সন্তকবি রবিদাসের ‘বেগমপুরা’ শহর
Published: 10th, November 2025 GMT
সন্ত রবিদাস (রইদাস, রবিদাসজি) পঞ্চদশ থেকে ষোড়শ শতকের এক মহান ভারতীয় সাধক, কবি ও সমাজসংস্কারক। উত্তর ভারতের ভক্তি আন্দোলনের তিনি অন্যতম পুরোধা। তাঁর অনুসারীরা রবিদাসিয়া নামে পরিচিত। তাঁর কাব্য ও শিক্ষা বর্ণভেদপ্রথার বিরুদ্ধে অবস্থান নেয় এবং এক ঈশ্বরপ্রেমমূলক, সমতাভিত্তিক সমাজের স্বপ্ন দেখায়। পাঞ্জাবি, হিন্দি ও ব্রজ ভাষায় রচিত তাঁর বহু পদ ‘গুরু গ্রন্থ সাহিব’-এ অন্তর্ভুক্ত হয়েছে, যা তাকে শিখধর্মের মধ্যেও বিশেষ মর্যাদা দিয়েছে।
সন্ত রবিদাসজির জন্ম ১৪৫০ সালের আশপাশে (কিছু মতে ১৩৭৭/১৩৮৮) বর্তমান উত্তর প্রদেশের বারানসি (কাশী) শহরের কাছে সীর গোবর্ধনপুর গ্রামে এক চর্মকার পরিবারে। তাঁর পিতা সন্তোক দাস ও মাতা কলসী দেবী ছিলেন সমাজে নিম্নবর্ণভুক্ত। পিতার পেশা ছিল চর্মশিল্প। রবিদাস ছোটবেলা থেকেই আধ্যাত্মিক ভাবধারায় আকৃষ্ট হন। সংসারধর্মে অত আগ্রহ ছিল না তাঁর।
সন্ত রবিদাস (রইদাস, রবিদাসজি) পঞ্চদশ থেকে ষোড়শ শতকের এক মহান ভারতীয় সাধক, কবি ও সমাজসংস্কারক। উত্তর ভারতের ভক্তি আন্দোলনের তিনি অন্যতম পুরোধা। তাঁর অনুসারীরা রবিদাসিয়া নামে পরিচিত।রবিদাস ছিলেন ভক্তিযুগের অন্যতম প্রাণপুরুষ। তাঁর উপাসনা ছিল ‘নির্গুণ ভক্তি’। কোনো মূর্তিতে নয়, বরং হৃদয়ের মধ্যেই ঈশ্বরের অনুভব ছিল তাঁর আরাধ্য। তিনি বিশ্বাস করতেন, ‘মন চাঙ্গা তো কাঠৌরি মে গঙ্গা’। অর্থাৎ, মন পবিত্র হলে, কাঠের পাত্রেও গঙ্গার পবিত্রতা বিরাজ করে। তিনি চেয়েছেন জাত-পাতের ভেদ ভুলে, সবাই যেন এক প্রভুর সন্তান হয়ে থাকে। তাঁর একটি বিখ্যাত কাব্যপঙ্ক্তি :
‘রবিদাস জন্ম কে কারণে হোতি নাহি কওি নীচ।
নারি ভুজন কর দ্বারায়ে সোই দেব সম তাচ।’
অর্থাৎ, রবিদাস বলে—জন্মের কারণে কেউ নীচ হয় না। নীচ করে তো মানুষের কর্ম, কর্মেরই কাদা তাকে ডোবায়। যে নারীকে সম্মান করে, তাকে দেবতার মতো জ্ঞান করো।
রবিদাস ছিলেন সমাজে প্রচলিত বর্ণবৈষম্যের কঠোর সমালোচক। নিজে চর্মকার হয়েও তিনি সমাজে ‘ভক্তি’র মাধ্যমে মর্যাদা অর্জন করেন। তিনি বলতেন, একজন নিম্নবর্ণভুক্ত মানুষও যদি পরম ভক্ত হন, তবে তিনি ব্রাহ্মণের চেয়ে শ্রেষ্ঠ।
‘বেগমপুরা’ তাঁর সবচেয়ে সাড়াজাগানো কবিতা। ‘বেগমপুরা’ হলো রবিদাসের স্বপ্নের শহর, মার্ক্সেরও আগের সাম্যবাদ, ফরাসি বিপ্লবেরও আগের সাম্য-মৈত্রী-স্বাধীনতার মেনিফেস্টো। রাষ্ট্রহীন, শ্রেণিহীন, বর্ণহীন—সব অসাম্যমুক্ত এক কল্পনগর।
রবিদাসজির এই বিখ্যাত ইউটোপিয়া আজও প্রাসঙ্গিক, আজও প্রণোদনা-জাগানিয়া, যেখানে নেই কোনো কষ্ট, জাতবিভেদ, শোষণ বা যন্ত্রণা। তিনি কল্পনা করেছিলেন এক বর্ণহীন ও শ্রেণিহীন সমাজের, যেখানে সবাই সমান, সবাই মুক্ত।
‘বেগমপুরা শহর কো নাঁও।
দুখ অন্ধোহ নাহি তহি ঠাঁও।।’
রবিদাস হিন্দি, ব্রজ ও পাঞ্জাবি মিশ্রিত ভাষায় পদ রচনা করেন। তাঁর কাব্যে ছিল সরলতা, ঈশ্বরপ্রেম ও মানবসমতার বার্তা। তাঁর প্রায় ৪০টি রচনা ‘শ্রী গুরু গ্রন্থ সাহিব’-এ অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। তাঁর পদাবলিতে আত্মবোধ, ভক্তিরাগ, সমাজসচেতনতা ও আধ্যাত্মিক অভিজ্ঞতার সমন্বয় লক্ষ করা যায়।
রবিদাসের প্রভাব উত্তর ভারতজুড়ে ছড়িয়ে পড়ে। তাঁর অনুসারীরা আজও রবিদাসিয়া নামে পরিচিত। পাঞ্জাবে, উত্তর প্রদেশে, মধ্যপ্রদেশে, রাজস্থানে এবং দেশের বাইরে পাঞ্জাবি শিখ ও দলিত জনগোষ্ঠীর মধ্যে তিনি গভীরভাবে সম্মানিত।
তিনি যে ‘বেগমপুরা’র স্বপ্ন দেখেছিলেন, তা আজও মানবসমাজের সামনে এক নৈতিক আদর্শ, যেখানে নেই শ্রেণি, নেই শোষণ—আছে কেবল প্রেম, সমতা ও ভক্তির ঐক্য।
সন্ত রবিদাসের একগুচ্ছ কবিতা রবিদাস হিন্দি, ব্রজ ও পাঞ্জাবি মিশ্রিত ভাষায় পদ রচনা করেন। তাঁর কাব্যে ছিল সরলতা, ঈশ্বরপ্রেম ও মানবসমতার বার্তা। তাঁর পদাবলিতে আত্মবোধ, ভক্তিরাগ, সমাজসচেতনতা ও আধ্যাত্মিক অভিজ্ঞতার সমন্বয় লক্ষ করা যায়।তুমি যদি পর্বত হও
তুমি যদি পর্বত হও,
তবে আমি ময়ূর।
তুমি যদি চাঁদ হও,
তবে আমি চকোর।
ও মাধো, তুমি যদি আমাকে ছাড়ো,
তবে আমিও তোমাকে ছাড়ব।
আর আমি যদি তোমায় ছাড়ি,
তবে আর কার শরণ নেব আমি?
তুমি যদি প্রদীপ হও,
তবে আমি সলতে।
তুমি যদি তীর্থস্থান হও,
তবে আমি তীর্থযাত্রী।
তোমার প্রতি আমার ভালোবাসা
খাঁটি এবং সত্য।
আমি যখন তোমায় ভালোবেসে ফেলি,
তখনই ত্যাগ করি সকল অন্য প্রেম।
আমি যেখানেই যাই,
সেখানে তোমারই সেবা করতে চাই।
আর কোনো দেবতা
তোমার মতো প্রভু হতে পারে না।
তোমার বন্দনায়
আমি কেটে ফেলি যমের ফাঁস।
ভালোবাসার তৃষ্ণায়
রবিদাস উচ্চ স্বরে গান গায়।
নামই সত্য
নামই একমাত্র সত্য,
হে রবিদাস, শুরুতে যেমন ছিল সত্য,
শেষেও তাই থাকবে সত্য।
নামই সমস্ত পাপ ও যন্ত্রণার বিনাশ করে,
এবং এটাই প্রকৃত আনন্দের ধনভান্ডার।
একমাত্র মনে করে ধ্যান করো,
ভগবানের প্রতি ভক্তি করো, হে রবিদাস।
ভেতরে যেন আপনিই যেন বাজে
সত্য নামের অনুরণন।
যখন সুরত (চেতনা) শব্দে (শব্দরূপ ঈশ্বরে) মিশে যায়,
তখনই মিলন ঘটে পরম আনন্দের।
ভেতরে জ্বলে আলো,
আর উদ্ভাসিত হয় ঐশ্বরিক সুখ।
যখন আমি ছিলাম
যখন আমি ছিলাম,
তখন তুমি ছিলে না।
এখন তুমি আছ,
আমি আর নেই।
যেন ঝড় তোলে ঢেউ
জলে—
তবু সবই জলজলে।
ও মাধো,
এই মায়াকে কেমন করে ব্যাখ্যা করি?
যা আমরা ভাবি, তা তো নেই।
একজন রাজা
সিংহাসনে ঘুমিয়ে
স্বপ্নে দেখে সে এক ভিখারি।
তার রাজ্য চোখের সামনে উধাও হয়ে গেলে
সে ভারী শোকে ডুবে যায়—
আমাদের অবস্থাও তাই।
যেন সেই সাপ-রশির কাহিনি—
আমি কিছুটা জানি এই রহস্য।
অনেক বালা দেখেও আমরা ভাবি
সোনার কত রকম রূপ!
কিন্তু সবই আসলে চিরকাল সোনা।
সবকিছুর মধ্যেই
আছেন প্রভু,
অসংখ্য রূপে প্রকাশিত।
প্রতিটি কণায় তিনি খেলেন।
রবিদাস বলে,
তিনি আমার হাতের থেকেও কাছাকাছি।
সবই ঘটে
তাঁরই ইচ্ছায়।
তুমি আমি এক
তুমি আমি এক—আমাদের মধ্যে পার্থক্য কোথায়?
আমরা সোনার মতো আর চুড়ির মতো,
জলের মতো আর ঢেউয়ের মতো।
আমি যদি পাপ না করতাম, হে অনন্ত প্রভু,
তবে তুমি পাপী উদ্ধারকারী নামে
কেমন করে পরিচিত হতে?
তুমি আমার প্রভু, অন্তরতত্ত্বজ্ঞানী, হৃদয়ের সন্ধানকারী।
ভৃত্য তার প্রভুর মাধ্যমে পরিচিত,
আর প্রভুও তার ভৃত্য দ্বারা জানা যায়।
আমার দেহ দিয়ে যেন তোমার সেবা ও উপাসনা করতে পারি।
রবিদাস বলে,
যে বোঝে যে প্রভু সবার মধ্যেই সমভাবে বিরাজমান,
সে মানুষ বিরল।
বেগমপুরা
বেগমপুরা—এই শহরের নাম,
যেখানে কোনো দুঃখ-কষ্ট নেই।
না কর, না খাজনা, না সম্পত্তির মালিকানা;
না অন্যায়, না ভয়, না নির্যাতন।
ভাইরে আমার, আমি তো এই শহরকেই নিজের বলে বেছে নিয়েছি,
দূরের এই দেশ, যেখানে সবকিছুই সঠিক, সবকিছুই সৎ।
এই রাজ্য চিরস্থায়ী, নিরাপদ ও সমৃদ্ধ,
যেখানে কেউ দ্বিতীয় বা তৃতীয় নয়—
সবাই সমান, সবাই এক।
সবাই যার যা ইচ্ছা তাই করে,
স্বচ্ছন্দে চলে রাজপ্রাসাদের ভিতর-বাহিরে,
কেউ বাধা দেয় না।
রবিদাস, এক চর্মকার, যে এখন মুক্ত;
যে আমার এই শহরের সাথি, সে-ই আমার বন্ধু।
????️ অন্য আলোর ফেসবুক পেজ ফলো করুন
.উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: রব দ স র ব গমপ র পর চ ত
এছাড়াও পড়ুন:
বিনা শুল্কে কয়টি মুঠোফোন আনতে পারবেন বিদেশফেরত যাত্রীরা
বিদেশে গেলে ফেরার সময় অনেকে মুঠোফোন কিনে আনেন। এই যাত্রীদের নিজের ছেলেমেয়ে, স্ত্রী, মা-বাবাসহ আত্মীয়স্বজনকে উপহার দেওয়ার জন্য মুঠোফোন নিয়ে আসেন। আপনি কি জানেন, বিনা শুল্কে কয়টি মুঠোফোন আনতে পারবেন?
অপর্যটক ব্যাগেজ রুলস অনুসারে, বিদেশফেরত একজন যাত্রী একটি নতুন মুঠোফোন বিনা শুল্কে আনতে পারবেন। এ ছাড়া দুটি ব্যবহৃত মুঠোফোনও আনতে পারবেন।
এর মানে হলো, নিজের ব্যবহার করা দুটি ফোনের পাশাপাশি একটি ফোন আনা যাবে। এর বেশি নতুন ফোন শুল্ক–কর দিতে হবে। মুঠোফোনে সর্বোচ্চ ২৫ হাজার টাকা কর।
একটির বেশি নতুন ফোন আনলে কত শুল্ক-কর
একটির বেশি নতুন মুঠোফোন আনা হলে একজন যাত্রীকে বাড়তি শুল্ক-কর দিতে হবে।
জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) শুল্ক বিভাগ সূত্র অনুসারে, বিদেশফেরত যাত্রীরা ৩০ হাজার টাকা পর্যন্ত দামের মুঠোফোনে শুল্ক-কর দিতে হবে ৫ হাজার টাকা। মুঠোফোনের দাম ৩০ হাজার থেকে ৬০ হাজার টাকা হলে শুল্ক-কর দিতে হবে ১০ হাজার টাকা। আর মুঠোফোনের মূল্য ৬০ হাজার টাকার বেশি হলে ২৫ হাজার টাকা শুল্ক-কর দিতে হবে।
ব্যাগেজ রুলসের আওতায় মুঠোফোন আনা কড়াকড়ি আরোপ থাকায় অবৈধপথে মুঠোফোন আসে। এতে বিপুলসংখ্যক ফোন বাজারে এসেছে। তাই মুঠোফোন আমদানিতে শুল্ক-কর কমানোর সুপারিশ করে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডকে (এনবিআর) চিঠি দিয়েছে বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশন (বিটিআরসি)।
বিনা শুল্কে আরও যা আনা যাবে
ব্যাগেজ রুলস অনুসারে, সব মিলিয়ে ১৯ ধরনের পণ্য বিনা শুল্কে এবং ১১ ধরনের পণ্য শুল্ক-কর পরিশোধ করে আনা যায়।
এ পণ্যের তালিকায় আছে দুটি ব্যবহৃত মুঠোফোন, একটি নতুন মোবাইল ফোন; ১৫ বর্গমিটার আয়তনবিশিষ্ট কার্পেট; ২৯ ইঞ্চি পর্যন্ত টেলিভিশন; ডেস্কটপ বা ল্যাপটপ; কম্পিউটার স্ক্যানার; প্রিন্টার; ভিডিও ক্যামেরা; স্টিল বা ডিজিটাল ক্যামেরা; ওভেন ও মাইক্রোওয়েভ ওভেন; রাইস কুকার, প্রেসার কুকার, গ্যাস ওভেন; টোস্টার, স্যান্ডউইচ মেকার, ব্লেন্ডার, ফুড প্রসেসর, জুসার, কফি মেকার; সেলাই মেশিন; টেবিল ফ্যান; ব্যক্তিগত ব্যবহারের জন্য খেলার সামগ্রী; ১০০ গ্রাম ওজনের সোনার গয়না; এক কার্টন সিগারেট; সিডি ও স্পিকারসহ মিউজিক সিস্টেম।
শুল্ক-কর পরিশোধ করে যে ১১ ধরনের পণ্য আনা যাবে। এগুলো হলো ১১৭ গ্রাম ওজনের স্বর্ণবার। এ জন্য ৪০ হাজার টাকা শুল্ক-কর দিতে হবে। এ ছাড়া ২৩৪ গ্রাম বা ২০ তোলা রৌপ্যবার; ৩০ ইঞ্চি ও তদূর্ধ্ব টেলিভিশন; হোম থিয়েটার; রেফ্রিজারেটর ও ডিপ ফ্রিজার; এয়ারকন্ডিশনার; ডিশ অ্যানটেনা; এইচডি ক্যামেরা; ঝাড়বাতি; বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের অনুমতি নিয়ে এয়ারগান; ডিশওয়াশার বা ওয়াশিং মেশিন বা ক্লথ ড্রায়ার আনা যাবে। এসব পণ্যে ৩০০ টাকা থেকে শুরু করে ৯০ হাজার টাকা পর্যন্ত শুল্ক-কর পরিশোধ করতে হয়।