করা যাবে বলে কমিশন আশা করছে।
কোন কোন ক্ষেত্রে সংস্কার আনা হবে, সে বিষয়ে ঐকমত্য হলেও সংস্কার বাস্তবায়নের পদ্ধতি নিয়ে এখনো সিদ্ধান্ত হয়নি। এ নিয়ে দলগুলোর মতভিন্নতা আছে। বিএনপি সনদ বাস্তবায়নে অঙ্গীকার করার বিষয়ে একমত। তবে জামায়াতে ইসলামী, জাতীয় নাগরিক পার্টিসহ (এনসিপি) কয়েকটি দল মনে করে, শুধু অঙ্গীকার করলেই হবে না। সনদকে আইনি ভিত্তি দিতে হবে এবং সনদ বাস্তবায়নের পদ্ধতি নির্ধারণ করতে হবে।
দলগুলোর দাবির পরিপ্রেক্ষিতে জাতীয় ঐকমত্য কমিশন সনদের আইন ভিত্তি দেওয়া এবং সনদ বাস্তবায়নের পদ্ধতি নিয়ে আইন ও সংবিধানবিশেষজ্ঞদের সঙ্গে আনুষ্ঠানিক ও অনানুষ্ঠানিক আলোচনা করছে। গণভোটের মাধ্যমে সনদ বাস্তবায়ন, জুলাই সনদকে আইনি কাঠামোর মধ্যে আনার বিষয়ে সুপ্রিম কোর্টের মতামত গ্রহণ (রেফারেন্স), বিশেষ পরিস্থিতি বিবেচনায় বিশেষ কোনো ব্যবস্থা নেওয়া যায় কি না দেখা, লিগ্যাল ফ্রেমওয়ার্ক অর্ডারের (এলএফও) মাধ্যমে সনদ বাস্তবায়ন করা—এ ধরনের বেশ কিছু বিকল্প পদ্ধতি আলোচনায় আছে।
গতকাল ঐকমত্য কমিশনের কার্যালয়ে অ্যাটর্নি জেনারেল মো. আসাদুজ্জামানের সঙ্গে আলোচনা করেন কমিশনের সহসভাপতি অধ্যাপক আলী রীয়াজ ও প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী মনির হায়দার। সেখানে সনদ বাস্তবায়নের আইনি বাধ্যবাধকতা তৈরির সম্ভাব্যতা নিয়ে আলোচনা হয়েছে বলে প্রথম আলোকে জানান মনির হায়দার।
৮টি অঙ্গীকার
সনদের খসড়ায় সনদ বাস্তবায়নে আট দফা অঙ্গীকারনামা রাখা হয়েছে। অঙ্গীকারগুলোর মধ্যে রয়েছে:
১. জনগণের অধিকার ফিরে পাওয়া এবং গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠার সুদীর্ঘ আন্দোলন-সংগ্রামের ধারাবাহিকতায় ২০২৪ সালের জুলাই-আগস্টের গণ–অভ্যুত্থানে হাজারো মানুষের জীবন ও রক্তদান এবং অগণিত মানুষের সীমাহীন ক্ষয়ক্ষতি ও ত্যাগ-তিতিক্ষার বিনিময়ে অর্জিত সুযোগ এবং তৎপ্রেক্ষিতে জন-আকাঙ্ক্ষা প্রতিফলন হিসেবে দীর্ঘ ধারাবাহিক প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে প্রণীত ও ঐকমত্যের ভিত্তিতে গৃহীত নতুন রাজনৈতিক বন্দোবস্তের দলিল হিসেবে ‘জুলাই জাতীয় সনদ ২০২৫’–এর পরিপূর্ণ বাস্তবায়ন নিশ্চিত করা।
২. এই রাষ্ট্রের মালিক জনগণ; তাদের অভিপ্রায়ই সর্বোচ্চ আইন এবং গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় জনগণের অভিপ্রায় প্রতিফলিত ও প্রতিষ্ঠিত হয় রাজনৈতিক দলের মাধ্যমে। এমতাবস্থায় রাজনৈতিক দল ও জোটসমূহ সম্মিলিতভাবে দীর্ঘ আলাপ-আলোচনার ভিত্তিতে জনগণের অভিপ্রায়ের সুস্পষ্ট ও সর্বোচ্চ অভিব্যক্তি হিসাবে ‘জুলাই জাতীয় সনদ ২০২৫’ প্রণয়ন করেছে বিধায় এই সনদের সব বিধান, নীতি ও সিদ্ধান্ত সংবিধানে অন্তর্ভুক্তকরণ নিশ্চিত করবে এবং বিদ্যমান সংবিধান বা অন্য কোনো আইনে ভিন্নতর কিছু থাকলে, সে ক্ষেত্রে এই সনদের বিধান/প্রস্তাব/সুপারিশ প্রাধান্য পাবে।
৩. এই সনদের কোনো বিধান, প্রস্তাব বা সুপারিশের ব্যাখ্যাসংক্রান্ত যেকোনো প্রশ্নের চূড়ান্ত মীমাংসার এখতিয়ার সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের ওপর ন্যস্ত থাকবে।
৪. সনদের প্রতিটি বিধান, প্রস্তাব ও সুপারিশ সাংবিধানিক ও আইনগতভাবে বলবৎ হিসেবে গণ্য হবে বিধায় এর বৈধতা, প্রয়োজনীয়তা কিংবা জারির কর্তৃত্ব সম্পর্কে কোনো আদালতে প্রশ্ন তোলা যাবে না।
৫. সনদে বাংলাদেশের সামগ্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থা তথা সংবিধান, বিচারব্যবস্থা, নির্বাচনব্যবস্থা, জনপ্রশাসন, পুলিশি ব্যবস্থা ও দুর্নীতি দমনব্যবস্থার বিষয়ে যেসব প্রস্তাব/সুপারিশ লিপিবদ্ধ রয়েছে, সেগুলো বাস্তবায়নের জন্য সংবিধানের প্রয়োজনীয় সংশোধন, সংযোজন, পরিমার্জন, লিখন ও পুনর্লিখন এবং বিদ্যমান আইনের প্রয়োজনীয় সংশোধন, পরিবর্তন, পরিমার্জন, লিখন, পুনর্লিখন বা নতুন আইন প্রণয়ন, প্রয়োজনীয় বিধি প্রণয়ন বা বিদ্যমান বিধি ও প্রবিধির পরিবর্তন বা সংশোধন করা।
৬. গণতন্ত্র, মানবাধিকার ও আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার জন্য জনগণের নিরবচ্ছিন্ন সংগ্রাম এবং বিশেষত ২০২৪ সালের অভূতপূর্ব গণ–অভ্যুত্থানের ঐতিহাসিক তাৎপর্যকে সাংবিধানিক তথা রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি দেওয়া হবে।
৭. রাষ্ট্র ২০২৪ সালের জুলাই-আগস্টের গণ–অভ্যুত্থানকালে সংঘটিত সব হত্যাকাণ্ডের বিচার, শহীদদের রাষ্ট্রীয় মর্যাদা প্রদান ও শহীদ পরিবারসমূহকে যথোপযুক্ত সহায়তা প্রদান এবং আহতদের সুচিকিৎসা ও পুনর্বাসনে ব্যবস্থা নিশ্চিত করবে।
৮. জুলাই জাতীয় সনদ ২০২৫–এর যেসব প্রস্তাব/সুপারিশ অবিলম্বে বাস্তবায়নযোগ্য বলে বিবেচিত হবে, সেগুলো কোনো প্রকার কালক্ষেপণ না করেই পরবর্তী জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে সরকার ও অন্যান্য সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষসমূহ সম্পূর্ণরূপে বাস্তবায়ন করবে।