বিরোধী দল নিষিদ্ধ করে গণতন্ত্র পুনরুজ্জীবিত করা সম্ভব নয়
Published: 27th, June 2025 GMT
১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর জনমনে যে উচ্ছ্বাস তৈরি হয়েছিল, তা সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে নিভে যেতে মাত্র চার বছর সময় লেগেছিল। গত বছর এক জনপ্রিয় অভ্যুত্থানের মাধ্যমে বাংলাদেশে দ্বিতীয়বার যে উচ্ছ্বাস দেখা যায়, তা আরও দ্রুত নিভে যাবে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। ২০২৪ সালের আগস্টে ছাত্র-নেতৃত্বাধীন এক অভ্যুত্থান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে উৎখাত করে, যিনি গত ১৫ বছর ক্রমবর্ধমান স্বৈরতান্ত্রিক উপায়ে দেশ শাসন করেছিলেন। ক্ষুদ্রঋণের পথিকৃৎ ও জাতীয়ভাবে শ্রদ্ধেয় ড.
সত্যি বলতে ড. ইউনূস ও তাঁর সরকারকে অত্যন্ত জটিল ও দুরূহ দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল। বছরের পর বছর চলতে থাকা দুঃশাসন গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে ভয়াবহভাবে ভঙ্গুর করে তুলেছিল। দুর্নীতি ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়েছিল এবং তা ছিল স্পষ্ট। দলীয় গুন্ডা বাহিনী সরকারবিরোধীদের ওপর চড়াও হয়েছিল। আকর্ষণীয় প্রবৃদ্ধির পর অর্থনীতি গতি হারিয়ে ফেলে। প্রায় এক-পঞ্চমাংশ বাংলাদেশি তরুণ ছিল বেকার। প্রচণ্ডভাবে ক্ষিপ্ত গণঅভ্যুত্থানকারী তরুণদের একটা অংশ যাদের শেখ হাসিনার সাহায্যকারী ভেবেছিল, তাদের ওপর প্রতিশোধ নেওয়ার প্রতিজ্ঞা করে।
নতুন সরকার ইতোমধ্যে কিছুটা অগ্রগতি অর্জন করেছে। তাদের আপাত ভাবনা, ২০২৬ সালের ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচন হবে। অর্থনীতি মন্থর হলেও স্থিতিশীল। মুদ্রাস্ফীতির গতি ধীর হয়েছে এবং আন্তর্জাতিক ঋণদাতারা ঋণ দিচ্ছে। তবুও এমন আরও অনেক কিছু তারা করছে, যেগুলো ঝুঁকিপূর্ণ বলে মনে হচ্ছে। বৈদেশিক বিষয়ে বাংলাদেশ বাণিজ্য, বিনিয়োগ ও সস্তা অস্ত্রের সম্ভাবনায় আকৃষ্ট হয়ে চীনের দিকে ঝুঁকে পড়েছে। এটি আমেরিকার সঙ্গে দেশটির সম্পর্ক বিপন্ন করে তোলে, যা বাংলাদেশের রপ্তানি পণ্যের সবচেয়ে বড় ক্রেতা এবং ট্রাম্প প্রশাসনের সহায়তা হ্রাসের আগ পর্যন্ত অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ দাতা ছিল। চীনের দিকে ঝুঁকে পড়ার পাশাপাশি পাকিস্তানের সঙ্গে আরও বেশি নমনীয়তা ভারতকেও ক্ষুব্ধ করেছে। গত গ্রীষ্ম পর্যন্ত বাংলাদেশের বিশাল প্রতিবেশীর সঙ্গে সম্পর্ক উন্নত হচ্ছিল, কিন্তু এখন তা দুর্বল হচ্ছে।
সাম্প্রতিক মাসগুলোতে ভারত একটি ট্রান্সশিপমেন্ট চুক্তি বাতিল করেছে, যার উপকারভোগী ছিল বাংলাদেশি সংস্থাগুলো এবং দেশটি বাংলাদেশি অভিবাসী বলে বহু লোক বহিষ্কার করে। এখন দেশটি এক গুরুত্বপূর্ণ নদীর পানি বণ্টন চুক্তি পুনর্বিবেচনা করতে চায়।
ড. ইউনূসের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজ হলো বাংলাদেশের রাজনীতির পুনর্গঠন। এর অর্থ হলো, দেশের বিবদমান দলগুলোকে নির্বাচনের জন্য নতুন নিয়মে একমত হতে রাজি করানো। এর বাইরেও রয়েছে অনেক কিছু। তবে এমন লক্ষণও দেখা যাচ্ছে, রাজনীতিবিদদের এই প্রক্রিয়ায় ধৈর্যচ্যুতি ঘটছে।
রাজনৈতিক মতবিরোধ রাস্তায় প্রকাশ পাচ্ছে। শেখ হাসিনার দল আওয়ামী লীগকে ২০১৮ সালের নির্বাচনের ফল নিজের পক্ষে নিতে সাহায্য করার অভিযোগে এক দল মব জুনের মাঝামাঝি সময়ে সাবেক প্রধান নির্বাচন কমিশনারের ওপর হামলা করে।
মে মাসে অন্তর্বর্তী প্রশাসন একটি বড় ভুল পদক্ষেপ নেয়। তারা আওয়ামী লীগকে রাজনীতি থেকে নিষিদ্ধ করে। ফলে দেশটি আগামী বছর অনুষ্ঠেয় নির্বাচনে অংশ নিতে পারবে না। আদালতে যথাযথভাবেই দলের নেতাদের বিরুদ্ধে ক্ষমতায় থাকাকালীন অপরাধের জন্য বিচারের আয়োজন চলছে। কিন্তু কিছুদিন আগেও আশা ছিল, বিভিন্ন পর্যায়ের নেতাকর্মীকে দলটির তৎপরতা পুনরুজ্জীবিত করার সুযোগ দেওয়া হবে।
সন্ত্রাসবিরোধী আইন সংশোধন করে যে আদেশের মাধ্যমে দলটিকে নিষিদ্ধ করা হয়েছে, আইনগত দিক থেকে তা প্রশ্নবিদ্ধ। এতে বাংলাদেশি রাজনীতিবিদরা দীর্ঘদিন ধরে তাদের বিরোধীদের দমন করার জন্য যে ধরনের নোংরা কৌশল ব্যবহার করে আসছেন, তার গন্ধ রয়েছে। এটি বাংলাদেশকে আবারও প্রতিশোধের চক্রে ঠেলে দেওয়ার ঝুঁকিতে ফেলেছে। যেখানে যেই পদে থাকুক না কেন, প্রতিদ্বন্দ্বীদের দমন করার জন্য তাদের ক্ষমতা ব্যবহার করে।
বাংলাদেশের নেতাদের উচিত আওয়ামী লীগের ওপর থেকে নিষেধাজ্ঞা তুলে নেওয়া এবং দলটিকে একটি সুষ্ঠু নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার সুযোগ দেওয়া। অনেক নাগরিকের কাছে এটি বিস্বাদ লাগতে পারে, কিন্তু বাংলাদেশের প্রাচীনতম দলটির সবাই কলঙ্কিত নয়। দলটি এখনও সংখ্যালঘু গোষ্ঠীসহ যথেষ্ট সংখ্যক মানুষের সমর্থন পায়। বছরের পর বছর ধরে অস্বচ্ছ নির্বাচনের পর এই ভোটাররা যাকে খুশি তার পক্ষে একটি সিল মারার অধিকার রাখে।
এই মুহূর্তে স্বাধীনভাবে প্রচারণা চালানোর অনুমতি দিলেও নির্বাচনে দলটি জিতবে না। কিন্তু সংসদে এর উপস্থিতি বিরোধী শিবিরকে শক্তিশালী করতে পারে, যা বিজয়ীদের সতর্ক থাকতে বাধ্য করবে। নতুন বন্দোবস্ত গড়ে তোলার জন্য প্রতিশোধ নয়; সমঝোতা প্রয়োজন।
লন্ডনভিত্তিক ম্যাগাজিন দি ইকোনমিস্ট থেকে সংক্ষেপিত ভাষান্তর
উৎস: Samakal
কীওয়ার্ড: মত মত র জন ত র জন য সরক র র ওপর
এছাড়াও পড়ুন:
দেশ যেন এক মগের মুল্লুকে পরিণত হয়েছে: হাফিজ উদ্দিন
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য মেজর (অব.) হাফিজ উদ্দিন আহমদ বলেছেন, ‘দেশে আইনশৃঙ্খলা বলে কিছু নেই। কখনো সাংবাদিককে কুপিয়ে হত্যা, কখনো সাধারণ মানুষকে হত্যা—দেশ যেন এক মগের মুল্লুকে পরিণত হয়েছে।’
শনিবার দুপুরে খুলনা প্রেসক্লাবের ব্যাংকোয়েট হলে ‘একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধ ও গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠায় শহীদ জিয়া’ শীর্ষক আলোচনা সভায় প্রধান অতিথির বক্তব্যে তিনি এ কথাগুলো বলেন। জাতীয়তাবাদী মুক্তিযোদ্ধা দল খুলনা মহানগর ও জেলা শাখা এ সভার আয়োজন করে।
হাফিজ উদ্দিন আহমদ বলেন, ‘একমাত্র একজন উপদেষ্টা আসিফ নজরুল ছাড়া কেউ গণ-আন্দোলনে অংশগ্রহণ করেনি। এদের অনেকেই শেখ হাসিনার দোসর ছিল। যে কারণে শেখ হাসিনার রেখে যাওয়া প্রশাসন ও পুলিশ বাহিনী একই আছে। মাঝখান থেকে সুযোগ নিয়েছে একটি রাজনৈতিক দল—যারা একাত্তরে আমাদের স্বাধীনতাযুদ্ধের বিরোধিতা করেছিল। তারা গুরুত্বপূর্ণ জায়গায় কীভাবে জানি না, তাদের প্রতিনিধি বসিয়ে দিয়েছে এবং তারা রাষ্ট্রক্ষমতায় গেলে যেসব সুযোগ পাওয়া যায়, সেটি দিব্যি ব্যবহার করছে। আর আমরা বিএনপির কর্মীরা শুধু যুদ্ধ করে গেলাম, জীবন দিয়ে গেলাম, কতবার জেলে গিয়েছি তার হিসাব নাই।’
মুক্তিযুদ্ধ ও গণতন্ত্র প্রসঙ্গে বিএনপির এই নেতা বলেন, ‘একাত্তরে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্য আমরা যুদ্ধ করেছিলাম। মুক্তিযুদ্ধের পর ইতিহাস বিকৃত করা হয়েছে তৎকালীন ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের দ্বারা। ১৯৭০ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ বিজয়ী হয়েছিল। প্রত্যেক রাজনৈতিক দলের উদ্দেশ্যই থাকে রাষ্ট্রক্ষমতায় যাওয়া। আওয়ামী লীগের উদ্দেশ্যও সেটিই ছিল। কিন্তু বাংলাদেশ স্বাধীন হবে—এ কথা তারা তখন চিন্তাই করেনি। স্বাধীনতার পর তারা কল্পকাহিনি শুরু করল যে অনেক আগে থেকেই তারা স্বাধীনতার জন্য লড়ছিল। বাংলাদেশের ছাত্র, জনতা, যুবক, শ্রমিকদের বীরত্বের কাহিনি আওয়ামী লীগের আমলে জনগণকে জানতে দেওয়া হয়নি।’
একাত্তরের স্মৃতিচারণা করতে গিয়ে হাফিজ উদ্দিন আহমদ বলেন, ‘প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধাদের এ জাতি চিনল না—এটা দুঃখের বিষয়। অধিকাংশ প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন লুঙ্গি পরা, খালি পায়ে, মাথায় গামছা বেঁধে খেটে খাওয়া মানুষ। কিন্তু স্বাধীনতার পর দেখলাম ঢাকা, চট্টগ্রাম, খুলনা, রাজশাহী মহানগরের ছেলেরা সব মুক্তিযোদ্ধা হয়ে গেছে। প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধাদের পরিচয় রাজনৈতিক দলগুলো আলোতে আসার সুযোগ দেয়নি।’
জামায়াতের পিআর পদ্ধতিতে নির্বাচন চাওয়া নিয়ে বিএনপির এই নেতা বলেন, ‘তারা নির্বাচন চায় না। তারা তো অলরেডি ক্ষমতা ভোগ করছে। নির্বাচন বিলম্বিত করার চেষ্টা করছে। তারা বলে পিআর সিস্টেমে নির্বাচন। এই দেশের মানুষ দীর্ঘকাল ধরে ভোট দিয়ে আসছে একজন প্রতিনিধিকে—এলাকার মানুষের আপদ-বিপদে যাঁকে পাওয়া যায়। যিনি কল্যাণরাষ্ট্র গঠনের জন্য নিবেদিতপ্রাণ, এমন মানুষকেই ভোট দেয়। কিন্তু তারা মনে করে আগামী দিনে তো আমরা ক্ষমতায় যেতে পারব না, বিএনপি ক্ষমতায় যাবে। সুতরাং বিএনপি যাতে ক্ষমতায় যেতে না পারে, এ জন্যই তারা পিআর সিস্টেমে নির্বাচন চায়। বাংলাদেশের জনগণ পিআর সিস্টেম বোঝে না, তারা পছন্দের ব্যক্তিকে দেখতে চায় তাদের প্রতিনিধি হিসেবে।’
আলোচনা সভায় প্রধান বক্তা ছিলেন জাতীয়তাবাদী মুক্তিযোদ্ধা দলের সভাপতি ইসতিয়াক আজিজ উলফাত। বিশেষ অতিথি ছিলেন বিএনপির জাতীয় নির্বাহী কমিটির তথ্যবিষয়ক সম্পাদক আজিজুল বারী হেলাল, খুলনা মহানগর বিএনপির সভাপতি শফিকুল আলম মনা, জেলা বিএনপির আহ্বায়ক মো. মনিরুজ্জামান এবং খুলনা মহানগর বিএনপির সাধারণ সম্পাদক মো. শফিকুল আলম। সভায় সভাপতিত্ব করেন জাতীয়তাবাদী মুক্তিযোদ্ধা দলের খুলনা মহানগরের সভাপতি শেখ আলমগীর হোসেন।