পুনর্বাসনে অসঙ্গতি, স্বাভাবিক জীবন ফিরে পাননি ভিক্ষুকরা
Published: 17th, May 2025 GMT
আয়নাল হক। গাইবান্ধা সদর উপজেলার কামারজানি ইউনিয়নের ব্রহ্মপুত্র নদের তীর ঘেঁষা গোঘাট গ্রামে বাড়ি। প্রায় দেড় বছর আগে মারা গেছেন তিনি।
আয়নাল হকের স্ত্রী ফুলমতি বেগমের ভাষ্যে, “স্বামী বেঁচে থাকতে সমাজসেবা অফিস থেকে ৮ থেকে ১০ হাজার টাকার মালামাল (চকলেটের বয়াম, তেল, লবণ, সাবান, চিপস ইত্যাদি) কিনে দিয়েছিল। পরে কেউ খোঁজ নিতে আসেনি। বর্তমানে দোকানে মালামাল নেই বললেই চলে। এই দোকান দিয়ে কি সংসার চালানো যায়?”
মানব সমাজে ভিক্ষাবৃত্তির প্রচলন সেই প্রাচীন কাল থেকেই চলে আসছে। বিভিন্ন শাসন আমলে নদী ভাঙ্গন, দারিদ্র্যতা, প্রাকৃতিক দুর্যোগ, অশিক্ষা ইত্যাদি নানা কারণে ভিক্ষাবৃত্তির ব্যাপক বিস্তৃতি ঘটে মঙ্গা পীড়িত গাইবান্ধা অঞ্চলে।
ভিক্ষুক সমাজের জীবনমান উন্নয়ন ও ভিক্ষাবৃত্তির লজ্জা থেকে দেশকে মুক্ত করার লক্ষ্য নিয়ে কাজ শুরু করে তৎকালীন সরকার।
সেজন্য একজন ভিক্ষুককে পুনর্বাসন ও বিকল্প কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করে দেওয়াই ছিল প্রকল্পের মূল লক্ষ্য। কিন্তু প্রকল্প বাস্তবায়নে খুঁজে পাওয়া গেছে বেশ কিছু অসঙ্গতি।
পুনর্বাসন পরবর্তী কেমন আছেন তারা সেটা জানতে সরেজমিনে গিয়ে দেখা গেছে, গাইবান্ধায় ভিক্ষুক পুনর্বাসন ও বিকল্প কর্মসংস্থান প্রকল্পে ভিক্ষুকদের জন্য দেওয়া বরাদ্দ সঠিকভাবে বিতরণ করা হয়নি। পুনর্বাসন পরবর্তী তদারকি না করা, প্রকৃত ভিক্ষুক নির্বাচন না করাসহ নানান অসঙ্গতি রয়েছে। সেকারণে ভিক্ষুকদের স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে আনার কথা থাকলেও আদৌও প্রকল্পের লক্ষ্য ফলপ্রসূ হয়নি। বরং দারিদ্র সীমার অনেক নিচে বসবাস করছে সুবিধাভোগী ভিক্ষুক পরিবারগুলো। আবার ভিক্ষুক নন এমন অনেকেই পেয়েছেন ভিক্ষুক পুনর্বাসনের বরাদ্দ।
ভিক্ষুক পুনর্বাসন ও বিকল্প কর্মসংস্থান প্রকল্পের আওতাভুক্ত আরেক ভিক্ষুক সদর উপজেলার গিদারি ইউনিয়নের প্রধানের বাজারের সিরাজুল ইসলাম। তার ছেলে আনিছুর রহমান বলেন, “আমাদের কোন জায়গা-জমি নেই। অন্যের দোকান ঘরে বসবাস করছি। সমাজসেবা অফিস থেকে ২০ হাজার টাকার মালামাল দেওয়ার কথা ছিল। কিন্তু বাস্তবে ৬ থেকে ৭ হাজার টাকার মালামাল কিনে দিয়েছে।”
তিনি আরও বলেন, “বাবা ব্রেইন স্ট্রোক করে ঢাকায় ছোট ভাইয়ের বাড়িতে আছে। দোকান না থাকায় আমরা খুব কষ্টে আছি। অন্যের দোকান ঘরে বউ বাচ্চা নিয়ে ভাড়া থাকছি। নামমাত্র ওই মালামাল দেওয়ার পর আর কেউ খোঁজ পর্যন্ত নেয়নি।”
সদর উপজেলার দাড়িয়াপুর এলাকার ভিক্ষুক আহম্মেদ আলী। বর্তমানে তিনি মানসিক ও শারীরিকভাবে অসুস্থ। স্ত্রী হালিমা বেগম জানান, পরিবারে তিন মেয়ে, এক ছেলে। অন্যের জায়গায় ঘর করে বসবাস করেন। সমাজসেবা অফিস থেকে দোকানঘর ও সামান্য কিছু মালামাল কিনে দেওয়া হলেও স্থায়ী জায়গার অভাবে দোকান দেওয়ার পর থেকেই তা বন্ধ। এক বছর ধরে ফোন করে সাহায্য চেয়েছেন। কিন্তু অফিসের কেউ গিয়ে দোকান চালানোর ব্যবস্থা করেনি। খুব কষ্টে আছেন।
তিনি বলেন, ‘‘আয় রোজগার না থাকায় বাধ্য হয়ে নাবালক ছেলেকে কাজে পাঠিয়েছি। তার আয়ে পাঁচজনের সংসার চলে না। স্বামীকে পাবনা থেকে চিকিৎসা করিয়ে এনেছি। অন্যের জায়গায় থাকি। অর্থের অভাবে ঠিকমতো চিকিৎসাও করাতে পারি না। মেয়েটা অসুস্থ, তাই স্বামীর বাড়ি থেকে ফেরত পাঠিয়েছে। এসব চিন্তায় কিছু ভালো লাগে না।” দোকান বসানোর ক্ষেত্রে প্রশাসন থেকে দ্রুত উদ্যোগ নেওয়ার আকুতি জানান তিনি।
গত বছর শহর সমাজ সেবা কার্যালয় থেকে একটি ব্যাটারি চালিত রিকশা কিনে দেওয়া হয় শহরের পুরাতন ব্রিজের নিচে বসবাসকারী বৃদ্ধা রমিছা বেগমকে। খোঁজ নিয়ে দেখা যায়, রিকশাটি চালাচ্ছেন অন্য এক ব্যক্তি। রিকশার পিছনে সমাজসেবার লোগোসহ রমিছা বেগমের নাম ও মোবাইল নাম্বার আছে। রিকশার পিছনে লেখা রয়েছে এটি ক্রয়, বিক্রয় বা হস্তান্তর যোগ্য নয়।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক সেই রিকশা চালক জানান, কয়েক হাত বদলের পর তিনি এখন এই রিকশা চালাচ্ছেন। রমিছা বেগম নামের কাউকে তিনি চেনেন না।
রমিছা বেগম রাইজিংবিডি ডটকমকে বলেন, “আমজাদ নামের এক ব্যক্তি ডিসি অফিসত নিয়্যে যায়া একটা রিকশা নিয়্যে দেয়। এর কিছুদিন পর আমজাদের শালা হাই মিয়া ও তার ব্যাটা বাবু ১৮ হাজার ট্যাকাত সেই রিকশা বেচি দিচে। মোক এক ট্যাকাও দেয় নাই।”
গাইবান্ধা সমাজসেবা অধিদপ্তর সূত্রে প্রাপ্ত তথ্যে জানা যায়, সমাজসেবা অধিদপ্তর থেকে ভিক্ষুকদের নির্দিষ্ট কোন পরিসংখ্যান নেই। তবে, তারা জানিয়েছে জেলায় প্রায় ৩ হাজার ভিক্ষুক আছে। ২০১৭–১৮ অর্থবছরে জেলায় ভিক্ষুক পুনর্বাসন ও বিকল্প কর্মসংস্থান সৃষ্টি প্রকল্পের কাজ শুরু হয়। চলতি বছর পর্যন্ত বরাদ্দ পাওয়া গেছে মোট ৭৬ লাখ ৯৪ হাজার টাকা। এ পর্যন্ত জেলার সাত উপজেলায় ১২১ জন ভিক্ষুককে প্রকল্পের আওতায় সুবিধা দেওয়া হয়েছে।
সদর উপজেলা কমিটির সদস্য সচিব ও সদর সমাজসেবা কর্মকর্তা নাসিরুদ্দিন শাহ বলেন, “সদর উপজেলায় এ পর্যন্ত ৭ জন ভিক্ষুককে প্রকল্পের সুবিধার আওতায় আনা হয়েছে। ব্যয় হয়েছে ১ লাখ ৭০ হাজার টাকা। তাদের পুনর্বাসন সঠিকভাবেই হয়েছে। ২০১৭ সালের একটি তালিকা অনুযায়ী সদরে ৭০০ থেকে ৮০০ জন ভিক্ষুক আছে।”
সঠিক পরিমাণে মালামাল না পাওয়া সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি বলেন, “এ ধরনের ঘটনা ঘটার সুযোগ নেই। তবে, মালামাল আরও বেশি পরিমাণে দিতে পারলে ভালো হতো। প্রকল্পটি প্রথম বাস্তবায়ন করা হয়েছে। কিছু ভুল-ত্রুটি থাকতে পারে। দ্রুত তাদের খোঁজ খবর নিয়ে পূনরায় বরাদ্দ দেওয়ার পাশাপাশি এখন থেকে পূনর্বাসন পরবর্তী তাদের বিষয়ে নিয়মিত খোঁজ, খবর নেওয়া হবে।”
এদিকে গাইবান্ধা শহর সমাজ সেবা অফিস থেকে প্রাপ্ত তথ্যে জানা যায়, ২০১৮ সালে ভিক্ষুক পুনর্বাসন কর্মসূচি চালুর পর ২০২৩-২৪ অর্থবছরে শহর সমাজসেবা কার্যালয়ে ৩ লাখ ৮৫ হাজার টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়। সেই টাকার পুরোটা ব্যয় করে শহরের পাঁচ ওয়ার্ডে পাঁচটি ব্যাটারি চালিত অটোরিকশা ও তৃতীয় লিঙ্গের দুইজনকে দুটি ইলেকট্রিক সেলাই মেশিন দেওয়া হয়েছে। এছাড়া ২০২৪-২৫ অর্থবছরে আরও ১ লাখ ৮৬ হাজার টাকা বরাদ্দ এসেছে।
তালিকা অনুযায়ী গাইবান্ধা পৌর শহরের ৪ নম্বর ওয়ার্ডের একরামুল ও রাখু মিয়া নামের দুই ভিক্ষুককে দুটি ব্যাটারি চালিত রিকশা দেওয়া হয়েছে। সরেজমিনে খোঁজ নিয়ে দেখা যায়, ওই মহল্লায় একরামুল ও রাখু নামের কোন ব্যক্তি নেই। তবে ৫ নম্বর ওয়ার্ডের গুচ্ছ গ্রামের বাসিন্দা জবেদ আলী একটি ব্যাটারি চালিত রিকশা পেয়েছেন। আবার ভিক্ষুক নন, অর্থনৈতিকভাবেও স্বচ্ছল তৃতীয় লীঙ্গের দুজনকে দুটি ইলেকট্রনিক সেলাই মেশিন দেওয়া হয়েছে।
৪ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর সুমন মিয়া বলেন, “আমার ওয়ার্ডের সব অলি-গলির মানুষকে আমি চিনি। এই নামে কোন ভিক্ষুক বা রিকশা চালক আমার ওয়ার্ডে নেই।”
ভিক্ষুক পুনর্বাসন ও বিকল্প কর্মসংস্থান প্রকল্পের সদর উপজেলা কমিটির সভাপতি সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মাহমুদ আল হাসান রাইজিংবিডি ডটকমকে বলেন, “আমরা ভিক্ষুক পুনর্বাসন কর্মসূচি সফল করতে কাজ করছি। ভুক্তভোগীদের কেউ আমার সঙ্গে যোগাযোগ করেনি। তাদের ব্যাপারে খোঁজ নিয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করব, যেন তারা ভালো থাকে।”
সমাজ সেবা অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক ফজলুল হক বলেন, “এই প্রকল্পটি বাস্তবায়নের জন্য উপজেলা ও জেলা পর্যায়ে কমিটি রয়েছে। ভিক্ষুক নির্বাচনে সেই কমিটিতে স্থানীয় ইউপি সদস্য ও চেয়ারম্যানরাও থাকেন। প্রয়োজনীয় মালামাল প্রাপ্তির ক্ষেত্রে অসঙ্গতি থাকলে জড়িত ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।”
প্রকল্পের জেলা সভাপতি ও জেলা প্রশাসক চৌধুরী মোয়াজ্জম আহম্মদ রাইজিংবিডি ডটকমকে বলেন, “ভিক্ষুক পুনর্বাসন কর্মসূচিতে এ ধরনের ঘটনা ঘটে থাকলে বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে খতিয়ে দেখা হবে। এছাড়া পুনরায় তাদেরকে পুনর্বাসন করার উদ্যোগ নেওয়া হবে।”
ঢাকা/এস
.উৎস: Risingbd
কীওয়ার্ড: চ কর চ কর সদর উপজ ল জন ভ ক ষ ক প রকল প র অফ স থ ক ব যবস থ অন য র বর দ দ বসব স
এছাড়াও পড়ুন:
আর্জেন্টাইন গায়িকাকে ছেড়ে কি ইতালিয়ান মডেলের প্রেমে মজেছেন ইয়ামাল
কয়েক মাস ধরে মাঠের ফুটবলের চেয়ে মাঠের বাইরের ঘটনা নিয়েই বেশি আলোচনায় লামিনে ইয়ামাল। গত জুন থেকে এখন পর্যন্ত কয়েকজন নারীর সঙ্গে নাম জড়িয়েছে তাঁর।
তবে ইয়ামাল নাকি প্রেমের সম্পর্কে জড়িয়েছিলেন শুধু একজনের সঙ্গে—আর্জেন্টিনার গায়িকা ও র্যাপার নিকি নিকোল। সম্প্রতি স্প্যানিশ সংবাদমাধ্যম জানিয়েছে, মাত্র তিন মাসেই নিকোলের সঙ্গে সম্পর্ক ভেঙে গেছে ইয়ামালের। চোট, ছন্দহীনতা, বিতর্ক কিংবা ব্যক্তিগত জীবন...সবখানেই হোঁচট খাচ্ছেন বার্সেলোনার এই উদীয়মান উইঙ্গার।
কিছু কিছু সংবাদমাধ্যমে এমনও খবর এসেছে যে ইয়ামাল বিশ্বাসভঙ্গ করাতেই তাঁর কাছ থেকে আলাদা হয়ে গেছেন নিকোল। ইতালির মিলানে এক পার্টিতে দেশটির ২০ বছর বয়সী মডেল আনা গেগনোসের সঙ্গে নাকি বেশ ঘনিষ্ঠ অবস্থায় দেখা গেছে ইয়ামালকে। বিষয়টি জানতে পারাতেই নিকোল নাকি ইয়ামালের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করেছেন।
তবে এ ধরনের অভিযোগ পুরোপুরি অস্বীকার করে নিজের অবস্থান স্পষ্ট করেছেন ইয়ামাল। স্প্যানিশ সাংবাদিক হাভি হোয়োসের অনুষ্ঠানে এসে ১৮ বছর বয়সী তারকা জানিয়েছেন, তাঁকে নিয়ে ওঠা সব খবর ভিত্তিহীন।
আরও পড়ুনইয়ামাল কি সত্যিই ১৩ বছরের বড় মডেলের প্রেমে মজেছেন১৮ জুন ২০২৫ইয়ামাল বলেছেন, ‘আমরা (তিনি ও নিকোল) এখন আর একসঙ্গে নেই। কিন্তু সেটা বিশ্বাসভঙ্গের কারণে নয়। আমরা শুধু আলাদা হওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছি। ব্যস, এইটুকুই। যা বলা হচ্ছে, কিছুই সত্যি নয়। আমি কারও সঙ্গে প্রতারণা করিনি, অন্য কারও সঙ্গেও ছিলাম না।’
ইয়ামালের দাবি, যেসব সংবাদমাধ্যম গল্প বানিয়ে প্রতারণার খবর ছড়াচ্ছে, সেগুলো স্রেফ গুজব।
নিকি নিকোলও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সব গুজব উড়িয়ে দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, ‘যদি কেউ আমাকে ঠকাত, আমি প্রথমেই সবাইকে জানাতাম। আগেও আমি তাই করেছি।’
২৫ বছর বয়সী এই আর্জেন্টাইন গায়িকা উদাহরণ হিসেবে মেক্সিকান গায়ক পেসো প্লুমার সঙ্গে বিচ্ছেদের বিষয়টি সামনে এনেছেন। গত বছর প্লুমা প্রতারণা করায় নিকোলের সঙ্গে ছাড়াছাড়ি হয়।
আরও পড়ুনইয়ামালের গাড়ি বা বান্ধবী নয়, ওর খেলা দেখুন: স্পেনের কোচ২৬ আগস্ট ২০২৫তবে ইয়ামালের সঙ্গে পারস্পরিক সম্মতিতে সম্পর্ক ভেঙেছে। এখানে প্রতারণার কোনো ব্যাপার নেই বলে জানিয়েছেন নিকোল, ‘আমরা আগেই আলাদা হয়েছি, শুধু ঘোষণা করিনি।’
ব্যক্তিগত জীবন সম্পর্কে নিজের অবস্থান স্পষ্ট করার পর ইয়ামাল এখন ফুটবলে মনোযোগী হতে চাইছেন।
ইয়ামালের গোল উদ্যাপন। কাল রাতে এলচের বিপক্ষে