ইসলাম মানুষের মধ্যে ভ্রাতৃত্ববোধ ও পারস্পরিক সম্পর্কের একটি শক্তিশালী ভিত্তি স্থাপন করে। এই সম্পর্কের মূলে রয়েছে মুসলিমদের একে অপরের প্রতি দায়িত্ব ও অধিকার। এ বিষয়টি সুস্পষ্টভাবে প্রকাশ পেয়েছে রাসুল (সা.)-এর একটি বাণীতে, যেখানে

তিনি বলেছেন, ‘মুসলিম সেই, যার জিহ্বা ও হাত থেকে মুসলিমরা নিরাপদ থাকে। আর মুহাজির সেই, যে আল্লাহ যা নিষেধ করেছেন, তা পরিত্যাগ করে।’ (সহিহ বুখারি, হাদিস: ১০)

হাদিসের তাৎপর্য ও ব্যাখ্যা

এই হাদিসে রাসুল (সা.

) মুসলিম, মুমিন, মুজাহিদ ও মুহাজিরের সংজ্ঞা দিয়েছেন। এটি কেবল পরিচয়ের সংজ্ঞা নয়; বরং ইমানের পূর্ণতা ও উত্তম চরিত্রের বৈশিষ্ট্য বর্ণনা করে। হাদিসের প্রথম অংশে বলা হয়েছে, ‘মুসলিম সেই, যার জিহ্বা ও হাত থেকে মুসলিমরা নিরাপদ থাকে।’

এর অর্থ, একজন প্রকৃত মুসলিম তার কথা ও কাজের মাধ্যমে অন্য মুসলিমদের কোনো ক্ষতি করেন না। এটি ইসলামের পূর্ণতার একটি লক্ষণ। তবে এর মানে এই নয় যে যিনি এই গুণ অর্জন করতে ব্যর্থ হন, তিনি ইসলামের বাইরে চলে যান; বরং এটি ইমানের কমাল বা পূর্ণতার দিকে ইঙ্গিত করে। (ইদরিস আহমদ, আল-মুসলিম মিন সালিমাল মুসলিমুন, পৃ. ৪৫, দারুল হিকমা, কায়রো, ২০২০)

একইভাবে হাদিসের দ্বিতীয় অংশে বলা হয়েছে, ‘মুহাজির সেই, যে আল্লাহ যা নিষেধ করেছেন, তা পরিত্যাগ করে।’ এখানে মুহাজির বলতে শুধু ভৌগোলিক হিজরত নয়; বরং পাপ ও নিষিদ্ধ কাজ থেকে দূরে থাকার কথা বলা হয়েছে।

যখন ভৌগোলিক হিজরতের সুযোগ শেষ হয়ে গেল, তখন রাসুল (সা.) সাহাবাদের জানিয়েছিলেন যে প্রকৃত হিজরত হলো আল্লাহর নিষেধকৃত কাজ ত্যাগ করা। এটি ইমানের পূর্ণতার আরেকটি দিক। (ইবনে হাজার আল-আসকালানি, ফাতহুল বারি, ১/৬৫, দারুল মা’রিফা, বৈরুত, ২০১৮)।

অন্য একটি রিওয়ায়েতে ফাদালা ইবনে উবায়দ (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘মুসলিম সেই, যার জিহ্বা ও হাত থেকে মুসলিমরা নিরাপদ থাকে। মুমিন সেই, যার কাছে মানুষ তাদের জান-মালের নিরাপত্তা পায়। মুজাহিদ সেই, যে আল্লাহর আনুগত্যের জন্য নিজের নফসের বিরুদ্ধে জিহাদ করে। আর মুহাজির সেই, যে পাপ ও অপরাধ ত্যাগ করে’ (মুসনাদে আহমদ, হাদিস: ২৩৭৫৮)।

এই বর্ণনা হাদিসের অর্থকে আরও বিস্তৃত করে এবং ইমানের বিভিন্ন স্তর ও চরিত্রের পূর্ণতার দিকে ইঙ্গিত করে।

আরও পড়ুনমহানবী (সা.) যেভাবে সমাজে ইতিবাচক পরিবর্তন এনেছিলেন০৬ সেপ্টেম্বর ২০২৫হাদিসের শিক্ষা

এই হাদিস থেকে আমরা বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষা পাই, যা মুসলিম জীবনের নীতি ও আচরণের মান নির্ধারণ করে:

১. অন্যের ক্ষতি না করা: প্রকৃত মুসলিম তার কথা ও কাজের মাধ্যমে অন্য মুসলিমদের ক্ষতি থেকে বিরত থাকেন। জিহ্বা দ্বারা ক্ষতি বলতে গিবত, অপবাদ, অশ্লীল কথা এবং হাত দ্বারা ক্ষতি বলতে অন্যায়ভাবে আঘাত করা, সম্পদ হরণ বা অন্য কোনো ক্ষতি করা বোঝায়।

হাসান বসরি (রহ.) বলেছেন, ‘সত্যিকারের নেককার ব্যক্তি তাঁরা, যাঁরা এমনকি পিঁপড়া বা কীটপতঙ্গেরও ক্ষতি করেন না।’ (আল-মুসলিম মিন সালিমাল মুসলিমুন, পৃ. ৫২, দারুল হিকমা, কায়রো, ২০২০)।

২. ইমানের স্তরবিন্যাস: এই হাদিস ইমানের বিভিন্ন স্তরের কথা বলে। কোরআনে বলা হয়েছে, ‘প্রকৃত মুমিন তারা, যাদের হৃদয় আল্লাহর স্মরণে কেঁপে ওঠে এবং তাঁর আয়াত পাঠ করা হলে তাদের ইমান বৃদ্ধি পায়’ (সুরা আনফাল, আয়াত: ২)।

যিনি অন্যের ক্ষতি থেকে বিরত থাকেন এবং আল্লাহর নিষেধকৃত কাজ ত্যাগ করেন, তিনি ইমানের উচ্চতর স্তরে পৌঁছান।

৩. ভ্রাতৃত্ব ও ঐক্য: হাদিসটি মুসলিমদের মধ্যে ভ্রাতৃত্ব ও ঐক্যের গুরুত্ব তুলে ধরে। বিচারক আল-কাদি বলেছেন, ‘ঐক্য ইসলামের একটি ফরজ এবং শরিয়তের মৌলিক ভিত্তি। এটি মুসলিম সমাজের শক্তি ও সংহতির প্রতীক’ (ফাতহুল বারি, ১/৭০, দারুল মা’রিফা, বৈরুত, ২০১৮)।

মুসলিমদের হৃদয়ে ভালোবাসা ও ঐক্য সৃষ্টি করা এই হাদিসের অন্যতম উদ্দেশ্য।

৪. জিহ্বা ও হাতের গুরুত্ব: হাদিসে জিহ্বা ও হাতের উল্লেখ করা হয়েছে। কারণ, এই দুটি অঙ্গ দিয়েই মানুষ সবচেয়ে বেশি ক্ষতি করে। তবে ক্ষতি শুধু জিহ্বা ও হাতের মাধ্যমে সীমাবদ্ধ নয়, চোখ দিয়ে অন্যের গোপনীয়তা লঙ্ঘন বা পা দিয়ে এমন স্থানে প্রবেশ করা, যা অন্যের জন্য কষ্টের কারণ হয়, এগুলোও ক্ষতির অন্তর্ভুক্ত।

৫. নিজের নফসের সঙ্গে জিহাদ: হাদিসে বলা হয়েছে, ‘মুজাহিদ সেই, যে আল্লাহর আনুগত্যের জন্য নিজের নফসের বিরুদ্ধে জিহাদ করে।’

নফস মানুষের সবচেয়ে বড় শত্রু। কারণ, এটি সব সময় তাকে পাপ ও অপরাধের দিকে টানে। বাহ্যিক শত্রুর সঙ্গে লড়াইয়ের চেয়ে নিজের নফসের সঙ্গে লড়াই অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ। কারণ, নফস সব সময় মানুষের সঙ্গে থাকে এবং তাকে ভালো কাজ থেকে বিরত রাখে।

আরও পড়ুনমহানবী (সা.)-এর সুস্থতার চর্চা থেকে শিক্ষা০৮ আগস্ট ২০২৫হিজরতের প্রকারভেদ

হাদিসে উল্লিখিত ‘মুহাজির’ শব্দটি বিভিন্ন অর্থ বহন করে। আলিমগণ হিজরতকে তিনটি প্রকারে ভাগ করেছেন:

১. স্থানের হিজরত: এটি হলো এমন স্থান ত্যাগ করা, যেখানে পাপ ও অপরাধ প্রকাশ্যে হয় বা যেটি কুফরের দেশ। তবে কুফরের দেশে ভ্রমণের জন্য তিনটি শর্ত পূরণ করতে হবে:

জ্ঞান: যা দ্বারা মানুষ শয়তানের ধোঁকা থেকে নিজেকে রক্ষা করতে পারে।

দ্বীনের দৃঢ়তা: যা তাকে শাহওয়াত বা প্রবৃত্তির প্রলোভন থেকে রক্ষা করে।

প্রয়োজন: যেমন চিকিৎসা, শিক্ষা বা ব্যবসার জন্য ভ্রমণ।

এই শর্ত ছাড়া কুফরের দেশে ভ্রমণ ইসলামে নিষিদ্ধ। (ইদরিস আহমদ, আল-মুসলিম মিন সালিমাল মুসলিমুন, পৃ. ৬৮, দারুল হিকমা, কায়রো, ২০২০)

২. কাজের হিজরত: এটি হলো আল্লাহর নিষিদ্ধ কাজ ত্যাগ করা। যেমন গিবত, মিথ্যা, রিবা, অশ্লীলতা ইত্যাদি থেকে দূরে থাকা। এটি প্রকৃত মুহাজিরের বৈশিষ্ট্য।

৩. ব্যক্তির হিজরত: কখনো কখনো কোনো ব্যক্তিকে পরিত্যাগ করা প্রয়োজন হয়, বিশেষ করে যদি সে প্রকাশ্যে পাপ করে এবং তাতে লজ্জিত না হয়। উদাহরণস্বরূপ, কেউ যদি ব্যবসায় প্রতারণা করে বা রিবার সঙ্গে জড়িত থাকে, তবে তার সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করা যেতে পারে, যাতে সে তার ভুল বুঝতে পারে এবং তওবা করে। এই হিজরতের উদ্দেশ্য হলো সংশোধন ও কল্যাণ।

হাদিসের ফিকহি দিক

এই হাদিস থেকে আমরা বেশ কিছু ফিকহি শিক্ষা পাই:

১. ইমানের বিভিন্ন স্তর: ইমান একটি সমান স্তরের বিষয় নয়। যিনি আল্লাহর ফরজ পালনের পাশাপাশি অন্য মুসলিমদের ক্ষতি থেকে বিরত থাকেন, তিনি ইমানের উচ্চতর স্তরে থাকেন।

২. অন্যের প্রতি দায়িত্ব: মুসলিমদের উচিত অন্যের প্রতি সদয় আচরণ করা, তাদের সম্মান রক্ষা করা এবং তাদের ক্ষতি থেকে বিরত থাকা। এটি ইসলামের একটি মৌলিক নীতি।

৩. সমাজের ঐক্য: মুসলিমদের মধ্যে ভালোবাসা ও ঐক্য স্থাপন ইসলামের একটি ফরজ। এটি সমাজের শক্তি ও স্থিতিশীলতা বৃদ্ধি করে।

৪. নিজের সংশোধন: নিজের নফসের বিরুদ্ধে জিহাদ এবং পাপ ত্যাগ করা ইমানের পূর্ণতার জন্য অপরিহার্য। এটি মুসলিম জীবনের একটি ক্রমাগত প্রক্রিয়া।

‘মুসলিম সেই, যার জিহ্বা ও হাত থেকে মুসলিমরা নিরাপদ থাকে’ — এই হাদিসটি মুসলিম জীবনের একটি মৌলিক নীতি প্রতিষ্ঠা করে। এটি আমাদের শিক্ষা দেয় যে, প্রকৃত মুসলিম তার কথা ও কাজের মাধ্যমে অন্যের ক্ষতি থেকে বিরত থাকেন এবং আল্লাহর নিষিদ্ধ কাজ ত্যাগ করেন।

এই হাদিস আমাদেরকে নিজের নফসের সঙ্গে জিহাদ করতে এবং সমাজে ভ্রাতৃত্ব ও ঐক্য স্থাপনের জন্য কাজ করতে উৎসাহিত করে। এটি ইমানের পূর্ণতার একটি পথনির্দেশ, যা মুসলিমদের জীবনে শান্তি, সম্মান ও সাফল্য নিয়ে আসে।

আরও পড়ুনমুসলিম জীবনে আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের ৯ উপায়১৫ অক্টোবর ২০২৫

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: ক জ ত য গ কর ন জ র নফস র ন র পদ থ ক প রক ত ম এই হ দ স ইসল ম র আল ল হ অন য র র জন য বল ছ ন ন স তর হ জরত র একট

এছাড়াও পড়ুন:

মুসলিম সে, যার জিহ্বা ও হাত থেকে অপর মুসলিম নিরাপদ থাকে

ইসলাম মানুষের মধ্যে ভ্রাতৃত্ববোধ ও পারস্পরিক সম্পর্কের একটি শক্তিশালী ভিত্তি স্থাপন করে। এই সম্পর্কের মূলে রয়েছে মুসলিমদের একে অপরের প্রতি দায়িত্ব ও অধিকার। এ বিষয়টি সুস্পষ্টভাবে প্রকাশ পেয়েছে রাসুল (সা.)-এর একটি বাণীতে, যেখানে

তিনি বলেছেন, ‘মুসলিম সেই, যার জিহ্বা ও হাত থেকে মুসলিমরা নিরাপদ থাকে। আর মুহাজির সেই, যে আল্লাহ যা নিষেধ করেছেন, তা পরিত্যাগ করে।’ (সহিহ বুখারি, হাদিস: ১০)

হাদিসের তাৎপর্য ও ব্যাখ্যা

এই হাদিসে রাসুল (সা.) মুসলিম, মুমিন, মুজাহিদ ও মুহাজিরের সংজ্ঞা দিয়েছেন। এটি কেবল পরিচয়ের সংজ্ঞা নয়; বরং ইমানের পূর্ণতা ও উত্তম চরিত্রের বৈশিষ্ট্য বর্ণনা করে। হাদিসের প্রথম অংশে বলা হয়েছে, ‘মুসলিম সেই, যার জিহ্বা ও হাত থেকে মুসলিমরা নিরাপদ থাকে।’

এর অর্থ, একজন প্রকৃত মুসলিম তার কথা ও কাজের মাধ্যমে অন্য মুসলিমদের কোনো ক্ষতি করেন না। এটি ইসলামের পূর্ণতার একটি লক্ষণ। তবে এর মানে এই নয় যে যিনি এই গুণ অর্জন করতে ব্যর্থ হন, তিনি ইসলামের বাইরে চলে যান; বরং এটি ইমানের কমাল বা পূর্ণতার দিকে ইঙ্গিত করে। (ইদরিস আহমদ, আল-মুসলিম মিন সালিমাল মুসলিমুন, পৃ. ৪৫, দারুল হিকমা, কায়রো, ২০২০)

একইভাবে হাদিসের দ্বিতীয় অংশে বলা হয়েছে, ‘মুহাজির সেই, যে আল্লাহ যা নিষেধ করেছেন, তা পরিত্যাগ করে।’ এখানে মুহাজির বলতে শুধু ভৌগোলিক হিজরত নয়; বরং পাপ ও নিষিদ্ধ কাজ থেকে দূরে থাকার কথা বলা হয়েছে।

যখন ভৌগোলিক হিজরতের সুযোগ শেষ হয়ে গেল, তখন রাসুল (সা.) সাহাবাদের জানিয়েছিলেন যে প্রকৃত হিজরত হলো আল্লাহর নিষেধকৃত কাজ ত্যাগ করা। এটি ইমানের পূর্ণতার আরেকটি দিক। (ইবনে হাজার আল-আসকালানি, ফাতহুল বারি, ১/৬৫, দারুল মা’রিফা, বৈরুত, ২০১৮)।

অন্য একটি রিওয়ায়েতে ফাদালা ইবনে উবায়দ (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘মুসলিম সেই, যার জিহ্বা ও হাত থেকে মুসলিমরা নিরাপদ থাকে। মুমিন সেই, যার কাছে মানুষ তাদের জান-মালের নিরাপত্তা পায়। মুজাহিদ সেই, যে আল্লাহর আনুগত্যের জন্য নিজের নফসের বিরুদ্ধে জিহাদ করে। আর মুহাজির সেই, যে পাপ ও অপরাধ ত্যাগ করে’ (মুসনাদে আহমদ, হাদিস: ২৩৭৫৮)।

এই বর্ণনা হাদিসের অর্থকে আরও বিস্তৃত করে এবং ইমানের বিভিন্ন স্তর ও চরিত্রের পূর্ণতার দিকে ইঙ্গিত করে।

আরও পড়ুনমহানবী (সা.) যেভাবে সমাজে ইতিবাচক পরিবর্তন এনেছিলেন০৬ সেপ্টেম্বর ২০২৫হাদিসের শিক্ষা

এই হাদিস থেকে আমরা বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষা পাই, যা মুসলিম জীবনের নীতি ও আচরণের মান নির্ধারণ করে:

১. অন্যের ক্ষতি না করা: প্রকৃত মুসলিম তার কথা ও কাজের মাধ্যমে অন্য মুসলিমদের ক্ষতি থেকে বিরত থাকেন। জিহ্বা দ্বারা ক্ষতি বলতে গিবত, অপবাদ, অশ্লীল কথা এবং হাত দ্বারা ক্ষতি বলতে অন্যায়ভাবে আঘাত করা, সম্পদ হরণ বা অন্য কোনো ক্ষতি করা বোঝায়।

হাসান বসরি (রহ.) বলেছেন, ‘সত্যিকারের নেককার ব্যক্তি তাঁরা, যাঁরা এমনকি পিঁপড়া বা কীটপতঙ্গেরও ক্ষতি করেন না।’ (আল-মুসলিম মিন সালিমাল মুসলিমুন, পৃ. ৫২, দারুল হিকমা, কায়রো, ২০২০)।

২. ইমানের স্তরবিন্যাস: এই হাদিস ইমানের বিভিন্ন স্তরের কথা বলে। কোরআনে বলা হয়েছে, ‘প্রকৃত মুমিন তারা, যাদের হৃদয় আল্লাহর স্মরণে কেঁপে ওঠে এবং তাঁর আয়াত পাঠ করা হলে তাদের ইমান বৃদ্ধি পায়’ (সুরা আনফাল, আয়াত: ২)।

যিনি অন্যের ক্ষতি থেকে বিরত থাকেন এবং আল্লাহর নিষেধকৃত কাজ ত্যাগ করেন, তিনি ইমানের উচ্চতর স্তরে পৌঁছান।

৩. ভ্রাতৃত্ব ও ঐক্য: হাদিসটি মুসলিমদের মধ্যে ভ্রাতৃত্ব ও ঐক্যের গুরুত্ব তুলে ধরে। বিচারক আল-কাদি বলেছেন, ‘ঐক্য ইসলামের একটি ফরজ এবং শরিয়তের মৌলিক ভিত্তি। এটি মুসলিম সমাজের শক্তি ও সংহতির প্রতীক’ (ফাতহুল বারি, ১/৭০, দারুল মা’রিফা, বৈরুত, ২০১৮)।

মুসলিমদের হৃদয়ে ভালোবাসা ও ঐক্য সৃষ্টি করা এই হাদিসের অন্যতম উদ্দেশ্য।

৪. জিহ্বা ও হাতের গুরুত্ব: হাদিসে জিহ্বা ও হাতের উল্লেখ করা হয়েছে। কারণ, এই দুটি অঙ্গ দিয়েই মানুষ সবচেয়ে বেশি ক্ষতি করে। তবে ক্ষতি শুধু জিহ্বা ও হাতের মাধ্যমে সীমাবদ্ধ নয়, চোখ দিয়ে অন্যের গোপনীয়তা লঙ্ঘন বা পা দিয়ে এমন স্থানে প্রবেশ করা, যা অন্যের জন্য কষ্টের কারণ হয়, এগুলোও ক্ষতির অন্তর্ভুক্ত।

৫. নিজের নফসের সঙ্গে জিহাদ: হাদিসে বলা হয়েছে, ‘মুজাহিদ সেই, যে আল্লাহর আনুগত্যের জন্য নিজের নফসের বিরুদ্ধে জিহাদ করে।’

নফস মানুষের সবচেয়ে বড় শত্রু। কারণ, এটি সব সময় তাকে পাপ ও অপরাধের দিকে টানে। বাহ্যিক শত্রুর সঙ্গে লড়াইয়ের চেয়ে নিজের নফসের সঙ্গে লড়াই অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ। কারণ, নফস সব সময় মানুষের সঙ্গে থাকে এবং তাকে ভালো কাজ থেকে বিরত রাখে।

আরও পড়ুনমহানবী (সা.)-এর সুস্থতার চর্চা থেকে শিক্ষা০৮ আগস্ট ২০২৫হিজরতের প্রকারভেদ

হাদিসে উল্লিখিত ‘মুহাজির’ শব্দটি বিভিন্ন অর্থ বহন করে। আলিমগণ হিজরতকে তিনটি প্রকারে ভাগ করেছেন:

১. স্থানের হিজরত: এটি হলো এমন স্থান ত্যাগ করা, যেখানে পাপ ও অপরাধ প্রকাশ্যে হয় বা যেটি কুফরের দেশ। তবে কুফরের দেশে ভ্রমণের জন্য তিনটি শর্ত পূরণ করতে হবে:

জ্ঞান: যা দ্বারা মানুষ শয়তানের ধোঁকা থেকে নিজেকে রক্ষা করতে পারে।

দ্বীনের দৃঢ়তা: যা তাকে শাহওয়াত বা প্রবৃত্তির প্রলোভন থেকে রক্ষা করে।

প্রয়োজন: যেমন চিকিৎসা, শিক্ষা বা ব্যবসার জন্য ভ্রমণ।

এই শর্ত ছাড়া কুফরের দেশে ভ্রমণ ইসলামে নিষিদ্ধ। (ইদরিস আহমদ, আল-মুসলিম মিন সালিমাল মুসলিমুন, পৃ. ৬৮, দারুল হিকমা, কায়রো, ২০২০)

২. কাজের হিজরত: এটি হলো আল্লাহর নিষিদ্ধ কাজ ত্যাগ করা। যেমন গিবত, মিথ্যা, রিবা, অশ্লীলতা ইত্যাদি থেকে দূরে থাকা। এটি প্রকৃত মুহাজিরের বৈশিষ্ট্য।

৩. ব্যক্তির হিজরত: কখনো কখনো কোনো ব্যক্তিকে পরিত্যাগ করা প্রয়োজন হয়, বিশেষ করে যদি সে প্রকাশ্যে পাপ করে এবং তাতে লজ্জিত না হয়। উদাহরণস্বরূপ, কেউ যদি ব্যবসায় প্রতারণা করে বা রিবার সঙ্গে জড়িত থাকে, তবে তার সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করা যেতে পারে, যাতে সে তার ভুল বুঝতে পারে এবং তওবা করে। এই হিজরতের উদ্দেশ্য হলো সংশোধন ও কল্যাণ।

হাদিসের ফিকহি দিক

এই হাদিস থেকে আমরা বেশ কিছু ফিকহি শিক্ষা পাই:

১. ইমানের বিভিন্ন স্তর: ইমান একটি সমান স্তরের বিষয় নয়। যিনি আল্লাহর ফরজ পালনের পাশাপাশি অন্য মুসলিমদের ক্ষতি থেকে বিরত থাকেন, তিনি ইমানের উচ্চতর স্তরে থাকেন।

২. অন্যের প্রতি দায়িত্ব: মুসলিমদের উচিত অন্যের প্রতি সদয় আচরণ করা, তাদের সম্মান রক্ষা করা এবং তাদের ক্ষতি থেকে বিরত থাকা। এটি ইসলামের একটি মৌলিক নীতি।

৩. সমাজের ঐক্য: মুসলিমদের মধ্যে ভালোবাসা ও ঐক্য স্থাপন ইসলামের একটি ফরজ। এটি সমাজের শক্তি ও স্থিতিশীলতা বৃদ্ধি করে।

৪. নিজের সংশোধন: নিজের নফসের বিরুদ্ধে জিহাদ এবং পাপ ত্যাগ করা ইমানের পূর্ণতার জন্য অপরিহার্য। এটি মুসলিম জীবনের একটি ক্রমাগত প্রক্রিয়া।

‘মুসলিম সেই, যার জিহ্বা ও হাত থেকে মুসলিমরা নিরাপদ থাকে’ — এই হাদিসটি মুসলিম জীবনের একটি মৌলিক নীতি প্রতিষ্ঠা করে। এটি আমাদের শিক্ষা দেয় যে, প্রকৃত মুসলিম তার কথা ও কাজের মাধ্যমে অন্যের ক্ষতি থেকে বিরত থাকেন এবং আল্লাহর নিষিদ্ধ কাজ ত্যাগ করেন।

এই হাদিস আমাদেরকে নিজের নফসের সঙ্গে জিহাদ করতে এবং সমাজে ভ্রাতৃত্ব ও ঐক্য স্থাপনের জন্য কাজ করতে উৎসাহিত করে। এটি ইমানের পূর্ণতার একটি পথনির্দেশ, যা মুসলিমদের জীবনে শান্তি, সম্মান ও সাফল্য নিয়ে আসে।

আরও পড়ুনমুসলিম জীবনে আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের ৯ উপায়১৫ অক্টোবর ২০২৫

সম্পর্কিত নিবন্ধ