৫ আগস্ট সকালটা শুরু হয়েছিল অন্য সাধারণ দিনের মতোই। অথচ কয়েক ঘণ্টার ব্যবধানে সাভার ও আশুলিয়ার রাজপথ পরিণত হয় রণক্ষেত্রে। রক্তাক্ত হয় শত শত ছাত্র-জনতা। গুলিতে ঝাঁঝরা হয় মানুষের বুক, রাস্তায় পড়ে থাকে লাশ। সেই দিনের ভয়াবহতা আজও তাড়া করে বেড়ায় প্রত্যক্ষদর্শীদের।

দীর্ঘদিন ধরে কোটা সংস্কার ও এক দফা এক দাবির আন্দোলনে উত্তাল ছিল সাভার-আশুলিয়া। প্রতিদিনের মতো সেদিনও মাঠে নামে ছাত্র-জনতা। কিন্তু এবার প্রতিক্রিয়া ছিল আরও হিংস্র, আরও পৈশাচিক।

সকালে সাভার ও আশুলিয়ার গুরুত্বপূর্ণ মোড়গুলোতে সেনাবাহিনীর কাঁটাতারের ব্যারিকেড দেখা গেলেও তাতে দমে যায়নি মানুষ। ব্যারিকেড পেরিয়ে ঢাকামুখী মিছিল, বাইপাইলে জমায়েত, চারপাশে গুঞ্জন-সব মিলিয়ে তখনকার দৃশ্য ছিল অগ্নিগর্ভ।

এরমধ্যেই পুলিশের দিক থেকে ধেয়ে আসে গুলি। মুহূর্তেই ছড়িয়ে পড়ে উত্তেজনা। বিক্ষুব্ধ জনতা ট্রাফিক বক্সসহ বিভিন্ন স্থানে আগুন ধরিয়ে দেয়। বহু মানুষ গুলিবিদ্ধ হয়ে রাস্তায় লুটিয়ে পড়ে। হাসপাতালে নেওয়ার আগেই অনেকে প্রাণ হারান।

দুপুরে যখন ছাত্র-জনতা জানতে পারে, সেনাপ্রধান জাতির উদ্দেশে ভাষণ দিতে যাচ্ছেন- তখন পরিস্থিতি রূপ নেয় মুখোমুখি সংঘর্ষে। পুলিশের গুলির জবাবে ছাত্র-জনতা ইট-পাটকেল ছোঁড়ে। সেসময় রাস্তায় অন্তত ডজনখানেক লাশ পড়ে থাকতে দেখা যায়।

আশুলিয়া থানার সামনে বিকেলে নতুন করে ছড়ায় বিভীষিকা। প্রত্যক্ষদর্শীদের ভাষ্য অনুযায়ী, পুলিশের গুলিতে ছয়জন নিহত হন এবং তাদের মরদেহ একটি ভ্যানে তোলা হয়। পরে ভ্যানভর্তি সেই লাশের স্তুপে আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয়।

এই ঘটনার মধ্যে ছড়িয়ে পড়ে শেখ হাসিনার দেশত্যাগের খবর। মুহূর্তেই আনন্দ আর বিক্ষোভ মিলেমিশে সড়কে নামে বিজয় মিছিল। বাইপাইল হয়ে এগিয়ে যায় মিছিল, উদ্দেশ্য—থানা ঘেরাও।

পুলিশ আত্মসমর্পণ ঘোষণা দিলেও গুলি ছোড়া বন্ধ করেনি। সেনাবাহিনী গিয়ে কিছু পুলিশ সদস্যকে সরিয়ে নেয় ক্যান্টনমেন্টে। পরে থানা ভবনে আগুন দেওয়া হয়, লুটপাট করা হয় অস্ত্র ও বিভিন্ন মালামাল।

থানার পাশের ভবনে ছিলেন হৃদয় আহমেদ। দুপুরে হঠাৎ গোলমালের শব্দে বাইরে বেরিয়ে তিনি দেখেন, “অনেক পুলিশ দাঁড়িয়ে ছিল, সামনে যাকেই পাচ্ছিল গুলি করছিল।” পুলিশ তাকে বাসায় ফিরে যেতে বললেও দ্বিতীয় তলা থেকে তিনি দেখেছেন, কীভাবে “২০ থেকে ১৫ জন গুলিবিদ্ধ হয়ে রাস্তায় পড়ে ছিল।”

তিনি বলেন, “৫ আগস্ট দুপুর ১২টা-১টার দিকে থানায় হঠাৎ হইহুল্লোড় শুরু হয়ে হয়। এসময় বাসা থেকে বের হয়ে দেখি অনেক পুলিশ অস্ত্র নিয়ে থানার সামনে দাঁড়িয়ে আছে। ছাত্র-জনতার সঙ্গে মারমুখী পরিস্থিতি দেখতে পাই। যে সামনে আসছে তাকেই গুলি করছে।”

তিনি আরও বলেন, “একটু সামনে যেতেই দুই থেকে তিনজন পুলিশ আমাকে ধমক দিয়ে বাসার দিকে পাঠিয়ে দেয়। পরে বাসায় গিয়ে দুইতলা থেকে দেখতে পাই পুলিশ অনবরত গুলি করছে। যখন ছাত্র জনতা থানার দিকে অগ্রসর হয়, তখনই তাদের সরাসরি গুলি করে মেরে ফেলেছে। বিকেল সাড়ে ৩টার দিকে যখন ছাত্র-জনতা জেনে যায় শেখ হাসিনা পালিয়েছে, তখন বিধ্বংসী একটি রূপ থানার সামনে দেখতে পাই। ছাত্র-জনতা তখন চতুর্দিক দিয়ে ঘিরে ফেলে। তখন পুলিশ যার কাছে যে অস্ত্র ছিল, সেই অস্ত্র দিয়েই গুলিবর্ষণ করছিল। আমার চোখের সামনে ২০ থেকে ১৫ জন গুলিবিদ্ধ হয়ে পড়ে ছিল। তাদের মধ্যে অনেকেই মারা যায়।”

হৃদয় আহমেদ বলেন, “লাশে আগুন দেওয়ার ঘটনা সরাসরি দেখতে পাইনি। যখন অসংখ্য গুলির শব্দ শুনতে পাই, তখন দরজা বন্ধ করে ঘরের ভেতর আশ্রয় নেই। ছয় থেকে সাতটার দিকে বাসা থেকে বের হয়ে দেখি ছাত্র জনতা থানার ভেতরে প্রবেশ করেছে, অনেকে থানা লুটপাট শুরু করে। এসময় তো অসংখ্য লোক ছিল যে কারণে কাউকে চেনা সম্ভব হয়নি।”

তিনি বলেন, “থানা লুটপাট এরপর থানায় আগুন ধরিয়ে দেয় ছাত্র-জনতা। রাতে যখন সবকিছু শান্ত, তখন থানার ওপর থেকে নিচ পর্যন্ত সবকিছু লুটপাট করে নিয়ে যাচ্ছিল। থানার সামনে লাশ পড়েছিল, থানা থেকে একটু এগোতেই বাইপাইল কেন্দ্রীয় মসজিদের সামনে সাতটি লাশ দেখতে পাই। ফুট ওভারব্রিজে আরও দুটি লাশ ঝোলানো ছিল। সব মিলিয়ে ভয়ানক পরিস্থিতির মুখোমুখি আমরা। এরপর বেশ কিছুদিন আমরা ট্রমার মধ্যে ছিলাম।”

আন্দোলনের সামনের সারিতে ছিলেন মেহেদী হাসান। তিনি বলেন, “গত বছরের ৪ আগস্ট সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত ছাত্র-জনতার ওপর হামলা করে আওয়ামী লীগের সন্ত্রাসীরা। কিন্তু দুপুরের পর হাজার হাজার ছাত্র-জনতার মুখে তারা আর টিকতে পারেনি। তবে ৫ আগস্ট তারা পুলিশকে সহযোগিতা করতে থাকে।”

তিনি বলেন, “সরাসরি তাদের রাজপথে দেখা যায়নি। ৫ আগস্ট সকালে কোনো ঝামেলা হয়নি। কিন্তু বেলা গড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে পুলিশ সরাসরি ছাত্র-জনতাকে লক্ষ্য করে গুলি ছোড়ে। সেদিন গুলিবিদ্ধ শত শত লোক জনকে হাসপাতালে ফ্রি-তে নিয়ে যান রিকশাচালকরা।”

তিনি আরও বলেন, “যখন শেখ হাসিনা পালিয়ে যায়, তখন উল্লাসে ফেটে পড়ে ছাত্র-জনতা। আশুলিয়া থানার দিকে যেতে থাকে তারা। এসময় পুলিশ ছাত্র-জনতাকে লক্ষ্য করে আবারও গুলি ছোড়ে। লাশ নিশ্চিহ্ন করতে ভ্যানে তুলে পুড়িয়ে দেওয়া হয়। ছাত্র-জনতার ক্ষোভ আরও বাড়ে। তারা থানার চারপাশ দিয়ে ঘিরে ফেলে। এমন সময় পুলিশ আত্মসমর্পণ করে মাইকে ঘোষণা দেয়। তখন ছাত্র-জনতা কিছুটা শান্ত হলে আবারও গুলি ছোড়ে পুলিশ। এবার আত্মসমর্পণেও আর ছাড় না দিয়ে পুলিশের ওপর আক্রমণ করার চেষ্টা করে। পুলিশ গুলি চালাতেই থাকে।”

মেহেদী হাসান বলেন, “আন্দোলন শেষে সন্ধ্যার পরও রাস্তাঘাটে আনন্দ উল্লাস করছিল জনতা। থানার সামনে গিয়ে দেখি থানা ভাঙচুর লুটপাট চলছে। চারদিকে আগুন, থানায় আগুন, যেখানে সেখানে লাশ পড়ে আছে। পরিস্থিতিটা খুবই ভয়ানক ছিল। আমাদের এলাকার মধ্যে বিভিন্ন স্থানে আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয়েছিল। আমরা আগুন নেভানোর চেষ্টা করছিলাম। কোনো সিলিন্ডার যেন বিস্ফোরণ না হয়, এমনকি এই আগুন যেন বসতবাড়ি পর্যন্ত না ছড়ায় সেই চেষ্টাটাই করছিলাম আমরা।”

তিনি বলেন, “থানা থেকে অনেকেই অস্ত্র লুট করে নিয়ে যায়। পরে সেনাবাহিনী এলাকায় মাইকিং করে অস্ত্র জমা দেওয়ার বিষয়ে জানালে অনেকেই অস্ত্র জমা দেয়। ৬ আগস্ট দেখলাম থানার সামনে লাশ পড়ে আছে, ফুট ওভারব্রিজে পায়ে কিছু একটা দিয়ে বেঁধে দুটি লাশ ঝুলিয়ে রাখা হয়েছে। এই দুটি লাশ ছিল পুলিশ সদস্যের।”

শহীদ আস-সাবুরের মা বলেন, “আন্দোলনে আমার ছেলেকে গুলি করে হত্যা করা হয়েছে। কী নির্মমভাবে হত্যা করা হয়েছে তাকে! প্রথমে গুলি করে হত্যা পরে লাশে আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দেওয়া হয়। এত বড় নির্মমতা, তারা লাশের সঙ্গেও পৈশাচিক বর্বরতা চালিয়েছে। আওয়ামী লীগের জড়িত সব নেতাকর্মীসহ শেখ হাসিনাকে দেশে ফিরিয়ে এনে তার শাস্তি দাবি করছি।”

ঢাকা জেলার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার শাহীনুর কবির বলেন, “গণঅভ্যুত্থানে সাভার ও আশুলিয়ায় সব চেয়ে বেশি ম্যাসাকার হয়েছে। এখন পর্যন্ত সাভার এবং আশুলিয়া থানা মিলে হত্যা মামলাসহ ১২৫টি মামলা দায়ের হয়েছে। এসব মামলায় আসামি ১০ হাজারেরও বেশি।”

তিনি বলেন, “এই মামলাগুলো আমরা সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে আসামিদের গ্রেপ্তার, লাশ উত্তোলনের যেসব প্রক্রিয়া ছিল সেসবও শেষ হয়েছে। চার্জশিট প্রস্তুত করার জন্য যেসব প্রক্রিয়া থাকে, এছাড়া অন্যান্য যে প্রক্রিয়া রয়েছে সবই মোটামুটি সম্পন্ন হয়েছে। শিগগিরই আমরা আদালতে চার্জশিট দেওয়া শুরু করব।”

ঢাকা/এস

.

উৎস: Risingbd

কীওয়ার্ড: চ কর চ কর ছ ত র জনত র থ ন র স মন পর স থ ত ৫ আগস ট ল টপ ট করছ ল

এছাড়াও পড়ুন:

প্রতারণা মামলার সাজাপ্রাপ্ত আসামি বক্তাবলীর মুর্শিদাকে কারাগারে প্রেরণ

প্রতারনা মামলার সাজাপ্রাপ্ত আসামি ফতুল্লার বক্তাবলীর মুর্শিদা বেগম (৪৮) কারাগারে পাঠিয়েছেন আদালত। দীর্ঘদিন পলাতক থাকার পর আদালতে আত্মসমর্পণ করলে বিজ্ঞ আদালত তাকে কারাগারে পাঠানোর নির্দেশ দেন। বৃহস্পতিবার (১৮ সেপ্টেম্বর) বিকালে নারায়ণগঞ্জ আদালত থেকে মুর্শিদাকে কারাগারে পাঠানোর বিষয়টি নিশ্চিত করেন। 

কারাগারে থাকা মুর্শিদা বেগম ফতুল্লার বক্তাবলী ইউনিয়নের রামনগর এলাকার মৃত আবুল হোসেন ওরফে কসাই আবুলের স্ত্রী। সে আওয়ামী লীগ নেতা শহিদুল্লাহর ভাইয়ের স্ত্রী বলেও জানা গেছে। 

আদালত এবং রাবেয়ার দায়েরকৃত মামলার সূত্রে জানা যায়, বক্তাবলী ইউনিয়নের চর রাজাপুর এলাকার আজিজুল ইসলামের স্ত্রী রাবেয়া বেগমের সাথে মুর্শিদার সাথে সম্পর্ক তৈরি হয়। সেই সুবাদে বিগত ২০২১ সালে রাবেয়ার কাছে মুর্শিদা তার বাড়ি বিক্রির প্রস্তাব দেয়। 

এতে রাবেয়া রাজি হলে তার কাছ থেকে বায়না বাবদ  ১১ লাখ টাকা গ্রহণ করে মুর্শিদা। টাকা নেয়ার প্রায় এক বছরের বেশি সময় পাড় হয়ে গেলেও মুর্শিদা তার বাড়ি দলিল করে দেয়ার বিষয় কিছু না বলায় রাবেয়া টাকার জন্য চাপ দেয়।

তাতে করে বাড়ির দলিল না করে দিয়ে রাবেয়াকে ১১ লাখ টাকার চেক প্রদান করে মুর্শিদা। পরে রাবেয়া মুর্শিদার বিরুদ্ধে আদালতে চেক ডিজঅনার মামলা দায়ের করে। 

মামলার একপর্যায়ে মুর্শিদার বিরুদ্ধে নারায়ণগঞ্জ যুগ্ম দায়রা জজ ফারজানা আক্তার এর ৩য় আদালতে রায় ঘোষণা করেন। বিজ্ঞ আদালত মুর্শিদাকে এক বছরের বিনাশ্রম কারাদণ্ড এবং ১১ লাখ টাকা জরিমানা করেন। 

পরে বিজ্ঞ আদালতে মুর্শিদা আদালতে অর্ধেক টাকা জমা দিয়ে জামিন নেয়। কিন্তু আদালতে বাকী টাকা দেয়ার কথা থাকলেও তা না করে আত্মগোপনে চলে যায়। পরে মুর্শিদা আদালতে আত্মসমর্পণ করলে বিজ্ঞ আদালত কারাগারে প্রেরণের আদেশ দেন।

এদিকে রাবেয়া অভিযোগ করেন সম্প্রতি মুর্শিদার কাছে টাকা চাইতে গেলে বিগত আওয়ামী লীগ শাসন আমলে সন্ত্রাসী দিয়ে আমার বাড়িতে হামলা চালায় এবং ভাঙচুর করে। এমনকি আমার ১১ লাখ টাকা আত্মসাত করতে মুর্শিদা আমার বিরুদ্ধে হয়রানি মূলক ভাবে মিথ্যা মামলা দায়ের করে। 

আর চেক ডিজঅনার মামলায় তাকে এক বছরের সাজা দেয় আদালত। সেই মামলায় মুর্শিদা কারাগারে রয়েছে। আদালতের কাছে  আমি সুষ্ঠু বিচার প্রার্থনা করছি এবং পাওনা টাকা যাতে দ্রুত পাই সেই ব্যবস্থা যেন করা হয়। 

মামলার বাদী রাবেয়ার আইনজীবী সাইদুর রহমান সাব্বির জানান, মুর্শিদা একটা প্রতারক। রাবেয়ার কাছে জমি বিক্রি করার কথা বলে ১১ লাখ টাকা নিয়ে নানা তালবাহানা করে।

একপর্যায়ে মুর্শিদার বিরুদ্ধে চেক ডিজঅনার মামলা দায়ের করলে স্বাক্ষ্য প্রমান থাকায় সেই মামলায় বিজ্ঞ আদালত রায় ঘোষণা করেন এবং মুর্শিদাকে এক বছরের সাজা এবং ১১ লাখ টাকা জরিমানা করা হয়। আর সেই মামলায় মুর্শিদা আদালতে আত্মসমর্পণ করলে তাকে জেল হাজতে প্রেরন করেন। বর্তমানে সে কারাগারে রয়েছে।
 

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • আত্মসমর্পণকারীরা দস্যুতায় ফিরছে , ‘দুলাভাই বাহিনী’সহ ১৪ দল সক্রিয়
  • প্রতারণা মামলার সাজাপ্রাপ্ত আসামি বক্তাবলীর মুর্শিদাকে কারাগারে প্রেরণ