ফিরে দেখা ৫ আগস্ট: সাভার-আশুলিয়া যুদ্ধক্ষেত্র
Published: 6th, August 2025 GMT
৫ আগস্ট সকালটা শুরু হয়েছিল অন্য সাধারণ দিনের মতোই। অথচ কয়েক ঘণ্টার ব্যবধানে সাভার ও আশুলিয়ার রাজপথ পরিণত হয় রণক্ষেত্রে। রক্তাক্ত হয় শত শত ছাত্র-জনতা। গুলিতে ঝাঁঝরা হয় মানুষের বুক, রাস্তায় পড়ে থাকে লাশ। সেই দিনের ভয়াবহতা আজও তাড়া করে বেড়ায় প্রত্যক্ষদর্শীদের।
দীর্ঘদিন ধরে কোটা সংস্কার ও এক দফা এক দাবির আন্দোলনে উত্তাল ছিল সাভার-আশুলিয়া। প্রতিদিনের মতো সেদিনও মাঠে নামে ছাত্র-জনতা। কিন্তু এবার প্রতিক্রিয়া ছিল আরও হিংস্র, আরও পৈশাচিক।
সকালে সাভার ও আশুলিয়ার গুরুত্বপূর্ণ মোড়গুলোতে সেনাবাহিনীর কাঁটাতারের ব্যারিকেড দেখা গেলেও তাতে দমে যায়নি মানুষ। ব্যারিকেড পেরিয়ে ঢাকামুখী মিছিল, বাইপাইলে জমায়েত, চারপাশে গুঞ্জন-সব মিলিয়ে তখনকার দৃশ্য ছিল অগ্নিগর্ভ।
এরমধ্যেই পুলিশের দিক থেকে ধেয়ে আসে গুলি। মুহূর্তেই ছড়িয়ে পড়ে উত্তেজনা। বিক্ষুব্ধ জনতা ট্রাফিক বক্সসহ বিভিন্ন স্থানে আগুন ধরিয়ে দেয়। বহু মানুষ গুলিবিদ্ধ হয়ে রাস্তায় লুটিয়ে পড়ে। হাসপাতালে নেওয়ার আগেই অনেকে প্রাণ হারান।
দুপুরে যখন ছাত্র-জনতা জানতে পারে, সেনাপ্রধান জাতির উদ্দেশে ভাষণ দিতে যাচ্ছেন- তখন পরিস্থিতি রূপ নেয় মুখোমুখি সংঘর্ষে। পুলিশের গুলির জবাবে ছাত্র-জনতা ইট-পাটকেল ছোঁড়ে। সেসময় রাস্তায় অন্তত ডজনখানেক লাশ পড়ে থাকতে দেখা যায়।
আশুলিয়া থানার সামনে বিকেলে নতুন করে ছড়ায় বিভীষিকা। প্রত্যক্ষদর্শীদের ভাষ্য অনুযায়ী, পুলিশের গুলিতে ছয়জন নিহত হন এবং তাদের মরদেহ একটি ভ্যানে তোলা হয়। পরে ভ্যানভর্তি সেই লাশের স্তুপে আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয়।
এই ঘটনার মধ্যে ছড়িয়ে পড়ে শেখ হাসিনার দেশত্যাগের খবর। মুহূর্তেই আনন্দ আর বিক্ষোভ মিলেমিশে সড়কে নামে বিজয় মিছিল। বাইপাইল হয়ে এগিয়ে যায় মিছিল, উদ্দেশ্য—থানা ঘেরাও।
পুলিশ আত্মসমর্পণ ঘোষণা দিলেও গুলি ছোড়া বন্ধ করেনি। সেনাবাহিনী গিয়ে কিছু পুলিশ সদস্যকে সরিয়ে নেয় ক্যান্টনমেন্টে। পরে থানা ভবনে আগুন দেওয়া হয়, লুটপাট করা হয় অস্ত্র ও বিভিন্ন মালামাল।
থানার পাশের ভবনে ছিলেন হৃদয় আহমেদ। দুপুরে হঠাৎ গোলমালের শব্দে বাইরে বেরিয়ে তিনি দেখেন, “অনেক পুলিশ দাঁড়িয়ে ছিল, সামনে যাকেই পাচ্ছিল গুলি করছিল।” পুলিশ তাকে বাসায় ফিরে যেতে বললেও দ্বিতীয় তলা থেকে তিনি দেখেছেন, কীভাবে “২০ থেকে ১৫ জন গুলিবিদ্ধ হয়ে রাস্তায় পড়ে ছিল।”
তিনি বলেন, “৫ আগস্ট দুপুর ১২টা-১টার দিকে থানায় হঠাৎ হইহুল্লোড় শুরু হয়ে হয়। এসময় বাসা থেকে বের হয়ে দেখি অনেক পুলিশ অস্ত্র নিয়ে থানার সামনে দাঁড়িয়ে আছে। ছাত্র-জনতার সঙ্গে মারমুখী পরিস্থিতি দেখতে পাই। যে সামনে আসছে তাকেই গুলি করছে।”
তিনি আরও বলেন, “একটু সামনে যেতেই দুই থেকে তিনজন পুলিশ আমাকে ধমক দিয়ে বাসার দিকে পাঠিয়ে দেয়। পরে বাসায় গিয়ে দুইতলা থেকে দেখতে পাই পুলিশ অনবরত গুলি করছে। যখন ছাত্র জনতা থানার দিকে অগ্রসর হয়, তখনই তাদের সরাসরি গুলি করে মেরে ফেলেছে। বিকেল সাড়ে ৩টার দিকে যখন ছাত্র-জনতা জেনে যায় শেখ হাসিনা পালিয়েছে, তখন বিধ্বংসী একটি রূপ থানার সামনে দেখতে পাই। ছাত্র-জনতা তখন চতুর্দিক দিয়ে ঘিরে ফেলে। তখন পুলিশ যার কাছে যে অস্ত্র ছিল, সেই অস্ত্র দিয়েই গুলিবর্ষণ করছিল। আমার চোখের সামনে ২০ থেকে ১৫ জন গুলিবিদ্ধ হয়ে পড়ে ছিল। তাদের মধ্যে অনেকেই মারা যায়।”
হৃদয় আহমেদ বলেন, “লাশে আগুন দেওয়ার ঘটনা সরাসরি দেখতে পাইনি। যখন অসংখ্য গুলির শব্দ শুনতে পাই, তখন দরজা বন্ধ করে ঘরের ভেতর আশ্রয় নেই। ছয় থেকে সাতটার দিকে বাসা থেকে বের হয়ে দেখি ছাত্র জনতা থানার ভেতরে প্রবেশ করেছে, অনেকে থানা লুটপাট শুরু করে। এসময় তো অসংখ্য লোক ছিল যে কারণে কাউকে চেনা সম্ভব হয়নি।”
তিনি বলেন, “থানা লুটপাট এরপর থানায় আগুন ধরিয়ে দেয় ছাত্র-জনতা। রাতে যখন সবকিছু শান্ত, তখন থানার ওপর থেকে নিচ পর্যন্ত সবকিছু লুটপাট করে নিয়ে যাচ্ছিল। থানার সামনে লাশ পড়েছিল, থানা থেকে একটু এগোতেই বাইপাইল কেন্দ্রীয় মসজিদের সামনে সাতটি লাশ দেখতে পাই। ফুট ওভারব্রিজে আরও দুটি লাশ ঝোলানো ছিল। সব মিলিয়ে ভয়ানক পরিস্থিতির মুখোমুখি আমরা। এরপর বেশ কিছুদিন আমরা ট্রমার মধ্যে ছিলাম।”
আন্দোলনের সামনের সারিতে ছিলেন মেহেদী হাসান। তিনি বলেন, “গত বছরের ৪ আগস্ট সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত ছাত্র-জনতার ওপর হামলা করে আওয়ামী লীগের সন্ত্রাসীরা। কিন্তু দুপুরের পর হাজার হাজার ছাত্র-জনতার মুখে তারা আর টিকতে পারেনি। তবে ৫ আগস্ট তারা পুলিশকে সহযোগিতা করতে থাকে।”
তিনি বলেন, “সরাসরি তাদের রাজপথে দেখা যায়নি। ৫ আগস্ট সকালে কোনো ঝামেলা হয়নি। কিন্তু বেলা গড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে পুলিশ সরাসরি ছাত্র-জনতাকে লক্ষ্য করে গুলি ছোড়ে। সেদিন গুলিবিদ্ধ শত শত লোক জনকে হাসপাতালে ফ্রি-তে নিয়ে যান রিকশাচালকরা।”
তিনি আরও বলেন, “যখন শেখ হাসিনা পালিয়ে যায়, তখন উল্লাসে ফেটে পড়ে ছাত্র-জনতা। আশুলিয়া থানার দিকে যেতে থাকে তারা। এসময় পুলিশ ছাত্র-জনতাকে লক্ষ্য করে আবারও গুলি ছোড়ে। লাশ নিশ্চিহ্ন করতে ভ্যানে তুলে পুড়িয়ে দেওয়া হয়। ছাত্র-জনতার ক্ষোভ আরও বাড়ে। তারা থানার চারপাশ দিয়ে ঘিরে ফেলে। এমন সময় পুলিশ আত্মসমর্পণ করে মাইকে ঘোষণা দেয়। তখন ছাত্র-জনতা কিছুটা শান্ত হলে আবারও গুলি ছোড়ে পুলিশ। এবার আত্মসমর্পণেও আর ছাড় না দিয়ে পুলিশের ওপর আক্রমণ করার চেষ্টা করে। পুলিশ গুলি চালাতেই থাকে।”
মেহেদী হাসান বলেন, “আন্দোলন শেষে সন্ধ্যার পরও রাস্তাঘাটে আনন্দ উল্লাস করছিল জনতা। থানার সামনে গিয়ে দেখি থানা ভাঙচুর লুটপাট চলছে। চারদিকে আগুন, থানায় আগুন, যেখানে সেখানে লাশ পড়ে আছে। পরিস্থিতিটা খুবই ভয়ানক ছিল। আমাদের এলাকার মধ্যে বিভিন্ন স্থানে আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয়েছিল। আমরা আগুন নেভানোর চেষ্টা করছিলাম। কোনো সিলিন্ডার যেন বিস্ফোরণ না হয়, এমনকি এই আগুন যেন বসতবাড়ি পর্যন্ত না ছড়ায় সেই চেষ্টাটাই করছিলাম আমরা।”
তিনি বলেন, “থানা থেকে অনেকেই অস্ত্র লুট করে নিয়ে যায়। পরে সেনাবাহিনী এলাকায় মাইকিং করে অস্ত্র জমা দেওয়ার বিষয়ে জানালে অনেকেই অস্ত্র জমা দেয়। ৬ আগস্ট দেখলাম থানার সামনে লাশ পড়ে আছে, ফুট ওভারব্রিজে পায়ে কিছু একটা দিয়ে বেঁধে দুটি লাশ ঝুলিয়ে রাখা হয়েছে। এই দুটি লাশ ছিল পুলিশ সদস্যের।”
শহীদ আস-সাবুরের মা বলেন, “আন্দোলনে আমার ছেলেকে গুলি করে হত্যা করা হয়েছে। কী নির্মমভাবে হত্যা করা হয়েছে তাকে! প্রথমে গুলি করে হত্যা পরে লাশে আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দেওয়া হয়। এত বড় নির্মমতা, তারা লাশের সঙ্গেও পৈশাচিক বর্বরতা চালিয়েছে। আওয়ামী লীগের জড়িত সব নেতাকর্মীসহ শেখ হাসিনাকে দেশে ফিরিয়ে এনে তার শাস্তি দাবি করছি।”
ঢাকা জেলার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার শাহীনুর কবির বলেন, “গণঅভ্যুত্থানে সাভার ও আশুলিয়ায় সব চেয়ে বেশি ম্যাসাকার হয়েছে। এখন পর্যন্ত সাভার এবং আশুলিয়া থানা মিলে হত্যা মামলাসহ ১২৫টি মামলা দায়ের হয়েছে। এসব মামলায় আসামি ১০ হাজারেরও বেশি।”
তিনি বলেন, “এই মামলাগুলো আমরা সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে আসামিদের গ্রেপ্তার, লাশ উত্তোলনের যেসব প্রক্রিয়া ছিল সেসবও শেষ হয়েছে। চার্জশিট প্রস্তুত করার জন্য যেসব প্রক্রিয়া থাকে, এছাড়া অন্যান্য যে প্রক্রিয়া রয়েছে সবই মোটামুটি সম্পন্ন হয়েছে। শিগগিরই আমরা আদালতে চার্জশিট দেওয়া শুরু করব।”
ঢাকা/এস
.উৎস: Risingbd
কীওয়ার্ড: চ কর চ কর ছ ত র জনত র থ ন র স মন পর স থ ত ৫ আগস ট ল টপ ট করছ ল
এছাড়াও পড়ুন:
বন্দরে ছোট ভাইয়ের স্ত্রীকে হত্যার পর থানায় যুবকের আত্মসমর্পণ
নারায়ণগঞ্জের বন্দরে ছোট ভাইয়ের স্ত্রী নদী আক্তার ওরফে নীলা (২৫) কে কুপিয়ে হত্যার পর থানায় আত্মসমর্পণ করেছেন ভাসুর রবিউল হাসান আবির (৩০)। রোববার (৩ আগস্ট) সকালে উপজেলা কুশিয়ারা এলাকায় এ ঘটনা ঘটে।
নিহত গৃহবধূ নদী আক্তার নীলা মুন্সিগঞ্জ জেলার সদর থানার ইদ্রাকপুর এলাকার শাহজাহান দেওয়ানের মেয়ে ও কুশিয়ারা এলাকার প্রবাসী রাসেল মিয়ার স্ত্রী। অভিযুক্ত রবিউল হাসান আবির ওই এলাকার মৃত আবুল হোসেনের ছেলে।
এদিকে এ হত্যাকান্ডের ঘটনার পর বন্দর থানার উপ পরিদর্শক কামরুজ্জামানসহ সঙ্গীয় ফোর্স দ্রুত ঘটনাস্থলে এসে গৃহবধূর মৃতদেহ উদ্ধার করে ময়না তদন্তের জন্য নারায়ণগঞ্জ জেনারেল হাসপাতাল মর্গে প্রেরণ করেন।
এলাকাবাসী ও বিভিন্ন তথ্য সূত্রে জানা গেছে, নিহত গৃহবধূ নদী আক্তারের পূর্বে ৩টি বিয়ে হয়ে ছিল। কুশিয়ারা এলাকার প্রবাসী রাসেল ছিল তার ৪ নাম্বার স্বামী।
এদিকে ঘাতক রবিউল হাসান ওরফে আবিরের মা বেশ কিছু দিন পূর্বে ব্যবসার জন্য ব্রাক ব্যাংক থেকে ৪ লাখ টাকা উত্তেলন করে তার ছোট ছেলে রাসেল ও তার স্ত্রী নদী আক্তারের হাতে তুলে দেন। কিন্তু রাসেল ঋণ পরিশোধ না করে প্রবাসে পাড়ি জমায়।
এ ঘটনায় ব্রাক ব্যাংক কর্তৃপক্ষ জিম্মাদার ভাসুর রবিউল হাসান আবিরকে টাকা পরিশোধের জন্য চাপসৃষ্টি করে। এ নিয়ে ছোট ভাইয়ের স্ত্রী নদী আক্তারের সাথে ভাসুর রবিউল হাসান আবির সাথে বিরোধ সৃষ্টি হয়।
এর জের ধরে রোববার সকাল ৭টায় ভাসুর রবিউল হাসান আবির তার ছোট ভাইয়ের স্ত্রী নদী আক্তারকে বাসা থেকে ডেকে নিয়ে কুশিয়ারা এলাকার একটি নির্জন বিলে নিয়ে এলোপাতাড়ি ভাবে কুপিয়ে হত্যা করে পালিয়ে যায়।
হত্যকান্ডের ২ ঘন্টা পর সকাল ৯টায় ভাসুর রবিউল হত্যাকান্ডের ব্যবহৃত ধারালো অস্ত্র নিয়ে বন্দর থানায় এসে আত্মসমর্পণ করে।
বিষয়টি নিশ্চিত করেন বন্দর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) লিয়াকত আলী বলেন, মরদেহের ময়না তদন্তের জন্য মর্গে প্রেরণ করা হয়েছে। এ ঘটনায় থানায় হত্যা মামলা দায়েরের প্রস্তুতি চলছে।