লস্কর–ই–তাইয়েবা কারা, পাকিস্তান কি তাদের সহায়তা করে
Published: 11th, May 2025 GMT
ভারতনিয়ন্ত্রিত কাশ্মীরের পেহেলগামে গত মাসে সংঘটিত হামলার প্রতিশোধ নিতে ভারত তার কথায় ‘সন্ত্রাসী ঘাঁটি’ লক্ষ্য করে পাকিস্তানে ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালিয়েছে। এর ফলে জম্মু ও কাশ্মীরে হামলায় জড়িত সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলো, বিশেষ করে লস্কর–ই–তাইয়েবাকে সহযোগিতা করে পাকিস্তান—ভারতের এ অভিযোগ এসেছে আবারও আলোচনায়।
লস্কর–ই–তাইয়েবা কীলস্কর–ই–তাইয়েবা (এলইটি) একটি দীর্ঘদিনের সশস্ত্র সংগঠন। এটি ১৯৮৬ সালে পাকিস্তানে প্রতিষ্ঠিত হয় এবং অনেক দেশ এটিকে ‘সন্ত্রাসী সংগঠন’ মনে করে। ২০০৮ সালে ভারতের মুম্বাই হামলায় এই সংগঠনকে দায়ী করেছিল নয়াদিল্লি। হামলায় ১৬৬ জন নিহত হন, যাঁদের মধ্যে বিদেশি নাগরিকও ছিলেন।
মারকাজ দাওয়াত–উল ইরশাদ নামক প্রচার ও ধর্মীয় শিক্ষাকেন্দ্রের সামরিক শাখা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল এলইটি। তৎকালীন পাকিস্তানি শাসক জিয়াউল হকের ‘ইসলামীকরণ’ নীতির অংশ হিসেবে গড়ে তোলা হয় লস্কর–ই–তাইয়েবা। লক্ষ্য ছিল, পাকিস্তানকে একটি বৈশ্বিক ইসলামি রাজনীতির কেন্দ্রে পরিণত করা।
লস্কর–ই–তাইয়েবা একটি বিশ্বব্যাপী ইসলামি খিলাফতের দর্শন প্রচার করে, যেখানে ‘হারানো’ ইসলামি ভূমি পুনরুদ্ধারের লক্ষ্যে প্রচার ও সশস্ত্র সংগ্রাম—দুই প্রচেষ্টাকে গুরুত্ব দেওয়া হয়।
জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের মতে, ১৯৯৩ সাল থেকে এলইটি বহু হামলা চালিয়েছে, যার মধ্যে রয়েছে ২০০৬ সালের মুম্বাইয়ে লোকাল ট্রেনে বিস্ফোরণ ও ২০০১ সালে ভারতের সংসদে হামলা।
এলইটির প্রধান হাফিজ মুহাম্মদ সাঈদ ২০১৯ সালে গ্রেপ্তার হন। সন্ত্রাসবাদে অর্থায়নের অভিযোগে পাকিস্তানে ৩১ বছরের কারাদণ্ডে দণ্ডিত হন তিনি। সংগঠনটি দীর্ঘদিন ধরে দাবি করে আসছে, তাদের সংগ্রাম শুধু কাশ্মীরে সীমাবদ্ধ নয়। তাদের লক্ষ্য ভারতের ভাঙন পর্যন্ত বিস্তৃত। মুম্বাই হামলার সময় একটি ইহুদি সেন্টারে হামলার মাধ্যমে এলইটির জোরালো ইহুদিবিদ্বেষও প্রকাশ পেয়েছে।যদিও ভারত–সংশ্লিষ্টতার কারণে বিতর্কিত কাশ্মীর অঞ্চলেই নিজেদের অধিকাংশ কার্যক্রম পরিচালনা করেছে এলইটি, তবে তাদের বৈরিতা শুধু সেখানে সীমাবদ্ধ নয়, ভারতজুড়ে।
এলইটির প্রধান হাফিজ মুহাম্মদ সাঈদ ২০১৯ সালে গ্রেপ্তার হন। সন্ত্রাসবাদে অর্থায়নের অভিযোগে পাকিস্তানে ৩১ বছরের কারাদণ্ডে দণ্ডিত হন তিনি। সংগঠনটি দীর্ঘদিন ধরে দাবি করে আসছে, তাদের সংগ্রাম শুধু কাশ্মীরে সীমাবদ্ধ নয়। তাদের লক্ষ্য ভারতের ভাঙন পর্যন্ত বিস্তৃত। মুম্বাই হামলার সময় একটি ইহুদি সেন্টারে হামলার মাধ্যমে এলইটির জোরালো ইহুদিবিদ্বেষও প্রকাশ পেয়েছে।
জইশ–ই–মুহাম্মদ কীমাওলানা মাসুদ আজহার ১৯৯৯ সালে ভারতের কারাগার থেকে মুক্তি পাওয়ার পর জইশ–ই–মুহাম্মদ (জেইএম) নামের সংগঠন প্রতিষ্ঠা করেন। পাকিস্তান সংগঠনটিকে ২০০২ সালে নিষিদ্ধ করে, কারণ এটি এলইটির সঙ্গে ২০০১ সালে ভারতের সংসদে হামলার জন্য অভিযুক্ত ছিল। জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের কথা অনুযায়ী, আল–কায়েদা ও তালেবানের সঙ্গে এ সংগঠনের সংশ্লিষ্টতা ছিল।
পাকিস্তান কি লস্কর–ই–তাইয়েবা ও অন্য সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলো সমর্থন করেএলইটি ও অন্যান্য ইসলামপন্থী সশস্ত্র সংগঠনের সঙ্গে পাকিস্তানের, বিশেষ করে দেশটির সেনাবাহিনী ও গোয়েন্দা সংস্থা আইএসআই (ইন্টার সার্ভিসেস ইন্টেলিজেন্স)–এর সম্পর্ক জটিল ও অনেকাংশে অস্পষ্ট।
আগে ইসলামাবাদ ভারতনিয়ন্ত্রিত কাশ্মীর ও আফগানিস্তানে প্রক্সি যোদ্ধা হিসেবে সশস্ত্র ইসলামপন্থী সংগঠনগুলোকে সমর্থন করেছে, কিন্তু বর্তমানে এ সম্পর্ক অনেকটাই অস্পষ্ট হয়ে পড়েছে।
ইতিহাসের দিকে তাকালে দেখা যায়, আশি ও নব্বইয়ের দশকে পাকিস্তান এমন সশস্ত্র সংগঠনগুলোকে সমর্থন দেওয়াকে কৌশলগত সফলতা মনে করত, বিশেষ করে আফগানিস্তান থেকে সোভিয়েত বাহিনীকে হটানোর পটভূমিতে।
শুরু থেকেই এলইটি পাকিস্তানের আস্থায় ছিল। কারণ, আফগানিস্তানে যুদ্ধ ও ভারতের বিরুদ্ধে সংগ্রাম, দুটিই পাকিস্তান সেনাবাহিনীর কৌশলগত উদ্দেশ্যের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ। পাকিস্তানের সেনাবাহিনীর লক্ষ্য, পশ্চিমে আফগানিস্তানকে নিয়ন্ত্রণে রাখা ও পূর্বে ভারতকে চাপে রাখা। —অ্যাশলি টেলিস, আন্তর্জাতিক নিরাপত্তা বিশ্লেষক২০১২ সালে ‘কার্নেগি এনডাউমেন্ট ফর পিস’–এ এক প্রবন্ধে আন্তর্জাতিক নিরাপত্তা বিশ্লেষক অ্যাশলি টেলিস লেখেন, ‘শুরু থেকেই এলইটি পাকিস্তানের আস্থায় ছিল, কারণ আফগানিস্তানে যুদ্ধ ও ভারতের বিরুদ্ধে সংগ্রাম—দুটিই পাকিস্তান সেনাবাহিনীর কৌশলগত উদ্দেশ্যের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ। পাকিস্তানের সেনাবাহিনীর লক্ষ্য, পশ্চিমে আফগানিস্তানকে নিয়ন্ত্রণে রাখা ও পূর্বে ভারতকে চাপে রাখা। দুই দশকের বেশি সময় এলইটির সঙ্গে আইএস গোপনে হলেও দৃঢ় সম্পর্ক বজায় রেখেছে এবং প্রয়োজন অনুযায়ী অর্থায়ন ও সামরিক প্রশিক্ষণ দিয়েছে।’
এলইটির প্রধান মুম্বাই হামলায় জড়িত থাকার কথা অস্বীকার করেছেন। তবু হামলার আগে ঘটনাস্থল পরিদর্শন করা মার্কিন–পাকিস্তানি নাগরিক ও এলইটির সদস্য ডেভিড হেডলি স্বীকার করেছেন যে মুম্বাই হামলার বিষয়ে পাকিস্তানি গোয়েন্দা কর্মকর্তাদের সঙ্গে সমন্বয় করেছিলেন তিনি।
আরও পড়ুনবিশ্বের প্রথম ‘ড্রোন যুদ্ধ’: ভারত-পাকিস্তান সংঘাতে নতুন অধ্যায়ের উন্মোচন ঘটাল৬ ঘণ্টা আগেতবে ওই হামলায় কতটা সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা ছিল, তা পরিষ্কার নয়। এলইটি কি সম্পূর্ণ স্বাধীনভাবে কাজ করেছে, নাকি সীমিত পর্যায়ে হলেও অনুমতি পেয়েছিল, সে বিষয়ে দ্বিধা রয়েছে।
যদিও পাকিস্তান ভারতের দাবিকে দৃঢ়ভাবে অস্বীকার করে, তথাপি এলইটির সঙ্গে যুক্ত সংগঠনগুলোর প্রতি তার সহনশীলতা, যেমন জামাত–উদ–দাওয়া এর মাধ্যমে এলইটির দাতব্য সংগঠন হিসেবে আবারও আত্মপ্রকাশ, পাকিস্তানের প্রতিশ্রুতি ও অস্বীকৃতিকে সন্দেহের মধ্যে ফেলে।
লস্কর–ই–তাইয়েবা ও জইশ–ই–মুহাম্মদ, দুই সংগঠনের প্রতি পাকিস্তানের আনুষ্ঠানিক সমর্থনের মাত্রা নিয়ে বিশেষজ্ঞদের মধ্যে দ্বিমত রয়েছে। কেউ কেউ বলেন, সাম্প্রতিক অস্থিরতা দেশটির সেনাবাহিনী ও আইএসআইয়ের কিছু সদস্যকে হয়তো এমন সশস্ত্র সংগঠনগুলোর সঙ্গে আরও সক্রিয়ভাবে যুক্ত করেছে। যেমনটা আগে রাজনৈতিক অস্থিরতার সময় রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা প্রতিষ্ঠানগুলো হুমকি অনুভব করলে দেখা গেছে।অস্ট্রেলিয়ার সরকার বলেছে, লস্কর–ই–তাইয়েবা ‘জামাত–উদ–দাওয়া’ নামে কার্যক্রম চালিয়েছে। ২০০২ সালে পাকিস্তান এলইটিকে নিষিদ্ধ করার ঠিক আগে ‘জামাত–উদ–দাওয়া’ প্রতিষ্ঠিত হয় হাফিজ সাঈদের মাধ্যমে একটি দাতব্য সংস্থা হিসেবে।
২০১৮ সালে মুম্বাই হামলার দশম বার্ষিকীতে ‘সেন্টার ফর এ নিউ আমেরিকান সিকিউরিটি’র স্টিফেন ট্যাঙ্কেল বলেন, পাকিস্তান এলইটি ও জেইউডির মধ্যে বাহ্যিক বিভাজন দেখায়। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্র ও জাতিসংঘ এগুলোকে একই ‘সন্ত্রাসী’ সংগঠন হিসেবে বিবেচনা করে।
আরও পড়ুনভারত–পাকিস্তান যুদ্ধবিরতির সিদ্ধান্তের প্রশংসায় বিশ্বনেতারা১ ঘণ্টা আগেবর্তমান পরিস্থিতিলস্কর–ই–তাইয়েবা ও জইশ–ই–মুহাম্মদ, দুই সংগঠনের প্রতি পাকিস্তানের আনুষ্ঠানিক সমর্থনের মাত্রা নিয়ে বিশেষজ্ঞদের মধ্যে দ্বিমত রয়েছে। কেউ কেউ বলেন, সাম্প্রতিক অস্থিরতা দেশটির সেনাবাহিনী ও আইএসআইয়ের কিছু সদস্যকে হয়তো এমন সশস্ত্র সংগঠনগুলোর সঙ্গে আরও সক্রিয়ভাবে যুক্ত করেছে। যেমনটা আগে রাজনৈতিক অস্থিরতার সময় রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা প্রতিষ্ঠানগুলো হুমকি অনুভব করলে দেখা গেছে।
তবে ট্যাঙ্কেল আরও জটিল ও দীর্ঘমেয়াদি এক প্রবণতার দিকে ইঙ্গিত করেন। তিনি বলেন, ‘পাকিস্তানের ওপর ঘনিষ্ঠভাবে নজর রাখেন, এমন পর্যবেক্ষকেরা স্বীকার করেছেন, লস্কর–ই–তাইয়েবা শুধু পাকিস্তানের ভেতর হামলা চালানো থেকে বিরত থাকে, তা–ই নয়। তারা এমন গোষ্ঠীগুলোর বিরুদ্ধেও কাজ করে, যারা রাষ্ট্রটির বিরুদ্ধে অবস্থান নেয়।’
এই বিশেষজ্ঞ আরও বলেন, ‘লস্কর–ই–তাইয়েবা বেলুচিস্তানের বিচ্ছিন্নতাবাদী ও অন্য অস্ত্রধারীদের বিরুদ্ধে গোয়েন্দা তথ্য সংগ্রহ ও কখনো তাদের নির্মূল করতেও সহায়তা করেছে। এমনকি রাষ্ট্রবিরোধী শক্তির বিরুদ্ধে একটি আদর্শিক ও ধর্মতাত্ত্বিক প্রতিপক্ষ হিসেবে কাজ করেছে সংগঠনটি।’
আরও পড়ুনযুদ্ধবিরতি ‘ভঙ্গ করা’ নিয়ে ভারত–পাকিস্তান বাহাস, শ্রীনগরে বিস্ফোরণের শব্দ৬ ঘণ্টা আগে.উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: সশস ত র স গঠন আফগ ন স ত ন সশস ত র স গ স ব ক র কর স গঠনগ ল র লক ষ য স গঠন র স গঠনট ইসল ম র সময়
এছাড়াও পড়ুন:
বন্দরে নৌপরিবহন উপদেষ্টাকে অবাঞ্ছিতের ঘোষণায় শোকজ, পরে ক্ষমা প্রার্থনা
নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) এম সাখাওয়াত হোসেনকে চট্টগ্রাম বন্দরে অবাঞ্ছিত করার ঘোষণা দেওয়ার পর ক্ষমা চেয়েছেন সাবেক সিবিএ নেতা হুমায়ুন কবীর।
নিউমুরিং কনটেইনার টার্মিনালের (এনসিটি) বিষয়ে মন্ত্রণালয়ের সিদ্ধান্তে ক্ষুদ্ধ হয়ে গত ২৮ জুন চট্টগ্রাম বন্দর অকশন শেড সংলগ্ন শ্রমিক দলের কার্যালয়ে এক কর্মীসভায় ওই সাবেক সিবিএ নেতা উপদেষ্টাকে নিয়ে এমন অসৌজন্যমূলক বক্তব্য দেন। তবে পরে এমন বক্তব্য ভুলবশত, অনিচ্ছাকৃত এবং অজ্ঞতাবশত বলে উল্লেখ করেন তিনি। এমন অসৌজন্যমূলক বক্তব্য প্রত্যাহার করে উপদেষ্টার কাছে এক কারণ দর্শানো নোটিশের জবাবে ক্ষমা প্রার্থনা করেন হুমায়ুন কবীর।
ওই সাবেক সিবিএ নেতার এমন বক্তব্যের কারণ জানতে চেয়ে গত ১ জুলাই কারণ দর্শানো নোটিশ ইস্যু করে বন্দর কর্তৃপক্ষ। চিঠিতে ৩ কর্মদিবসের মধ্যে লিখিতভাবে তাকে এর উত্তর জানানোর জন্য নির্দেশ দেওয়া হয়। পরে নোটিশের জবাবে হুমায়ুন কবীর ক্ষমা প্রার্থনা করেন।
মো. হুমায়ুন কবীর চট্টগ্রাম বন্দরের অভ্যন্তরীণ নিরীক্ষা ও পরিদর্শন বিভাগের সুপারিন্টেনডেন্ট অডিট হিসেবে কর্মরত। তিনি চট্টগ্রাম বন্দর জাতীয়তাবাদী শ্রমিক দলের (সাবেক সিবিএ) প্রচার ও প্রকাশনা সম্পাদক। এনসিটি বিদেশিদের কাছে ইজারা দেওয়ার সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে তার নেতৃত্বে দীর্ঘদিন আন্দোলন কর্মসূচি পালন করছে চট্টগ্রাম বন্দর জাতীয়তাবাদী শ্রমিক দল। সর্বশেষ এক কর্মসূচিতে উপদেষ্টাকে নিয়ে বক্তব্যের মাধ্যমে নতুন করে আলোচনায় আসেন তিনি।