জার্মান ঐক্যের ৩৫ বছর: রাজনীতিতে নতুন মেরুকরণ
Published: 26th, September 2025 GMT
৩০ সেপ্টেম্বর ১৯৮৯ সাল। পশ্চিম জার্মানির পররাষ্ট্রমন্ত্রী হ্যান্স-ডিয়েট্রিচ গেনশার প্রাগে অবস্থিত পশ্চিম জার্মানির দূতাবাসের বারান্দা থেকে বক্তৃতা দিলেন। দূতাবাস প্রাঙ্গণে পূর্ব জার্মানি থেকে আসা নাগরিকদের উপচে পড়া ভিড়। তাঁরা সবাই পূর্ব ছেড়ে পশ্চিমে যেতে চাইলেন। পররাষ্ট্রমন্ত্রী গেনশার তাঁদের অনুরোধ রক্ষা করে বিশেষ ট্রেনে পশ্চিম জার্মানিতে আসার অনুমতি দিলেন।
দূতাবাসে আশ্রয় নিতে আসা হাজারখানেক পূর্ব জার্মানির নাগরিক উল্লাসে ফেটে পড়লেন। পশ্চিমে তাঁদের অভিবাসনের দরজা খুলে গেল। ১৯৮৯ সালের ৯ নভেম্বর বার্লিন প্রাচীর ভেঙে পড়ে। ৩ অক্টোবর, ১৯৯০ তারিখে জার্মান পুনর্মিলন আনুষ্ঠানিকভাবে সম্পন্ন হয়। এই ছিল ইউরোপে পূর্ব ও পশ্চিমের সীমান্ত শান্তিপূর্ণ ও অহিংসভাবে অতিক্রম করার পথে তিনটি মাইলফলক।
এর আগে পূর্ব জার্মানির নাগরিক সমাজ নানা সভা–মিছিল এবং চার্চে সাপ্তাহিক শান্তি প্রার্থনা করে কমিউনিস্ট সরকারের পতন চেয়েছিল। ড্রেসডেন, লাইপজিগ এরফুর্ট ও পূর্ব বার্লিনে নাগরিক আন্দোলন শক্তিশালী হচ্ছিল। সেই বছর জার্মান গণতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্র বা পূর্ব জার্মানির ৪০তম বার্ষিকী স্মরণে প্লাউয়েন শহরে অনুষ্ঠান চলছিল। সেই অনুষ্ঠানে হঠাৎ করেই বড় ধরনের সরকারবিরোধী বিক্ষোভ শুরু হয়। ১৫ হাজারের বেশি মানুষ সমাজতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্র উদ্যাপনের পরিবর্তে সংস্কার এবং ভ্রমণের স্বাধীনতার দাবিতে স্লোগান দিতে থাকেন। পুলিশ জলকামানের ব্যবহার এবং গ্রেপ্তার করে বিক্ষোভ ছত্রভঙ্গ করতে পারেনি।
১৯৮৯ সালের নভেম্বরে বার্লিন প্রাচীর পতনের পর, পূর্ব জার্মানির ক্ষমতাসীন সমাজতান্ত্রিক ঐক্য জার্মানি পার্টির (Sozialistische Einheitspartei Deutschlands) নেতৃত্ব তাদের কর্তৃত্ব হারিয়ে ফেলে। ডিসেম্বরের ৭ তারিখে বার্লিনের বনহোফার হোটেলে বৈঠকে বসেন সমাজতান্ত্রিক ঐক্য জার্মানি পার্টি ও নাগরিক অধিকারকর্মীরা। তাঁরা পূর্ব জার্মানিতে নতুন গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা নিয়ে আলোচনা করেন। একাধিক বৈঠকে একনায়কতন্ত্র থেকে সংসদীয় গণতন্ত্রে ফিরে আসার বিষয়ে ঐকমত্য হয়। সব পক্ষই এই রূপান্তরের বিষয়টি অহিংসভাবে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার কথা বলেন।
এখন থেকে ৩৫ বছর আগে পূর্ব জার্মানির নাগরিকেরা পথে নেমেছিলেন একনায়কতন্ত্র অধিক গণতন্ত্রের জন্য। গণতন্ত্র আর সমাজতান্ত্রিক ঘরানা থেকে বের হয়ে আসতে তাঁরা মরিয়া হয়ে উঠেছিলেন। আজকে তাঁরাই আবার গণতন্ত্রের অনুশাসন মানছেন না। অধিক গণতন্ত্রের পথ ছেড়ে ক্রমেই সাবেক পূর্ব জার্মানির পাঁচটি রাজ্যের অধিকাংশ জনগণ অতি জাতীয়তাবাদী স্বৈরাচারী রাজনীতির ধারক হয়ে উঠছেন। তার ছায়া পড়েছে পশ্চিমেও। অতি জাতীয়তাবাদীদের এই উত্থান আতঙ্ক ছড়াচ্ছে জার্মানির সমকালীন রাজনীতিতে।
এই উগ্রবাদী অতি জাতীয়তাবাদী রাজনীতির ধারক ‘জার্মানির জন্য বিকল্প’ বা অলটারনেটিভ ফর জার্মানি দলটি। গত বছর জার্মানির ২১তম জাতীয় নির্বাচনে ১৫২ আসন পেয়ে জার্মানির দ্বিতীয় বৃহত্তর দল হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেছে। এই মুহূর্তে দলটি জনপ্রিয়তার দিক থেকে ক্ষমতাসীন কোয়ালিশন জোটের বড় দল ক্রিশ্চিয়ান গণতান্ত্রিক দলটির মতোই জনপ্রিয়।
১৯৩৫ সালের ১৫ সেপ্টেম্বর দক্ষিণ জার্মানির নুরেমবার্গ শহরে অ্যাডলফ হিটলার তাঁর তথাকথিত ‘জাতিগত আইন’ পাস করেন। যা ছিল মূলত ইহুদি জনগোষ্ঠী, পাশাপাশি সিন্তি এবং রোমা, সমকামী, সামাজিকভাবে সুবিধাবঞ্চিত মানুষ, বিদেশি বংশোদ্ভূত মানুষদের একঘরে করে রাখার বন্দোবস্ত। এই শ্রেণির মানুষদের জার্মান হিসেবে বিবেচনা করা নির্বিচারে অস্বীকার করা হয়েছিল।
বর্তমানে জার্মানির দ্বিতীয় বৃহত্তম, উগ্রবাদী অতি জাতীয়তাবাদী রাজনীতির ধারক ‘জার্মানির জন্য বিকল্প’ দলটি হিটলারের মতো তেমন কোনো আইন পাস করার সুযোগ পায়নি। তবে তাদের রাজনীতি সেই একই কায়দার বিদেশি বা অভিবাসী বিদ্বেষের রাজনীতি।
জার্মানির কার্লসরুয়ে ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজি বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসবিদ রোল্ফ-উলরিখ কুঞ্জে সম্প্রতি ডয়েচে ভেলেকে বলেছেন, ‘জার্মানির জন্য বিকল্প’ দলটি একটি ঐতিহাসিক ধারাবাহিকতার অংশ। তিনি বলেছেন, ‘আমার দৃষ্টিকোণ থেকে, “জার্মানির জন্য বিকল্প” দলটি নাৎসি মতাদর্শের সঙ্গে সংযুক্ত।’ তিনি আধুনিক জার্মানির ইতিহাস ব্যাখ্যা করে বলেন, ‘সেই সময়ে নুরেমবার্গ নাগরিকত্ব আইনের দ্বারা জার্মান নাগরিক এবং পরবর্তী সময়ে জার্মান নাগরিকত্ব হওয়া নিয়ে পার্থক্য নিয়ন্ত্রিত হয়েছিল। এত দিন পর সেই একই রাজনীতি “প্রকৃত জার্মান” এবং পরবর্তী সময়ে “নাগরিকত্ব পাওয়া জার্মানদের” মধ্যে পার্থক্যের বিষয়টি হিটলারের ধারণার সঙ্গে সাদৃশ্যপূর্ণ।’
এই দৃষ্টান্ত এখন শুধু জার্মানিতে নয়। জনপ্রিয়তাবাদীরা ইউরোপ–আমেরিকায় ছড়িয়ে পড়েছে। যুক্তরাষ্ট্রে ডোনাল্ড ট্রাম্প, ইতালিতে জর্জিয়া মেলোনি, ফ্রান্সে মেরিন লে পেন এবং জার্মানিতে কট্টরবাদী দলটির নেত্রী অ্যালিস ভায়ডেল। এঁরা সবাই রাজনীতিতে ধর্ম বর্ণ গণতন্ত্রের কথা বলেন; কিন্তু তাঁদের প্রধান লক্ষ্য ক্ষমতা। আর তা অর্জনের জন্য তাঁরা বিপজ্জনক পদ্ধতি ব্যবহার করছেন। আসলে আজকের বিশ্ব, সত্য-পরবর্তী সময় বা পপুলিজমের যুগ বলে মনে হচ্ছে। জনপ্রিয় স্লোগান বা ধর্ম, বর্ণ, অভিবাসী এবং জাতিগত ঘৃণা নিয়ে রাজনীতি জনপ্রিয় হচ্ছে।
ঐক্যের ৩৫ বছরে জার্মানির রাজনীতিতে এই বিপজ্জনক মেরুকরণ গণতন্ত্রের প্রতি প্রচ্ছন্ন হুমকি। সম্প্রতি বছরগুলোতে পূর্ব জার্মানির নির্বাচনে কট্টরবাদী ‘জার্মানির জন্য বিকল্প’ দলটি এমনভাবে প্রচারণা চালিয়েছিল, যেন ‘অভিবাসীরা সব সমস্যার মূল’।
জার্মানির পূর্বের জনগণের কট্টরবাদী রাজনীতি ইদানীং পশ্চিমেও সংক্রমিত হচ্ছে, তবে তা পূর্বাঞ্চলের মতো নয়। বিশ্লেষকেরা অনেকেই বলেন বিগত ৩৫ বছরে পূর্ব জার্মানির জনগণ, ঐক্যবদ্ধ জার্মানির সমাজজীবনকে নিয়ে অনেক বেশি স্বপ্ন দেখেছিল। মূলত পূর্বাঞ্চলের পাঁচটি রাজ্যের একটি সুবিধাবঞ্চিত অংশ কট্টরবাদী রাজনীতির ধারক হয়ে উঠেছে।
এই প্রসঙ্গে জার্মানির সাবেক রাষ্ট্রপতি জোয়াকিম গাউক, যিনি পূর্বাঞ্চলে থাকতেন, তাঁর একটি উক্তি উল্লেখ করার মতো। তিনি পূর্বাঞ্চলের নাগরিকদের কাছে পশ্চিমের ভাবমূর্তি বর্ণনা করে বলেছিলেন, ‘তখন আমরা পূর্বে পশ্চিম জার্মানির মতো স্বর্গের স্বপ্ন দেখতাম, কিন্তু বাস্তবতা অন্য জিনিস।’
জার্মান সরকারের ফেডারেল এজেন্সি ফর সিভিক এডুকেশন, সম্প্রতি প্রকাশিত একটি তথ্যে জানিয়েছে, ‘সাবেক পূর্ব জার্মানির নাগরিকেরা নিজেদের অবহেলিত, পর্যাপ্তভাবে স্বীকৃত নন বা সাধারণত “দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিক” মনে করেন। প্রায় ৬০ শতাংশ মানুষ মনে করেন যে তাঁদের জীবনের অর্জনগুলোকে অবমূল্যায়ন করা হয়েছে।’
জার্মানির পুনর্মিলনের ৩৫ বছরের দিকে তাকালে দেখা যায়, পূর্ব ও পশ্চিমের জনগণ নানা তিতিক্ষার মূল্যায়ন ভাগ করে নিয়েছেন। এই ঐক্য একটি সাফল্যের ইতিহাস। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ৪০ বছর বিভক্ত হয়ে থাকা জার্মানি এখন পুনঃ ঐক্যের সাড়ে তিন দশক পার করছে। সমাজ, রাজনীতি এবং সংস্কৃতিতে নানা ভিন্নতা থাকলেও জার্মানি এগিয়ে যাচ্ছে।
সরাফ আহমেদ প্রথম আলোর জার্মানি প্রতিনিধি
[email protected]
.উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: গণতন ত র র র জন ত ত জনপ র য় ৩৫ বছর র র জন
এছাড়াও পড়ুন:
মাতৃরূপে ঈশ্বরের উপাসনা
ধর্মতত্ত্ব, সমাজতত্ত্ব ও নৃতত্ত্ব বিষয়ে বিশেষজ্ঞদের গবেষণা, যা–ই বলুক না কেন, সাধারণ বুদ্ধিতে মনে হয়, সভ্য মানুষ যখন প্রথম ঈশ্বরের কল্পনা করেছিল, অথবা মানুষ যখন তার চেয়ে উচ্চতর বা ঊর্ধ্বতর কোনো অলৌকিক অথবা অতিপ্রাকৃত শক্তির প্রথম কল্পনা করেছিল, তখন সে ঈশ্বরকে অথবা সেই অতিমানবিক শক্তিকে নারী হিসেবেই ভেবেছিল। আমাদের মনে হয়, মানবেতিহাসে ঈশ্বর–ধারণার সে–ই সূচনা৷
বলা বাহুল্য, মানুষের মানসচক্ষে ঈশ্বরের যে রূপটি তখন ভেসে উঠেছিল, তা ছিল স্বাভাবিকভাবেই তার আপন গর্ভধারিণীরই এক মহত্তর, আদর্শায়িত রূপকল্প। অর্থাৎ সভ্য মানুষের চিন্তায় ঈশ্বর সম্ভবত মাতৃরূপেই প্রথম কল্পিত হয়েছেন।
আমরা নিছক কল্পনার ডানায় ভর করে এ কথা বলছি তা নয়। আমাদের ধারণার ভিত্তি অবশ্যই আছে। মানবসভ্যতার প্রাচীনতম সাহিত্য বা মানুষের প্রাচীনতম ‘লিপিবদ্ধ ইতিহাস’ ঋগ্বেদে আমরা এর সমর্থন পাচ্ছি। ঋগ্বেদের দশম মণ্ডলের দশম অনুবাকের ১২৫তম সূক্তটি ‘দেবীসূক্ত’ নামে প্রসিদ্ধ।
মানবসভ্যতার প্রভাতে উচ্চারিত এই সূক্তে আমরা ঋষি অম্ভৃণের কন্যা ঋষি বাকের উপলব্ধির সঙ্গে পরিচিত হই। ঋষি বাক উপলব্ধি করেছিলেন: জগৎ-প্রপঞ্চের পেছনে জগৎ-কারণরূপে যিনি অবস্থান করছেন, যাঁর অঙ্গুলি হেলনে বা ইচ্ছানুসারে সূর্য, চন্দ্র, গ্রহ, নক্ষত্র প্রভৃতি পরিচালিত হচ্ছে; যাঁর প্রভাব ব্যতীত রুদ্র তাঁর ধনুকে জ্যা বসাতে অসমর্থ; ব্রহ্মাণ্ডের সবকিছুর মধ্যে যিনি ওতপ্রোতভাবে অনুস্যূত ও পরিব্যাপ্ত এবং তার বাইরেও যিনি বিদ্যমান, তিনি একজন নারী। তিনিই জগতের ঈশ্বরী, আদ্যাশক্তি। দেবীসূক্তের পরেই ‘রাত্রিসূক্ত’। ঋগ্বেদের দশম মণ্ডলের দশম অনুবাকের ১২৭তম সূক্তটিই প্রসিদ্ধ ‘রাত্রিসূক্ত’।
এই সূক্তে তৎকালীন মানুষের যে পরিচয় আমরা পাই, সে মানুষ হিংস্র প্রাণী ও দুর্ধর্ষ দস্যুর পীড়নে আর্ত ও সন্ত্রস্ত; শত্রুর (অসুরের?) আক্রমণের আশঙ্কায় সদা উদ্বিগ্ন। শঙ্কাহীন, নিরুদ্বেগ জীবন ও শত্রুনাশের জন্য তারা তাই ব্যাকুলভাবে প্রার্থনায় রত।
স্মরণাতীতকালে আমাদের এই অগ্রজদের প্রার্থনা কার কাছে? কার উদ্দেশে তাঁরা নতজানু? রাত্রিসূক্তের ঋষি কুশিকের ভাষায়—তিনি হলেন সর্বব্যাপিনী, বিশ্ববিধাত্রী, বিশ্বত্রাত্রী, বিশ্বপ্রসবিত্রী, জগৎ-প্রকাশিকা আদ্যাশক্তি। ঋষি তাঁকে ‘রাত্রি’ নামে অভিহিত করেছেন।
ভাষ্যকারদের মতে, ‘রাত্রি’ শব্দের অর্থ ‘অভীষ্টদাত্রী’। শুধু ঋগ্বেদেই নয়, সামবেদেও ‘রাত্রিসূক্ত’ আছে। সেখানেও দেখা যায়, আদ্যাশক্তির আদেশে সূর্য, বায়ু, বরুণ ও পৃথিবী নিজ নিজ ভূমিকা পালন করছেন। অসুরবধের জন্য, অমঙ্গলনাশের জন্য তিনি বারবার পৃথিবীতে আবির্ভূত হন।
যজুর্বেদ ও অথর্ববেদেও বিভিন্ন স্ত্রী-দেবতার উল্লেখ রয়েছে। বেদের আরণ্যক, ব্রাহ্মণ ও উপনিষদ অংশেও বহু স্ত্রী দেবতার নাম পাওয়া যায়। পণ্ডিতদের মতে, দেবীসূক্তের বাক্ এবং রাত্রিসূক্তের রাত্রি–পরবর্তীকালে যথাক্রমে সরস্বতী ও কালীতে রূপান্তরিত হয়েছেন।
ঋগ্বেদের পরিশিষ্টভুক্ত ‘শ্রীসূক্ত’-এর মধ্যে ঋগ্বেদের শেষের দিকের শক্তিভাবনার উল্লেখ পাওয়া যায়। পণ্ডিতদের মতে, ‘শ্রীসূক্ত’-এর শ্রী পরবর্তীকালে লক্ষ্মীতে রূপান্তরিত হয়েছেন।
বৈদিক যুগের পর মহাভারত ও পুরাণে স্ত্রী-দেবতার আরাধনা এক উল্লেখযোগ্য আকার ধারণ করে। পাশাপাশি বিশাল তন্ত্রসাহিত্যের মধ্যেও শাক্ত আরাধনা প্রবলভাবে বিকশিত হয়। ‘তন্ত্রসাহিত্য’ বলতে বৈষ্ণব, শৈব ও শাক্ত ধর্মীয় সাহিত্যের একটি বিশেষ ধারাকে বোঝানো হলেও, ‘তন্ত্র’ বলতে সাধারণত শাক্ত ধর্মীয় সাহিত্যকেই বোঝায়। তবে শাক্ত তন্ত্রসাহিত্য বা তান্ত্রিক ধারার কাল নিয়ে মতভেদ রয়েছে।
কেউ কেউ তন্ত্রকে বৈদিক যুগের সমসাময়িক, এমনকি তারও প্রাচীন বলে মতপ্রকাশ করেছেন। তবে তন্ত্রসাহিত্যের কাল সম্ভবত অতটা প্রাচীন নয় এবং বহু তন্ত্র-গ্রন্থই পরবর্তীকালে রচিত। তা সত্ত্বেও ধর্মীয় সাহিত্য হিসেবে তন্ত্র সুপ্রাচীন না হলেও ধর্মীয় পদ্ধতি হিসেবে তন্ত্র যে যথেষ্টই প্রাচীন, সে বিষয়ে সন্দেহ নেই। তন্ত্রসাহিত্যের সূচনা যখনই হোক না কেন, অন্তত দেড় হাজার বছর আগে হিন্দুদের ধর্মসাহিত্য ও ধর্মসাধনা প্রধানত বৈদিক ও তান্ত্রিক—এই দুই ধারায় বিভক্ত ছিল।
শুধু বৈদিক যুগেই নয়, প্রাক্-বৈদিক যুগেও মানুষ ঈশ্বরকে মাতৃরূপে উপাসনা করত। হরপ্পা ও মহেঞ্জোদারোর ধ্বংসাবশেষ থেকে আবিষ্কৃত সুপ্রাচীন (পৃথিবীর সভ্যতাগুলোর মধ্যে প্রাচীনতম?) সিন্ধুসভ্যতার প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন থেকে প্রমাণিত হয় যে ওই দুই প্রাচীন নগরের অধিবাসীদের প্রধান উপাস্য ছিলেন স্ত্রী দেবতারা।
তান্ত্রিকপদ্ধতির বীজ কি সেখানেই নিহিত ছিল? কে জানে! তবে সিন্ধু সভ্যতার প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শনগুলোতে যেসব স্ত্রী দেবতার মূর্তি পাওয়া গেছে, সেগুলোকে নিঃসন্দেহে পরবর্তীকালের শক্তিমূর্তিগুলোর আদিরূপ বলা যেতে পারে। নৃতত্ত্ববিদদের মতে, ওই মূর্তিগুলো প্রধানত শস্য, প্রাণশক্তি ও প্রজননশক্তির প্রতীকস্বরূপিনী মাতা বসুন্ধরা বা পৃথিবীর প্রতিমূর্তি।
শুধু ভারতের প্রাগৈতিহাসিক সভ্যতার ইতিহাসই নয়, পৃথিবীর অন্যান্য প্রাচীন সভ্যতার ইতিহাস বিচার-বিশ্লেষণ করলেও স্পষ্ট বোঝা যায়, ঈশ্বরকে মাতৃরূপে উপাসনা মানুষের স্বাভাবিক প্রবণতা থেকেই উদ্ভূত।
‘স্বাভাবিক প্রবণতা’ কেন বলছি? পৃথিবীর আলোয় মানুষ প্রথম যাঁকে দেখে, তিনি মা। তাই বোধ হয় আমাদের কণ্ঠ-উৎসারিত প্রথম শব্দটিও ‘মা’। একমাত্র মায়ের সঙ্গেই মানুষের ‘নাড়ি’র সম্পর্ক। এই সম্পর্ক যেমন জৈবিক (বায়োলজিক্যাল) অর্থে সত্য, তেমনি মানসিক (মেন্টাল), মনস্তাত্ত্বিক (সাইকোলজিক্যাল) এবং আধ্যাত্মিক (স্পিরিচুয়াল) অর্থেও সত্য। সব অর্থেই মানুষ মায়ের সঙ্গেই সর্বাপেক্ষা নিকট–সম্পর্কযুক্ত।
সে কারণেই জন্মলগ্ন থেকেই মানুষের চরিত্রে মায়ের প্রভাব—জ্ঞাতসারে অথবা অজ্ঞাতসারে, সবচেয়ে বেশি ক্রিয়াশীল থাকে। শিশুর সবচেয়ে বড় নির্ভরতা মা-ই, মা-ই তার সবচেয়ে বিশ্বস্ত জন। যখন সে ভয় পায়, তখন মায়ের কোলেই আশ্রয় খোঁজে; যখন আনন্দ পায়, তখন সবার আগে মাকেই সেই আনন্দের ভাগীদার করতে চায়।
দুঃখ বা আনন্দে, ভয় কিংবা উদ্বেগে—মাকেই সে প্রথম খোঁজে। মায়ের সঙ্গে এই সম্পর্কের কারণেই দেখা যায়, মা যখন শিশুসন্তানকে দুষ্টুমির জন্য মারেন, তখন এক হাতে চোখের জল মুছতে মুছতে অন্য হাতে শিশুটি মাকেই জড়িয়ে ধরে। কারণ, জন্মলগ্ন থেকেই তার ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় তাকে বুঝিয়ে দিয়েছে—যে হাত তাকে আঘাত করেছে, সেই হাতই পরক্ষণে তাকে বুকে জড়িয়ে ধরবে; আর যে চোখ ও মুখ এতক্ষণ ক্রোধে জ্বলছিল, সেই চোখই কয়েক মুহূর্ত পরে জলে ভাসবে এবং সেই মুখই তার অশ্রুলিপ্ত মুখকে চুম্বনে ভরিয়ে দেবে।
বস্তুত, মানুষ যাকে সবচেয়ে বেশি ভালোবাসে বা শ্রদ্ধা করে, অথবা যাকে সবচেয়ে বেশি ভালোবাসা বা শ্রদ্ধা অর্পণ করতে চায়, তার মধ্যে সম্ভবত সে অজ্ঞাতসারে নিজের মাকেই দেখতে চায়। এটিই মানুষের সহজাত মনস্তত্ত্ব। সভ্য মানুষ যখন ইতিহাসের উষালগ্নে ঈশ্বরের শরণাপন্ন হয়েছিল, তখন তার ভাবনায় বোধ হয় এই মনস্তত্ত্বই ক্রিয়াশীল ছিল।
যাহোক, ঈশ্বরের মাতৃরূপের এই ভাবনা ভারতবর্ষে প্রাক্-বৈদিক, বৈদিক, তান্ত্রিক ও পৌরাণিক—এই চার প্রধান ধারায় অভিব্যক্ত হয়েছে। বৈদিক ভাবনা পরবর্তীকালে উপনিষদে ক্রমবিবর্তিত হয়ে যে রূপ লাভ করেছিল, তারই উত্তরোত্তর প্রকাশ দেখা গেছে রামায়ণ, মহাভারত এবং পুরাণ ও উপপুরাণগুলোতে। পাশাপাশি প্রাক্-বৈদিক যুগে দেবীভাবনার ধারণা একটি স্বতন্ত্র ধারায় বিকাশ লাভ করছিল।
অনেক বিশেষজ্ঞ মনে করেন, আমরা যাকে ‘তন্ত্র’ বলে জানি, তার উৎস নিহিত আছে প্রাক্-বৈদিক যুগের দেবীভাবনায়। সুপ্রাচীনকাল থেকেই কিন্তু আরেকটি ধারা ছিল। সেটি হলো আদিবাসী, উপজাতি ও সমাজের নিম্নবর্ণের মধ্যে প্রচলিত লোকায়ত ধারা। পরবর্তীকালে প্রতিটি ধারাই একে অন্যের দ্বারা প্রভাবিত হয়েছে, একের মধ্যে অন্যের চিন্তাভাবনা ও পদ্ধতির অনুপ্রবেশ ঘটেছে। ভারতের সর্বত্রই এই সংমিশ্রণ ও পারস্পরিক প্রভাব কমবেশি ঘটেছে।
বৈদিক সাহিত্যে দেবীকে অদিতি, উষা, অম্বিকা, উমা, সরস্বতী, দুর্গা, সাবিত্রী, পৃথিবী প্রভৃতি নামে অভিহিত করা হলেও ‘কালী’ ও ‘চণ্ডী’ নাম দুটি কোথাও পাওয়া যায় না। ‘কালী’ নামটি প্রথম পাওয়া যায় মুণ্ডক উপনিষদে, তবে সেখানে এটি কোনো স্ত্রী দেবতার নাম নয়; সেখানে ‘কালী’ অগ্নির সপ্ত জিহ্বার একটি নাম। স্ত্রী দেবতা হিসেবে ‘কালী’ নামটির প্রথম উল্লেখ পাওয়া যায় মহাভারতে। আর ‘চণ্ডী’র প্রথম সাক্ষাৎ ঘটে পৌরাণিক দেবীরূপে সাহিত্যে। ‘চণ্ডী’ বা ‘চণ্ডিকা’ নামে তাঁকে সর্বাধিক অভিহিত হতে দেখা যায় মার্কণ্ডেয় পুরাণের অন্তর্গত ‘দেবীমাহাত্ম্যে’, যা ‘চণ্ডী’ বা ‘দুর্গাসপ্তশতী’ নামে প্রসিদ্ধ।
‘কালী’ নামটিও সেখানে উল্লেখযোগ্যভাবে এসেছে। ক্রমে দুর্গা ও কালীকে সেখানে একই মহাদেবীর বিভিন্ন রূপ হিসেবে বর্ণনা করা হয়েছে। পরবর্তী কালে দুর্গা, কালী প্রভৃতি পরিচিত নামের পাশাপাশি অন্যান্য পুরাণ ও উপপুরাণে ‘চামুণ্ডা’, ‘উগ্রচণ্ডী’, ‘উগ্রচণ্ডিকা’ প্রভৃতি নাম আদ্যাশক্তির ক্ষেত্রে ব্যবহৃত হতে থাকে। ধীরে ধীরে ‘চণ্ডী’ হয়েছেন ‘মঙ্গলচণ্ডী’—যিনি মানুষের সকল অশুভ ও অমঙ্গল নাশ করেন। তবে চণ্ডীর মঙ্গলচণ্ডী হয়ে ওঠা এক দিন বা এক যুগে হয়নি। এই বিবর্তনের সঙ্গে যুক্ত রয়েছে বৈদিক, প্রাক্-বৈদিক, তান্ত্রিক, পৌরাণিক ও লোকায়ত ঐতিহ্যের পারস্পরিক ক্রিয়া ও বিক্রিয়ার দীর্ঘ পর্ব।
এভাবে পৌরাণিক ধারা ও লোকায়ত ধারার মধ্য দিয়ে দেবী হয়ে উঠেছেন আমাদের পরিবারের অঙ্গ, আমাদের একান্ত কাছের মানুষ। দেবী ও মানবী ভাব মিশে আমাদের দেবীভাবনায় যুক্ত হয়েছে এক নতুন মাত্রা। অবশেষে হিন্দুর শক্তিভাবনায় দুটি নাম প্রধান স্থান লাভ করেছে দুর্গা ও কালী। এই দুই মায়ের মধ্যেই হিন্দুর ধর্মভাবনায় মাতৃরূপে ঈশ্বরের উপাসনা কেন্দ্রীভূত হয়েছে। আজ এই দুই দেবীর পূজাই ভারতবর্ষে, বিশেষত বঙ্গদেশে, হিন্দুদের সর্বাধিক জনপ্রিয় মাতৃপূজা।
স্বামী পূর্ণাত্মানন্দ অধ্যক্ষ ও সম্পাদক, রামকৃষ্ণ মঠ ও রামকৃষ্ণ মিশন, ঢাকা