‘অন্ধকারে হঠাৎ দেখতে পাই থেঁতলানো পা ও হাত’
Published: 21st, May 2025 GMT
‘কয়েকজন মিলে বাবাকে খুঁজতে বের হই। বৃষ্টির দিন, সড়কে ছিল অন্ধকার। হঠাৎ দেখতে পাই থেঁতলানো পা ও হাত পড়ে আছে। আরেকটু দূরে গিয়ে দেখি নাড়িভুঁড়ি ছড়ানো ছিটানো। মাথা ও মুখমণ্ডল চেনা যাচ্ছে না। পরে কুড়িয়ে কুড়িয়ে বস্তায় ভরে নিয়ে আসি।’
বাবার মৃত্যুর এমন বর্ণনা দিতে গিয়ে জ্ঞান হারিয়ে ফেলেন হাতির আক্রমণে নিহত এফিলিস মারাকের মেয়ে প্রিয়া হাদিমা (১৮)। জ্ঞান ফেরার পর বিলাপ করে প্রিয়া বলতে থাকেন, ‘হে সৃষ্টিকর্তা, বাবার এমন মৃত্যু যেন কোনো সন্তানকে দেখতে না হয়।’ প্রিয়া বলেন, ধান কাটার কাজ শেষে গত মঙ্গলবার রাতে বাড়ি ফিরছিলেন তাঁর বাবা ও সঙ্গে থাকা লোকজন। গজনী তিন সড়কের মোড়ে আসার পর হাতির পালের সামনে পড়েন তারা। সহকর্মীরা দৌড়ে চলে গেলেও তাঁর বাবা দৌড়াতে পারেননি। হাতির পাল তাঁকে নির্মমভাবে হত্যা করে।
নিহত এফিলিস মারাক শেরপুরের ঝিনাইগাতী উপজেলার কাংশা ইউনিয়নের বড় গজনী এলাকার বাসিন্দা। তাঁর মেয়ে প্রিয়া ময়মনসিংহে একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে নার্সিং প্রশিক্ষণ নিচ্ছেন। ছেলে ঢাকায় চাকরি করেন।
কৃষি শ্রমিক এফিলিসের স্ত্রী টিটিনাস হাদিমা বলেন, ‘স্বামীর রোজগারে সংসার চলত। আমরা গরিব মানুষ, কিছুই নাই, এখন কিভাবে সংসার চলবে সৃষ্টিকর্তা জানেন।’
কথা হয় নিহত কৃষি শ্রমিকের ছোট বোনজামাই বানেন্দ্র ম্রংয়ের সঙ্গে। তাঁর ভাষ্য, কাজ শেষে বাড়ি ফেরার পথে তাদের সামনে পড়ে ৩০-৪০টি হাতি। সবাই দৌড়ে পালান। কিন্তু এফিলিসকে হাতি পা দিয়ে পিষে ও শুঁড় দিয়ে আছড়ে টুকরো টুকরো করে ফেলে।
এফিলিসের খালাতো ভাই ফরটিন হাগিদক জানান, এক সপ্তাহ ধরে লোকালয়ে হাতি। অথচ কোনো ব্যবস্থা নেয়নি বন বিভাগ। হাতি ধানক্ষেত থেকে শুরু করে কাঁঠাল, লিচু, আম যেখানে যা আছে সেখানেই হানা দিচ্ছে।
একই দিন মঙ্গলবার রাত সাড়ে ৯টার দিকে হাতির আক্রমণে নিহত হন গান্ধীগাঁও গ্রামের যুবক আজিজুর রহমান আকাশ। তাঁর বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, বাবার লাশের পাশে বসে আহাজারি করছেন তাঁর তিন ছেলে ও স্ত্রী শিউলি আক্তার। দরিদ্র আকাশের বাড়িতে একটি মাটির ঘর ছাড়া কিছুই নেই। ছোট ছোট তিন সন্তানকে জড়িয়ে ধরে তাঁর স্ত্রী চিৎকার করে কাঁদছেন আর বলছেন, ‘আল্লাহ কেন তুমি আমারে এত বড় শাস্তি দিলা।’
নিহত দিনমজুর আকাশের বড় ছেলে সিহাব (১৫) জানায়, সবার সঙ্গে হাতি দেখতে দরবেশতলায় গিয়েছিলেন তার বাবা। কিন্তু হাতির তাড়া খেয়ে মাটিতে পড়ে যান। এ সময় তাঁকে আক্রমণ করে হাতি। বাবার কথা বলতে বলতে কান্নায় ভেঙে পড়ে সিহাব। সে বলে, সম্ভবত তার আর পড়াশোনা হবে না। মা, ভাইদের দায়িত্ব নিতে হবে তাকে। তা না হলে পেটে ভাত জুটবে না।
সিহাবের মামা কাংশা ইউনিয়ন যুবদলের সভাপতি মোহাম্মদ দুলাল মণ্ডলের ভাষ্য, আকাশের তিন সন্তান। দিন আনে দিন খায়। এখন তাদের দায়িত্ব কে নেবে? তিনি জানান, গত ২৫ বছরে গারো পাহাড়ে হাতি-মানুষের দ্বন্দ্ব নিরসনে বাস্তবসম্মত উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। অথচ তিনি ভারতের আসামে গিয়ে দেখেছেন, গ্রাম ভাগ করে হাতি ও মানুষের জন্য পৃথক আবাসের ব্যবস্থা করা হয়েছে। মাঝখান দিয়ে দেওয়া হয়েছে সোলার ফ্যান্সিং।
খবর পেয়ে গতকাল বুধবার দুপুরে ভুক্তভোগী দুই পরিবারকে সমবেদনা জানাতে তাদের বাড়িতে যান শেরপুর-৩ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য বিএনপি নেতা মাহমুদুল হক রুবেল। এ সময় তিনি কিছু আর্থিক সহায়তা তুলে দেন ভুক্তভোগী পরিবারের হাতে।
কথা হয় শেরপুর বন বিভাগের সদ্য বিদায়ী সহকারী বন সংরক্ষক ও প্রাণী গবেষক মঞ্জুরুল আলমের সঙ্গে। তাঁর ভাষ্য, হাতি খুব শান্তিপ্রিয় প্রাণী। তারা সাধারণত কাউকে অযথা বিরক্ত করে না। যারা হাতি তাড়ায়, তারা হাতিকে আঘাত করেন। হাতি খুব স্পর্শকাতর প্রাণী, আঘাত করলে ভুলে না। পাল্টা আঘাত করে।
বন বিভাগের রাংটিয়া রেঞ্জের রেঞ্জার আব্দুল করিম বলেন, নিহত দু’জনের পরিবারকে তিন লাখ টাকা করে ক্ষতিপূরণ দেওয়া হবে। ইআরটি টিমকে কেরোসিন তেল দেওয়া হয়েছে। তারা হাতি তাড়াবেন। স্থানীয়দের ইআরটি টিমকে সহায়তা করতে বলা হয়েছে।
শেরপুর বন্য প্রাণী সংরক্ষণ অধিদপ্তরের তথ্যমতে, ময়মনসিংহ বন বিভাগের অধীনে গারো পাহাড়ে ২০১৪ সাল থেকে এখন ৪৪ জন মানুষ হাতির আক্রমণে নিহত হয়েছেন। এই সময়ে হাতি মারা গেছে ৩৩টি।
উৎস: Samakal
এছাড়াও পড়ুন:
শার্লক হোমস স্রষ্টা আর্থার কোনান ডয়েলের জগৎ
স্যার আর্থার কোনান ডয়েল জগৎ বিখ্যাত কিশোর উপন্যাস ‘পিটার প্যান’ স্রষ্টা জেমস ব্যারির সাথে ক্রিকেট খেলছেন, ‘প্রিজনার অফ জেন্ডা’র লেখক অ্যান্থনি হোপ তার সহ-খেলোয়াড় অথবা ‘দ্যা জঙ্গল বুক’ লেখক রুডিয়ার্ড কিপলিং এবং তিনি ভারমন্টের মাঠে গলফ খেলছেন—এই তথ্য জানলে আমাদের মনে হতেই পারে ডয়েলের পুরো জীবনটাই বোধহয় এমন আনন্দে পূর্ণ ছিল। তিনি ওই সময়ের শ্রেষ্ঠ অভিনেতাদের জন্য নাটক লিখছিলেন—থিওডর রুজভেল্ট, উইনস্টন চার্চিলের সঙ্গে নিয়মিত রাতের খাবার সারেন, প্রিন্স অফ ওয়েলস এক গেলাসের ইয়ার—এসব রূপকথার মতো শোনায়। সবার আগ্রহের কেন্দ্রে আসার আগে যাত্রাপথ কেমন ছিল তার?
জেমস রায়ান, ডয়েলের সারা জীবনের বন্ধু তাকে বলতেন, ‘তুমি যে চিঠিতে তারিখ দাও না এজন্য জীবনীকাররা তোমায় অভিম্পাত দেবেন।’ তিনি একজন চিকিৎসক ছিলেন প্রথম জীবনে, খেলোয়াড় হিসেবে নাম করেছিলেন, সামাজিক ন্যায় বিচার এবং অপরাধ দমনের প্রয়োজনীয়তার বিষয়ে প্রতিবাদী অধিকারকর্মী ছিলেন, ওয়ার করেসপন্ডেন্ট, সামরিক ইতিহাসবিদ এবং শেষ পর্যন্ত প্রবর্তন করতে চেয়েছিলেন আস্ত একটা ধর্ম। তার নির্মিত রোমাঞ্চ কাহিনির মতোই ছিল তার জীবন। প্রায় সময় আর্থার কোনান ডয়েলের কার্যক্রম তীব্র বিতর্কের শীর্ষে অবস্থান করত। আর লিখতেন প্রচুর চিঠি—নামী, অনামী সবাইকেই।
ছাত্র হিসেবে মন্দ ছিলেন না তবু চিকিৎসা বিদ্যালয়ের ছাত্র হিসেবে এডিনবার্গ বিশ্ববিদ্যালয়ে খুবই অস্বস্তিকর সময় কাটাতে হয়েছিল। তিমি শিকারের জাহাজে ডাক্তার হিসাবে ছয় মাস পার করে কিছুটা মুক্তির আনন্দ তিনি উপভোগ করতে পেরেছিলেন। যদিও বরফের বিশাল টুকরোতে একবার জীবন-সংশয়ের মুখে পড়েছিলেন। কোনান ডয়েল এসেছিলেন বিখ্যাত এক চিত্রকর পরিবার থেকে যাদের শিকড় ছিল আইরিশ। অবশ্য তার সময় এই পরিবারটি ইংল্যান্ডে থিতু কয়েক প্রজন্ম জুড়ে। জন ডয়েল, তার দাদা, ছিলেন খুবই বিখ্যাত রাজনৈতিক ব্যঙ্গচিত্রী। ‘এইচ বি’ আদ্যাক্ষরে স্বাক্ষরকৃত তার ছবিগুলো এখন ব্রিটিশ মিউজিয়ামে রাখা আছে। স্বনামধন্য ব্যঙ্গপত্রিকা পাঞ্চ ম্যাগাজিনের প্রচ্ছদ করেছিলেন তার এক কাকা রিচার্ড। আরেক কাকা জেমস ইংল্যান্ডের প্রাতিষ্ঠানিক ব্যারনদের তালিকা করেছিলেন। দ্যা ন্যাশনাল গ্যালারি অব আয়ারল্যান্ড প্রতিষ্ঠাতা ডয়েলের অন্যতম এক কাকা হেনরি। ন্যাশনাল বায়োগ্রাফি অভিধানে আর্থার কোনান ডয়েলসহ তিন প্রজন্মের জীবনী লিপিবদ্ধ আছে।
বাবা চার্লস আলটামন্ট ডয়েলও একজন চিত্রকর ছিলেন। পৌরসভায় কাজ করতে গিয়ে নিজের জীবনসঙ্গীর দেখা পান। ভিক্টোরিয়ান ব্রিটিশদের তুলনায় স্ত্রী ছিলেন স্বশিক্ষিত। ‘রেভ্যু দ্যো দ্যু মন্ড’ পত্রিকা থেকে দুনিয়ার খবর আহরণ করতেন এবং ফরাসিতে অনর্গল কথা বলতে পারতেন। দক্ষ ছিলেন কুলচিহ্নবিদ্যায়। ইতিহাস এবং বংশতালিকা অর্থাৎ অতীতের ঘটনা, মানুষ সম্পর্কে জানা মায়ের খুবই প্রিয় ছিল। আর্থার মায়ের কাছ থেকেই এই দুটি বিষয়ে আগ্রহী হন। গবেষকরা বলেন, ঐতিহাসিক কাহিনির প্রতি লেখকের মুগ্ধতা এবং চর্চার উৎস হচ্ছে মাতৃচরিতমানস। নিজেই বলেছেন—অবিরত চিঠি লেখার প্রতি আমার প্রেম, গল্প বলার ভেতরকার আগ্রহ এই সবকিছুই আমি পেয়েছি আমার মায়ের কাছ থেকে।
২.
আমরা সবাই জানি ডয়েল পৃথিবী জোড়া খ্যাতি পেয়েছেন শার্লক হোমসের সূত্রে। কিন্তু প্রফেসর চ্যালেঞ্জার এবং বিগ্রেডিয়ার জেরার্ডের কথা ভুললে চলবে না। কিছু বিজ্ঞান কল্পকাহিনি আর অনেকটাই নির্জলা কল্পনা মিলিয়ে লেখা চ্যালেঞ্জার চরিত্রের উপাখ্যানমালা। আমাদের অনেকেরই মনে আছে, আমরা ছেলেবেলায় সেবা প্রকাশনীর অনুবাদে পড়েছিলাম ‘বিষ বলয়’ আর ‘হারানো পৃথিবী’ যথাক্রমে ‘দ্যা পয়জন বেল্ট’ আর ‘দ্যা লস্ট ওয়ার্ল্ডে’র অনুবাদ। পরেরটিকে নিয়ে কত ধরনের চলচ্চিত্র নির্মিত হয়েছে তার ইয়ত্তা নেই। বাংলা কল্পকাহিনির আরেক নামী লেখক অদ্রীশ বর্ধনের সুবিখ্যাত চরিত্র প্রফেসর নাটবল্টু চক্রের মূল অনুপ্রেরণা ডয়েলের চরিত্র এই খেয়ালী বিজ্ঞানী। লিখছিলাম এক বিগ্রেডিয়ারের কথা। জেরার্ড চরিত্রটিকে কেন্দ্র করে সতেরটি গল্প, একটি নাটক প্রণীত হয়। এক উপন্যাসেও অনেক জায়গা জুড়ে থাকেন। নেপোলিয়নের যুদ্ধের সময় এক ঘোড়সওয়ার অফিসার এই ভদ্রলোক, ফরাসি সেনাবাহিনীর। অত্যন্ত সাহসী ভাবেন নিজেকে। শ্রেষ্ঠ সোর্ড ফাইটার হিসেবে জাহির করেন সবসময়। সুন্দরী সান্নিধ্যে গলে যান। সংক্ষেপে, লেখক তাকে গড়েছেন কৌতুক আবহে।
কবিতা খুব বেশি লেখেননি। প্রায় সবই যুদ্ধ, পরিবেশ, সাম্রাজ্য সম্পর্কিত। একটি ছোট কবিতার নমুনা অনুবাদের চেষ্টা করে আমাদের কৈশোরের প্রিয়তম ভিনভাষী লেখকের জন্মদিনে শুভ বাসনা জানাই।
সাম্রাজ্য১৯০২
তারা বলে এটির ছিল মাটির পা,
তাই পতন নিশ্চিত ও দ্রুত।
গতকালের অগ্নিশিখায়
সকল মাটি পুড়ে হয়েছিল ইট।
যখন তারা আমাদের সমাধিফলক লিখতে এল
আর চিহ্নিত করল আহ্বানদূর পতিত হিসেবে,
আমরা, আমরা ফিরে বললাম, জোরে হেসে,
সাম্রাজ্যটাই তো ফুটে যাচ্ছে হে পতনের দিকে।