গাড়ির বিমা কেন করবেন, কী সুবিধা পাবেন
Published: 11th, November 2025 GMT
গাড়ি এখন আর নিছক বিলাসিতার উপাদান নয়, প্রয়োজনেরও বটে। সে কারণে দেশের মধ্যবিত্তের বড় একটি অংশ গাড়ি কেনেন। এর মধ্য দিয়ে শখের সঙ্গে প্রয়োজনও মেটাচ্ছেন তাঁরা।
শখ ও প্রয়োজন যেখানে একাকার হয়ে যায়, সেখানে যত্নআত্তির বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। গাড়ির সাধারণ দেখাশোনার পাশাপাশি বিমাও একধরনের যত্নআত্তির মতো। কেননা, ঢাকাসহ দেশের সব সড়কের নিরাপত্তা নিয়ে জনমনে বড় ধরনের উদ্বেগ থাকে। দেশে প্রতিবছর ছোট–বড় অনেক দুর্ঘটনা হয়। এসব দুর্ঘটনায় গাড়ির ক্ষতি হয়।
যাঁরা গাড়ি ব্যবহার করেন, তাঁরা জানেন, একবার গাড়ির ক্ষতি হলে কত টাকা খরচ হয়। সে কারণে বিমা গুরুত্বপূর্ণ। গাড়ির যেকোনো দুর্ঘটনায় ক্ষতিগ্রস্ত মানুষ বা সম্পদের ক্ষতিপূরণ গাড়ির মালিককে বহন করতে হবে। কিন্তু দেশের প্রচলতি আইন অনুযায়ী গাড়ির জন্য বিমা করা বাধ্যতামূলক নয়। তারপরও বিমা করা ভালো। বিমার কাজ হলো ঝুঁকির বিপরীতে নিরাপত্তা দেওয়া। ফলে মোটর বিমা করা থাকলে একদিকে যেমন গাড়ির মালিক সুরক্ষিত থাকতে পারেন, তেমনি সরকারও রাজস্ব আয় করতে পারে।
গাড়ি বিমায় যেসব সুবিধা
বিমা করা থাকলে কিছু সুনির্দিষ্ট কারণে গাড়ি ক্ষতিগ্রস্ত হলে বিমা সুবিধা পাওয়া যায়। সেগুলো হলো:
১.
২. চুরি, বাড়ি ভাঙা বা ডাকাতি
৩. চুরির কারণে সম্পত্তি নষ্ট
৪. দাঙ্গা, ধর্মঘট, ক্ষতিকর কর্মকাণ্ড
৫. দাঙ্গা, ধর্মঘট, ইচ্ছাকৃত ক্ষতি বা সন্ত্রাস কর্মকাণ্ড
৬. প্রাকৃতিক দুর্যোগ ও ভূমিকম্প
৭. সরাসরি ভূমিকম্প বা ভূমিকম্পের ফলে অগ্নিকাণ্ড
৮. বন্যা, ঝড়, ঘূর্ণিঝড়, সাইক্লোন
৯. দুর্ঘটনাজনিত গাড়ির বাইরের অংশের ক্ষতি
১০. গাড়ি পরিবহনের সময় পথে ক্ষতি
কী লাভ
এই ধরনের ক্ষতির পুষিয়ে নিতে বিপুল অর্থের প্রয়োজন হয়। বিমা মানুষকে অর্থাৎ গাড়ির মালিকদের এ ধরনের ঝুঁকি থেকে সুরক্ষিত রাখে। অর্থাৎ ক্ষতিপূরণ দেয়। তাই রাস্তায় গাড়ি নামাতে বা চালাতে হলে মোটর বিমা বাধ্যতামূলক করা উচিত বলেই মনে করেন বিশ্লেষকেরা।
এ বিষয়ে নিটোল ইনস্যুরেন্সের চেয়ারম্যান এ কে এম মনিরুল হক বলেন, বাংলাদেশের আর্থসামাজিক পরিস্থিতি বিবেচনায় এবং পার্শ্ববর্তী দেশগুলোর আদলে তৃতীয় পক্ষের মোটর বিমা বাধ্যতামূলক করা যেতে পারে। এতে অন্তত ন্যূনতম দায়বদ্ধতা থাকবে। বর্তমান প্রিমিয়ামের হার ও ক্ষতিপূরণের অঙ্ক বাড়াতে হবে। ক্ষতি ও দাবি পূরণের প্রক্রিয়া সহজ করা, আদালতে স্থায়ী বেঞ্চ গঠন করে ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তিদের শিগগিরই ক্ষতিপূরণের ব্যবস্থা করার সুপারিশ করেন তিনি।
বিমা করতে কী লাগে
মোটর বিমা করতে সাধারণত গাড়ির রেজিস্ট্রেশন–সংক্রান্ত কাগজপত্র, ড্রাইভিং লাইসেন্স, কর পরিশোধের প্রমাণপত্র (ট্যাক্স টোকেন), মালিকের পরিচয়পত্রসহ (যেমন জাতীয় পরিচয়পত্র বা পাসপোর্ট) নানা তথ্য ও দলিল প্রয়োজন হয়। বিমা করতে চাইলে এসব কাগজপত্র নিয়ে সরাসরি বিমা কোম্পানির কার্যালয়ে যোগাযোগ করা যায়।
উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: দ র ঘটন
এছাড়াও পড়ুন:
কোল-বসতি উচ্ছেদ: পুনর্বাসনের পথ বনাম অধিকারের জমিন
‘বাবুডাইং’ ছবির মতো সুন্দর এক ছিমছাম গ্রাম, যার অবস্থান কাগজে-কলমে রাজশাহীর গোদাগাড়ীতে হলেও চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলার সদরই এখানকার নিকটবর্তী নাগরিক লোকালয়। এই গ্রামের অধিকাংশ মানুষ জাতিতে কোল ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর সদস্য, তাঁরা কথাও বলেন কোল ভাষায়।
অস্ট্রো-এশিয়াটিক ভাষার সঙ্গে বাংলা ভাষার একটা বেশ ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক আছে দেশি শব্দের উৎস হিসেবে। এই ভাষার সংরক্ষণের কাজের সুবাদেই কোলভাষীদের সঙ্গে জানাশোনা বেশ লম্বা সময়ের। বাবুডাইং ও এর আশপাশের আরও কিছু গ্রামেই বসবাসরত বেশ কিছু কোল পরিবার মিলিয়ে এই ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর মানুষের সংখ্যা প্রায় হাজার তিনেক। মাটির একদম কাছাকাছি এসব মানুষ নিখাদ নির্বিরোধী।
ক্ষেত্রবিশেষে আমাদের শহুরে বুদ্ধির হিসেবে এতই সরল যে, আমরা নির্দ্বিধায় তাঁদের বোকা বলে বসতে পারি। যেমন সমতলের এমন ভূমিপুত্রদেরই এক মানুষের পিতা–মাতার নামের স্থানে লেখা হয় ‘মনে নাই’; কিংবা কারও নাম বিবিজানের বদলে লেখা হয় ‘টিটিজান’।
আরও পড়ুনআসুন, কোলদের প্রতি মানবিক হই০৪ নভেম্বর ২০২৫নামবদলের এই রসিকতাকে এত সরল চোখে দেখার আগে, আবার স্মরণ করা যাক, ২৭ অক্টোবর বাবুডাইং গ্রামের পাঁচটি কোল পরিবারের ঘরবাড়ি কোনো প্রত্যক্ষ নোটিশ ছাড়াই রীতিমতো গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। বাড়িঘরের সঙ্গে গুঁড়িয়ে যায় সাদাসিধে আসবাব, ধান কাটার কাস্তে, কৃষির সরঞ্জাম, গৃহপালিত পশুপাখির জায়গা, রান্নাঘরের দুপুরের আধা সিদ্ধ হওয়া ভাত এবং তাঁদের এত দিনের বসতভিটার অধিকারবোধ! তাঁরা জানতেন যে এখানেই তাঁদের বাস, এটা খাসজমিই বটে।
কিন্তু তাঁরা জানতেন না, তাঁদের কয়েক পুরুষ আগের তিলক মাঝি, দিনু মাঝি, ভাদু মাঝিদের নাম থেকে নিজেদের মালিকানায় জমির দখল রাখতে হয়। তাঁরাই নিজেদের পূর্বপুরুষের পূর্ণ নাম থেকেই বিস্মৃত হন। কারণ, তাঁদের পরিচয়পত্রের পিতা–মাতার নামের স্থলে দায়সারাভাবে ‘মনে নাই’ শব্দজোড়া বসিয়ে দেওয়ার নজিরও রয়েছে। এই রকম অবিশ্বাস্য রকমের ভুলের এবং অবহেলার চূড়ান্তে এসব মানুষের বাস, যা আমাদের নাগরিক মানসে এক বিষাদী-মশকরা হয়ে ধরা দেয়।
যেসব মানুষ নিজেদের জমির মালিকানা বিষয়েই অবগত নন, যাঁদের অনেকেরই এখনো জাতীয় পরিচয়পত্র ভুলে ভরা, যাঁদের অনেকেই এখনো দিতে জানেন না স্বাক্ষর—তাঁরা খাসজমি খুঁজে পাওয়ার দায়িত্ব নেবেন, আর খুঁজেও পাবেন, এটা অনেকটাই অবাস্তব।এ ঘটনার ১২ দিন পেরোলেও, ৭ নভেম্বর পর্যন্ত, এই পাঁচ পরিবারের কিছু মানুষের বসবাস এখনো বাঁশঝাড়ের নিচে, কিছু মানুষ বাড়ির আধভাঙা ঘরে। এই সময়েও একটি রাষ্ট্রের এত জন নাগরিক খোলা আকাশের নিচে বাস করছেন, এমন সংবাদ সয়ে নেওয়ার নির্লিপ্ততা অর্জন করলেও—কোল মানুষদের কাছ থেকেই আমরা তাঁদের স্পষ্ট কথা, উচ্ছেদের কোনো নোটিশ তাঁরা পাননি। এমনকি উচ্ছেদের জন্য আসার পর তাঁরা তাঁদের একান্ত জরুরি ব্যবহার্য কিছুই সরিয়ে নিতে পারেননি, অনেক অনুরোধ সত্ত্বেও।
উচ্ছেদ কার্যক্রমে আসা পুলিশের প্রতিনিধির কাছে তাঁরা যখন রায়ের কপিটি দেখতে চেয়েছিলেন, সেটিও দেখানো হয়নি। প্রশ্ন আসতে পারে, কেন স্থানীয় প্রশাসন এ ব্যাপারে কিছু অবগত ছিল না? সে উত্তর এখনো অনুচ্চারিত। পরবর্তী সময় বিভিন্ন গণমাধ্যমের প্রতিবেদনে উচ্ছেদের বিষয়টি অনেকেরই দৃষ্টিগোচর হলে, স্থানীয় প্রশাসনের পক্ষ থেকে তাঁদের পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করা হবে বলে জানানো হয়।
এরই পরিপ্রেক্ষিতে তাঁদের অন্য খাসজমিতে ঘর তুলে দেওয়ার ব্যবস্থা করার আশ্বাস থাকলেও সে ব্যাপারে আদতে উল্লেখযোগ্য পদক্ষেপ এখনো আসেনি; বরং কোল মানুষদেরই বলা হয়েছে, খাসজমি খুঁজে স্থানীয় জনপ্রতিনিধি, তথা সংশ্লিষ্ট ইউপি চেয়ারম্যান-মেম্বারদের জানান দিতে। যেসব মানুষ নিজেদের জমির মালিকানা বিষয়েই অবগত নন, যাঁদের অনেকেরই এখনো জাতীয় পরিচয়পত্র ভুলে ভরা, যাঁদের অনেকেই এখনো দিতে জানেন না স্বাক্ষর—তাঁরা খাসজমি খুঁজে পাওয়ার দায়িত্ব নেবেন, আর খুঁজেও পাবেন, এটা অনেকটাই অবাস্তব। এবং আসলেই নতুন খাসজমিতে পুনর্বাসনের সদিচ্ছা কতটুকু, তা–ও প্রশ্নের জন্ম দেয় আবারও। এমনকি যে উচ্ছেদকৃত জমিতে তাঁদের বসতবাড়ির ধ্বংসাবশেষ পড়ে আছে, সেটাও আগামী কয়েক দিনের মধ্যে সরিয়ে ফেলার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। একদিকে যেমন তাঁদের ঘরবাড়ির ভেঙে দেওয়া হলো, আবার সেই ভগ্নাংশটুকুও সরিয়ে ফেলায় দায়িত্বটুকুও তাঁদেরই ওপরেই চাপানো হচ্ছে।
এ ক্ষেত্রে স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের প্রত্যক্ষ অংশগ্রহণ আর স্থানীয় প্রশাসনের সক্রিয় তদারকি না হলে, যাবতীয় পুনর্বাসন প্রতিশ্রুতি অনেকটাই পত্রিকার কাগুজে হরফেই আটকে থাকবে। এখন ব্যাপার হচ্ছে, এই যে নতুন জমিতে পুনর্বাসনের আগে এটি নিশ্চিত করা যে এই জমির আসল মালিকানা কোল জাতিগোষ্ঠীর মানুষদের কি না? স্টিফেন সরেনসহ অন্যান্য আদিবাসী সংগঠনের দায়িত্বশীলেরাও জানিয়েছেন, এই বিষয়ে আইনি পদক্ষেপ নেওয়ার সুযোগ আছে। এমন পরিস্থিতিতে আদালতের উচ্ছেদ আদেশের ওপর যদি সাময়িক স্থগিতাদেশও নিশ্চিত করা যায়, সেটিই সবচেয়ে উপকারী ও মানবিক সিদ্ধান্ত হবে।
উচ্ছেদের শিকার কোল মানুষগুলোর এখন স্থির দাবি এমনটাই, তাঁরা যে জমিতে বাস করছিলেন, সেই জমি নিয়ে একটি নিরপেক্ষ এবং আন্তরিক অনুসন্ধানী সিদ্ধান্ত। এখনো আকাশের নিচে বাস করা মানুষগুলোর এইটুকু মনের জোর আছে, এই জমিগুলোর মূল উত্তরাধিকারী তাঁরাই। তাঁদের এই দাবির সত্যতা যাচাইয়ের জন্য হিমালয়সম পর্বত পার হতে হয় না, বরং স্থানীয় ভূমি অফিসের রেকর্ড অনুসন্ধান করেই এর সুরাহা সম্ভব দ্রুততম সময়ে।
একই সঙ্গে কোল জাতির এসব মানুষের পূর্বসূরিদের মৃত্যু নিবন্ধন এবং তাঁদের ওয়ারিশনামা মিলিয়েও নিশ্চিত করা তাঁদের ভূমির অধিকার, যদি এই রাষ্ট্রব্যবস্থা অন্তত কিছুটা হলেও মানবিক হওয়ার দায় রাখে।
স্থানীয় জনপ্রতিনিধি ও প্রশাসনের সমন্বয় শুধু মৌখিক নির্দেশের বলয়ে না থেকে; বরং বাস্তবায়নের নিমিত্তে স্থানীয় শিক্ষিত কোল-তরুণদের সঙ্গে নিয়ে নিশ্চিত করা গেলেই আরও যেসব জমির মালিকানা কোল জাতির মানুষদের আছে, সেগুলো বের করে তাঁদের প্রাপ্য জমির হিস্যা বুঝিয়ে দেওয়া সম্ভব হওয়া অসম্ভব কিছু নয়।
সমতলের যেসব আদিবাসী তথা ভিন্ন জাতিসত্তার মানুষেরা আছেন, বাঙালির একডাকে সবাইকে ডেকে ফেলে—সাঁওতাল! অথচ সাঁওতাল ছাড়াও রয়েছে কোল, মুন্ডা, মাহলে, পাহাড়িয়া, কোডা, পাহানসহ অন্য আরও সব জাতিসত্তার আদিবাসী মানুষ। তাই প্রান্তিকের মধ্যেও প্রান্তিকতম কোল মানুষদের ছোট্ট বলয় ওই বাবুডাইং গ্রামের চারপাশ; আর সেখানেও যখন ভূমিগ্রাসী মানুষের ক্ষমতার কৌশল ধারালো হয় ক্রমে, কোল মানুষদের অধিকারের জমিন ক্রমে সংকুচিত হয়। রুমালি হাঁসদাকে জিজ্ঞাসা করা হয়, কেমন আছেন?
প্রত্যুত্তরে রুমালি দিদি যখন বলেন, কেমন আর থাকা যায়? আমরা উত্তরপ্রাপ্তির বদলে আরেক প্রশ্নই পাই, যার উত্তর খোদ ক্ষমতা ও রাষ্ট্রের কাছে। দায়িত্বশীল প্রতিষ্ঠান হিসেবে রাষ্ট্র যখন নিরুত্তর থাকে, তখন আমাদেরই সমস্বরে সেই উত্তর খোঁজার একটা দায় থাকে। কারণ, কোল জাতির এই আবাসের উচ্ছেদ শুধু একটি একক কোনো ঘটনা তো নয় বটেই; বরং সমতলের জাতিসত্তার মানুষের ভূমির অধিকারের প্রতি অন্যায্যতার শুরুর ঘটনা। এর প্রতিরোধের দায়টাও নাগরিক হিসেবে সবারই, নতুবা কোল বসতির এই অন্যায্য উচ্ছেদ অন্যায্যতার চিহ্ন ছাপই হয়ে থাকবে এই আমাদেরই জমিনে।
মাশরুর ইমতিয়াজ সহকারী অধ্যাপক, ভাষাবিজ্ঞান বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
*মতামত লেখকের নিজস্ব