ভারতনিয়ন্ত্রিত কাশ্মীরের পেহেলগামে গত মাসে সংঘটিত হামলার প্রতিশোধ নিতে ভারত তার কথায় ‘সন্ত্রাসী ঘাঁটি’ লক্ষ্য করে পাকিস্তানে ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালিয়েছে। এর ফলে জম্মু ও কাশ্মীরে হামলায় জড়িত সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলো, বিশেষ করে লস্কর–ই–তাইয়েবাকে সহযোগিতা করে পাকিস্তান—ভারতের এ অভিযোগ এসেছে আবারও আলোচনায়।

লস্কর–ই–তাইয়েবা কী

লস্কর–ই–তাইয়েবা (এলইটি) একটি দীর্ঘদিনের সশস্ত্র সংগঠন। এটি ১৯৮৬ সালে পাকিস্তানে প্রতিষ্ঠিত হয় এবং অনেক দেশ এটিকে ‘সন্ত্রাসী সংগঠন’ মনে করে। ২০০৮ সালে ভারতের মুম্বাই হামলায় এই সংগঠনকে দায়ী করেছিল নয়াদিল্লি। হামলায় ১৬৬ জন নিহত হন, যাঁদের মধ্যে বিদেশি নাগরিকও ছিলেন।

মারকাজ দাওয়াত–উল ইরশাদ নামক প্রচার ও ধর্মীয় শিক্ষাকেন্দ্রের সামরিক শাখা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল এলইটি। তৎকালীন পাকিস্তানি শাসক জিয়াউল হকের ‘ইসলামীকরণ’ নীতির অংশ হিসেবে গড়ে তোলা হয় লস্কর–ই–তাইয়েবা। লক্ষ্য ছিল, পাকিস্তানকে একটি বৈশ্বিক ইসলামি রাজনীতির কেন্দ্রে পরিণত করা।

লস্কর–ই–তাইয়েবা একটি বিশ্বব্যাপী ইসলামি খিলাফতের দর্শন প্রচার করে, যেখানে ‘হারানো’ ইসলামি ভূমি পুনরুদ্ধারের লক্ষ্যে প্রচার ও সশস্ত্র সংগ্রাম—দুই প্রচেষ্টাকে গুরুত্ব দেওয়া হয়।

জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের মতে, ১৯৯৩ সাল থেকে এলইটি বহু হামলা চালিয়েছে, যার মধ্যে রয়েছে ২০০৬ সালের মুম্বাইয়ে লোকাল ট্রেনে বিস্ফোরণ ও ২০০১ সালে ভারতের সংসদে হামলা।

এলইটির প্রধান হাফিজ মুহাম্মদ সাঈদ ২০১৯ সালে গ্রেপ্তার হন। সন্ত্রাসবাদে অর্থায়নের অভিযোগে পাকিস্তানে ৩১ বছরের কারাদণ্ডে দণ্ডিত হন তিনি। সংগঠনটি দীর্ঘদিন ধরে দাবি করে আসছে, তাদের সংগ্রাম শুধু কাশ্মীরে সীমাবদ্ধ নয়। তাদের লক্ষ্য ভারতের ভাঙন পর্যন্ত বিস্তৃত। মুম্বাই হামলার সময় একটি ইহুদি সেন্টারে হামলার মাধ্যমে এলইটির জোরালো ইহুদিবিদ্বেষও প্রকাশ পেয়েছে।

যদিও ভারত–সংশ্লিষ্টতার কারণে বিতর্কিত কাশ্মীর অঞ্চলেই নিজেদের অধিকাংশ কার্যক্রম পরিচালনা করেছে এলইটি, তবে তাদের বৈরিতা শুধু সেখানে সীমাবদ্ধ নয়, ভারতজুড়ে।

এলইটির প্রধান হাফিজ মুহাম্মদ সাঈদ ২০১৯ সালে গ্রেপ্তার হন। সন্ত্রাসবাদে অর্থায়নের অভিযোগে পাকিস্তানে ৩১ বছরের কারাদণ্ডে দণ্ডিত হন তিনি। সংগঠনটি দীর্ঘদিন ধরে দাবি করে আসছে, তাদের সংগ্রাম শুধু কাশ্মীরে সীমাবদ্ধ নয়। তাদের লক্ষ্য ভারতের ভাঙন পর্যন্ত বিস্তৃত। মুম্বাই হামলার সময় একটি ইহুদি সেন্টারে হামলার মাধ্যমে এলইটির জোরালো ইহুদিবিদ্বেষও প্রকাশ পেয়েছে।

জইশ–ই–মুহাম্মদ কী

মাওলানা মাসুদ আজহার ১৯৯৯ সালে ভারতের কারাগার থেকে মুক্তি পাওয়ার পর জইশ–ই–মুহাম্মদ (জেইএম) নামের সংগঠন প্রতিষ্ঠা করেন। পাকিস্তান সংগঠনটিকে ২০০২ সালে নিষিদ্ধ করে, কারণ এটি এলইটির সঙ্গে ২০০১ সালে ভারতের সংসদে হামলার জন্য অভিযুক্ত ছিল। জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের কথা অনুযায়ী, আল–কায়েদা ও তালেবানের সঙ্গে এ সংগঠনের সংশ্লিষ্টতা ছিল।

পাকিস্তান কি লস্কর–ই–তাইয়েবা ও অন্য সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলো সমর্থন করে

এলইটি ও অন্যান্য ইসলামপন্থী সশস্ত্র সংগঠনের সঙ্গে পাকিস্তানের, বিশেষ করে দেশটির সেনাবাহিনী ও গোয়েন্দা সংস্থা আইএসআই (ইন্টার সার্ভিসেস ইন্টেলিজেন্স)–এর সম্পর্ক জটিল ও অনেকাংশে অস্পষ্ট।

আগে ইসলামাবাদ ভারতনিয়ন্ত্রিত কাশ্মীর ও আফগানিস্তানে প্রক্সি যোদ্ধা হিসেবে সশস্ত্র ইসলামপন্থী সংগঠনগুলোকে সমর্থন করেছে, কিন্তু বর্তমানে এ সম্পর্ক অনেকটাই অস্পষ্ট হয়ে পড়েছে।

ইতিহাসের দিকে তাকালে দেখা যায়, আশি ও নব্বইয়ের দশকে পাকিস্তান এমন সশস্ত্র সংগঠনগুলোকে সমর্থন দেওয়াকে কৌশলগত সফলতা মনে করত, বিশেষ করে আফগানিস্তান থেকে সোভিয়েত বাহিনীকে হটানোর পটভূমিতে।

শুরু থেকেই এলইটি পাকিস্তানের আস্থায় ছিল। কারণ, আফগানিস্তানে যুদ্ধ ও ভারতের বিরুদ্ধে সংগ্রাম, দুটিই পাকিস্তান সেনাবাহিনীর কৌশলগত উদ্দেশ্যের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ। পাকিস্তানের সেনাবাহিনীর লক্ষ্য, পশ্চিমে আফগানিস্তানকে নিয়ন্ত্রণে রাখা ও পূর্বে ভারতকে চাপে রাখা। —অ্যাশলি টেলিস, আন্তর্জাতিক নিরাপত্তা বিশ্লেষক

২০১২ সালে ‘কার্নেগি এনডাউমেন্ট ফর পিস’–এ এক প্রবন্ধে আন্তর্জাতিক নিরাপত্তা বিশ্লেষক অ্যাশলি টেলিস লেখেন, ‘শুরু থেকেই এলইটি পাকিস্তানের আস্থায় ছিল, কারণ আফগানিস্তানে যুদ্ধ ও ভারতের বিরুদ্ধে সংগ্রাম—দুটিই পাকিস্তান সেনাবাহিনীর কৌশলগত উদ্দেশ্যের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ। পাকিস্তানের সেনাবাহিনীর লক্ষ্য, পশ্চিমে আফগানিস্তানকে নিয়ন্ত্রণে রাখা ও পূর্বে ভারতকে চাপে রাখা। দুই দশকের বেশি সময় এলইটির সঙ্গে আইএস গোপনে হলেও দৃঢ় সম্পর্ক বজায় রেখেছে এবং প্রয়োজন অনুযায়ী অর্থায়ন ও সামরিক প্রশিক্ষণ দিয়েছে।’

এলইটির প্রধান মুম্বাই হামলায় জড়িত থাকার কথা অস্বীকার করেছেন। তবু হামলার আগে ঘটনাস্থল পরিদর্শন করা মার্কিন–পাকিস্তানি নাগরিক ও এলইটির সদস্য ডেভিড হেডলি স্বীকার করেছেন যে মুম্বাই হামলার বিষয়ে পাকিস্তানি গোয়েন্দা কর্মকর্তাদের সঙ্গে সমন্বয় করেছিলেন তিনি।

আরও পড়ুনবিশ্বের প্রথম ‘ড্রোন যুদ্ধ’: ভারত-পাকিস্তান সংঘাতে নতুন অধ্যায়ের উন্মোচন ঘটাল৬ ঘণ্টা আগে

তবে ওই হামলায় কতটা সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা ছিল, তা পরিষ্কার নয়। এলইটি কি সম্পূর্ণ স্বাধীনভাবে কাজ করেছে, নাকি সীমিত পর্যায়ে হলেও অনুমতি পেয়েছিল, সে বিষয়ে দ্বিধা রয়েছে।

যদিও পাকিস্তান ভারতের দাবিকে দৃঢ়ভাবে অস্বীকার করে, তথাপি এলইটির সঙ্গে যুক্ত সংগঠনগুলোর প্রতি তার সহনশীলতা, যেমন জামাত–উদ–দাওয়া এর মাধ্যমে এলইটির দাতব্য সংগঠন হিসেবে আবারও আত্মপ্রকাশ, পাকিস্তানের প্রতিশ্রুতি ও অস্বীকৃতিকে সন্দেহের মধ্যে ফেলে।

লস্কর–ই–তাইয়েবা ও জইশ–ই–মুহাম্মদ, দুই সংগঠনের প্রতি পাকিস্তানের আনুষ্ঠানিক সমর্থনের মাত্রা নিয়ে বিশেষজ্ঞদের মধ্যে দ্বিমত রয়েছে। কেউ কেউ বলেন, সাম্প্রতিক অস্থিরতা দেশটির সেনাবাহিনী ও আইএসআইয়ের কিছু সদস্যকে হয়তো এমন সশস্ত্র সংগঠনগুলোর সঙ্গে আরও সক্রিয়ভাবে যুক্ত করেছে। যেমনটা আগে রাজনৈতিক অস্থিরতার সময় রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা প্রতিষ্ঠানগুলো হুমকি অনুভব করলে দেখা গেছে।

অস্ট্রেলিয়ার সরকার বলেছে, লস্কর–ই–তাইয়েবা ‘জামাত–উদ–দাওয়া’ নামে কার্যক্রম চালিয়েছে। ২০০২ সালে পাকিস্তান এলইটিকে নিষিদ্ধ করার ঠিক আগে ‘জামাত–উদ–দাওয়া’ প্রতিষ্ঠিত হয় হাফিজ সাঈদের মাধ্যমে একটি দাতব্য সংস্থা হিসেবে।

২০১৮ সালে মুম্বাই হামলার দশম বার্ষিকীতে ‘সেন্টার ফর এ নিউ আমেরিকান সিকিউরিটি’র স্টিফেন ট্যাঙ্কেল বলেন, পাকিস্তান এলইটি ও জেইউডির মধ্যে বাহ্যিক বিভাজন দেখায়। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্র ও জাতিসংঘ এগুলোকে একই ‘সন্ত্রাসী’ সংগঠন হিসেবে বিবেচনা করে।

আরও পড়ুনভারত–পাকিস্তান যুদ্ধবিরতির সিদ্ধান্তের প্রশংসায় বিশ্বনেতারা১ ঘণ্টা আগেবর্তমান পরিস্থিতি

লস্কর–ই–তাইয়েবা ও জইশ–ই–মুহাম্মদ, দুই সংগঠনের প্রতি পাকিস্তানের আনুষ্ঠানিক সমর্থনের মাত্রা নিয়ে বিশেষজ্ঞদের মধ্যে দ্বিমত রয়েছে। কেউ কেউ বলেন, সাম্প্রতিক অস্থিরতা দেশটির সেনাবাহিনী ও আইএসআইয়ের কিছু সদস্যকে হয়তো এমন সশস্ত্র সংগঠনগুলোর সঙ্গে আরও সক্রিয়ভাবে যুক্ত করেছে। যেমনটা আগে রাজনৈতিক অস্থিরতার সময় রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা প্রতিষ্ঠানগুলো হুমকি অনুভব করলে দেখা গেছে।

তবে ট্যাঙ্কেল আরও জটিল ও দীর্ঘমেয়াদি এক প্রবণতার দিকে ইঙ্গিত করেন। তিনি বলেন, ‘পাকিস্তানের ওপর ঘনিষ্ঠভাবে নজর রাখেন, এমন পর্যবেক্ষকেরা স্বীকার করেছেন, লস্কর–ই–তাইয়েবা শুধু পাকিস্তানের ভেতর হামলা চালানো থেকে বিরত থাকে, তা–ই নয়। তারা এমন গোষ্ঠীগুলোর বিরুদ্ধেও কাজ করে, যারা রাষ্ট্রটির বিরুদ্ধে অবস্থান নেয়।’

এই বিশেষজ্ঞ আরও বলেন, ‘লস্কর–ই–তাইয়েবা বেলুচিস্তানের বিচ্ছিন্নতাবাদী ও অন্য অস্ত্রধারীদের বিরুদ্ধে গোয়েন্দা তথ্য সংগ্রহ ও কখনো তাদের নির্মূল করতেও সহায়তা করেছে। এমনকি রাষ্ট্রবিরোধী শক্তির বিরুদ্ধে একটি আদর্শিক ও ধর্মতাত্ত্বিক প্রতিপক্ষ হিসেবে কাজ করেছে সংগঠনটি।’

আরও পড়ুনযুদ্ধবিরতি ‘ভঙ্গ করা’ নিয়ে ভারত–পাকিস্তান বাহাস, শ্রীনগরে বিস্ফোরণের শব্দ৬ ঘণ্টা আগে.

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: সশস ত র স গঠন আফগ ন স ত ন সশস ত র স গ স ব ক র কর স গঠনগ ল র লক ষ য স গঠন র স গঠনট ইসল ম র সময়

এছাড়াও পড়ুন:

সীমান্তে পুশইন: নতুন মাত্রায় পুরোনো করণীয়

ভারত-পাকিস্তান ‘যুদ্ধ’ নিয়ে দক্ষিণ এশিয়া যখন সরগরম, তখন বাংলাদেশ সীমান্তে বলতে গেলে নীরবে ‘পুশইন’ বা কিছু মানুষকে শূন্যরেখায় ঠেলে দেওয়া শুরু করেছে নয়াদিল্লি। গত এক সপ্তাহে কুড়িগ্রাম, খাগড়াছড়ি, মৌলভীবাজার ও সাতক্ষীরা জেলার বিভিন্ন সীমান্ত দিয়ে দুই শতাধিক মানুষকে এভাবে ঠেলে দিয়েছে ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনী বিএসএফ। সমকালসহ বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমের খবর অনুযায়ী, এদের কেউ কেউ ভোরবেলা বিভিন্ন সীমান্ত অতিক্রম করে বাংলাদেশের ভেতরে ঘোরাঘুরির সময় স্থানীয়রা তাদের বিজিবি’র হাতে তুলে দিয়েছে। আবার কাউকে কাউকে সুন্দরবনের মতো জনবিরল এলাকায় ফেলে রেখে গিয়েছে বিএসএফ। এই আশঙ্কা অমূলক হতে পারে না যে, আরও অনেকে স্থানীয় অধিবাসী, সীমান্তরক্ষী, পুলিশ বা মাঠ প্রশাসনের নজর এড়িয়ে জনারণ্যে মিশে গেছে।

বাংলাদেশ-ভারত সীমান্তে নয়াদিল্লির এমন মানবাধিকারবিরোধী কৌশল নেহাত নতুন নয়; অন্তত আড়াই দশক পুরোনো। ১৯৯৮ সালে বিজেপি নেতৃত্বাধীন এনডিএ জোট ক্ষমতায় আসার পর থেকেই চলছিল। তবে ২০০২-০৩ সালে তুঙ্গে উঠেছিল। মনে আছে, সেই সময় ভারতের এই অমানবিক প্রক্রিয়া ‘পুশইন’ নাম পায়; আর এসব মানুষকে পুনরায় ভারতে ফেরত পাঠিয়ে দেওয়ার প্রক্রিয়ার নাম দেওয়া হয় ‘পুশব্যাক’। দুই পক্ষের ঠেলাঠেলিতে নারী, শিশুসহ এসব অসহায় মানুষ শূন্যরেখায় অবস্থান নিতে বাধ্য হতো। খাদ্য-পানীয় ও প্রাকৃতিক ক্রিয়াদির সংকট নিয়ে শীত, গরম, রোদ, বৃষ্টিতে শূন্যরেখায় এসব মানুষের অসহায়ত্ব নিয়ে তখন বাংলাদেশ-ভারত ছাড়াও আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমে বেশ আলোড়ন সৃষ্টি হয়েছিল। অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালসহ আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠনগুলোও বিবৃতি দিয়েছিল। 
২০০৪ সালে নয়াদিল্লিতে কংগ্রেস নেতৃত্বাধীন ইউপিএ জোট ক্ষমতায় আসার পর ধীরে ধীরে তথাকথিত পুশইন অবশ্য কমে গিয়েছিল। ২০১৪ সালে এনডিএ জোট যদিও আবার ক্ষমতায় এসেছিল, বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পর্কে ‘সুবর্ণ অধ্যায়’ বিবেচনায় সম্ভবত পুশইন আগের মাত্রায় ছিল না। অবশ্য ২০১৬ সাল থেকে বিজেপি আসামের রাজ্য সরকার গঠন করার পর থেকে ওই সীমান্তে বিচ্ছিন্নভাবে কিছু এমন পরিস্থিতি সৃষ্টি হতে থাকে। লক্ষণীয়, গত বছর জুলাই-আগস্টের গণঅভ্যুত্থানে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর সেই পরিস্থিতি পরিবর্তন হতে থাকে। ঢাকা-নয়াদিল্লি সম্পর্কের অবনতির ডামাডোলে হয়তো বাংলাদেশের মিডিয়ার চোখ এড়িয়ে গেছে; দীর্ঘ বিরতির পর আগস্টের তৃতীয় সপ্তাহে ফের ‘পুশইন’ শুরু হয়েছিল। সেই দফায় অন্তত ৪ জনকে ‘বাংলাদেশি’ আখ্যা দিয়ে সীমান্তের এপাশে ঠেলে দেওয়া হয়। আসামের মুখ্যমন্ত্রী হিমন্ত বিশ্বশর্মা স্বয়ং এ নিয়ে ‘টুইট’ করেন (দ্য হিন্দু, ২০ আগস্ট ২০২৪)।

সর্বসাম্প্রতিক পুশইন পরিস্থিতে যোগ হয়েছে কিছু নতুন মাত্রা। আগে সাধারণত ভারতের বাংলাভাষী মুসলিম জনগোষ্ঠীকে ‘বাংলাদেশি’ আখ্যা দিয়ে সীমান্তের এপাশে ঠেলে দেওয়া হতো। এবার দেখা যাচ্ছে, এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী। কুড়িগ্রামের দুই উপজেলা রৌমারী ও ভুরুঙ্গামারী সীমান্তে যে ৪৪ জনকে ‘পুশইন’ করা হয়েছে, তাদের ৩৫ জনই মিয়ানমারের নাগরিক (দ্য ডেইলি স্টার, ৮ মে ২০২৫)। তার মানে, কেবল ভারতীয় বাংলাভাষী মুসলিম নয়, আরাকানি মুসলিমদেরও বাংলাদেশে ঠেলে দিচ্ছে নয়াদিল্লি!

এবারের ‘পুশইন’ স্পষ্টত ভারতের কেন্দ্রীয় পরিকল্পনার অংশ; বাংলাদেশ সীমান্তবর্তী পশ্চিমবঙ্গ বা আসামের রাজ্য সরকার বা প্রশাসনের সিদ্ধান্ত নয়। খাগড়াছড়িতে আটকদের কাছ থেকেও জানা গেছে যে, তাদের গুজরাট থেকে বিমানে করে ত্রিপুরায় এনে ঘণ্টাখানেক হাঁটিয়ে সীমান্ত পার করে দিয়েছে বিএসএফ (বিবিসি বাংলা, ৮ মে ২০২৫)। 

মনে আছে, সম্প্রতি ভারতের গুজরাটে ‘বাংলাদেশি’ আটকের নামে মূলত বাংলাভাষী ভারতীয় মুসলিম ও রোহিঙ্গা মুসলিমদের আটক করা হয়েছিল। পরিস্থিতি কেমন ছিল, পশ্চিমবঙ্গের শীর্ষস্থানীয় বাংলা সংবাদপত্রেও খবর হয়েছে এভাবে– “বাংলাদেশি সন্দেহে গুজরাত পুলিশের হাতে আটক পশ্চিমবঙ্গের তিন যুবক। তাঁদের দু’জনের বাড়ি বীরভূম এবং একজন পূর্ব বর্ধমানের বাসিন্দা। পরিবারের দাবি, সমস্ত নথিপত্র থাকা সত্ত্বেও তিনজনকে আটক করে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর রাজ্যের পুলিশ। তার পর থেকে আর যোগাযোগ করা যাচ্ছে না তিনজনের সঙ্গে। এ বিষয়ে ‘দিদিকে বলো’-তে ফোন করে অভিযোগ জানিয়েছে তারা” (আনন্দবাজার পত্রিকা, ২৯ এপ্রিল ২০২৫)।
এখন দেখা যাচ্ছে, গুজরাটে আটক বাংলাভাষী ভারতীয় মুসলমানদেরই বাংলাদেশ সীমান্তের এপাশে ঠেলে দেওয়া হচ্ছে। এর মধ্য দিয়ে ভারত দ্বিগুণ মানবাধিকার লঙ্ঘন করছে। একদিকে তারা আটক এইসব মানুষের মানবাধিকারের তোয়াক্কা করছে না, অন্যদিকে প্রতিবেশী রাষ্ট্রের সঙ্গে সঙ্গে গায়ের জোর দেখাচ্ছে। এসব মানুষের কেউ কেউ যদি সত্যিকার অর্থেই বৈধ নথিপত্রহীন বাংলাদেশি হয়েও থাকে, তাদের ‘ডিপোর্ট’ করার জন্য সুনির্দিষ্ট আন্তর্জাতিক আইন ও রেওয়াজ রয়েছে। আর যারা রোহিঙ্গা, স্পষ্টতই মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যের অধিবাসী, তাদের বাংলাদেশে ঠেলে দেওয়ার অর্থ পায়ে পা দিয়ে ঝগড়া বাধানো ছাড়া কিছু নয়।

এবারের ‘পুশইন’ পরিস্থিতিতে আরেকটি নতুন মাত্রা হচ্ছে ভারতীয় সংবাদমাধ্যমের সন্দেহজনক নীরবতা। ২০০২-০৩ সালে যখন ভারত একই অন্যায় করছিল, তখন সেদেশের সংবাদমাধ্যম ও শুভবুদ্ধিসম্পন্ন নাগরিকরা এই অন্যায্যতার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করেছিল। এবার দেখছি, বিষয়টি নিয়ে যেমন সংবাদমাধ্যম সুনসান, তেমনই নাগরিক সমাজ ও মানবাধিকার সংগঠনগুলোও স্পিকটি নট!
এই নিবন্ধ যেদিন লিখছি, ১০ মে ২০২৫, সেদিনই ভারতীয় ইংরেজি সংবাদপত্র ‘টাইমস অব ইন্ডিয়া’ খবর দিয়েছে যে, দেশটির মেঘালয় ও আসাম রাজ্যের বাংলাদেশ সীমান্তে যথাক্রমে ‘নাইট কারফিউ’ ও ‘হাই অ্যালার্ট’ জারি করা হয়েছে। খোঁজ নিয়ে ত্রিপুরা ও পশ্চিমবঙ্গ সীমান্তেও এমন পরিস্থিতি দেখা গেলে অবাক হওয়ার কিছু নেই।

প্রশ্ন হচ্ছে, নতুন মাত্রার এই ‘পুশইন’ পরিস্থিতিতে বাংলাদেশ কী করতে পারে? আগেরবার যদিও ‘পুশব্যাক’ করার চেষ্টা চলেছিল, সেটা কাজে দেয়নি। ভারত যেহেতু সিদ্ধান্ত ও প্রস্তুতি নিয়ে এভাবে মানুষকে অমানবিক পরিস্থিতিতে ঠেলে দিয়ে থাকে, দেশটির সীমান্তরক্ষী বাহিনীর কড়া পাহারা পেরিয়ে তাদের ফিরে যাওয়া সম্ভব হয় না। সেবার অসহায় মানুষগুলো শূন্যরেখায় অপেক্ষমাণ অবস্থাতেই একজন দু’জন করে অন্তর্ধান হয়েছিল। বেশির ভাগই যে বাংলাদেশেই অনুপ্রবেশ করেছিল, সেটা বোঝার জন্য বিশেষজ্ঞ হওয়ার প্রয়োজন নেই।
এবার ‘পুশইন’ ঠেকাতে অতি অবশ্যই সীমান্তে কড়া পাহারা ও গোয়েন্দা নজরদারি বাড়াতে হবে। সীমান্তের ওপাশে কোথায় কোথায় লোকজন জড়ো করা হয়েছে, সেই অনুসন্ধান কঠিন হলেও অসম্ভব হতে পারে না। 

এদিকে, বাংলাদেশে, অন্তর্বর্তী সরকারের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা ড. খলিলুর রহমান বুধবার সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে বলেছেন যে, ভারত থেকে এভাবে পুশইন সঠিক প্রক্রিয়া নয়; এ বিষয়ে ভারত সরকারের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা চলছে (সমকাল অনলাইন, ৭ মে ২০২৫)। এর পরে এই বিষয়ে কী ঘটেছে, সে ব্যাপারে কোনো তথ্য সংবাদমাধ্যমে পেলাম না এই নিবন্ধ রচনাকাল পর্যন্ত।
আমার মতে, বাংলাদেশ সরকারের উচিত হবে অবিলম্বে আনুষ্ঠানিকভাবে ভারতের কাছে প্রতিবাদ জানানো। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় ও সংবাদমাধ্যমকে জানানোর ক্ষেত্রেও দেরি করা যাবে না। জাতিসংঘসহ আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠনগুলোকেও জানানো দরকার। বিশেষত রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীকে ধরে ভারত যেভাবে বাংলাদেশে ফেরত পাঠাচ্ছে, তা যে কোনো মানদণ্ডে চরম মানবাধিকার লঙ্ঘন।
বাংলাদেশ-ভারত কূটনৈতিক সম্পর্কের বিদ্যমান অবস্থায় পুশইন নিয়ে আগের মতো দ্বিপক্ষীয় যোগাযোগ ও আলোচনার ভরসায় বসে থাকা আর ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়ের কৌতুকের মতো ‘দেখি না কী হয়’ ভেবে বসে থাকা সমান কথা।

শেখ রোকন: লেখক ও নদী-গবেষক
skrokon@gmail.com

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • সীমান্তে পুশইন: নতুন মাত্রায় পুরোনো করণীয়