স্বাস্থ্যব্যবস্থা পুনর্গঠন: রাষ্ট্র মেরামতের কেন্দ্রে প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা
Published: 16th, October 2025 GMT
দক্ষিণ বাংলাদেশের ঝালকাঠি জেলার এক গ্রামে ৫২ বছর বয়সী আবদুল করিম কয়েক দিন ধরে দুর্বলতা, মাথা ঘোরা ও শ্বাসকষ্টে ভুগছিলেন। ঘণ্টার পর ঘণ্টা হেঁটে তিনি পৌঁছালেন উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে। কিন্তু সেখানে গিয়ে দেখলেন—লম্বা লাইন, উচ্চ রক্তচাপের ওষুধ নেই, ল্যাব বন্ধ। বলা হলো, ‘আগামীকাল আসুন।’
সেই রাতে করিমের অবস্থা আরও খারাপ হয়। বাধ্য হয়ে পরিবার তাঁকে দূরের শের-ই-বাংলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যায়। যাত্রা ছিল কষ্টকর, ব্যয়বহুল, আর চিকিৎসাও করিমের প্রত্যাশা পূরণ করতে পারেনি। চিকিৎসা শেষে তিনি শুধু হতাশই নন, বরং চিন্তিত। কারণ, চিকিৎসার এই খরচ মেটাতে তাঁর পরিবারকে ধার করতে হয়েছে প্রতিবেশীর কাছ থেকে।
আবদুল করিমের এই কষ্ট একার নয়; এটি বাংলাদেশের স্বাস্থ্যব্যবস্থার গভীর সংকটের প্রতিচ্ছবি। গ্রামাঞ্চল হোক বা শহরের বস্তি, কোথাও কার্যকর প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা নেই। অনেক জায়গায় সেবাকেন্দ্র আছে, কিন্তু জনবল নেই, ওষুধ নেই, সেবার মান নেই।
দীর্ঘদিনের খণ্ডিত বিনিয়োগ, শহরমুখী ও হাসপাতালনির্ভর প্রবণতা এবং সামগ্রিক বৈষম্যের ফলে স্বাস্থ্যব্যবস্থা হয়ে উঠেছে দুর্বল ও অকার্যকর। কোভিড-১৯ মহামারি এই দুর্বলতাগুলো স্পষ্ট করে দিয়েছে, যেখানে বাংলাদেশের কোটি মানুষ প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবার নিরাপত্তা থেকে বঞ্চিত। এই পরিপ্রেক্ষিতে বিএনপির ৩১ দফা রাষ্ট্র মেরামতের এজেন্ডা উপস্থাপন করছে এক যুগান্তকারী রূপরেখা, যার মূল কেন্দ্রবিন্দু প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা।
দুর্বল ও খণ্ডিত প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবাবাংলাদেশে প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা এখনো দুর্বল, খণ্ডিত এবং অসমভাবে বিতরণকৃত। ‘সবার জন্য স্বাস্থ্যসেবা’ সাংবিধানিক প্রতিশ্রুতি হলেও, আজও দেশব্যাপী কার্যকর প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা নেটওয়ার্ক গড়ে ওঠেনি। গ্রামীণ এলাকায় কমিউনিটি ক্লিনিক, ইউনিয়ন স্বাস্থ্যকেন্দ্র ও উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স রয়েছে, কিন্তু সেখানে পর্যাপ্ত জনবল, ওষুধ, লজিস্টিক ও রেফারেল ব্যবস্থা নেই। অপর দিকে শহরাঞ্চলে, যেখানে এখন প্রায় অর্ধেক মানুষ বাস করে, প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা কার্যত অনুপস্থিত। ফলে নিম্ন আয়ের নাগরিকেরা বাধ্য হচ্ছেন অপরিকল্পিত প্রাইভেট ক্লিনিক বা ওষুধের দোকানে নির্ভর করতে।
দীর্ঘদিন ধরে প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা দুর্বল থেকেছে জবাবদিহির অভাব, নীতিনির্ধারণে অব্যবস্থাপনা এবং শেখ হাসিনার ফ্যাসিবাদী সরকারের ব্যাপক দুর্নীতির কারণে। জনগণের অর্থে নির্মিত স্বাস্থ্যব্যবস্থা ধীরে ধীরে পরিণত হয়েছে এক লুটপাটের কেন্দ্রে, যেখানে প্রকৃত সেবার চেয়ে দলীয় নিয়ন্ত্রণ ও কমিশন–বাণিজ্যই মুখ্য হয়ে উঠেছে। সবচেয়ে বড় সমস্যা হলো, একটি সুস্পষ্ট কৌশলগত দৃষ্টিভঙ্গির অভাব। প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা যে একটি কার্যকর ও ন্যায়ভিত্তিক স্বাস্থ্যব্যবস্থার ভিত্তি, সেই মৌলিক উপলব্ধিই শাসকগোষ্ঠীর নীতিতে প্রতিফলিত হয়নি।
এর ফলে প্রতিরোধযোগ্য রোগে অসুস্থতা ও মৃত্যুহার বেড়েছে এবং নিজের পকেট থেকে স্বাস্থ্য ব্যয় দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে সর্বোচ্চ পর্যায়ে অবস্থান করছে। এই খণ্ডিত ও দুর্নীতিগ্রস্ত ব্যবস্থা দেশের অসংক্রামক রোগ নিয়ন্ত্রণ, মাতৃ ও শিশুস্বাস্থ্য এবং জরুরি স্বাস্থ্যসেবা ব্যবস্থাপনাকেও মারাত্মকভাবে দুর্বল করে দিয়েছে।
নতুন প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা মডেলবিএনপির সংস্কার এজেন্ডার মূল প্রতিশ্রুতি হলো প্রতিটি ইউনিয়নে ও প্রতিটি পৌর ওয়ার্ডে একটি পূর্ণাঙ্গ প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা ইউনিট (PHCU) স্থাপন। এটি হবে নতুন জাতীয় স্বাস্থ্য কাঠামোর প্রথম সারির কেন্দ্র। এই ইউনিটগুলো ২৪ ঘণ্টা খোলা থাকবে, থাকবে একটি মিনি ল্যাব, প্রাথমিক রোগনির্ণয়ের সরঞ্জাম এবং প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবার ওষুধ সরবরাহকারী ফার্মেসি। প্রতিটি ইউনিট জনগণকে প্রতিরোধমূলক চিকিৎসা ও পুনর্বাসনমূলক সেবা দেবে, যা হবে নাগরিকদের স্বাস্থ্যসেবার প্রথম প্রবেশদ্বার।
প্রতিটি ইউনিটের সঙ্গে যুক্ত থাকবে তিনটি স্যাটেলাইট হেলথ হাব, যেখানে তিনজন করে কমিউনিটি স্বাস্থ্যকর্মী পরিবারভিত্তিক সেবা দেবেন। এসব হাব অসংক্রামক রোগ প্রতিরোধ, শিশু পুষ্টি উন্নয়ন ও স্বাস্থ্য প্রচারণায় কাজ করবে। রক্তচাপ, ডায়াবেটিস ও অপুষ্টি দ্রুত শনাক্তকরণ এবং জীবনধারা পরিবর্তনের মাধ্যমে জনগণকে সুস্থ রাখা ও হাসপাতালে চাপ কমানোই এর লক্ষ্য।
মানসিক স্বাস্থ্য ও প্রবীণ সেবার একীকরণনতুন প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা কাঠামো শুধু সংক্রামক ও দীর্ঘস্থায়ী রোগের বিরুদ্ধে লড়বে না; বরং দুটি দীর্ঘদিন উপেক্ষিত মানসিক স্বাস্থ্য ও প্রবীণবান্ধব সেবা বিষয়ে গুরুত্ব দেবে। সাম্প্রতিক তথ্যে দেখা যায়, বাংলাদেশের প্রায় ১৮ দশমিক ৭ শতাংশ প্রাপ্তবয়স্ক ব্যক্তি মানসিক রোগে আক্রান্ত, কিন্তু তাঁদের মধ্যে মাত্র ১০ শতাংশ চিকিৎসা পান। তা ছাড়া ৮০ শতাংশ প্রবীণ ব্যক্তি উদ্বেগ বা বিষণ্নতায় ভুগছেন, অনেকের রয়েছে একাধিক শারীরিক সমস্যা।
নতুন মডেলে প্রতিটি প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা ইউনিটে মানসিক স্বাস্থ্য স্ক্রিনিং, কাউন্সেলিং ও জনসচেতনতা কার্যক্রম থাকবে। প্রবীণ জনগোষ্ঠী, যারা এখন দেশের ৯-১০ শতাংশ, তাদের জন্য থাকবে সহজপ্রাপ্য, ধারাবাহিক ও মর্যাদাপূর্ণ সেবা। এই উদ্যোগের লক্ষ্য হলো মানসিক ও প্রবীণ স্বাস্থ্যসেবা কমিউনিটি পর্যায়েই নিশ্চিত করা, যাতে হাসপাতালের ওপর অতিরিক্ত চাপ না পড়ে।
দক্ষতা, গুণগত মান ও জবাবদিহির জন্য ডিজিটাল রূপান্তরপ্রতিটি নাগরিকের জন্য চালু করা হবে ইলেকট্রনিক হেলথ কার্ড, যা হবে একীভূত রেফারেল ও পেশেন্ট ম্যানেজমেন্ট সিস্টেমের অংশ। এই কার্ডের মাধ্যমে রোগীর তথ্য নিরাপদভাবে সংরক্ষণ ও শেয়ার করা যাবে, যা চিকিৎসা, রোগনির্ণয় ও ফলোআপ প্রক্রিয়াকে আরও কার্যকর করবে। যদি কোনো প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা ইউনিট চিকিৎসা দিতে না পারে, রোগীকে ইলেকট্রনিকভাবে পরবর্তী স্তরে পাঠানো হবে। এই রেফারেলভিত্তিক ব্যবস্থা হাসপাতালের অপ্রয়োজনীয় ভিড় কমাবে, ব্যয় হ্রাস করবে এবং সার্বিক দক্ষতা বৃদ্ধি করবে। জরুরি অবস্থা ছাড়া কেউ এই রেফারেল পদ্ধতি বাইপাস করতে পারবে না। ফলে জটিল রোগীদের জন্য বিশেষায়িত হাসপাতাল সংরক্ষিত থাকবে, আর সাধারণ সেবা পাওয়া যাবে স্থানীয় পর্যায়েই।
ন্যায়, দক্ষতা ও বিকেন্দ্রীকরণএই প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবাকেন্দ্রিক ভিশন কেবল একটি স্বাস্থ্যনীতি নয়, এটি একটি সামাজিক চুক্তি। এটি বিএনপির বৃহত্তর রাষ্ট্র মেরামতের এজেন্ডার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ। এর মাধ্যমে প্রতিটি নাগরিকের জন্য মৌলিক সেবা নিশ্চিত করা হবে, স্থানীয় প্রশাসনকে ক্ষমতায়ন করা হবে এবং সিদ্ধান্ত গ্রহণ হবে বিকেন্দ্রীকৃতভাবে।
স্থানীয় প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা ইউনিটগুলোকে দেওয়া হবে সীমিত প্রশাসনিক ও আর্থিক স্বায়ত্তশাসন, যাতে তারা নিজস্বভাবে ছোটখাটো সরঞ্জাম কিনতে, ওষুধ মজুত রাখতে ও অবকাঠামো রক্ষণাবেক্ষণ করতে পারে। এতে সেবার গুণগত মান বাড়বে, সমস্যা সমাধান দ্রুত হবে এবং জবাবদিহি নিশ্চিত হবে।
একই সঙ্গে, চিকিৎসায় অবহেলা ও গাফিলতি রোধে প্রয়োজনীয় আইনি সংস্কার আনা হবে। বছরের পর বছর ধরে ফ্যাসিবাদী শাসনের অধীনে জনগণের আস্থা যে ভেঙে পড়েছে, সেই আস্থা পুনরুদ্ধারে এটি হবে একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ। চিকিৎসাব্যবস্থায় জবাবদিহি, স্বচ্ছতা ও ন্যায়ের সংস্কৃতি প্রতিষ্ঠা করলেই জনগণ আবার বিশ্বাস ফিরে পাবে—যে স্বাস্থ্যসেবা তাদের অধিকার, অনুগ্রহ নয়।
একটি সুস্থ ও ন্যায্য বাংলাদেশের পথেবিএনপির স্বাস্থ্যবিষয়ক লক্ষ্য একটি বিশ্বাসের ওপর দাঁড়ানো, ‘কোনো মানুষ যেন চিকিৎসা ছাড়া মারা না যায়’। এটি কেবল রাজনৈতিক প্রতিশ্রুতি নয়; এটি মর্যাদা, ন্যায় ও মানবিকতার প্রতীক। দেশব্যাপী প্রযুক্তিনির্ভর, উদ্ভাবনী ও কমিউনিটি-ভিত্তিক প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা নেটওয়ার্ক গড়ে তুলে বাংলাদেশকে একটি প্রতিরোধমূলক ও মানুষকেন্দ্রিক স্বাস্থ্যব্যবস্থায় রূপান্তর করা সম্ভব। এই রূপান্তর শুধু স্বাস্থ্যব্যবস্থাকে উন্নত করবে না; বরং চাকরি সৃষ্টি, স্বাস্থ্য পণ্যের স্থানীয় উৎপাদন এবং গ্রামীণ উদ্যোক্তা উন্নয়নের মাধ্যমে অর্থনীতিকেও শক্তিশালী করবে।
শেষ কথাএকটি সুস্থ বাংলাদেশের যাত্রা শুরু হবে হাসপাতাল থেকে নয়, বরং প্রতিটি গ্রাম, ওয়ার্ড ও কমিউনিটি থেকে, যেখানে মানুষ বাস করে এবং স্বপ্ন দেখে। বিএনপির প্রস্তাবিত প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা বিপ্লব, ৩১ দফা রাষ্ট্র মেরামতের এজেন্ডার সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে, সর্বজনীন স্বাস্থ্যসেবা অর্জন ও জনগণের আস্থা পুনরুদ্ধারের এক বাস্তব ও দূরদর্শী রূপরেখা উপস্থাপন করছে।
ড.
জিয়াউদ্দিন হায়দার বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা, বিশ্বব্যাংকের সাবেক স্বাস্থ্য ও পুষ্টি বিশেষজ্ঞ
*মতামত লেখকের নিজস্ব
উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: র ষ ট র ম র মত র ক র যকর ব যবস থ ব এনপ র র জন য দ র বল প রব ণ ইউন ট
এছাড়াও পড়ুন:
জুলাই সনদ বাস্তবায়ন আর গণভোটের রাজনীতি
শেষ পর্যন্ত জুলাই সনদ কতটুকু বাস্তবায়ন হবে কিংবা কীভাবে বাস্তবায়ন হবে সেটা নিশ্চিত নয়, কিন্তু এটা নিশ্চিত—সংস্কার, জুলাই সনদ, গণপরিষদ, গণভোট এই শব্দগুলো রাজনীতিসচেতন মানুষের কাছে আটপৌরে শব্দে পরিণত হয়েছে। বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের সময়ে গঠিত বিভিন্ন সংস্কার কমিশন এবং বিশেষ করে ঐকমত্য কমিশনকে কেন্দ্র করে মূলধারার সংবাদমাধ্যম এবং সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে যথেষ্ট পরিমাণ আলোচনা, বিতর্ক এই প্রেক্ষাপট তৈরি করেছে।
শেখ হাসিনার পতন এবং পলায়ন-পরবর্তী সময়ে রাজনৈতিক দলগুলো সংস্কার প্রশ্নে তাদের মতো করে আন্তরিক, এটা স্পষ্ট। কিন্তু এটাও আমরা খেয়াল করছি, সংস্কারের পরিমাণ, ব্যাপ্তি এবং সেটার বাস্তবায়নের সময় ও পদ্ধতিকে কেন্দ্র করে রাজনৈতিক দলগুলো তীব্র বিতর্কে জড়িয়েছে।
এই বিতর্ক যে শুধু ঐকমত্য কমিশনে হয়েছে তা নয়, এই বিতর্ক ছড়িয়েছে মাঠে–ময়দানেও। এমনকি চলছে রাজনৈতিক কর্মসূচিও। এবারই সংখ্যানুপাতিক প্রতিনিধিত্বের ভিত্তিতে জাতীয় সংসদ নির্বাচন এবং জুলাই সনদ বাস্তবায়নে জাতীয় নির্বাচনের আগেই গণভোট অনুষ্ঠান করার দাবিতে জামায়াতে ইসলামী এবং কিছু ইসলামি দল মাঠে জনসমাবেশ, মিছিল, মানববন্ধনের মতো কর্মসূচি পালন করছে।
আরও পড়ুনজুলাই সনদ সই হলে বাস্তবায়নের পথ কতটা মসৃণ৪ ঘণ্টা আগেমোটাদাগে বলা যায় ঐকমত্য কমিশনের প্রস্তাবিত সংস্কারগুলোতে অপরাপর দলগুলোর তুলনায় বেশি দ্বিমত প্রকাশ করেছে বিএনপি। এবং এই দ্বিমত প্রকাশকে কেন্দ্র করে নানাভাবে বিএনপিকে প্রশ্নের মুখে ফেলেছে প্রতিদ্বন্দ্বী রাজনৈতিক দলগুলো। আকার-ইঙ্গিতে বলার চেষ্টা করা হয়েছে কম সংস্কার চাওয়ার মাধ্যমে বিএনপি নতুন করে স্বৈরাচারী হয়ে ওঠার মানসিকতার প্রমাণ দিয়েছে। অর্থাৎ এটাকে রাজনীতির লাভালাভের বিষয় বানিয়েছে প্রতিদ্বন্দ্বী দলগুলো।
জুলাই সনদ বাস্তবায়নে ঐকমত্য কমিশন প্রাথমিক প্রস্তাবে বলেছিল প্রস্তাবগুলো পরবর্তী সংসদ প্রথম দুই বছরের মধ্যে বাস্তবায়ন করবে। এই প্রস্তাবের সঙ্গে বিএনপি একমত হলেও জামায়াতে ইসলামী, এনসিপিসহ আরও বেশ কিছু দল প্রস্তাবটি মেনে নেয়নি। তারা চেয়েছে নির্বাচনের আগেই জুলাই সনদের আইনি ভিত্তি নিশ্চিত করতে হবে। এর মাধ্যমে অন্য দলগুলো বিএনপির ওপরে অনাস্থা জনগণের সামনে প্রকাশ করেছে। এখানেও আছে রাজনৈতিক লাভালাভের প্রশ্ন।
ঐকমত্য কমিশনে বিএনপি যেভাবে আলোচনা করেছে, তাতে যৌক্তিকভাবেই মনে হয় যতটুকু সংস্কারের সঙ্গে বিএনপি একমত হয়েছে, সেটুকু তারা নিশ্চয়ই বাস্তবায়ন করবে। বাস্তবায়নের সদিচ্ছা না থাকলে দলটি একমত হয়নি, এমন অনেক ব্যাপারে আপাত–মতৈক্য দেখিয়ে সমালোচনা এড়াতে পারত। কিন্তু সেটা না করে বিএনপি তার অবস্থানে শক্ত থেকেছে। এর ফলে দীর্ঘদিন নাগরিক সমাজে আলোচিত কিছু মৌলিক কাঠামোগত সংস্কারের সঙ্গে দ্বিমত হওয়ায় বিএনপি সমালোচিত হয়েছে।
সংখ্যানুপাতিক প্রতিনিধিত্বের ভিত্তিতে জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আলাপে জামায়াতে ইসলামী বেশ আগে থেকেই ছিল। শেখ হাসিনার পতনের পর তারা এটার কথা বললেও জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের প্রাথমিক প্রস্তাবের পর আলোচনায় জামায়াতে ইসলামী এই দাবি তোলেনি। কিন্তু তিন মাস আগে ঢাকায় মহাসমাবেশ করে জামায়াতে ইসলামী এবং ইসলামী আন্দোলন সংসদ নির্বাচনে সংখ্যানুপাতিক প্রতিনিধিত্বের পক্ষে বেশ কঠোর অবস্থান নেয়। শুধু তাই না, পরবর্তী সময়ে জামায়াতে ইসলামী বিভাগ, জেলা এমনকি উপজেলা পর্যায়েও এই দাবিতে মিছিল, সমাবেশ করেছে।
জামায়াতে ইসলামী এই সংসদ নির্বাচন সংখ্যানুপাতিক প্রতিনিধিত্বের ভিত্তিতে করাতে ব্যর্থ হওয়া তার নির্বাচনের ফলে প্রভাব পড়তে পারে ভেবে নিশ্চয়ই শঙ্কিত। বিশেষ করে আওয়ামী লীগের অবর্তমানে জামায়াত যখন বিএনপির বিরুদ্ধে শক্ত প্রতিদ্বন্দ্বিতা গড়ে তোলা এমনকি তাকে পরাজিত করার স্বপ্ন দেখছে, তখন এটা তাদের জন্য বড় রাজনৈতিক মূল্য চোকানোর কারণ হতে পারে। অর্থাৎ জামায়াতকে একটা বিজয় নিয়ে নির্বাচনে যাওয়ার পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। এখানেই আছে গণভোট নিয়ে রাজনীতির প্রশ্ন।সংখ্যানুপাতিক প্রতিনিধিত্বের ভিত্তিতে জাতীয় সংসদ নির্বাচনের দাবি রাজনৈতিক পরিমণ্ডলে জামায়াতকে বেশ প্রাসঙ্গিক রেখেছে লম্বা সময়। মূলধারার সংবাদমাধ্যমের খবরে, টক শোতে সামাজিক মাধ্যমে তুমুল আলোচনা-বিতর্ক হয়েছে এমন একটি ইস্যুতে, যেটা আলোচনায় আসার কথাই ছিল না। কারণ, জাতীয় সংসদ নির্বাচনে (উচ্চকক্ষ চালু হলে যা হবে নিম্নকক্ষ) সংখ্যানুপাতিক প্রতিনিধিত্বের ভিত্তিতে নির্বাচন আমাদের মতো অত্যন্ত অবিকশিত গণতন্ত্রের (গত দেড় দশক সেটাও ছিল না) দেশে মোটেও উপযোগী নয় তো বটেই, এটা সরকারের স্থায়িত্ব নষ্ট করে রাষ্ট্রকে মারাত্মকভাবে অস্থিতিশীল করে তুলবে, এটা মোটামুটি একটা সেটেল্ড ইস্যু ছিল।
রাজনৈতিক দলগুলো যা যা বলে সব সময় সেটা যে আন্তরিকভাবে ধারণ করে, সেটা না–ও হতে পারে। দলগুলোর মুখে অনেক সময় অনেক বক্তব্য থাকে, যেটা কারও প্রতি কোনো বার্তা বা চাপ প্রয়োগের জন্য হয়।
আরও পড়ুনজুলাই সনদ: গণভোটে বাড়বে বিভাজনের ঝুঁকি০৫ অক্টোবর ২০২৫আমি বিশ্বাস করি, নিম্নকক্ষে সংখ্যানুপাতিক প্রতিনিধিত্বের ভিত্তিতে নির্বাচন এবারই নিশ্চিত করতে সক্ষম হবে জামায়াতে ইসলামী নিজেও সম্ভবত এটা নিয়ে আশাবাদী ছিল না; বিভিন্ন সংসদীয় এলাকায় জামায়াতে ইসলামীর প্রার্থীরা বিদ্যমান পদ্ধতি মাথায় রেখেই তুমুল নির্বাচনী প্রচারণা চালাচ্ছেন অনেক দিন থেকেই। এটা নিয়ে কর্মসূচি মূলত চাপ প্রয়োগ বা শক্তি প্রদর্শনের (সরকার বা বিএনপিকে) উদ্দেশ্যেই ছিল। কিন্তু ইস্যুটিকে কেন্দ্র করে অনেক মনোযোগ পাওয়া এবং আলোচনার কেন্দ্রে থাকা জামায়াতকে অনেক বেশি দীর্ঘ সময় ইস্যুটি নিয়ে পড়ে থাকতে প্রলুব্ধ করেছে। ফলে একটা আন্দোলন করে জামায়াত পরাজিত হয়েছে, এমন একটা বোধ জনগণের মধ্যে তৈরি হতে পারে।
বাংলাদেশের রাজনীতিতে নির্বাচনের আগে কোনো রাজনৈতিক দল একটা আন্দোলনের বিজয় নিয়ে নির্বাচনে যেতে চায়। আমাদের অভিজ্ঞতা বলে এমন ক্ষেত্রে রাজনৈতিক দলগুলোর নির্বাচনে ভালো করার সম্ভাবনা অনেক বেড়ে যায়। জামায়াতে ইসলামী এই সংসদ নির্বাচন সংখ্যানুপাতিক প্রতিনিধিত্বের ভিত্তিতে করাতে ব্যর্থ হওয়া তার নির্বাচনের ফলে প্রভাব পড়তে পারে ভেবে নিশ্চয়ই শঙ্কিত। বিশেষ করে আওয়ামী লীগের অবর্তমানে জামায়াত যখন বিএনপির বিরুদ্ধে শক্ত প্রতিদ্বন্দ্বিতা গড়ে তোলা এমনকি তাকে পরাজিত করার স্বপ্ন দেখছে, তখন এটা তাদের জন্য বড় রাজনৈতিক মূল্য চোকানোর কারণ হতে পারে। অর্থাৎ জামায়াতকে একটা বিজয় নিয়ে নির্বাচনে যাওয়ার পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। এখানেই আছে গণভোট নিয়ে রাজনীতির প্রশ্ন।
আরও পড়ুনজুলাই সনদকে সংবিধানের ওপরে স্থান দেওয়া যাবে না২১ সেপ্টেম্বর ২০২৫জুলাই সনদ বাস্তবায়নে গণভোট নিয়ে বিএনপিসহ সব রাজনৈতিক দল মতৈক্যে পৌঁছেছিল। কিন্তু সেই নির্বাচন জাতীয় সংসদ নির্বাচনের দিন একই সঙ্গে, নাকি আগেই হবে, সেটা নিয়ে আবার মতদ্বৈধতা তৈরি হয়েছে। সত্যি বলতে যে গণভোটে রাজনৈতিক দলগুলো একমত হয়েছে, সেই গণভোট জুলাই সনদ বাস্তবায়ন করে ফেলবে না, সেটা বরং আগামী সংসদে বাস্তবায়ন করা হবে নাকি হবে না সেই প্রশ্নে। অর্থাৎ এই গণভোট জাতীয় নির্বাচনের আগে বা একই দিন করার ক্ষেত্রে নির্বাচনী ব্যবস্থাপনায় সুবিধা–অসুবিধার বেশি কোনো সমস্যা আসলে নেই। কিন্তু জাতীয় নির্বাচনের আগেই গণভোট আয়োজন করা নিয়ে জামায়াত এবং তার সহযোগী কয়েকটি দল এটা নিয়ে মাঠে চাপ জারি রাখছে।
একবার সংসদ নির্বাচন সংখ্যানুপাতিক প্রতিনিধিত্বের ভিত্তিতে করা নিয়ে, আবার গণভোট আয়োজনের সময় নিয়ে মাঠে কর্মসূচি দিয়ে জামায়াত নিজের শক্তি প্রদর্শনের মাধ্যমে সরকার ও বিএনপিকে চাপ প্রয়োগ যেমন করতে চায়, তেমনি আরও কয়েকটি ইসলামি দলকে সঙ্গে নিয়ে নির্বাচনী মোর্চা তৈরির ক্ষেত্রেও সেটাকে কাজে লাগাতে চায়। কিন্তু গণভোট নিয়ে তাদের আন্দোলন আসলে সংখ্যানুপাতিক প্রতিনিধিত্বের দাবিতে কর্মসূচির ‘পরাজয়কে’ ভুলিয়ে ‘জয়’ নিয়ে নির্বাচনে যাওয়ার চেষ্টার অংশ বলে মনে করার যৌক্তিক কারণ আছে।
আরও পড়ুনজুলাই সনদ নিয়ে গণভোটের সাংবিধানিক ও আইনি চ্যালেঞ্জগুলো কী০৬ অক্টোবর ২০২৫একটা গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় ক্রিয়াশীল সব রাজনৈতিক দল রাষ্ট্র এবং জনগণের কল্যাণে সব বিষয়ে একমত হবে, এটা আশা করতে দোষ নেই, কিন্তু বিশ্বের গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রগুলোর পথপরিক্রমার ইতিহাস দেখলে দেখা যায়, ব্যবস্থাটা এভাবে কাজ করে না। রাষ্ট্র ও জনগণের কল্যাণের কীভাবে, কোন পদ্ধতিতে করা হবে, সেটা নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর যেমন দর্শনগত পার্থক্য আছে, তেমনি আছে যেকোনো পদক্ষেপ নেবার ক্ষেত্রে নিজ দলের লাভ–ক্ষতির হিসাব। জনগণ, রাষ্ট্র, রাজনৈতিক দলসহ সব অংশীজনের মিথস্ক্রিয়ার মাধ্যমেই গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা জনগণ এবং রাষ্ট্রের কল্যাণ নিশ্চিত করে। রাতারাতি সব সমস্যার সমাধান না হয়ে গেলেও এই ব্যবস্থা ক্রিয়াশীল রাখার মাধ্যমে জনগণের কল্যাণ এবং চাওয়াকে ক্রমে কার্যকর করা যায়।
জাহেদ উর রহমান বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক
মতামত লেখকের নিজস্ব