প্রতীকী ছবি

.

উৎস: Prothomalo

এছাড়াও পড়ুন:

নতুন দর্শক-শ্রোতার সামনে হারিয়ে যাওয়া গাজীর গান

বিভিন্ন নাচের দল একের পর এক মঞ্চ মাতিয়ে গেছে। শেষে পরিবেশিত হয় লোকনৃত্য ‘ধামাইল’। এরপরই ছিল ভিন্ন আয়োজন, ভিন্ন এক পরিবেশ। রঙিন আলখাল্লায় মঞ্চে আসেন ‘গাজীর খলিফা’। একে একে তাঁর সঙ্গে সবাই মঞ্চে আসন গ্রহণ করেন। ঢোলে বাড়ি পড়তেই চাঙা হয়ে ওঠে গানের আসরটি। নতুন কিছুর অপেক্ষায় দর্শক-শ্রোতা নড়েচড়ে বসলেন।

ধীরে ধীরে বন্দনা শেষে গাজীর খলিফা শুরু করেন পুঁথির বয়ান। প্রায় হারিয়ে যাওয়া লোকজ ঐতিহ্যের ‘গাজীর গান’ যেন প্রাণ ফিরে পেয়ে জেগে ওঠে নতুন প্রজন্মের সামনে। গত ২৯ এপ্রিল সন্ধ্যায় মৌলভীবাজার পৌরসভা প্রাঙ্গণে মেয়র চত্বরের খোলা মঞ্চে ছিল এই আয়োজন। বৈশাখী লোকনাট্য উৎসব উপলক্ষে বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির নাট্যকলা ও চলচ্চিত্র বিভাগ এ আয়োজন করে। ব্যবস্থাপনায় ছিল শিল্পকলা একাডেমি মৌলভীবাজার জেলা।

সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসতেই গাজীর গানের আসর শুরু হয়। গায়েন আর বায়েন জমিয়ে তুলেন সরল কথা ও সুরের আসর। রঙিন আলখাল্লায় মোড়া গাজীর খলিফার ভূমিকায় ছিলেন মো. আবদুস শহীদ। মঞ্চে ঘুরে ঘুরে আল্লাহ-রাসুল ও অলি-আউলিয়ার নাম নিয়ে পয়ার ধরেন। একেক করে শ্রদ্ধা নিবেদন করেন, সঙ্গে বায়েনেরা গলা মেলান। সুরে ও কথার গীতল ঝংকারে চত্বরটি প্রাণে প্রাণে জেগে ওঠে।

সামনে বসা দর্শক-শ্রোতা যেমন তালে তালে দুলে ওঠেন, তেমনি চত্বরের সীমানার বাইরে সড়কের ওপর রিকশার সারি জমে যায়। রিকশাওয়ালা যাত্রী বহন বাদ দিয়ে রিকশার আসনে বসে কিংবা রিকশায় হেলান দিয়ে শোনেন গাজীর গান। শহুরে শ্রোতা-দর্শকের কাছে এ এক নতুন পাঠ, নতুন কিছু। এর আগে অনেকে গাজীর গানের নাম শুনে থাকলেও, এমন করে গাজীর গানের সঙ্গে অনেকেরই নতুন পরিচয়, নতুন মুগ্ধতা।

চতুর্দিকে বন্দনা শেষ হলে ‘খলিফা’ বা ‘গায়েন’ আসেন মূল পুঁথির কাহিনি নিয়ে। গান ও কথায় মধ্যযুগের এক প্রেমকাহিনি ‘গাজী কালু চম্পাবতী’র বয়ান চলতে থাকে। পুঁথির পরতে পরতে চমকে দেওয়ার মতো ঘটনা, পঙ্‌ক্তি, যা নির্মল আনন্দকে ধারণ করে আছে। ‘দারুণ বিধিরে না জানি কী ঘটল তামশা আমার কপালে’ কিংবা ‘হায়রে পিরিতের মরা মরছেরে মঙ্গলবারে’ এ ধরনের অনেক পঙ্‌ক্তি একদম সরল অনুভূতির প্রকাশ হয়ে বাতাসে বাতাসে ঘুরতে থাকে। পুঁথির কাহিনি গায়েন নানা অঙ্গভঙ্গি করে, মঞ্চে ঘুরে ঘুরে বলতে থাকেন। বায়েনরা সুরে সুরে সেই কথারই রেশ ধরে টানেন। এভাবে ঘণ্টাখানেক ধরে কথা ও গানে ‘গাজী–কালু চম্পাবতী’র কাহিনি বর্ণনা চলে। তাঁদের দলে গায়েনসহ ছিলেন পাঁচজন।

লোক-গবেষক ও স্থানীয় লোকজনের ভাষ্য, একসময় গ্রামীণ জনপদে আনন্দ-বিনোদনের অন্যান্য লোকজ উপাদানের সঙ্গে এই গাজীর গানটিও ছিল। নানা উৎসব-পার্বণ, নানা দিবসে গাজীর গান গাওয়া হতো। প্রায় এলাকাতেই গাজীর খলিফা ছিলেন, ছিল তাঁর দলবল। তাঁরা ঘুরে ঘুরে এগ্রাম-ওগ্রাম হয়ে দূরদূরান্তেও গাইতে যেতেন। কারও বাড়ির উঠান, কোনো খোলা জায়গায় আসর বসেছে। সারা রাত ধরে গাজীর গান চলেছে। নানা ধর্ম-বর্ণের নারী-পুরুষ, নানা বয়স ও শ্রেণির মানুষ মিলেমিশে একসঙ্গে চাটাই পেতে আসর জমিয়ে রেখেছেন।

বিনোদনের বিভিন্ন আধুনিক মাধ্যম সহজ হওয়ার পর এই লোকজ উপাদানগুলো ক্রমশ লুপ্ত হতে থাকে। অনেকেই গাজীর গানসহ লোকজ সংস্কৃতি ভুলতে বসেছেন। হারিয়ে গেছেন গায়েন ও বায়েন। তবু কিছু এলাকায় এখনো কিছু গায়েন দলবল নিয়ে গাজীর গানকে আঁকড়ে আছেন। আবদুস শহীদ এ রকমই একজন ‘গাজীর খলিফা’। তিনি এখনো ধরে রেখেছেন ১২-১৩ জনের একটি দলকে।

মেয়র চত্বরের মঞ্চে ওঠার প্রস্তুতির সময় কথা হয় আবদুস শহীদের সঙ্গে। তিনি বললেন, তাঁর বাড়ি মৌলভীবাজারের কমলগঞ্জ উপজেলার নছরতপুরে। প্রায় ৩০ বছর ধরে তিনি গাজীর গানের সঙ্গে জড়িয়ে আছেন। শুরুতে একই উপজেলার (কমলগঞ্জ) বড়গাছের ওস্তাদ আবদুল বারীর সঙ্গে বিভিন্ন স্থানে বায়েন হয়ে যেতেন। একটা পর্যায়ে তিনি ওস্তাদের সম্মতিতে খলিফার ভূমিকায় উন্নীত হন। গাজীর গানের দল নিয়ে স্থানীয়ভাবে বিভিন্ন গ্রামে গান গেয়ে থাকেন। সিলেট, গাজীপুরসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে তিনি দল নিয়ে গেছেন। তাঁর ভাষ্য, গাজীর গান আগের থেকে কমেছে। কিন্তু সাধারণ মানুষের মধ্যে গাজীর গানের আবেদন এখনো আছে। তিনি বছরে ৮-১০টা আসরে গানের ডাক পান। কখনো কোনো পালা-অনুষ্ঠানে, কখনো পারিবারিক আয়োজনে। অনেকে মানত করেও গাজীর গানের আয়োজন করে থাকেন।

স্ত্রী, দুই ছেলে নিয়ে আবদুস শহীদের সংসার। আগে পরিবহনশ্রমিক ছিলেন। এখন একটি সিএনজিচালিত অটোরিকশাস্ট্যান্ডে ব্যবস্থাপকের দায়িত্ব পালন করেন। দায়িত্ব পালনের ফাঁকেই গাজীর গানের ডাক আসে, এখানে-ওখানে ছুটে যান। প্রতিবছর ১০ ফাল্গুন বাড়িতে গাজীর গানের আয়োজন করেন তিনি। স্থানীয় লোকজন ছাড়াও দূরদূরান্তের মানুষ গাজীর গানের ভক্তরা তাঁর বাড়িতে ছুটে আসেন। আবদুস শহীদ বলেন, ‘গাজীর গান আমারে নতুন জীবন দিছে। যত দিন বাঁচিয়া আছি, গাজীর গান গাইমু।’

লোক-গবেষক আহমদ সিরাজ প্রথম আলোকে বলেন, আগে জারি–সারি গ্রামাঞ্চলে ব্যাপকভাবে ছিল। এখন তা প্রায় বিলুপ্তির পথে। আধুনিক বিনোদনের প্রবাহে সংস্কৃতির এই লোকজ উপাদান হারিয়ে যেতে বসছে। তবে মানুষের মধ্যে এখনো এসবের আবেদন আছে, আগ্রহ আছে। চতুর্দশ শতাব্দীতে এই গাজীর গানের উৎপত্তি। সারা দেশেই কমবেশি গাজীর গান প্রচলিত ছিল। ‘গাজী কালু-চম্পাবতী’ মধ্যযুগের একটি অসাম্প্রদায়িক, অপরূপ প্রেমকাহিনির পুঁথি। লোকজ এই ধারা টিকিয়ে রাখা দরকার। এগুলো হচ্ছে একটি সমন্বিত সংস্কৃতি, সব ধরনের মানুষকে টানে।

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • নতুন দর্শক-শ্রোতার সামনে হারিয়ে যাওয়া গাজীর গান