দেশে সোনার দাম কীভাবে ঠিক হয়, কেন ভারত ও দুবাইয়ের চেয়ে দাম বেশি
Published: 23rd, October 2025 GMT
সোনার ভরি এখন দুই লাখ টাকা ছাড়িয়ে সোয়া দুই লাখের পথে। বাজারে সোনার দর এই পর্যায়ে যেতে পারে, তা ছয় মাস আগেও কেউ কল্পনা করেনি। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে, সোনা এখন অন্য যেকোনো সময়ের তুলনায় দামি ধাতু। ফলে এক রতি সোনার দাম দাঁড়িয়েছে ২ হাজার ২৬৪ টাকা।
সোনা দামি থেকে অতি দামি হয়ে উঠলেও বাংলাদেশে ধাতুটির দর নির্ধারণের প্রক্রিয়া পুরোপুরি স্বচ্ছ নয়। এ জন্য দেশে বৈধভাবে সোনা আমদানির সুযোগ না থাকাকে বড় কারণ মনে করছেন জুয়েলারি ব্যবসায়ীরা।
দুবাই জুয়েলারি গ্রুপ নামে জুয়েলার্স সমিতির ওয়েবসাইটের তথ্যানুযায়ী, সংযুক্ত আরব আমিরাতের দুবাইয়ে গত বুধবার ভ্যাট ও মজুরি ছাড়া ২২ ক্যারেট মানের সোনার ভরির দাম ছিল ৫ হাজার ২৬৯ দিরহাম, যা বাংলাদেশি মুদ্রায় ১ লাখ ৭৫ হাজার ২৫৪ টাকা। অন্যদিকে পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতের বুলিয়ন অ্যান্ড জুয়েলার্স অ্যাসোসিয়েশনের ওয়েবসাইটে দেওয়া দর বলছে, দেশটিতে গতকাল বুধবার সোনার গয়নার প্রতি ভরির দাম ছিল ১ লাখ ৪১ হাজার ৫৩ রুপি। অর্থাৎ ১ লাখ ৯৬ হাজার ৬৩ টাকা।
বাংলাদেশ জুয়েলার্স সমিতির বেঁধে দেওয়া দাম অনুযায়ী, গতকাল দেশের বাজারে ভ্যাট ও মজুরি ছাড়া ২২ ক্যারেটের এক ভরি সোনার দাম ছিল ২ লাখ ১৭ হাজার ৩৮২ টাকা। তাতে দেখা যাচ্ছে, দুবাইয়ের তুলনায় দেশে এক ভরি সোনার দাম ৪২ হাজার ১২৮ টাকা বেশি। আর ভারতের তুলনায় দাম বেশি ২১ হাজার ৭ টাকা। অবশ্য বৈশ্বিক বাজারে সোনার দাম কমে যাওয়ায় আজ বৃহস্পতিবার থেকে দেশের বাজারে সোনার দাম ভরিতে ৮ হাজার ৩৮৬ টাকা কমছে। তাতে ২২ ক্যারেটের সোনার ভরি দাঁড়িয়েছে প্রায় ২ লাখ ৯ হাজার টাকা।
বাংলাদেশে বাণিজ্যিকভাবে সোনা আমদানি হয় না বললেই চলে। সোনা আসে বিদেশফেরত যাত্রীদের হাত ধরে। ‘যাত্রী (অপর্যটক) ব্যাগেজ (আমদানি) বিধিমালা, ২০১৬’ অনুযায়ী, একজন যাত্রী বিদেশ থেকে আসার সময় ভরিপ্রতি ৫ হাজার টাকা শুল্ক দিয়ে ১০ ভরির মতো (১১৭ গ্রাম) সোনা আনতে পারেন। ভরিপ্রতি ৫ হাজার টাকা শুল্ক আমলে নেওয়ার পরও দেখা যায়, বাংলাদেশে সোনার দাম বেশি। যদিও দেশে অবশ্য অবৈধ পথেই বেশির ভাগ সোনা আসে বলে সন্দেহ করা হয়। এ ছাড়া চাহিদার বড় একটি অংশ পূরণ হয় পুরোনো সোনা দিয়ে।
বাংলাদেশে দীর্ঘদিন ধরে সোনার দাম নির্ধারণ করে আসছে বাংলাদেশ জুয়েলার্স সমিতি বা বাজুস। বৈশ্বিক বাজারে দাম বাড়লে বা কমলে সমিতির নেতারা তার ভিত্তিতে দর সমন্বয় করেন। তবে দাম বাড়ানোর আনুষ্ঠানিক ঘোষণায় সমিতির পক্ষ থেকে বলা হয়, স্থানীয় বাজারে তেজাবি সোনা বা পিওর গোল্ডের দাম বেড়েছে। তাই সমিতির সংশ্লিষ্ট কমিটির সদস্যরা দাম বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। দাম কমলেও একই কথা বলা হয়।
কীভাবে দাম নির্ধারণ হয়জুয়েলার্স সমিতির নেতারা সোনার দাম নির্ধারণ করলেও এ ক্ষেত্রে ভিত্তি ধরা হয় পুরান ঢাকার তাঁতীবাজারকেন্দ্রিক পাইকারি বাজারের সোনার দাম। এই দাম নির্ধারণ করে বাংলাদেশ পোদ্দার সমিতি, যা মূলত ব্যবসায়ী পর্যায়ে কেনাবেচা হয়ে থাকে।
একাধিক জুয়েলার্স ব্যবসায়ী জানান, পোদ্দার সমিতি প্রতিদিন বেলা তিনটার দিকে সোনার (পিওর গোল্ড) দাম নির্ধারণ করে। এ ক্ষেত্রে বাজারে ব্যাগজ রুলসে আসা সোনা ও সারা দেশ থেকে আসা পুরোনো অলংকারের সোনার সরবরাহের পরিমাণ বিবেচনায় নেওয়া হয়। একই সঙ্গে কলকাতায় সোনার দাম কত, সেটিও জেনে নেয়। তারপরই সোনার দাম হ্রাস-বৃদ্ধি করা হয়।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, সোনার দাম সমন্বয় করার জন্য জুয়েলার্স সমিতির একটি কমিটি রয়েছে, যার নাম—বাজুস স্ট্যান্ডিং কমিটি অন প্রাইসিং অ্যান্ড প্রাইস মনিটরিং। সোনার দাম সমন্বয়ে এই কমিটি প্রথমেই পোদ্দার সমিতির নির্ধারিত পাইকারি সোনার দর বিবেচনায় নেয়। যেমন ১৯ অক্টোবর জুয়েলার্স সমিতি সোনার দাম বাড়িয়েছে। সেদিন পাইকারি বাজারে প্রতি ভরি সোনার দাম ছিল ২ লাখ ২ হাজার টাকা। তার সঙ্গে জুয়েলারি ব্যবসায়ীদের জন্য ৫ হাজার টাকা মুনাফা যুক্ত করে ২১ ক্যারেটের দাম চূড়ান্ত করা হয়। একইভাবে অন্যান্য ক্যারেটের সোনার দাম নির্ধারণ করা হয়। ক্রেতারা দোকান থেকে অলংকার কিনতে গেলে সোনার দামের সঙ্গে ৫ শতাংশ ভ্যাট ও অলংকার তৈরির মজুরি যোগ হবে।
আগে জুয়েলার্স সমিতির কমিটি পাইকারি বাজারের সোনার (পিওর গোল্ড) দামের ১ দশমিক ২৫ গুণ করে সোনার দর নির্ধারণ করত। সোনার দাম বেড়ে যাওয়ার কারণে সেই ব্যবস্থা থেকে সরে এসেছে সমিতি। তার বদলে সোনার দামের বাইরে ভ্যাট ও অলংকার তৈরির মজুরি নেওয়ার বিষয়ে কড়াকড়ি আরোপ করেছে সমিতি।
জানতে চাইলে বাংলাদেশ পোদ্দার সমিতির সাধারণ সম্পাদক জয়নাল আবেদিন প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা আন্তর্জাতিক বাজারদর, তাঁতীবাজারে সোনার সরবরাহ ও পার্শ্ববর্তী দেশের দাম বিবেচনায় নিয়ে প্রতিদিন দাম নির্ধারণ করে থাকি।’ আন্তর্জাতিক বাজারের চেয়ে দাম বেশি কেন জানতে চাইলে তিনি বলেন, বিদেশ থেকে ব্যাগেজ রুলসে যাঁরা সোনা নিয়ে আসেন, তাঁরা মুনাফা করেন। পাইকারি ব্যবসায়ীদেরও মুনাফার বিষয় আছে। এরপর আবার জুয়েলার্স ব্যবসায়ীদের মুনাফা। এভাবে কয়েক ধাপে দাম কিছুটা বেড়ে যায় বলে মন্তব্য করেন তিনি।
দেশে সোনার ব্যবসায় স্বচ্ছতা আনতে ২০১৮ সালে স্বর্ণ নীতিমালা করেছিল বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। তারপর বাংলাদেশ ব্যাংক ২০১৯ সালের নভেম্বরে একটি ব্যাংকসহ ১৮টি প্রতিষ্ঠানকে বাণিজ্যিকভাবে সোনা আমদানির লাইসেন্স দেয়। পরে আরও একটি প্রতিষ্ঠান লাইসেন্স পায়। শুরুতে একাধিক প্রতিষ্ঠান কয়েকটি চালানে সোনা আমদানি করেছিল। পরে বৈদেশিক মুদ্রার সংকট, অনুমতি পেতে সময়ক্ষেপণ ও ভ্যাটের কারণে আমদানিতে আগ্রহ হারান ব্যবসায়ীরা।
দাম নির্ধারণ কতটা যৌক্তিকসোনা বেচাকেনায় বিভিন্ন দেশে ‘কমোডিটি এক্সচেঞ্জ’ চালু থাকলেও বাংলাদেশে নেই। কমোডিটি এক্সচেঞ্জ এমন একটি ব্যবস্থা, যেখানে শেয়ারের মতো পণ্য কেনাবেচা হয়। পণ্য সরাসরি নয়, কাগুজে বা ইলেকট্রনিক পদ্ধতিতে কেনাবেচা হয়। আর মূল পণ্য থাকে কোনো গুদামে বা মাঠে। সেখান থেকে একটি নির্দিষ্ট সময় পর এটির চূড়ান্ত নিষ্পত্তি বা হস্তান্তর হয়।
জুয়েলার্স ব্যবসায়ীরা বিভিন্ন সময় বলেছেন, বাংলাদেশ ব্যাংকের ব্যবস্থাপনায় সোনা কেনাবেচার ব্যবস্থা করলে জুয়েলার্স ব্যবসায়ীরা বৈশ্বিক দরের কাছাকাছি দরে সোনা কিনতে পারবেন। তখন ক্রেতারাও সেই সুবিধা পাবেন।
জানতে চাইলে বাংলাদেশ জুয়েলার্স সমিতির সাবেক সাধারণ সম্পাদক দেওয়ান আমিনুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, বর্তমান বাস্তবতায় যে পদ্ধতিতে সোনার দাম নির্ধারণ করা হচ্ছে, সেটিকে যৌক্তিক বলতে হবে। কারণ, যতক্ষণ দেশের অভ্যন্তরে প্রাতিষ্ঠানিকভাবে বৈশ্বিক দরে সোনা কেনা যাবে না, ততক্ষণ জুয়েলারি ব্যবসায়ীরাও সেই দামে দিতে পারবেন না। তা ছাড়া আপাতদৃষ্টে সোনার দাম বেশি মনে হলেও ক্রেতারাও কিন্তু যে দামে কিনছেন, সেই দামেই আবার বিক্রি করতে পারছেন।
বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের তথ্যানুযায়ী, দেশে বার্ষিক সোনার চাহিদা ২০ থেকে ৪০ টন। এর মধ্যে ১০ শতাংশ পুরোনো অলংকার থেকে পূরণ হয়। বাকিটা ব্যাগেজ রুলের আওতায় বিদেশ থেকে আসে। অবৈধভাবেও প্রচুর সোনা দেশে আসে।
জানতে চাইলে বেসরকারি গবেষণাপ্রতিষ্ঠান সিপিডির গবেষণা পরিচালক খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম প্রথম আলোকে বলেন, বাংলাদেশের বাজারে সোনার দামের ওঠানামার সঙ্গে বৈশ্বিক বাজারের সম্পর্ক দুর্বল। ধাতুটির মূল্য নির্ধারণের প্রক্রিয়া ত্রুটিপূর্ণ। জুয়েলার্স সমিতি বলে, সোনার দাম নির্ধারণে তারা একটি ফর্মুলা মেনে চলে। তবে সেই ফর্মুলা তারা প্রকাশ করে না। সোনার দাম নির্ধারণের ক্ষেত্রে কার কাছে বেশি মজুত আছে, কতটুকু সোনা বেচাকেনা হয়, আনুষ্ঠানিকভাবে কতটুকু সোনা আসছে, সেগুলো বিবেচনায় নেওয়ার কথা বলা হলেও তা জানা যায় না।
খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম আরও বলেন, সোনার মূল্য নির্ধারণের ক্ষেত্রে প্রতিযোগিতামূলকভাবে কাজটি করা হয় না। সে জন্য প্রতিযোগিতা কমিশন ও ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর সোনার মূল্য নির্ধারণের বিষয়টি খতিয়ে দেখতে পারে বলে মন্তব্য করেন তিনি।
.উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: জ য় ল র স ব যবস য় ব যবস য় র ব যবস থ অল ক র প রথম আমদ ন
এছাড়াও পড়ুন:
যৌনকর্মীদের কাছে কনডম নেই, এইচআইভি সংক্রমণের ঝুঁকি
যশোরের বাবুবাজার যৌনপল্লিতে প্রায় ১৫ বছর ধরে আছেন যৌনকর্মী আশা (ছদ্মনাম)। স্বাস্থ্য সুরক্ষায় কনডমের ব্যবহার সম্পর্কে তাঁর স্পষ্ট ধারণা আছে। তবে ধারণা থাকলে কী হবে, সেই সুরক্ষাসামগ্রী এখন আর বিনা পয়সায় পাচ্ছেন না তিনি। বছর দুয়েক হলো এ সমস্যা। এখন কনডমের সংকট চরমে, জানান আশা।
যৌনপল্লিতে এখন খদ্দের অনেক কম বলে জানান তিনি। এরপর শুরু হয়েছে কনডমের সংকট। আশার কথা, ‘নিজির টাকায় কনডম কিনতি হয় বাইরের দোকান থেইকে। অনেক দাম দিতি হয়। কাস্টমারের বেশির ভাগই কনডম আনে না। আর আমার ঘরে কনডম না থাকলি কাস্টমার চলি যায়। কী আর করব, খাবার জোটাই মুশকিল। এখন কনডম কিনতি খরচ বেশি।’
খদ্দেরদের কাছে যদি কনডম না থাকে তখন এটা ছাড়াই যৌনকাজ করতে হয় বলে জানান আশা।
আশার মতো দেশের লক্ষাধিক যৌনকর্মী সুরক্ষা বা কনডমের স্বল্পতায় ঝুঁকির মধ্যে পড়েছেন। এদিকে দেশে প্রতিবছর যৌনবাহিত রোগ এইডসে আক্রান্ত ও মৃত্যুর সংখ্যা বাড়ছে। এই বাবুবাজার যৌনপল্লিতেই চলতি বছর একাধিক যৌনরোগবাহিত নারী যৌনকর্মীর সন্ধান পাওয়া গেছে বলে জানিয়েছেন সেখানকার এক স্বাস্থ্যকর্মী।
গত সোমবার (১ ডিসেম্বর) পালিত হয়েছে বিশ্ব এইডস দিবস। চলতি বছর দিনটির প্রতিপাদ্য ছিল, ‘চ্যালেঞ্জ পেরিয়ে, নতুনভাবে এইডস প্রতিরোধ গড়ে তোলা।’
নতুনভাবে এইডসের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলার কথা বললেও, সুরক্ষাসামগ্রীর অভাব এই রোগের ঝুঁকিতে থাকা লক্ষাধিক যৌনকর্মীকে নতুন চ্যালেঞ্জের মুখে ফেলেছে। যৌনকর্মী, বিভিন্ন সংগঠন এবং বিশেষজ্ঞদের কথা, যৌনপল্লি এবং ভাসমান যৌনকর্মীদের সুরক্ষাসামগ্রী দেওয়ার কাজটি মূলত বেসরকারি সংগঠনগুলোই করত। মূলত এইচআইভি থেকে সুরক্ষায় এই কনডম দেওয়া হতো। এখন এ খাতে বিশেষত বৈদেশিক সহযোগিতা একেবারেই কমে গেছে। আর তাতে বাড়ছে এই নারীদের ঝুঁকি।
বাড়ছে এইডস রোগ
চলতি বছর এখন পর্যন্ত বাংলাদেশে ১ হাজার ৮৯১ জন এইডস রোগের ভাইরাস এইচআইভিতে সংক্রমিত হয়েছেন। একই সময়ে দেশে এইডসে মারা গেছেন ২১৯ জন। গতকাল বিশ্ব এইডস দিবস উপলক্ষে রাজধানীতে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের জাতীয় এইডস ও এসটিডি নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচি আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে এ তথ্য জানা যায়।
এ সময় আরও বলা হয়, মিয়ানমার থেকে বাস্তুচ্যুত হয়ে বাংলাদেশে আসা রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর মধ্যে এ বছর ২১৭ জন এইচআইভিতে সংক্রমিত হয়েছেন। আর দেশে এখন এইচআইভিতে সংক্রমিত ব্যক্তির মোট অনুমিত সংখ্যা ১৭ হাজার ৪৮০। বাংলাদেশে ১৯৮৯ সালে প্রথম এইচআইভি (এইডসের ভাইরাস) পজিটিভ ব্যক্তি শনাক্ত হন। এরপর প্রতিবছর এইডসে আক্রান্ত ব্যক্তি পাওয়া গেছে। দু-এক বছর এইডসে আক্রান্ত ব্যক্তির সংখ্যা কমে গেলেও বেড়ে যাওয়ার প্রবণতাই ছিল বেশি। গত বছর (২০২৩ সালের নভেম্বর থেকে ২০২৪ সালের অক্টোবর পর্যন্ত) ১ হাজার ৪৩৮ জন নতুন করে সংক্রমিত হন। এ সময় এইডসে মারা যান ১৯৫ জন।
সরকারি হিসাব অনুযায়ী, গত এক বছরে আক্রান্তদের মধ্যে ৫২ শতাংশের বেশি বিবাহিত। আক্রান্তদের মধ্যে ৮১ শতাংশ পুরুষ।
দেশের সবচেয়ে বড় যৌনপল্লি রাজবাড়ীর দৌলতদিয়ায়। সেখানকার যৌনকর্মী মালিহা (ছদ্মনাম) দুই বছর ধরে এ পাড়ায় আছেন। এখানে আসার পর বিনা মূল্যে কনডম পেলেও এখন একেবারেই সেই সরবরাহ নেই বলে জানান তিনি।যৌন রোগ বাড়ছে
যশোরের বাবুবাজার যৌনপল্লিতে পিএসটিসি নামের একটি সংগঠন যৌনকর্মীদের স্বাস্থ্য সহায়তা দেয়। তবে তাঁদের কনডম দেওয়ার কর্মসূচি এখন আর নেই। এ সংগঠনের কর্মী সালমা খাতুন জানিয়েছেন, যৌনকর্মীদের মধ্যে কনডম বিতরণের কর্মসূচি এখন প্রায় বন্ধ হয়ে যাওয়ায় নানা ঝুঁকি তৈরি হচ্ছে। এতে মেয়েরা নানা রোগ এবং গর্ভধারণের শিকার হচ্ছে।
চলতি বছর এ যৌনপল্লিতে ছয়জন নারী সিফিলিসে আক্রান্ত হয়েছে বলে জানান সালমা। গর্ভধারণ ও গর্ভপাতের সংখ্যা ছয়। তিনি বলেন, ‘আগের বছর এ রকম কেস পাইনি। তবে এ বছর রোগ বাড়তিছে মেয়েদের মধ্যে।’
আগে পাড়াগুলোতে এনজিওদের কাজ ছিল। এখন তো কোনো কাজই নেই। মেয়েগুলো অসহায়। কনডম না থাকার কারণে বড় ঝুঁকি আছে।মোর্চা সেক্স ওয়ার্কার্স নেটওয়ার্কের সভাপতি নূর নাহারদেশের সবচেয়ে বড় যৌনপল্লি রাজবাড়ীর দৌলতদিয়ায়। সেখানকার যৌনকর্মী মালিহা (ছদ্মনাম) দুই বছর ধরে এ পাড়ায় আছেন। এখানে আসার পর বিনা মূল্যে কনডম পেলেও এখন একেবারেই সেই সরবরাহ নেই বলে জানান তিনি।
দেশের যৌনকর্মীদের সংগঠনগুলোর মোর্চা সেক্স ওয়ার্কার্স নেটওয়ার্কের হিসাব অনুযায়ী, দেশের ১১টি যৌনপল্লিতে ৪ হাজার ৫৩১ জন যৌনকর্মী আছেন। নেটওয়ার্কের সভাপতি নূর নাহার (রানু)। প্রথম আলোকে বলছিলেন, ‘আগে পাড়াগুলোতে এনজিওদের কাজ ছিল। এখন তো কোনো কাজই নেই। মেয়েগুলো অসহায়। কনডম না থাকার কারণে বড় ঝুঁকি আছে।’
ভাসমান যৌনকর্মীদের নিয়ে বড় ঝুঁকি
সেক্স ওয়ার্কার্স নেটওয়ার্ক বাংলাদেশের তথ্য অনুযায়ী, দেশে এখন ১ লাখ ২০ হাজারের বেশি যৌনকর্মী আছে ভাসমান। কনডমের সরবরাহ কমে যাওয়ায় যৌনপল্লিগুলোর চেয়ে এই ভাসমান যৌনকর্মীরা অনেক বেশি ঝুঁকিতে আছেন বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।
কনডম সরবরাহের হার এখন অনেক কমে গেছে। এখন হাতে গোনা কিছু প্রতিষ্ঠান সরবরাহ দেয়। আগে যেখানে মেয়েরা ১০টি কনডম পেত, সেখানে এখন বড়জোর ৩টি পায়।কল্যাণময়ী নারী সংঘের সভাপতি রীনা বেগমরাজধানীর যাত্রাবাড়ী এলাকায় যৌনকাজ করেন মর্জিনা (ছদ্মনাম)। তিনি বলছিলেন, ‘এখন চেয়েচিন্তে কনডম নেওয়া লাগে। রাস্তার লোক তো কনডম রাহে না। আমাদেরই রাকতে অয়। কিন্তু আমরা কিনে কিনে কত দিন চালাব?’
ঢাকার ভাসমান যৌনকর্মীদের নিয়ে কাজ করে কল্যাণময়ী নারী সংঘ। এ সংগঠনের সভাপতি রীনা বেগম বলছিলেন, ‘কনডম সরবরাহের হার এখন অনেক কমে গেছে। এখন হাতে গোনা কিছু প্রতিষ্ঠান সরবরাহ দেয়। আগে যেখানে মেয়েরা ১০টি কনডম পেত, সেখানে এখন বড়জোর ৩টি পায়।’
এইচআইভি থেকে সুরক্ষায় কমছে সহায়তা
জাতীয় পর্যায়ের তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশ সামগ্রিকভাবে এখনো নিম্ন বিস্তৃতির দেশ হলেও গত কয়েক বছরে নতুন সংক্রমণ বাড়ছে। ঝুঁকিপূর্ণ জনগোষ্ঠী—যার একটি অংশ যৌনকর্মী ও তাঁদের খদ্দের—তাঁদের মধ্যে সুরক্ষাহীন যৌন সম্পর্কই সংক্রমণ বৃদ্ধির সবচেয়ে বড় কারণ হিসেবে দেখছেন বিশেষজ্ঞরা। এইচআইভি বাড়লেও এ খাতে দেশে দাতাদের সহায়তা কমছে ব্যাপক হারে। এ চিত্র শুধু বাংলাদেশের না।
বিশ্ব এইডস দিবস উপলক্ষে ইউএনএইডসের ‘ওভারকামিং ডিসরাপশন: ট্রান্সফরমিং দ্য এইডস রেসপন্স’ নামের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, আন্তর্জাতিক স্তরে এইচআইভি খাতে সহায়তা কমে যাওয়ায় মারাত্মক প্রভাব পড়ছে। জাতীয় এইডস ব্যয় মূল্যায়ন সম্পন্ন করা আটটি দেশের (বাংলাদেশ, বেলিজ, বেনিন, কোত দিভোয়ার, মোজাম্বিক, নাইজেরিয়া, পাকিস্তান, পাপুয়া নিউগিনি) তথ্য বলছে—বিভিন্ন বেসরকারি সংগঠন এ খাতে ৯৯ শতাংশ অর্থসহায়তা পায় দাতাদের কাছে থেকে। দেশের নিজস্ব উৎস থেকে পাওয়া সহায়তা মোট ব্যয়ের শূন্য দশমিক ১ শতাংশেরও কম।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের উপপরিচালক জুবাইদা নাসরিন বলেন, ‘যৌনপল্লিগুলোতে কনডম সরবরাহ কমে গেছে, তা জানি। এর মূল কারণ ইউএসএইডসহ দাতারা এ খাতে যে অর্থ দিতেন তা কমে গেছে। আমরা কিছু দাতা সংস্থার সঙ্গে কথা বলেছি এ খাতে এগিয়ে আসতে।’
সরকারের পক্ষ থেকে কনডম বা লুব্রিকেন্টের যে সরবরাহ তাতে ঘাটতি নেই। যৌনপল্লি বা ভাসমানদের মধ্যে কনডমের সংকটের কথাটা শুনলাম।স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পরিচালক (এইচআইভি/এসটিডি) মো. খায়রুজ্জমানস্বাস্থ্য অধিদপ্তর থেকে জানানো হয়, দেশের ৩১টি ড্রপ-ইন সেন্টার থেকে নিয়মিত কনডমসহ প্রয়োজনীয় উপকরণ সরবরাহ করা হয়। তারা যৌনপল্লিতে সরবরাহের কাজ করে না। এটা কখনোই করা হতো না বলে জানান স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পরিচালক (এইচআইভি/এসটিডি) মো. খায়রুজ্জমান। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, সরকারের পক্ষ থেকে কনডম বা লুব্রিকেন্টের যে সরবরাহ তাতে ঘাটতি নেই। যৌনপল্লি বা ভাসমানদের মধ্যে কনডমের সংকটের কথাটা শুনলাম।
এইচআইভি ও এইডস প্রতিরোধে বৈশ্বিক সহায়তা কমে যাওয়ার কারণেই যৌনকর্মীদের স্বাস্থ্য সুরক্ষার বিষয়টি অনেক বেশি উপক্ষিত এখন। এ ক্ষেত্রে সরকারের মনোযোগী হওয়াটা দরকার বলে মনে করেন গবেষক ডি এম অহিদুল ইসলাম। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, এইচআইভি–সংক্রান্ত কাজে গুরুত্ব ও অর্থায়ন নিশ্চিত করা অত্যন্ত জরুরি। তরুণ এবং ঝুঁকিপূর্ণ জনগোষ্ঠীর মধ্যে নতুন সংক্রমণ বাড়ায় বাংলাদেশকে তার প্রতিরোধ ও চিকিৎসা কৌশল পুনর্মূল্যায়ন করতে হবে।