এখনো সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে হত্যা মামলা হচ্ছে, এটা গ্রহণযোগ্য নয়: কামাল আহমেদ
Published: 4th, May 2025 GMT
গণমাধ্যম সংস্কার কমিশনের প্রধান কামাল আহমেদ বলেছেন, এখনো সাংবাদিকরা গালাগালির শিকার হচ্ছেন, অনেকের বিরুদ্ধে হত্যা মামলা হচ্ছে, এটা গ্রহণযোগ্য নয়। ন্যায্য পারিশ্রমিক ও নীতিগত সহায়তা সাংবাদিকতা ও গণমাধ্যমের স্বাধীনতা নিশ্চিত করতে জরুরি। সাংবাদিক ও সংবাদমাধ্যম উভয়ে আর্থিক নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছে, যা তাদের আপস করতে বাধ্য করছে।
আজ রোববার রাজধানীর ধানমন্ডিতে ‘ব্রেভ নিউ বাংলাদেশ: রিফর্ম রোডম্যাপ ফর প্রেস ফ্রিডম’ শীর্ষক সেমিনারে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপনের সময় তিনি এসব কথা বলেন। বিশ্ব মুক্ত গণমাধ্যম দিবস উপলক্ষে যৌথভাবে সেমিনারটি আয়োজন করে ইউনেসকো ঢাকা অফিস, ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি) ও সুইডেন দূতাবাস।
সেমিনারে কামাল আহমেদ বলেন, অনেকে বলছেন যে, সংবাদমাধ্যমকে পাবলিক লিমিটেড কোম্পানিতে রূপান্তরের যে প্রস্তাব কমিশন করেছে, তা অবাস্তব। কারণ হিসেবে তারা বলেছেন, বেশিরভাগ সংবাদমাধ্যম লাভ করতে পারছে না বা রুগ্ন প্রতিষ্ঠান। কিন্তু এসব গণমাধ্যম কোম্পানির মধ্যে যাদের হিসাব রেজিস্ট্রার অব জয়েন্ট স্টক কোম্পানির দপ্তর থেকে পাওয়া গেছে, তার আর্থিক বিবরণী বিশ্লেষণে দেখা গেছে, প্রায় দেড় ডজনের বেশি সংবাদমাধ্যম লাভজনক, যা প্রমাণ করে- এ ধরনের রূপান্তর মোটেও অযৌক্তিক নয় এবং তা বাস্তবায়ন করা সম্ভব।
তিনি আরও বলেন, মূল সমস্যা হলো বাজারে প্রয়োজনের তুলনায় অনেক বেশি গণমাধ্যম প্রতিষ্ঠান যেনতেনভাবে পরিচালিত হচ্ছে। তারা রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষকতা বা বিভিন্ন স্বার্থবাদী গোষ্ঠীর সহায়তার ওপর নির্ভরশীল হয়ে আছে। পাঠক বা শ্রোতার আকৃষ্ট করতে না পারলেও তারা টিকে থাকার চেষ্টায় বিজ্ঞাপনের দরে অস্বাভাবিক হারে ছাড় দিয়ে পুরো খাতের ক্ষতি করছে।
কামাল আহমেদ বলেন, গণমাধ্যমের সেলফ সেন্সরশিপ ও সাংবাদিকদের ওপর বেশিরভাগ হামলার পেছনে এখন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে হুমকি এবং কথিত মব ভায়োলেন্স কাজ করছে। সরকারের এগুলো কঠোর হাতে নিয়ন্ত্রণের কথা থাকলেও তা দেখা যাচ্ছে না।
অনলাইনে ভুল তথ্য ও প্রপাগান্ডা মোকাবিলায় কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (এআই) ব্যবহার করা যেতে পারে বলে মন্তব্য করেছেন ঢাকায় নিযুক্ত সুইডেনের রাষ্ট্রদূত নিকোলাস লিনাস রাগনার উইকস। তিনি বলেন, ‘এখনো গণমাধ্যমকর্মীরা বলছেন, তারা অনেক প্রতিবেদন করার ক্ষেত্রে ফিল্টারিং করছেন, এখনো মুক্তভাবে কাজ করতে পারছেন না।’
গণমাধ্যম সূচকে বাংলাদেশের কিছুটা এগিয়ে আসা ইতিবাচক উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘গণমাধ্যমে নারীদের সুষ্ঠু কর্ম পরিবেশ নিশ্চিত করতে হবে।
মুক্ত গণমাধ্যম ছাড়া মানবাধিকার নিশ্চিত করা যাবে না বলেও মনে করেন রাষ্ট্রদূত। তিনি বলেন, ‘যখন সাংবাদিকের বাকস্বাধীনতা কেড়ে নেওয়া হয়, তখন তার সঙ্গে সাধারণ জনগণও বাকস্বাধীনতা হারায়।’
বাংলাদেশে মুক্ত গণমাধ্যম ও স্বাধীন সাংবাদিকতার অবস্থা দিন দিন আরও খারাপ হচ্ছে বলে মন্তব্য করেন সংবাদপত্রের মালিকদের সংগঠন নিউজপেপার্স ওনার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (নোয়াব) এর সভাপতি ও টাইমস মিডিয়া লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক এ কে আজাদ।
অন্তর্বর্তী সরকারের সময়কালে গণমাধ্যমের স্বাধীনতা সূচকে বাংলাদেশের ১৬ ধাপ এগোনোর কথা উল্লেখ করে তিনি বলেছেন, কথা বলার অবস্থা ছিল না। মুক্ত গণমাধ্যম সূচকে আমরা ১৬ ধাপ এগিয়েছি। রাজনৈতিক সরকার ক্ষমতায় এলে ৩২ ধাপ পেছাবো না, এ নিশ্চয়তা কে দেবে।
এ কে আজাদ বলেন, প্রেস কাউন্সিল একটি পঙ্গু ও প্যারালাইজড অর্গানাইজেশন। এর কোনো ভূমিকা নেই। সরকারের আজ্ঞাবহ প্রতিষ্ঠান।
তিনি বলেন, আপনার আমার নিরাপত্তা দেবে কে? একজন সাংবাদিক অপরাধ করলে তাকে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে জেলে মারা যেতে হবে কেন। মুশতাক আহমেদকে (কারাগারে মারা যাওয়া লেখক মুশতাক আহমেদ) কেন জীবন দিতে হয়েছে? কী অপরাধ ছিল তার? এটি নিয়ে কেউ কখনো কথা বলেছি? কথা বলার অবস্থা ছিল না।
নোয়াব সভাপতি আরও বলেন, একটা নির্দিষ্ট সময়ে নির্বাচন হবে। রাজনৈতিক সরকার ক্ষমতায় আসবে। স্বাধীনতার পর দেখেছি, কোনো সংবাদপত্র স্বাধীনভাবে ফাংশন করতে পারেনি। অবস্থা আরও খারাপ হচ্ছে। এই ১৬ শতাংশ অগ্রগতি আগামী দিনে ৩২ শতাংশ পিছিয়ে যাবে না, তার কোনো গ্যারান্টি আমরা দিতে পারবো?
সরকারের ‘সিক্রেট এজেন্সিস’ খবরে হস্তক্ষেপ করে অভিযোগ করে এ কে আজাদ বলেন, মফস্বল সাংবাদিকরা ভীতিকর অবস্থার মধ্যে সাংবাদিকতা করে। সমকালের দুই মফস্বল সাংবাদিক হত্যার শিকার হয়েছেন।
সেমিনারে আরও বক্তব্য দেন এএফপির ব্যুরো চিফ শেখ সাবিহা আলম, বিজেসির চেয়ারম্যান রেজয়ানুল হক রাজা। সেমিনার সঞ্চালনা করেন টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান।
.উৎস: Samakal
কীওয়ার্ড: ক ম ল আহম দ স ব ধ নত সরক র র র অবস থ দ বল ন
এছাড়াও পড়ুন:
‘লন্ডন বৈঠকে’ ক্ষুব্ধ জামায়াত বয়কট করল ঐকমত্য কমিশনের সংলাপ
শুধুমাত্র বিএনপির সঙ্গে বৈঠক করে নির্বাচনের সম্ভাব্য সময়সীমা নির্ধারণের প্রতিবাদে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সংলাপ বয়কট করেছে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী।
সংবিধান সংস্কারে আজ মঙ্গলবার রাজধানীর বেইলি রোডের ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে ঈদের ছুটির পর দ্বিতীয় ধাপের সংলাপ শুরু হয়। তিন দিনব্যাপী এ সংলাপে ৩০ রাজনৈতিক দল ও জোটকে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে। বিএনপি, এনসিপিসহ অন্যন্য দল এলেও আসেনি জামায়াত।
দলটির সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল এবং এতদিন সংলাপে প্রতিনিধিত্ব করা ড. হামিদুর রহমান আযাদ সমকালকে বলেন, ‘একটি দলের সঙ্গে বৈঠক করে নির্বাচনের সময়সীমা ঠিক করায়, সরকারের অবস্থান নিয়ে প্রশ্ন তৈরি হয়েছে বলে মনে করে জামায়াত। এর প্রতিবাদে জামায়াত সংলাপে যায়নি। সরকার অবস্থান পরিষ্কার করবে বলে জামায়াত আশা করে।’
আগামীকাল বুধবার এবং পরশু বৃহস্পতিবারও সংলাপ চলবে। জামায়াত সূত্র জানিয়েছে, প্রতীকী প্রতিবাদ হিসেবে আজকের সংলাপ বয়কট করা হয়েছে। কাল থেকে আলোচনায় ফিরবে জামায়াত। তবে অতীতে সংলাপে প্রতিনিধিত্ব করা একজন নেতা সমকালকে বলেছেন, ‘ঐকমত্য কমিশন নিশ্চয় আজকের সংলাপের পর জানতে চাইবে, জামায়াত কেন যোগ দেয়নি। তখন জামায়াত দলীয় অবস্থান তুলে ধরবে। ঐকমত্য কমিশনের জবাব সন্তোষজনক হলে জামায়াত সংলাপে ফিরবে।’
জানা যায়, ডিসেম্বর থেকে জুনের মধ্যে নির্বাচন হবে- সরকারের এ অবস্থানকে জামায়াত সমর্থন করলেও বিএনপি ডিসেম্বরের মধ্যে নির্বাচনের দাবিতে সরকারকে চাপে রেখেছিল। এপ্রিলের প্রথমার্থে নির্বাচনের ঘোষণাও দলটি প্রত্যাখান করেছিল।
গত ১৩ জুন লন্ডনে প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে বৈঠক করেন বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান। বৈঠকের যৌথ বিবৃতিতে বলা হয়, সংস্কার ও বিচারের অগ্রগতি সাপেক্ষে আগামী ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচন হতে পারে।
পরে দলের নির্বাহী পরিষদের বৈঠক থেকে এ যৌথ বিবৃতি নিয়ে প্রশ্ন তোলে ৫ আগস্টের পর বিএনপির নির্বাচনী প্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে ওঠার প্রচেষ্টায় থাকা জামায়াত। দলটি বলে, যৌথ বিবৃতি বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতির ব্যত্যয় বলে আমরা মনে করি। এর মাধ্যমে প্রধান উপদেষ্টার একটি দলের প্রতি বিশেষ অনুরাগ প্রকাশ করেছেন, যা তার নিরপেক্ষতা ক্ষুণ্ন করেছে।
জামায়াত ১৪ জুন বিবৃতিতে বলেছিল, সরকার প্রধান হিসেবে কোনো একটি দলের সঙ্গে যৌথ প্রেস ব্রিফিং নৈতিকভাবে কিছুতেই যথার্থ নয়। প্রধান উপদেষ্টা একটি দলের সঙ্গে বৈঠকের পর যৌথ বিবৃতি দেওয়ায় আগামী নির্বাচন অবাধ, সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য হওয়ার বিষয়ে জনগণের মধ্যে আশঙ্কা তৈরি হয়েছে। যেখানে বাংলাদেশে অনেকগুলো রাজনৈতিক দল সক্রিয়ভাবে বিদ্যমান, সেখানে শুধু একটি দলের সঙ্গে আলাপে দেশের সামগ্রিক রাজনৈতিক বিষয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা সঠিক বলে বিবেচিত হতে পারে না। জামায়াত আশা করে, অবাধ, সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের জন্য বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকার নিরপেক্ষ থেকে লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড তৈরি করবেন এবং বিচার ও সংস্কারের ব্যাপারে যথাযথ পদক্ষেপ নিশ্চিত করবেন। সরকারের নিরপেক্ষতা এবং অবাধ, সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন নিয়ে যে সংশয় দেখা দিয়েছে তা নিরসনে প্রধান উপদেষ্টার ভূমিকা জাতির সামনে স্পষ্ট করবে।
লন্ডন বৈঠকের বিষয়ে জামায়াতের শীর্ষস্থানীয় নেতারা সমকালকে বলেছিলেন, জামায়াতই প্রথম বলেছে, রমজানের আগে নির্বাচন হওয়া উচিত। তাই নির্বাচনের যে নতুন সময়সীমা বলা হচ্ছে, এ নিয়ে আপত্তির কিছু নেই। কিন্তু সরকার যেভাবে শুধু বিএনপির সঙ্গে বৈঠক করে সময়সীমা নির্ধারণ করেছে, তা অগ্রহণযোগ্য। বিএনপিকে তোয়াজ করতে লল্ডনে তারেক রহমানের সঙ্গে বৈঠক হয়েছে– ঠিক আছে। কিন্তু আলোচনার পর ঢাকায় সর্বদলীয় বৈঠক করে রমজানের আগে ভোটের ঘোষণা দিলে সব দল এবং সরকারের জন্য ভালো হতো। লন্ডন বৈঠকের পর ঘোষণা দেওয়ায় মানুষের কাছে বার্তা গেল– বিএনপিই একমাত্র রাজনৈতিক শক্তি। বিএনপির কাছেই ক্ষমতা হস্তান্তর করে বিদায় নেবে ইউনূস সরকার। এ বার্তার কারণে অন্য দলগুলো নির্বাচনের মাঠে প্রশাসন ও রাষ্ট্রযন্ত্রের প্রতিবন্ধকতায় পড়বে। এক-এগারো সরকারের তথাকথিত ‘সেফ এক্সিট’ পরিকল্পনার কারণেই ২০০৮ সালে আওয়ামী লীগ অস্বাভাবিক সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেয়েছিল। এবারও তা হবে।
জামায়াত নেতারা সমকালকে বলেন, যৌথ বিবৃতির মাধ্যমে বোঝানো হচ্ছে– সরকার এবং বিএনপি সমশক্তি। জামায়াতসহ অন্যরা গৌণ। এর প্রতিবাদেই জামায়াত সংলাপে যায়নি। যদি সরকার সবদলের প্রতি সমান আচরণ না করে, তবে জামায়াত সরকারকে সহযোগিতা অব্যাহত রাখবে কী তা ভাববে। জামায়াতের মুখপাত্র মতিউর রহমান আকন্দ সমকালকে বলেন, ‘আজ আমরা সংলাপে যাচ্ছি না।’
৩ জুন মুলতবির পর আজ শুরু হওয়া সংলাপে ৭০ অনুচ্ছেদ, সংরক্ষিত নারী আসনের নির্বাচর পদ্ধতি এবং কোন কোন সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি পদ বিরোধী দলকে দেওয়া হবে; এ বিষয়ে আলোচনা চলে। সব ইস্যুতেই বিএনপির সঙ্গে জামায়াতের মতবিরোধ রয়েছে।
জামায়াতের অবস্থান ঐকমত্য কমিশনের সুপারিশের কাছাকাছি। মৌলিক সংস্কারেও দলটির একই অবস্থান। সংস্কার প্রক্রিয়ায় যুক্ত একজন জামায়াত নেতা সমবালকে বলেছেন, ‘বিএনপি সংস্কারের প্রতি পদে পদে বাধা দিচ্ছে। জামায়াত যথাসম্ভব ছাড় দিয়ে নিজের অবস্থান বদল করেছে ঐকমত্যের স্বার্থে। তারপরও সরকার বিএনপির সঙ্গে আলোচনায় নির্বাচনের সময় নির্ধারণ করে, একপ্রকার স্বীকার করে নিয়েছে বিএনপি চাইলে সংস্কার হবে। নয়তো হবে না। বিএনপি যেসব বিষয়ে রাজি হবে, শুধু সেগুলোতেই ঐকমত্য হয়েছে ধরে জুলাই সনদ হবে। তাই সংস্কারের সংলাপ এখন অর্থহীন।’