মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প গর্ভবতী নারীদের জনপ্রিয় ব্যথানাশক ওষুধ টাইলেনল, যা প্যারাসিটামল নামেও পরিচিত, এড়িয়ে চলার আহ্বান জানিয়েছেন। তিনি বলেছেন, এই ওষুধটির সঙ্গে অটিজমের সম্পর্ক থাকতে পারে।

এদিকে, ট্রাম্পের এমন মন্তব্য চিকিৎসক ও বিজ্ঞানীদের তীব্র প্রতিক্রিয়ার মুখে পড়েছে। কারণ প্যারাসিটামলের সঙ্গে অটিজমের সংযোগ এখনও বৈজ্ঞানিকভাবে প্রমাণত নয়। 

আরো পড়ুন:

অধ্যাপক ইউনূস নিজের স্বার্থে পার্টিগুলোকে ব্যবহার করছেন, দাবি সামান্তার

নির্বাচনের জন্য দেশ প্রস্তুত: প্রধান উপদেষ্টা

মঙ্গলবার (২৩ সেপ্টেম্বর) এক প্রতিবেদনে এ তথ্য জানিয়েছে কাতারভিত্তিক সংবাদমাধ্যম আল-জাজিরা। 

প্রতিবেদনে বলা হয়, যুক্তরাষ্ট্রের ওষুধ নিয়ন্ত্রক সংস্থা (এফডিএ) সম্প্রতি ঘোষণা দেয় যে, প্যারাসিটামল জাতীয় ওষুধের প্যাকেজে এমন এক লেবেল যুক্ত করা হবে, যেখানে উল্লেখ থাকবে যে এই ওষুধ শিশুদের অটিজম ও অতি-চঞ্চলতা বা মনোযোগহীনতার (এডিএইচডি) ঝুঁকি বাড়াতে পারে। 

এই সতর্কবার্তার পরপরই ট্রাম্প হোয়াইট হাউজে এক সংবাদ সম্মেলনে বলেন, “টাইলেনল খাবেন না। খাবেন না। যেভাবেই হোক খাওয়া থেকে বিরত থাকুন।” তবে তিনি আরো বলেন, “কখনো কখনো হয়তো এই ওষুধ খেতে হতে পারে। তখন সেটা নিয়ে আপনাকেই সিদ্ধান্ত নিতে হবে।” 

ট্রাম্প শিশুদের ভ্যাকসিন দেওয়া নিয়েও সন্দেহ প্রকাশ করেছেন এবং পরামর্শ দিয়েছেন যে, হাম, মামস ও রুবেলার মতো টিকা একসঙ্গে না দিয়ে আলাদা আলাদা দেওয়া উচিত। এ প্রসঙ্গে মার্কিন প্রেসিডেন্ট বলেন, “আমার মতে, হাম, মামস ও রুবেলা- তিনটি টিকা আলাদাভাবে দেওয়া উচিত। এগুলো একসঙ্গে নিলে সমস্যা হতে পারে।”

এদিকে, ট্রাম্পের এমন বক্তব্যের নিন্দা জানিয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন চিকিৎসক সংগঠন। আমেরিকান একাডেমি অব পেডিয়াট্রিকস ও আমেরিকান কলেজ অব অবস্টেট্রিশিয়ানস অ্যান্ড গাইনোকোলজিস্টস দীর্ঘদিন ধরে প্যারাসিটামলকে গর্ভাবস্থায় নারীদের জন্য নিরাপদ ওষুধ হিসেবে সুপারিশ করে আসছে।

বিশ্বজুড়ে প্রায় অর্ধেক গর্ভবতী নারী ব্যথা কমানো বা জ্বর কমাতে প্যারাসিটামল সেবন করেন বলে ধারণা করা হয়।বিভিন্ন দেশে এই ওষুধ ডাইম্যান, প্যানাডল ও প্যানাম্যাক্সসহ নানা নামে বিক্রি হয়। গর্ভবতী নারী ও ভ্রূণ উভয়ের জন্যই জ্বর ঝুঁকিপূর্ণ হতে পারে।

আমেরিকান কলেজ অব অবস্টেট্রিশিয়ানস অ্যান্ড গাইনোকোলজিস্টসের প্রেসিডেন্ট স্টিভেন জে.

ফ্লেইশম্যান ট্রাম্পের মন্তব্যকে ‘দায়িত্বজ্ঞানহীন’ বলে আখ্যা দিয়েছেন। তিনি বলেন, ‘গর্ভাবস্থায় ওষুধ সেবনের সময় সম্ভাব্য ঝুঁকি এবং তার পাশাপাশি উপকারিতা দুটোই বিবেচনা করা গুরুত্বপূর্ণ। অসংখ্য গবেষণার ফলাফল বলছে, গর্ভবতী নারীদের সুস্থতায় অ্যাসিটামিনোফেন (প্যারাসিটামল) গুরুত্বপূর্ণ ও নিরাপদ ভূমিকা রাখে।”

যুক্তরাষ্ট্রে প্যারাসিটামল ‘অ্যাসিটামিনোফেন’ নামে পরিচিত। 

আল-জাজিরা জানিয়েছে, কিছু গবেষণায় প্যারাসিটামল ও অটিজমের মতো স্নায়বিক সমস্যার মধ্যে সম্পর্ক পাওয়া গেলেও, চিকিৎসা বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বড় আকারের ও শক্তিশালী গবেষণাগুলোতে এ ধরনের কোনো প্রমাণ পাওয়া যায়নি।

গত বছর দ্য জার্নাল অব আমেরিকান মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশনে সুইডেনের গবেষকদের বড় আকারের একটি গবেষণায় বলা হয়েছে, গর্ভাবস্থায় ব্যথানাশক ওষুধের সংস্পর্শে আসা শিশুদের সঙ্গে ব্যথানাশক ওষুধের সংস্পর্শে না আসা তাদের ভাইবোনদের তুলনা করার সময় কোনো পার্থক্য পাওয়া যায়নি।

 

নিউইয়র্ক বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্রসম্যান স্কুল অব মেডিসিনের বায়োএথিসিস্ট আর্থার ক্যাপলান ট্রাম্প প্রশাসনের পদক্ষেপগুলোকে জনস্বাস্থ্যের জন্য ‘অত্যন্ত নেতিবাচক’ বলে অভিহিত করেছেন। তিনি বলেন, ‘অটিজম নিয়ে ট্রাম্পের বক্তব্য সম্পূর্ণ ভুল তথ্য, প্রমাণের অভাব, বাজে পরামর্শ ও একটি ভুয়া ব্যাখ্যা।’ তিনি আরো বলেন, “মূলধারার চিকিৎসাবিদ্যা ট্রাম্পের এই মন্তব্য উপেক্ষা করবে। এখন যুক্তরাষ্ট্রে রোগীরা ফেডারেল বিজ্ঞানকে ভরসা করতে পারছেন না, বরং অন্য নির্ভরযোগ্য উৎসে তাকাতে হচ্ছে।”

অটিজম বিশেষজ্ঞ ও লস অ্যাঞ্জেলসের ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোরোগবিদ্যার অধ্যাপক ক্যাথেরিন লর্ড বলেন, “আমি মনে করি চিকিৎসক সমাজ দৃঢ়ভাবে একমত হবে যে, গর্ভাবস্থায় টাইলেনল (প্যারাসিটামল) অটিজমের কারণ হয় না। তবে গর্ভবতী নারীদেরকে ওষুধের বিষয়ে সবসময়ই সতর্ক থাকা উচিত।”

তিনি আরো বলেন, “কিন্তু এটাও বুঝতে হবে, গর্ভবতী নারীর উচ্চ জ্বর বা ব্যথা থাকা ভ্রণের জন্যও ভালো নয়, তাই তাদের চিকিৎসকের সঙ্গে পরামর্শ করা উচিত।”

এদিকে সোমবার ঘোষিত যুক্তরাষ্ট্রের ওষুধ নিয়ন্ত্রক সংস্থার (এফডিএ) নতুন নির্দেশিকায় বলা হয়েছে, কিছু গবেষণায় প্যারাসিটামল ব্যবহার ও অটিজমের মধ্যে ‘সম্পর্ক’ পাওয়া গেছে, বিশেষ করে যখন গর্ভাবস্থায় দীর্ঘ সময় ধরে এটি সেবন করা হয়।

তবে এফডিএ স্পষ্ট করেছে যে, এর কারণ বা যোগসূত্র এখনো নিশ্চিত নয় এবং বৈজ্ঞানিক সাহিত্যে এর বিপরীত ফলাফলও রয়েছে।

সংস্থাটি আরো বলেছে, ‘অ্যাসিটামিনোফেন (প্যারাসিটামল) গর্ভাবস্থায় জ্বর কমানোর জন্য অনুমোদিত একমাত্র ওভার-দ্য-কাউন্টার ওষুধ এবং গর্ভবতী নারীর উচ্চ জ্বর সন্তানের জন্য ঝুঁকি তৈরি করতে পারে।’

আমেরিকান একাডেমি অব পেডিয়াট্রিকস বলছে, অটিজমের কোনো একক কারণ জানা নেই। এটি জিনগত ও পরিবেশগত নানা উপাদানের মিলিত প্রভাবে ঘটে।

ঢাকা/ফিরোজ

উৎস: Risingbd

কীওয়ার্ড: চ কর চ কর য ক তর ষ ট র য ক তর ষ ট র আম র ক ন চ ক ৎসক র জন য

এছাড়াও পড়ুন:

মুসলিম বিশ্বে আধুনিকতার ধারণা এল যেভাবে

আধুনিকতা এসেছে যেন ঝড়ের মতো—শিল্পের উত্থান, যুক্তির জয়গান, ধর্মনিরপেক্ষ চিন্তা আর বিশ্বায়নের ঢেউ নিয়ে। এই পরিবর্তনের মধ্যে মুসলিম বিশ্ব দাঁড়িয়ে আছে এক ত্রিমুখী পথের সামনে: পুরোনো ঐতিহ্য ধরে রাখা, পশ্চিমের পথ অনুসরণ করা, নাকি ঐতিহ্যের আলোকে নতুন করে পথ খোঁজা।

এই লেখায় আমরা দেখব কীভাবে মুসলিম চিন্তাবিদেরা তাঁদের বিশ্বাসের জায়গা থেকে আধুনিক জীবনের প্রশ্নের উত্তর খুঁজেছেন এবং ঐতিহ্যকে নতুন রূপে ফিরিয়ে আনতে চেয়েছেন।

আধুনিকতার ঢেউ আর ঐতিহ্যের টানাপোড়েন

আধুনিকতা মানে পুরোনো জীবনযাত্রার সঙ্গে বিচ্ছেদ। এটি যুক্তি, ব্যক্তিস্বাধীনতা আর শিল্পের উন্নতিকে তুলে ধরে, কিন্তু প্রায়ই ধর্মীয় জীবনের পবিত্রতাকে দূরে ঠেলে দেয়।

সমাজবিজ্ঞানী ম্যাক্স ওয়েবার আধুনিকতাকে যুক্তির জয় আর মোহভঙ্গের গল্প বলেছেন, কার্ল মার্ক্স এতে দেখেছেন পুঁজিবাদের উত্থান, আর এমিল দুর্খাইম দেখেছেন শিল্পসমাজে ব্যক্তির নতুন জায়গা।

মুসলিম চিন্তাবিদদের সামনে দাঁড়িয়েছিল তিনটি পথ: ঐতিহ্যকে আঁকড়ে ধরা, পশ্চিমকে প্রত্যাখ্যান করা, নাকি ঐতিহ্যকে নতুন করে বোঝা।

মুসলিম বিশ্বে, যেখানে ধর্ম আর সম্প্রদায় জীবনের মূল ছিল, আধুনিকতার এই ধারণাগুলো যেন হৃদয়ে ধাক্কা দিয়েছে। ব্যক্তিস্বাধীনতা, অধিকার আর শাসনের নতুন ধারণা ঐতিহ্যের সঙ্গে মিলতে চায়নি।

তাই মুসলিম চিন্তাবিদদের সামনে দাঁড়িয়েছিল তিনটি পথ: ঐতিহ্যকে আঁকড়ে ধরা, পশ্চিমকে প্রত্যাখ্যান করা, নাকি ঐতিহ্যকে নতুন করে বোঝা। (মোহাম্মদ শাতাতু, ‘মডার্নিটি অ্যান্ড দ্য মুসলিম ওয়ার্ল্ড’, পৃ. ১৮, মরক্কো ওয়ার্ল্ড নিউজ, রাবাত, ২০২৫)

এই দ্বন্দ্ব মুসলিম হৃদয়ে গভীর প্রশ্ন জাগিয়েছে: কীভাবে আমরা আমাদের বিশ্বাস ধরে রাখব, অথচ নতুন দিনের সঙ্গে পা মেলাব? এই প্রশ্নের উত্তরে মুসলিম পণ্ডিতেরা পথ খুঁজেছেন—না পশ্চিমের অন্ধ অনুকরণে, না ঐতিহ্যের জড়তায়, বরং একটি সৃজনশীল সমন্বয়ে।

আরও পড়ুনপূর্ব যুগে মুসলিম সমাজে প্রতিবাদের ধরন১০ মে ২০২৫‘ইসলামি আধুনিকতাবাদ’

উনিশ শতকে ইউরোপীয় ঔপনিবেশিকতার মুখে ‘ইসলামি আধুনিকতাবাদ’ জন্ম নেয়। সংস্কারকেরা বলেছিলেন, ইসলাম গণতন্ত্র, যুক্তি, অগ্রগতি আর শিক্ষার সঙ্গে পুরোপুরি মিলে যায়।

তাঁরা নতুন ধরনের স্কুল চেয়েছিলেন, যেখানে ধর্মীয় আর আধুনিক শিক্ষা একসঙ্গে চলবে। সংবাদপত্রের মাধ্যমে সংলাপের পথ খুলতে চেয়েছিলেন, আর সাংবিধানিক শাসনের কথা বলেছিলেন, যা ইসলামি নীতির মধ্যে থেকে স্বৈরাচারকে সীমিত করবে।

মিসরে মুহাম্মদ আলী পাশা আর খেদিভ ইসমাইল শরিয়াকে আধুনিক রাষ্ট্রের সঙ্গে মেলানোর চেষ্টা করেছিলেন। তাঁরা শরিয়াকে নতুন আইনি কাঠামোয় ঢেলেছিলেন, যাতে এটি আধুনিক জাতীয়তাবাদের সঙ্গে পা মেলায়। তাঁদের স্বপ্ন ছিল ইসলামি পরিচয় আর আধুনিক শাসনের একটি মেলবন্ধন। (মোহাম্মদ শাতাতু, ‘মডার্নিটি অ্যান্ড দ্য মুসলিম ওয়ার্ল্ড’, পৃ. ২২, মরক্কো ওয়ার্ল্ড নিউজ, রাবাত, ২০২৫)

মিসরের আল-আজহার বিশ্ববিদ্যালয় তখনকার সেই সমন্বয় সাধনের একটি উদাহরণ। এখানে ধর্মীয় শিক্ষার পাশাপাশি বিজ্ঞান, সমাজবিজ্ঞান আর দর্শন পড়ানো হয়, যেন তা ইসলাম নতুন সময়ের সঙ্গে হাত মিলিয়ে চলতে পারে।

মিসরে মুহাম্মদ আলী পাশা আর খেদিভ ইসমাইল শরিয়াকে আধুনিক রাষ্ট্রের সঙ্গে মেলানোর চেষ্টা করেছিলেন। তাঁরা শরিয়াকে নতুন আইনি কাঠামোয় ঢেলেছিলেন।কোরআনের নতুন ব্যাখ্যা

আধুনিকতাবাদের পাশাপাশি কিছু সংস্কারক কোরআনের নতুন ব্যাখ্যার মাধ্যমে ঐতিহ্যকে জাগিয়ে তোলার চেষ্টা করে। স্যার সৈয়দ আহমদ খান ও মুহাম্মদ আবদুহু পুরোনো ফিকহের শ্রেণিবিন্যাসের বদলে কোরআনের নৈতিক বার্তাকে কেন্দ্রে আনায় উদ্যোগী হন। তাঁরা স্বাধীন ইজতিহাদের মাধ্যমে আধুনিক প্রশ্নের উত্তর খুঁজেছিলেন।

মুহাম্মদ আবদুহু বিশ্বাস করতেন, কোরআন সব যুগের জন্য প্রাসঙ্গিক, যদি এটি সময়ের প্রেক্ষিতে বোঝা যায়। তিনি শিক্ষা সংস্কারের মাধ্যমে যুক্তি ও বিশ্বাসের মেলবন্ধন ঘটাতে চেয়েছিলেন। (মুহাম্মদ আবদুহু, তাফসির আল-মানার, ১/৪৫, দার আল-কুতুব, কায়রো, ১৯০৫)

কিন্তু এই প্রচেষ্টা কখনো কখনো পদ্ধতিগত গভীরতার অভাবে ঐতিহ্য থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়ার ঝুঁকি তৈরি করেছে। (মোহাম্মদ শাতাতু, ‘মডার্নিটি অ্যান্ড দ্য মুসলিম ওয়ার্ল্ড’, পৃ. ২৫, মরক্কো ওয়ার্ল্ড নিউজ, রাবাত, ২০২৫)

নৈতিকতার নতুন পথ

ফজলুর রহমানের মতো নব্য-আধুনিকতাবাদী চিন্তাবিদেরা যুক্তি, নৈতিকতা আর সময়ের প্রেক্ষিতে ইসলামকে নতুন করে বুঝতে চেয়েছেন। তিনি বলেছিলেন, কোরআনকে তার ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট আর আধুনিক জীবনের আলোকে একসঙ্গে দেখতে হবে।

তিনি নৈতিকতাকে আইনের ওপরে স্থান দিয়েছেন। ফলে দেখা যায়, তিনি শোষণমূলক সুদ নিষিদ্ধ করলেও যুক্তিসংগত সুদের অনুমোদন দেওয়ার কথা বলেছেন, যেন তা আধুনিক অর্থনীতির চাহিদা পূরণ করে। (ফজলুর রহমান, ইসলাম অ্যান্ড মডার্নিটি, পৃ. ১২৩, ইউনিভার্সিটি অফ শিকাগো প্রেস, শিকাগো, ১৯৮২)

মরক্কোর দার্শনিক তাহা আব্দুর রাহমান ইসলামি নৈতিকতার ওপর ভিত্তি করে একটি মানবিক আধুনিকতার কথা বলেছেন। তিনি পশ্চিমের একমুখী মডেল প্রত্যাখ্যান করে বহুমুখী আধুনিকতার পক্ষে কথা বলেন।

তাঁর চিন্তা যুক্তি, ভাষা, নৈতিকতা আর আধ্যাত্মিকতার মিশেলে গড়া, যা আধুনিক প্রয়োজনের সঙ্গে মিলে, কিন্তু ইসলামি মূল্যবোধের প্রতি বিশ্বস্ত থাকে। (তাহা আব্দুর রাহমান, দ্য স্পিরিট অব মডার্নিটি, পৃ. ৮৭, দার আল-ফিকর, রাবাত, ২০০৬)

কিন্তু এই প্রচেষ্টা কখনো কখনো পদ্ধতিগত গভীরতার অভাবে ঐতিহ্য থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়ার ঝুঁকি তৈরি করেছে।আরও পড়ুনভালো মুসলিম হওয়ার ১০ উপায়১০ আগস্ট ২০২৫নারীর কণ্ঠস্বর

ফাতিমা মেরনিসি ও লায়লা আহমেদের মতো নারীবাদী পণ্ডিতেরা ইসলামের মধ্যে নারীর কণ্ঠস্বরকে নতুন করে সামনে এনেছেন। মেরনিসির মতে, কোরআন–হাদিসের পবিত্র পাঠের পিতৃতান্ত্রিক ব্যাখ্যা নারীর অধিকারকে সীমিত করেছে। তিনি নারীর অভিজ্ঞতা ও অধিকারকেন্দ্রিক ব্যাখ্যার পক্ষে কথা বলেছেন। (ফাতিমা মেরনিসি, দ্য ভেইল অ্যান্ড দ্য মেল এলিট, পৃ. ৬৪, পার্সিয়াস বুকস, মাসাচুসেটস, ১৯৯১)

লায়লা আহমেদ তাঁর উইমেন অ্যান্ড জেন্ডার ইন ইসলাম বইয়ে মুসলিম সমাজে লিঙ্গ ভূমিকার ঐতিহাসিক গতিপথ দেখিয়েছেন, যা পশ্চিমের সরলীকৃত চিত্রের বিপক্ষে অবস্থান গ্রহণ করে। (পৃ. ১০২, ইয়েল ইউনিভার্সিটি প্রেস, নিউ হ্যাভেন, ১৯৯২)

এই নারীবাদী চিন্তাবিদদের যুক্তি ছিল, কোরআন সব মানুষের সমান মর্যাদার কথা বলে (সুরা হুজুরাত, আয়াত: ১৩) এবং প্রথম যুগের মুসলিম নারীরা পণ্ডিত, ব্যবসায়ী ও নেত্রী হিসেবে উজ্জ্বল ভূমিকা রেখেছেন।

স্বর্ণযুগের জ্ঞানের এতিহ্য

ইসলামি স্বর্ণযুগ (অষ্টম-চতুর্দশ খ্রিষ্টাব্দ) আমাদের জন্য একটি উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। ইবনে সিনা আর ইবনে রুশদের মতো পণ্ডিতেরা বিশ্বাস আর যুক্তির মেলবন্ধন ঘটিয়েছিলেন। বাগদাদের বাইত আল-হিকমা ছিল জ্ঞানের মিলনমেলা, যেখানে বিভিন্ন ধর্ম ও সংস্কৃতির মানুষ একসঙ্গে জ্ঞান চর্চা করত।

এই যুগ দেখিয়েছে, ধর্মীয় ঐতিহ্য যখন জ্ঞান, যুক্তি আর উন্মুক্ততাকে আলিঙ্গন করে, তখন সৃজনশীলতার ফুল ফোটে। (সৈয়দ হোসাইন নসর, সায়েন্স অ্যান্ড সিভিলাইজেশন ইন ইসলাম, পৃ. ৫৬, হার্ভার্ড ইউনিভার্সিটি প্রেস, কেমব্রিজ, ১৯৬৮)

আধুনিক সময়ে ইসলাম

আধুনিকতা আর ইসলামি ঐতিহ্য পরস্পরের বৈরি নয় বটে এবং ইসলামি স্বর্ণযুগ দেখিয়েছে, বিশ্বাস আর যুক্তি একসঙ্গে ফুল ফুটিয়ে তুলতে পারে কিন্তু ‘ইসলামি আধুনিকতাবাদ’ বহু ক্ষেত্রে আধুনিক নৈতিকতাকে প্রাধান্য দিতে গিয়ে ইসলামের মৌলিক ধারণাকে এড়িয়ে গিয়েছে বলে মনে হয়।

ধর্মীয় ঐতিহ্য যখন জ্ঞান, যুক্তি আর উন্মুক্ততাকে আলিঙ্গন করে, তখন সৃজনশীলতার ফুল ফোটে। সৈয়দ হোসাইন নসর, সায়েন্স অ্যান্ড সিভিলাইজেশন ইন ইসলাম

যেমন, সুদ যেখানে মানবজাতির জন্য ধ্বংসের কারণ হিসেবে উল্লেখ করেছেন আল্লাহ, সেখানে আধুনিক সময়ের প্রয়োজনে সুদের অনুমোদন দেওয়ার কথা বলা কোরআনের ব্যাখ্যার সঙ্গে সাংঘর্ষিক বলার অবকাশ আছে।

বরং আধুনিকতা মুসলিম বিশ্বের জন্য একটি মঞ্চ, যেখানে ঐতিহ্য তার সবচেয়ে সুন্দর রূপে ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করা যেতে পারে। পশ্চিমের অনুকরণে নয়, বরং ইসলামি মূল্যবোধে নিহিত একটি নিজস্ব আধুনিকতা দরকার। কোরআনের আলো, নবীজির শিক্ষা আর ঐতিহ্যের গভীরতা আমাদেরকে পথ দেখাতে পারে—এমন পথ যা ন্যায়, করুণা আর মানবিকতার, যা হৃদয়ে শান্তি এনে দেয়।

আরও পড়ুনআধুনিক এই প্রবণতার শিকড় ইসলামে২০ মে ২০২৫

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • টিকার সঙ্গে আসলে কি অটিজমের সম্পর্ক আছে, কেন ট্রাম্প এমন বলছেন
  • প্রেমের গুঞ্জনের মধ্যেই কার বিয়েতে হাজির হচ্ছেন জায়েদ-মাহি?
  • মুসলিম বিশ্বে আধুনিকতার ধারণা এল যেভাবে