৩০ সেপ্টেম্বর ১৯৮৯ সাল। পশ্চিম জার্মানির পররাষ্ট্রমন্ত্রী হ্যান্স-ডিয়েট্রিচ গেনশার প্রাগে অবস্থিত পশ্চিম জার্মানির দূতাবাসের বারান্দা থেকে বক্তৃতা দিলেন। দূতাবাস প্রাঙ্গণে পূর্ব জার্মানি থেকে আসা নাগরিকদের উপচে পড়া ভিড়। তাঁরা সবাই পূর্ব ছেড়ে পশ্চিমে যেতে চাইলেন। পররাষ্ট্রমন্ত্রী গেনশার তাঁদের অনুরোধ রক্ষা করে বিশেষ ট্রেনে পশ্চিম জার্মানিতে আসার অনুমতি দিলেন।

দূতাবাসে আশ্রয় নিতে আসা হাজারখানেক পূর্ব জার্মানির নাগরিক উল্লাসে ফেটে পড়লেন। পশ্চিমে তাঁদের অভিবাসনের দরজা খুলে গেল। ১৯৮৯ সালের ৯ নভেম্বর বার্লিন প্রাচীর ভেঙে পড়ে। ৩ অক্টোবর, ১৯৯০ তারিখে জার্মান পুনর্মিলন আনুষ্ঠানিকভাবে সম্পন্ন হয়। এই ছিল ইউরোপে পূর্ব ও পশ্চিমের সীমান্ত শান্তিপূর্ণ ও অহিংসভাবে অতিক্রম করার পথে তিনটি মাইলফলক।

এর আগে পূর্ব জার্মানির নাগরিক সমাজ নানা সভা–মিছিল এবং চার্চে সাপ্তাহিক শান্তি প্রার্থনা করে কমিউনিস্ট সরকারের পতন চেয়েছিল। ড্রেসডেন, লাইপজিগ এরফুর্ট ও পূর্ব বার্লিনে নাগরিক আন্দোলন শক্তিশালী হচ্ছিল। সেই বছর জার্মান গণতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্র বা পূর্ব জার্মানির ৪০তম বার্ষিকী স্মরণে প্লাউয়েন শহরে অনুষ্ঠান চলছিল। সেই অনুষ্ঠানে হঠাৎ করেই বড় ধরনের সরকারবিরোধী বিক্ষোভ শুরু হয়। ১৫ হাজারের বেশি মানুষ সমাজতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্র উদ্‌যাপনের পরিবর্তে সংস্কার এবং ভ্রমণের স্বাধীনতার দাবিতে স্লোগান দিতে থাকেন। পুলিশ জলকামানের ব্যবহার এবং গ্রেপ্তার করে বিক্ষোভ ছত্রভঙ্গ করতে পারেনি।

১৯৮৯ সালের নভেম্বরে বার্লিন প্রাচীর পতনের পর, পূর্ব জার্মানির ক্ষমতাসীন সমাজতান্ত্রিক ঐক্য জার্মানি পার্টির (Sozialistische Einheitspartei Deutschlands) নেতৃত্ব তাদের কর্তৃত্ব হারিয়ে ফেলে। ডিসেম্বরের ৭ তারিখে বার্লিনের বনহোফার হোটেলে বৈঠকে বসেন সমাজতান্ত্রিক ঐক্য জার্মানি পার্টি ও নাগরিক অধিকারকর্মীরা। তাঁরা পূর্ব জার্মানিতে নতুন গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা নিয়ে আলোচনা করেন। একাধিক বৈঠকে একনায়কতন্ত্র থেকে সংসদীয় গণতন্ত্রে ফিরে আসার বিষয়ে ঐকমত্য হয়। সব পক্ষই এই রূপান্তরের বিষয়টি অহিংসভাবে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার কথা বলেন।

এখন থেকে ৩৫ বছর আগে পূর্ব জার্মানির নাগরিকেরা পথে নেমেছিলেন একনায়কতন্ত্র অধিক গণতন্ত্রের জন্য। গণতন্ত্র আর সমাজতান্ত্রিক ঘরানা থেকে বের হয়ে আসতে তাঁরা মরিয়া হয়ে উঠেছিলেন। আজকে তাঁরাই আবার গণতন্ত্রের অনুশাসন মানছেন না। অধিক গণতন্ত্রের পথ ছেড়ে ক্রমেই সাবেক পূর্ব জার্মানির পাঁচটি রাজ্যের অধিকাংশ জনগণ অতি জাতীয়তাবাদী স্বৈরাচারী রাজনীতির ধারক হয়ে উঠছেন। তার ছায়া পড়েছে পশ্চিমেও। অতি জাতীয়তাবাদীদের এই উত্থান আতঙ্ক ছড়াচ্ছে জার্মানির সমকালীন রাজনীতিতে।

এই উগ্রবাদী অতি জাতীয়তাবাদী রাজনীতির ধারক ‘জার্মানির জন্য বিকল্প’ বা অলটারনেটিভ ফর জার্মানি দলটি। গত বছর জার্মানির ২১তম জাতীয় নির্বাচনে ১৫২ আসন পেয়ে জার্মানির দ্বিতীয় বৃহত্তর দল হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেছে। এই মুহূর্তে দলটি জনপ্রিয়তার দিক থেকে ক্ষমতাসীন কোয়ালিশন জোটের বড় দল ক্রিশ্চিয়ান গণতান্ত্রিক দলটির মতোই জনপ্রিয়।

১৯৩৫ সালের ১৫ সেপ্টেম্বর দক্ষিণ জার্মানির নুরেমবার্গ শহরে অ্যাডলফ হিটলার তাঁর তথাকথিত ‘জাতিগত আইন’ পাস করেন। যা ছিল মূলত ইহুদি জনগোষ্ঠী, পাশাপাশি সিন্তি এবং রোমা, সমকামী, সামাজিকভাবে সুবিধাবঞ্চিত মানুষ, বিদেশি বংশোদ্ভূত মানুষদের একঘরে করে রাখার বন্দোবস্ত। এই শ্রেণির মানুষদের জার্মান হিসেবে বিবেচনা করা নির্বিচারে অস্বীকার করা হয়েছিল।

বর্তমানে জার্মানির দ্বিতীয় বৃহত্তম, উগ্রবাদী অতি জাতীয়তাবাদী রাজনীতির ধারক ‘জার্মানির জন্য বিকল্প’ দলটি হিটলারের মতো তেমন কোনো আইন পাস করার সুযোগ পায়নি। তবে তাদের রাজনীতি সেই একই কায়দার বিদেশি বা অভিবাসী বিদ্বেষের রাজনীতি।

জার্মানির কার্লসরুয়ে ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজি বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসবিদ রোল্ফ-উলরিখ কুঞ্জে সম্প্রতি ডয়েচে ভেলেকে বলেছেন, ‘জার্মানির জন্য বিকল্প’ দলটি একটি ঐতিহাসিক ধারাবাহিকতার অংশ। তিনি বলেছেন, ‘আমার দৃষ্টিকোণ থেকে, “জার্মানির জন্য বিকল্প” দলটি নাৎসি মতাদর্শের সঙ্গে সংযুক্ত।’ তিনি আধুনিক জার্মানির ইতিহাস ব্যাখ্যা করে বলেন, ‘সেই সময়ে নুরেমবার্গ নাগরিকত্ব আইনের দ্বারা জার্মান নাগরিক এবং পরবর্তী সময়ে জার্মান নাগরিকত্ব হওয়া নিয়ে পার্থক্য নিয়ন্ত্রিত হয়েছিল। এত দিন পর সেই একই রাজনীতি “প্রকৃত জার্মান” এবং পরবর্তী সময়ে “নাগরিকত্ব পাওয়া জার্মানদের” মধ্যে পার্থক্যের বিষয়টি হিটলারের ধারণার সঙ্গে সাদৃশ্যপূর্ণ।’

এই দৃষ্টান্ত এখন শুধু জার্মানিতে নয়। জনপ্রিয়তাবাদীরা ইউরোপ–আমেরিকায় ছড়িয়ে পড়েছে। যুক্তরাষ্ট্রে ডোনাল্ড ট্রাম্প, ইতালিতে জর্জিয়া মেলোনি, ফ্রান্সে মেরিন লে পেন এবং জার্মানিতে কট্টরবাদী দলটির নেত্রী অ্যালিস ভায়ডেল। এঁরা সবাই রাজনীতিতে ধর্ম বর্ণ গণতন্ত্রের কথা বলেন; কিন্তু তাঁদের প্রধান লক্ষ্য ক্ষমতা। আর তা অর্জনের জন্য তাঁরা বিপজ্জনক পদ্ধতি ব্যবহার করছেন। আসলে আজকের বিশ্ব, সত্য-পরবর্তী সময় বা পপুলিজমের যুগ বলে মনে হচ্ছে। জনপ্রিয় স্লোগান বা ধর্ম, বর্ণ, অভিবাসী এবং জাতিগত ঘৃণা নিয়ে রাজনীতি জনপ্রিয় হচ্ছে।

ঐক্যের ৩৫ বছরে জার্মানির রাজনীতিতে এই বিপজ্জনক মেরুকরণ গণতন্ত্রের প্রতি প্রচ্ছন্ন হুমকি। সম্প্রতি বছরগুলোতে পূর্ব জার্মানির নির্বাচনে কট্টরবাদী ‘জার্মানির জন্য বিকল্প’ দলটি এমনভাবে প্রচারণা চালিয়েছিল, যেন ‘অভিবাসীরা সব সমস্যার মূল’।

জার্মানির পূর্বের জনগণের কট্টরবাদী রাজনীতি ইদানীং পশ্চিমেও সংক্রমিত হচ্ছে, তবে তা পূর্বাঞ্চলের মতো নয়। বিশ্লেষকেরা অনেকেই বলেন বিগত ৩৫ বছরে পূর্ব জার্মানির জনগণ, ঐক্যবদ্ধ জার্মানির সমাজজীবনকে নিয়ে অনেক বেশি স্বপ্ন দেখেছিল। মূলত পূর্বাঞ্চলের পাঁচটি রাজ্যের একটি সুবিধাবঞ্চিত অংশ কট্টরবাদী রাজনীতির ধারক হয়ে উঠেছে।

এই প্রসঙ্গে জার্মানির সাবেক রাষ্ট্রপতি জোয়াকিম গাউক, যিনি পূর্বাঞ্চলে থাকতেন, তাঁর একটি উক্তি উল্লেখ করার মতো। তিনি পূর্বাঞ্চলের নাগরিকদের কাছে পশ্চিমের ভাবমূর্তি বর্ণনা করে বলেছিলেন, ‘তখন আমরা পূর্বে পশ্চিম জার্মানির মতো স্বর্গের স্বপ্ন দেখতাম, কিন্তু বাস্তবতা অন্য জিনিস।’

জার্মান সরকারের ফেডারেল এজেন্সি ফর সিভিক এডুকেশন, সম্প্রতি প্রকাশিত একটি তথ্যে জানিয়েছে, ‘সাবেক পূর্ব জার্মানির নাগরিকেরা নিজেদের অবহেলিত, পর্যাপ্তভাবে স্বীকৃত নন বা সাধারণত “দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিক” মনে করেন। প্রায় ৬০ শতাংশ মানুষ মনে করেন যে তাঁদের জীবনের অর্জনগুলোকে অবমূল্যায়ন করা হয়েছে।’

জার্মানির পুনর্মিলনের ৩৫ বছরের দিকে তাকালে দেখা যায়, পূর্ব ও পশ্চিমের জনগণ নানা তিতিক্ষার মূল্যায়ন ভাগ করে নিয়েছেন। এই ঐক্য একটি সাফল্যের ইতিহাস। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ৪০ বছর বিভক্ত হয়ে থাকা জার্মানি এখন পুনঃ ঐক্যের সাড়ে তিন দশক পার করছে। সমাজ, রাজনীতি এবং সংস্কৃতিতে নানা ভিন্নতা থাকলেও জার্মানি এগিয়ে যাচ্ছে।

সরাফ আহমেদ প্রথম আলোর জার্মানি প্রতিনিধি

[email protected]

.

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: গণতন ত র র র জন ত ত জনপ র য় ৩৫ বছর র র জন

এছাড়াও পড়ুন:

পারভেজের কথায় ‘বিজয় নেবে ধানের শীষ’

চিত্রনায়ক পারভেজ আবীর চৌধুরীর এবার গান লিখলেন। 'বিজয় নেবে ধানের শীষ' শিরোনামের গানটির সুর করেছেন আহমেদ হুমায়ুন।

গানটিতে কণ্ঠ দিয়েছেন শিল্পী মাটি রহমান, আর কোরাসে অংশ নিয়েছেন প্রায় ৩০ জন সঙ্গীতশিল্পী। টিম কো–অর্ডিনেটর হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন চলচ্চিত্র অভিনেতা মারুফ আকিব।

গানটির মূল পরিকল্পক ও গীতিকার পারভেজ আবীর চৌধুরী জানান, বিএনপির নির্বাচনী প্রচারণার অংশ হিসেবে গানটি দেশজুড়ে প্রচার করা হবে। সম্প্রতি রাজধানীর ‘কোক স্টুডিও কলরব’-এ গানটির রেকর্ডিং সম্পন্ন হয়েছে।

রেকর্ডিং সেশনে উপস্থিত ছিলেন চলচ্চিত্র পরিচালক বদিউল আলম খোকন ও মারুফ আকিব। তারা গানটির পরিবেশনা, উপস্থাপনা এবং সামগ্রিক সুর–আবহ নিয়ে শিল্পীদের পরামর্শ দেন।

গীতিকার পারভেজ আবীর চৌধুরী বলেন, "পুরো গানজুড়ে আমি তুলে ধরার চেষ্টা করেছি এ দেশের ১৮ কোটি মানুষের আশীর্বাদ, তাদের আশা–প্রত্যাশা এবং গণতন্ত্র ফিরে পাওয়ার আকুতি। গানের কথায় উঠে এসেছে শহীদ জিয়াউর রহমানের বহুদলীয় গণতন্ত্রের দর্শন, দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়ার সংগ্রামী নেতৃত্ব এবং তারেক রহমানের একত্রিশ দফার ন্যায়, পরিবর্তন ও গণতন্ত্রের প্রতিশ্রুতি।”

ঢাকা/রাহাত/লিপি

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • জাবি শিক্ষকের বিরুদ্ধে পরীক্ষার খাতা অবমূল্যায়ন ও ট্যাগিংয়ের অভিযোগ
  • সিদ্ধিরগঞ্জে দুই গাড়িতে অগ্নিসংযোগের ঘটনায় মামলা
  • একীভূত হতে যাওয়া পাঁচ ব্যাংকের দুরবস্থার সময় দায়িত্বে ছিলেন যারা
  • বিভ্রান্তি-হতাশা-অনিশ্চয়তার মধ্যেও নির্বাচন অনুষ্ঠানের সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে: ফখরুল
  • নানা দাবির নামে নির্বাচন ব্যাহত করার চেষ্টা চলছে: মির্জা ফখরুল
  • রোনালদো কি সত্যিই বিশ্বকাপে ১-২ ম্যাচ মিস করবেন
  • সেই গণতন্ত্র যেন আর কোন ফ্যাসিবাদের জন্ম না দেয় : মামুন মাহমুদ
  • পারভেজের কথায় ‘বিজয় নেবে ধানের শীষ’
  • শামীম ওসমান দিনের পর দিন না’গঞ্জবাসীর সাথে  প্রতারণা করেছে : কম. সাঈদ
  • শামীম ওসমান দিনের পর দিন না’গঞ্জবাসীর সাথে  প্রতারণা করেছে: কম. সাঈদ