সংরক্ষিত নারী আসনে সরাসরি ভোটে বাধা রাজনৈতিক দলগুলো
Published: 9th, August 2025 GMT
নির্বাচন কমিশন, খান ফাউন্ডেশনের ‘‘এমপাওয়ারিং উইমেন থ্রু রির্জাভড সিট ইন পার্লামেন্ট: ফাইট অর ফ্লাইট রেসপন্স?’ (সংসদে সংরক্ষিত আসনের মাধ্যমে নারীর ক্ষমতায়ণ: লড়াই নাকি পালানোর প্রবণতা?’ শিরোনামের গবেষণা প্রতিবেদন, ডেমোক্রেসি ইন্টারন্যাশনালের বিভিন্ন নিউজ লেটার ও প্রথম আলোর নিজস্ব প্রতিবেদন থেকে দেখা যায়, ১৯৭৩-১৯৭৫ মেয়াদের প্রথম জাতীয় সংসদে ১৫টি সংরক্ষিত আসনের প্রতিনিধিরাই ছিলেন সংসদের নারী প্রতিনিধিত্ব। ১৯৭৯-১৯৮২ মেয়াদে দ্বিতীয় সংসদে ২ জন নির্বাচিত ও ৩০টি নারী আসন মিলিয়ে মোট ৩২ জন নারী সংসদ সদস্য ছিলেন। ১৯৮৮-৯০ মেয়াদে চতুর্থ সংসদে সংরক্ষিত আসন ছিল না। ৪ জন নির্বাচিত প্রতিনিধি ছিলেন। ১৯৯১-১৯৯৫ মেয়াদে পঞ্চম সংসদে ৫ জন নির্বাচিত সহ ৩৫ জন নারী সংসদ সদস্য ছিলেন। ১৯৯৬ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে বিএনপির এক তরফা ষষ্ঠ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ৩ জন নারী সরাসরি নির্বাচিত হন। ৩০টি সংরক্ষিত আসন ছিল। ওই নির্বাচনটি বাতিল হয়ে ওই বছরের জুন মাসে (১৯৯৬-২০০১ মেয়াদে) ৭ম সংসদ নির্বাচন হয়। ওই নির্বাচনে সরাসরি নির্বাচিত ৮ নারীসহ মোট নারী প্রতিনিধি ছিলেন ৩৮ জন। ২০০১-২০০৬ মেয়াদে অষ্টম জাতীয় নির্বাচনে ৭টি আসনে সরাসরি ও ৪৫টি সংরক্ষিত আসনসহ মোট ৫২ জন নারী সংসদ সদস্য হন। ২০০৯-২০১৩ মেয়াদের নবম জাতীয় সংসদে ২১ জন নারী সরাসরি নির্বাচিত হন। তবে সুনামগঞ্জ-৪ আসনের মমতাজ ইকবাল মারা গেলে ওই আসনের উপ নির্বাচনে পুরুষ নির্বাচিত হন। ওই মেয়াদে নারী আসন বাড়িয়ে ৫০টি করা হয়। মোট নারী সংসদ সদস্য হন ৭০ জন। আওয়ামী লীগের আমলে ২০১৪, ২০১৮, ২০২৪ এর দশম, একাদশ ও দ্বাদশ নির্বাচন ছিল একতরফা ও বির্তকিত। দশম জাতীয় নির্বাচনে ১৮ জন সরাসরি সহ মোট নারী সংসদ সদস্য ছিলেন ৬৮ জন, ২০১৮ সালে ২৩ জন সরাসরি নির্বাচিতসহ মোট ৭৩ জন ও ২০২৪ সালে ১৯ জন সরাসরি নির্বাচিতসহ মোট ৬৯ জন নারী প্রতিনিধি ছিলেন।
দলগুলোর মনোভাবনারী আসন নিয়ে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের আলোচনায় বিএনপির প্রতিনিধিরা বলেছিলেন, সংরক্ষিত নারী আসন ১০০টিতে উন্নীত করতে হবে এবং আগের মতো করে সংসদ নির্বাচনে প্রাপ্ত আসনসংখ্যার ভিত্তিতে দলগুলোর মধ্যে এসব আসন বিতরণ করতে হবে।
জামায়াতে ইসলামীর প্রতিনিধিরা বলেছিলেন, তাঁরা পিআর (সংখ্যানুপাতিক) পদ্ধতিতে নির্বাচন হলে সংসদীয় আসন ৪০০টি এবং এর মধ্যে ১০০টি নারী আসনের বিষয়ে একমত।
জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) প্রতিনিধিরা ১০০ নারী আসনে সারসরি নির্বাচনের পক্ষে। তবে পরে তাঁরা নারী আসনের বিষয়ে একটি নতুন প্রস্তাব দিয়েছেন। সেখানে বলেছেন, প্রতিটি দল ১০-১৫ শতাংশ নারী প্রার্থী মনোনয়ন দেবে। তাতে ৩৫০-৪০০ নারী প্রার্থী পাওয়া যাবে। যাঁরা নির্বাচনে জয়ী হবেন, তাঁরা সংসদ সদস্য হবেন। আর যেসব নারী প্রার্থী পরাজিত হবেন, তাঁদের মধ্য থেকে সর্বোচ্চ ভোট পাওয়া ১০০ জন হবেন সংরক্ষিত নারী আসনের সদস্য।
অন্যদিকে নারীবিষয়ক সংস্কার কমিশনের প্রস্তাব ছিল, সংসদে আসনসংখ্যা বাড়িয়ে ৬০০ করা। এর মধ্যে ৩০০ আসন নারীর জন্য সংরক্ষিত রাখা। সেসব আসনে নারী প্রার্থীদের মধ্যে সরাসরি নির্বাচন হতে হবে। নারীবিষয়ক সংস্কার কমিশনের প্রতিবেদন পরে জমা হওয়ায় তাদের সুপারিশ কমিশনের টার্মস অব রেফারেন্স বা কাজের পরিধিতে অর্ন্তভুক্ত করা যায়নি বলে প্রথম আলোকে জানিয়েছেন ঐকমত্য কমিশনের সহসভাপতি অধ্যাপক আলী রীয়াজ। ফলে দলগুলোর সঙ্গে নারীবিষয়ক সংস্কার কমিশনের সুপারিশ নিয়ে কোনো আলোচনা হয়নি। আবার সংসদের আসনসংখ্যা বাড়িয়ে ৬০০ করা এবং এর মধ্যে ৩০০ আসন নারীর জন্য সংরক্ষিত রাখার প্রস্তাব দেশের বাস্তবতার সঙ্গে সংগতিপূর্ণ নয় বলেও বিভিন্ন দলের নেতারা মনে করেন।
এনসিপির জ্যেষ্ঠ যুগ্ম আহ্বায়ক সামান্তা শারমিন প্রথম আলোকে বলেন, নারী আসনের বিষয়ে কোনো সম্মানজনক উপায় বের হয়নি, এটা দুঃখজনক। নারী আসনে সরাসরি নির্বাচনব্যবস্থায় দলগুলোর অনাগ্রহের বড় কারণ হচ্ছে দীর্ঘদিনের অভ্যস্ততা। সংরক্ষিত আসনে সরাসরি নির্বাচনের ব্যবস্থা বা বেশিসংখ্যক নারীকে সরাসরি নির্বাচনে মনোনয়ন দেওয়া—বিষয়টি দেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতি নেই।
সামান্তা শারমিন বলেন, প্রচলিত রাজনৈতিক সংস্কৃতি হচ্ছে অস্ত্রের ঝনঝনানির মাধ্যমে, দুর্নীতি করে, প্রচুর অর্থ খরচ করে নির্বাচনে জিতে আসেন অনেকে। আরেকটি রাজনৈতিক সংস্কৃতি হচ্ছে পারিবারিক পৃষ্ঠপোষকতায় অনেক নারীকে সংরক্ষিত আসনে জায়গা দেওয়া হয়। রাজনীতিতে নারীর অংশগ্রহণ বাড়াতে হলে প্রচলিত রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে পরিবর্তন আনতে হবে।
নারীবিষয়ক সংস্কার কমিশনের প্রস্তাব ছিল, সংসদে আসনসংখ্যা বাড়িয়ে ৬০০ করা। এর মধ্যে ৩০০ আসন নারীর জন্য সংরক্ষিত রাখা। সেসব আসনে নারী প্রার্থীদের মধ্যে সরাসরি নির্বাচন হতে হবে।‘হ্যাঁ’ বা ‘না’ ভোটে সীমাবদ্ধজাতীয় সংসদে সংরক্ষিত আসনগুলোর নাম ‘সংরক্ষিত মহিলা আসন’। ১৯৭২ সালের সংবিধানে জাতীয় সংসদে নারীদের জন্য ১৫টি আসন সংরক্ষিত রাখা হয়। সংরক্ষিত আসনের সুবিধা প্রথমে ১০ বছরের জন্য রাখা হয়েছিল। পরে ১৯৭৮ সালে সংরক্ষিত আসনসংখ্যা বাড়িয়ে করা হয় ৩০। একই সঙ্গে ১০ বছরের মেয়াদ বাড়িয়ে ১৫ বছর করা হয়। ১৯৮৭ সালে সংরক্ষিত আসনের মেয়াদ শেষ হয়। ১৯৮৮ সালে চতুর্থ জাতীয় সংসদে সংরক্ষিত আসন ছিল না।
এরপর ১৯৯০ সালে ১০ বছরের জন্য সংরক্ষিত আসনব্যবস্থা ফিরিয়ে আনা হয়। মেয়াদ শেষ হয়ে যাওয়ায় ২০০১ সালে অষ্টম সংসদের শুরুতে সংরক্ষিত আসন ছিল না। পরে এই সংসদেই সংবিধানের ১৪তম সংশোধনীর (২০০৪ সালে) মাধ্যমে ১০ বছর মেয়াদে নারী আসনসংখ্যা বাড়িয়ে ৪৫ করা হয়। ওই সময় সংরক্ষিত আসনে নির্বাচনপদ্ধতিতে পরিবর্তন আনা হয়। সংসদে একটি রাজনৈতিক দলের কতজন প্রতিনিধিত্ব করছেন, সেই অনুপাতে ওই সংরক্ষিত আসনের কয়টি দল পাবে, তা নির্ধারিত হয়। দলগুলোর নির্বাচিত সংসদ সদস্যরা ভোট দিয়ে নিজ নিজ দলের সংরক্ষিত আসনের নারী সদস্যদের নির্বাচিত করেন। নবম সংসদে ২০১১ সালে সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে নারী আসনসংখ্যা বাড়িয়ে ৫০টি করা হয়।
এবার জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের আলোচনায় নারীর আসন নিয়ে পুরুষেরা সিদ্ধান্ত নিলেন। খুব হতাশ হয়েছি যে একটি নারীকে জোগাড় করা গেল না আলোচনায় নিয়ে যাওয়ার জন্য! এটাকে দলের ব্যর্থতা, নাকি নেতৃত্বের ব্যর্থতা বলব, বুঝতে পারছি না।রুমিন ফারহানা, সাবেক সংসদ সদস্য, বিএনপিআইন অনুযায়ী, সংরক্ষিত আসনের নারী সংসদ সদস্যরা নির্বাচিত সংসদ সদস্যদের মতোই মাসিক বেতন–ভাতা, শুল্কমুক্ত সুবিধায় গাড়ি কেনাসহ অন্যান্য সুযোগ–সুবিধা পান।
বিগত সময়ে সংরক্ষিত আসনে যাঁরা নারী সদস্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন, দু–একজন ব্যতিক্রম ছাড়া বেশির ভাগের ভূমিকা সংসদে ‘হ্যাঁ’ বা ‘না’ ভোটের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল। দলের প্রতি আনুগত থাকা, বিরাগভাজন না হয়ে পাঁচ বছর কাটিয়ে দেওয়া এবং ভবিষ্যতে আবারও মনোনীত হওয়ার সুযোগ খোলা রাখার জন্য বেশির ভাগ নারী সদস্য চুপ থাকাকেই ‘নিরাপদ’ বলে ভেবেছেন। এমনকি নারী নির্যাতনের আলোচিত ঘটনাতেও তাঁদের সংসদে খুব একটা সোচ্চার হতে দেখা যায়নি।
নারী আসনের বিষয়ে কোনো সম্মানজনক উপায় বের হয়নি, এটা দুঃখজনক। নারী আসনে সরাসরি নির্বাচনব্যবস্থায় দলগুলোর অনাগ্রহের বড় কারণ হচ্ছে দীর্ঘদিনের অভ্যস্ততা। সংরক্ষিত আসনে সরাসরি নির্বাচনের ব্যবস্থা বা বেশিসংখ্যক নারীকে সরাসরি নির্বাচনে মনোনয়ন দেওয়া—বিষয়টি দেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতি নেই।এনসিপির জ্যেষ্ঠ যুগ্ম আহ্বায়ক সামান্তা শারমিনএকাদশ সংসদে (২০১৮ মেয়াদে) সংরক্ষিত আসনে বিএনপি মনোনীত একমাত্র নারী সদস্য ছিলেন রুমিন ফারহানা। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ৫৩ বছর ধরে সময়ে–সময়ে নারী আসনসংখ্যা বাড়ানো হলো। কিন্তু নারী আসন কোনোভাবেই নারীর পথকে সুগম করেনি, প্রশস্ত করেনি। অনেক নেতা পরিবারের নারী সদস্যদের সেসব আসনে বসিয়ে সুবিধা দিয়েছেন। তিনি বলেন, ‘এবার জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের আলোচনায় নারীর আসন নিয়ে পুরুষেরা সিদ্ধান্ত নিলেন। খুব হতাশ হয়েছি যে একটি নারীকে জোগাড় করা গেল না আলোচনায় নিয়ে যাওয়ার জন্য! এটাকে দলের ব্যর্থতা, নাকি নেতৃত্বের ব্যর্থতা বলব, বুঝতে পারছি না।’
নারীর প্রশ্নে গোষ্ঠীস্বার্থ না দেখে নারীর স্বার্থ দেখতে রাজনৈতিক দলগুলোর প্রতি আহ্বান জানিয়ে আসছেন নারী অধিকার নিয়ে কাজ করা সংগঠনগুলো। তারা বলছে, জুলাইয়ে নারীরা ছিল সামনের সারিতে। এই নারীদের আর হারিয়ে যেতে দেওয়া যাবে না। সিদ্ধান্ত গ্রহণের জায়গায় নারীকে রাখতে হবে। নারী আসনে সরাসরি নির্বাচনের বিষয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর ওপর চাপ রাখতে হবে।
নারী আসন নিয়ে নারীদের ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া সম্পর্কে জানতে চাইলে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সহসভাপতি অধ্যাপক আলী রীয়াজ প্রথম আলোকে বলেন, সংসদে নারীদের জন্য আসন বাড়ানো ও সেসব আসনে সরাসরি নির্বাচন নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোকে বলা হলেও তারা তা শোনেনি। কমিশন রাজনৈতিক দলকে কোনো সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দিতে পারে না। নারী আসন নিয়ে নারীদের দাবি পূরণের আর সুযোগ আছে কি না, জানতে চাইলে তিনি বলেন, এ দাবি পূরণে এখন নাগরিক সমাজকে সক্রিয় হতে হবে।
.উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: র জন ত ক স স ক ত স রক ষ ত র খ সদস য ছ ল ন প রথম আল ক স সব আসন আসনস খ য প রস ত ব আসন ন য় সদস য হ ব যবস থ দলগ ল র ১০ বছর জন ন র র আল চ সহ ম ট বছর র ব এনপ
এছাড়াও পড়ুন:
ঐকমত্য না হলে দেশে টালমাটাল অবস্থা তৈরি হবে
জুলাই সনদের ধারণাটাই একটা অভিনব ধারণা। সেটাকে সংবিধানে সংযুক্ত করা, আইনি বাধ্যবাধকতা তৈরি করা—এগুলো একটা দীর্ঘ কাজের ব্যাপার, যা এর আগে বাংলাদেশে কখনো করা হয়নি। ফলে এই কাজে মতভিন্নতা স্বাভাবিক। তবে নাগরিক হিসেবে আমরা আশা করব, রাজনৈতিক দলগুলো প্রজ্ঞার পরিচয় দেবে। যতটুকু ছাড় দিলে কোনো দলের বড় কোনো মৌলিক ক্ষতি হয় না, তার বিনিময়ে যদি একটা বৃহত্তর ঐক্য হয়; সেটা তারা বিবেচনা করবে বলে আমরা মনে করি।
আমাদের প্রত্যাশা, জাতীয় স্বার্থে রাজনৈতিক দলগুলো প্রজ্ঞার পরিচয় দেবে, দল ও গোষ্ঠীর স্বার্থকে উপেক্ষা করে জাতীয় স্বার্থকে প্রাধান্য দিয়ে কতগুলো ন্যূনতম জায়গায় শিথিলভাবে হলেও তারা একমত হবে। ঐকমত্য হলে হয়তো ১০০–এর বদলে ৮০ বা ৬০ মেনে নিতে হবে। যদি ঐকমত্য না হয়, এমন সম্ভাবনা আছে যে সবারই ১০০–ই হারাতে হবে। দেশ আরেকবার অনিশ্চয়তার মধ্যে পড়ে যাবে, টালমাটাল অবস্থা তৈরি হবে।
আরও পড়ুনযেটা ৮ মাসে হয়নি, সেটা ৮ দিনের কম সময়ে কীভাবে হবে৮ মিনিট আগেগণভোট ও অধ্যাদেশ
গণভোট হয় আসলে নীতিনির্ধারণী বিষয়। ধরা যাক, আমরা জুলাই সনদের বাস্তবায়ন চাই কি না, নির্বাচিত সরকার এসে সনদের বাস্তবায়ন কত দিনের মধ্যে করবে—এ রকম নীতিনির্ধারণী দু–চারটি প্রশ্ন হলে গণভোট ঠিক আছে। কিন্তু যদি জুলাই সনদের এই ধারা–ওই ধারা নিয়ে প্রশ্ন থাকে বা প্রশ্ন দু–চারটির বেশি হয়, তখন সেটা একটা দুরূহ ব্যাপার হবে। গণভোটের প্রশ্নপত্রের আদলে ব্যালট তা কে বা কারা তৈরি করবেন, বিশেষজ্ঞরা নিশ্চয়ই ভেবেছেন।
এই মুহূর্তে অধ্যাদেশ জারি করে গণভোট দেওয়ার ক্ষেত্রে কিছু জটিলতা দেখা দিয়েছে। একটা পক্ষ বলছে, সনদে প্রধান উপদেষ্টা স্বাক্ষর করবেন। কিন্তু বিদ্যমান আইনি বাধ্যবাধকতা অনুযায়ী প্রধান উপদেষ্টা এটা পারবেন না। অধ্যাদেশ জারি করতে পারেন কেবল রাষ্ট্রপতি।
কিন্তু বর্তমান রাষ্ট্রপতি স্বৈরাচারের নিয়োগ দেওয়া এবং তাদের ধারা বহন করা ব্যক্তি। আবার এ কথাও সত্য যে এই রাষ্ট্রপতির কাছেই বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টা পরিষদকে শপথ নিতে হয়েছে। জুলাই গণ–অভ্যুত্থানের পর আমরা এমন কোনো বিপ্লবী সরকার গঠন করিনি, যারা এই সংবিধান রদ করেছে বা এই রাষ্ট্রপতিকে অস্বীকার করেছে।
এই রাষ্ট্রপতি যদি অধ্যাদেশ ঘোষণা করেন, জুলাইয়ে প্রাণ দেওয়া ও আত্মত্যাগকারী এবং তাঁদের পরিবার, স্বজন ও সংশ্লিষ্ট রাজনৈতিক পক্ষগুলোর জন্য এটা মেনে নেওয়া কঠিন। সব পক্ষের আলাপ–আলোচনার মধ্য দিয়ে এ বিষয়ে একটা পথ বের করতে হবে। এটা খুঁজে দেখা যেতে পারে, পৃথিবীতে কোথাও এমন কোনো দৃষ্টান্ত আছে কি না, যেখানে সাংবিধানিকভাবে রাষ্ট্রপতি ছাড়া অন্য কেউ অধ্যাদেশ জারি করেছেন। কিংবা এ–সংক্রান্ত এখতিয়ার রাষ্ট্রপতি কাউকে অর্পণ করতে পারেন কি না এবং তাঁর বদলে অন্য কেউ স্বাক্ষর করতে পারেন কি না।
তবে রাষ্ট্রপতির অধ্যাদেশ জারির বিষয়টাকে জনগণের ক্ষমতার কাছে বিগত রেজিমের লিগ্যাসি বহনকারী রাষ্ট্রপতির মাথা নোয়ানো হিসেবেও দেখা যেতে পারে।
দলগুলোর সহযোগিতা সরকারের লাগবে
নির্বাচন সুষ্ঠু করতে রাজনৈতিক দলগুলোর ঐকমত্য লাগবে। রাজনৈতিক দলগুলোর সক্রিয় সহযোগিতা সরকারের লাগবে। অন্তত একটা কার্যকর আলাপ–আলোচনা সরকারের সঙ্গে রাজনৈতিক দলগুলোর লাগবে।
মাঠে যে পুলিশ আছে, সেই পুলিশের ওপর এখনো জনগণের পুরোপুরি আস্থা নেই। পুলিশের মধ্যে বিগত রেজিমের অপচ্ছায়া আছে। সেই পুলিশ, সামরিক ও আধা সামরিক বাহিনীকে যখন মাঠে মোতায়েন করা হবে, ম্যাজিস্ট্রেসি পাওয়ার থাকবে কি না—এই প্রশ্নগুলো গুরুত্বপূর্ণ। এ ছাড়া দেশীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষকেরা যাতে নির্বাচনে অবাধে কাজ করতে পারেন, তা–ও নিশ্চিত করতে হবে।
একটা জাতীয় ঐকমত্য তৈরির ক্ষেত্রে যেন সরকার এখন থেকেই উদ্যোগী হয়—যাতে সব নাগরিক ভোটাধিকার প্রয়োগ করতে উদ্দীপ্ত হন। জনগণ যদি ভাবেন যে ভোটকেন্দ্রে গেলে গোলাগুলি হবে, তাহলে তাঁরা কেন্দ্রে যাবেন না। জনগণের মনে আস্থা, সাহস ও আত্মবিশ্বাস ফিরিয়ে আনতে সরকারকে কাজ করতে হবে। আমরা চাইব, সরকার সর্বতোভাবে একটা জবাবদিহিমূলক ও স্বচ্ছ নির্বাচনের ব্যবস্থা করবে।