একজন সাবেক প্রধান বিচারপতির দুই হাত পিছমোড়া করে হাতকড়া পরানো এবং তাঁকে বুলেটপ্রুফ জ্যাকেট ও হেলমেট পরিয়ে আদালতে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে—এমন দৃশ্য যেকোনো বিবেকবান মানুষের জন্যই অস্বস্তিকর। তবে গণ-অভ্যুত্থানের মুখে আরেকজন প্রধান বিচারপতির পালিয়ে সেনানিবাসে আশ্রয় নেওয়া কিংবা সাদা পোশাকধারী নিরাপত্তাকর্মীদের দ্বারা আরেকজন প্রধান বিচারপতিকে দেশ থেকে বের করে দেওয়ার ঘটনাকে সর্বশেষ এ ঘটনার চেয়ে মোটেও কম ভয়ংকর বলা যাবে না।

উদ্বেগের কথা হলো, গত আট বছরে এর সব ঘটনাই বাংলাদেশে ঘটেছে। এটি এমন এক করুণ ঘটনাক্রম, যেখানে দেখা যায়, একচ্ছত্র ক্ষমতাধর শাসক হয়ে ওঠা শেখ হাসিনা কীভাবে ঠান্ডা মাথায় ধাপে ধাপে দেশের বিচার বিভাগকে ধ্বংস করে দিয়েছিলেন।

এই ধ্বংসের অন্যতম মোড় পরিবর্তনকারী ঘটনা ছিল সংবিধানের ত্রয়োদশ সংশোধনী বাতিল করা। এই সংশোধনের মাধ্যমে নির্বাচনকালীন নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বাতিল করা হয়। এর ফলে শেখ হাসিনা টানা তিনটি একতরফা নির্বাচন আয়োজন করতে পেরেছেন এবং ক্ষমতায় নিজের অবস্থান শক্ত সংহত করেছেন।

সুপ্রিম কোর্টের এই সংশোধনী নিয়ে সিদ্ধান্ত দেওয়ার এখতিয়ার ছিল। কিন্তু তৎকালীন প্রধান বিচারপতি এ বি এম খায়রুল হকের ভূমিকা নিয়ে অনেক প্রশ্ন রয়েছে। তিনি উন্মুক্ত আদালতে ঘোষিত সংক্ষিপ্ত আদেশ পরে পাল্টে দেন এবং অবসর নেওয়ার ১৬ মাস পরে পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশ করেন। অনেকেই মনে করেন, এটি শুধু বিচারিক অসদাচরণ নয় বরং এটি ছিল প্রতারণা বা জালিয়াতির মতো কিছু।

এ ধরনের আচরণ বিচার বিভাগের নিরপেক্ষতা ও সততার যেই মান থাকা উচিত, তার বড় বিচ্যুতি। এতে বিচার বিভাগের প্রতি জনসাধারণের আস্থা অনেকটাই নষ্ট হয়েছে। অনেকে সন্দেহ করেন, পূর্ণাঙ্গ রায় দিতে ইচ্ছা করে দেরি করা হয়েছিল, যাতে শেখ হাসিনা ওই সংক্ষিপ্ত আদেশ এড়িয়ে আইন পাস করতে পারেন। কারণ, সংক্ষিপ্ত আদেশে আরও দুটি নির্বাচন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে করতে হতো। এ সুযোগটাই হাসিনা কাজে লাগান। সংসদের একটি কমিটি তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থাকে দুই মেয়াদে বহাল রাখার সুপারিশ করলেও তিনি তা উপেক্ষা করে সেটি পুরোপুরি বাতিল করে দেন।

এস কে সিনহার এই অভিজ্ঞতা আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয় যে বাংলাদেশে বিচার বিভাগকে দমন করার ঘটনা একেবারেই নতুন নয়। বলা যায়, এস কে সিনহাই ছিলেন প্রথম এবং একমাত্র প্রধান বিচারপতি, যিনি দায়িত্বে থাকা অবস্থায় সরকারের দ্বারা প্রকাশ্যে নিগৃহীত হন।

তার চেয়েও চিন্তার বিষয় হলো তৎকালীন বিচারপতি খায়রুল হকের বিরুদ্ধে এমন অভিযোগ উঠেছিল যে যখন তাঁর বেঞ্চে সরকারের বিরুদ্ধে কিছু মামলা চলছিল, সে সময় তিনি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ত্রাণ তহবিল থেকে তাঁর স্ত্রীর চিকিৎসার জন্য আর্থিক সহায়তা চেয়েছিলেন। এমন কাজ বিচারিক নৈতিকতার দিক থেকে একটি বড় আপস বা দুর্বলতাকেই সামনে আনে।

সমালোচকেরা আরও বলেন, খায়রুল হক অবসরের পরও অনেক বছর আইন কমিশনের চেয়ারম্যান হিসেবে চুক্তিভিত্তিক কাজ করে গেছেন। এই পদে তাঁর নিয়োগ বারবার বাড়ানো হয়। শেখ হাসিনার সরকারের পতন পর্যন্ত তিনি ওই পদে ছিলেন।

আশ্চর্যের বিষয় হলো, তত্ত্বাবধায়ক সরকার বাতিলসংক্রান্ত ত্রয়োদশ সংশোধনী মামলায় তিনি নিজে রায় দিয়েছিলেন—বিচারপতিরা অবসর নেওয়ার পর লাভজনক কোনো রাষ্ট্রীয় পদ গ্রহণ করতে পারবেন না। কিন্তু বাস্তবে তিনি নিজেই ঠিক সেই কাজ করেছেন। তিনি এমন একটি সরকারের অধীনে চাকরি করেছেন, যে সরকার তাঁর বিচারিক রায়েই সবচেয়ে বড় সুবিধা পেয়েছিল।

তবে খায়রুল হক আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতে (আইসিসি) বিচারক হওয়ার চেষ্টা করেও সফল হননি। শেখ হাসিনার সরকার ২০১৫ ও ২০২০ সালে তাঁকে দুবার প্রার্থী করেছিল। কিন্তু মানবাধিকার সংস্থাগুলোর প্রবল আপত্তি এবং সদস্যরাষ্ট্রগুলোর সমর্থনের অভাবে শেষ পর্যন্ত উভয়বারই তাঁর প্রার্থিতা প্রত্যাহার করে নেওয়া হয়।

সম্প্রতি খায়রুল হকের গ্রেপ্তার নিয়ে মানুষের মধ্যে মিশ্র প্রতিক্রিয়া দেখা দিয়েছে। অনেকেই অস্বস্তি বোধ করছেন, কারণ যেসব অভিযোগ বা বিচারিক অসদাচরণের কথা আগেই বলা হচ্ছিল, সেসবের কোনোটিতেই তাঁকে গ্রেপ্তার করা হয়নি। বরং তাঁকে আটক করা হয়েছে হত্যার অভিযোগে করা মামলায়, যা অনেকের কাছে বিশ্বাসযোগ্য মনে হয় না।

দুঃখের বিষয় হলো, যাদের সরকার জেলে পাঠাতে চায়, তাদের বিরুদ্ধে এখনো মিথ্যা হত্যা মামলা দিয়ে ফাঁসানো হচ্ছে। আমরা ভেবেছিলাম, একনায়কতন্ত্র শেষ হলে এসবও শেষ হবে। কিন্তু তা হয়নি। দেখা যাচ্ছে, এখনো এটি একটি জনপ্রিয় কৌশল হিসেবে টিকে আছে।

অনেকেই অনেক দিন ধরে বিচারপতি খায়রুল হকের বিরুদ্ধে অভিযোগ করেন, তাঁর কারণেই শেখ হাসিনা বিচার বিভাগকে রাজনীতির হাতিয়ার বানাতে পেরেছিলেন। তাঁরা এখন তাঁর গ্রেপ্তারে একধরনের স্বস্তি বা প্রতিশোধের অনুভূতি পাচ্ছেন। তাঁদের মতে, খায়রুল হক এমন একটি বিচারব্যবস্থা গড়ে তুলতে সাহায্য করেছেন, যা বিরোধী দলের বহু মানুষকে ন্যায়বিচার থেকে বঞ্চিত করেছে, এমনকি অনেক সময় তাদের ওপর সরকারি নির্যাতনেও ভূমিকা রেখেছে। তাই তাঁরা মনে করেন, খায়রুল হকের বিচারও সেই অনুযায়ী হওয়া উচিত।

তবে এখানেই যে গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নটি উঠে আসে, সেটি হলো: তাহলে কেন খায়রুল হককে তাঁর ত্রয়োদশ সংশোধনী রায়ের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট দুটি মামলায় গ্রেপ্তার করা হলো না?

মামলা দুটির একটিতে অভিযোগ ছিল, তিনি সংক্ষিপ্ত আদেশ থেকে রায় পাল্টে দিয়ে জালিয়াতি করেছেন। তাঁর বিরুদ্ধে আরেকটি মামলা নারায়ণগঞ্জে দায়ের হয়েছিল রাষ্ট্রদ্রোহের অভিযোগে। (হত্যা মামলায় গ্রেপ্তারের দুদিন পর তাঁকে রায় জালিয়াতির মামলাতেও গ্রেপ্তার দেখানো হয়েছে।)

কিছু আইনবিশেষজ্ঞ মনে করেন, জুডিশিয়াল ইমিউনিটি বা বিচারক হিসেবে দায়িত্ব পালনের সময় করা কাজের জন্য তাঁদের যে আইনি সুরক্ষা দেওয়া হয়, সেটি ওই দুই মামলায় খায়রুল হককে গ্রেপ্তার না দেখানোর কারণ হতে পারে। কিন্তু অন্য আইনজ্ঞরা বলছেন, ১৮৫০ সালের জুডিশিয়াল অফিসার্স প্রোটেকশন অ্যাক্ট অনুযায়ী বিচারকদের যে সুরক্ষা দেওয়ার কথা বলা আছে, তা বিচারক অবসরে যাওয়ার পর, বিশেষ করে সাধারণ নাগরিক অবস্থায় কোনো ভুল বা অপরাধ করলে তা আর তাঁর ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হয় না।

অন্যদিকে বিচারপতি এস কে সিনহা, যিনি ষোড়শ সংশোধনী বাতিল করে রায় দিয়েছিলেন (যে সংশোধনীটি বহাল থাকলে সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতিদের সংসদের কাছে জবাবদিহি করতে হতো), তিনি নিজেই লিখে জানিয়েছেন, কীভাবে ডিরেক্টরেট জেনারেল অব ফোর্সেস ইন্টেলিজেন্সের (ডিজিএফআই) কর্মকর্তারা তাঁকে আদালতের ভেতরে হেনস্তা করেছিলেন এবং শেষ পর্যন্ত তাঁকে দেশ ছাড়তে বাধ্য করা হয়েছিল।

এস কে সিনহার এই অভিজ্ঞতা আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয় যে বাংলাদেশে বিচার বিভাগকে দমন করার ঘটনা একেবারেই নতুন নয়। বলা যায়, এস কে সিনহাই ছিলেন প্রথম এবং একমাত্র প্রধান বিচারপতি, যিনি দায়িত্বে থাকা অবস্থায় সরকারের দ্বারা প্রকাশ্যে নিগৃহীত হন।

এখন বিচার বিভাগের ওপর জনগণের আস্থা ফিরিয়ে আনা আগের যেকোনো সময়ের চেয়ে বেশি জরুরি হয়ে উঠেছে। এখন বাংলাদেশের প্রয়োজন একটি এমন বিচারব্যবস্থা, যা নির্বাহী বিভাগের প্রভাব থেকে স্বাধীন থাকবে এবং যেখানে কাজ চলবে স্বচ্ছতা, সততা ও ন্যায়ের ভিত্তিতে। সে ধরনের ব্যবস্থাই এমন অবস্থা নিশ্চিত করতে পারে, যেখানে কোনো বিচারপতিকে আর অপমানজনক মামলায় ফাঁসানো হবে না কিংবা দেশ ছেড়ে পালাতে হবে না।

[ইংরেজি থেকে অনূদিত। লেখাটি গত ৩০ জুলাই ডেইলি স্টারে ছাপা হয়েছিল]

কামাল আহমেদ সাংবাদিক

* মতামত লেখকের নিজস্ব

.

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: ব ত ল কর ব যবস থ র সরক র সরক র র হয় ছ ল কর ছ ন ব চ রক অবস থ

এছাড়াও পড়ুন:

বিভিন্ন দাবি নিয়ে জাতীয় শিক্ষক ফোরাম না’গঞ্জ মহানগরের মানববন্ধন

শিক্ষাব্যবস্থা জাতীয়করণ, নিঃশর্ত বদলী, অবসর ও কল্যাণ ভাতা দ্রুত প্রদান, বৃত্তি বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানকে অংগশগ্রহণ নিশ্চিতকরণ ও ধমশিক্ষার অন্তর্ভুক্তি, কওমি সনদে সরকারি চাকুরি এবং শিক্ষা সংস্কার কমিশন গঠনের দাবিতে মানববন্ধন করেছে জাতীয় শিক্ষক ফোরাম নারায়ণগঞ্জ মহানগর। শনিবার (২ আগস্ট) দুপুরে নারায়ণগঞ্জ প্রেসক্লাবের সামনে ই মানববন্ধন অনুষ্ঠিত হয়।

জাতীয় শিক্ষক ফোরাম নারায়ণগঞ্জ মহানগরের সভাপতি আলতাফ হোসেন গাজীর সভাপতিত্বে ও সাধারণ সম্পাদক আমীর হোসেনের সঞ্চালনায় মানববন্ধনে বিশেষ অতিথি ছিলেন ইসলামী আন্দোল নারায়ণগঞ্জ মহানগরের সভাপতি ও জাতীয় শিক্ষক ফোরাম মহানগরের উপদেষ্টা মুফতি মাসুম বিল্লাহ। 

এছাড়া আরো উপস্থিত ছিলেন, নারায়ণগঞ্জ জাতীয় ফোরাম নারায়ণগঞ্জ মহানগরের সহ সভাপতি আব্দুল আলী, সাংগঠনিক সম্পাদক মোহাম্মদ মাহফুজুর রহমান ,সহ সাংগঠনিক সম্পাদক এইচ এম ইয়াসিন আরাফাত, প্রচার সম্পাদক মাওলানা আব্দুল আল মাহাতাব প্রমুখ

মানববন্ধনে বক্তারা বলেন, বাংলাদেশে শিক্ষার যে পরিস্থিতি বিগত ফ্যাসিস্ট সরকার শিক্ষাব্যবস্থাকে ধ্বংস করে দিয়েছে। মুসলমান হয়েও হিন্দুদের ধর্ম বিষয় জানতে হবে। মুসলমানদের ধর্মী বিষয় থাকা না থাকার কোনো বিষয় ছিলো না। কিন্তু হিন্দুদের ধর্মীয় বিষয় জানতে হবে এমন একটি বিষয় ছিলো।

বিগত সময় বাংলাদেশে যে কঠিন পরিস্থিতি গেছে এ কঠিন পরিস্থিতি থেকে উত্তোলনের জন্য বর্তমান সরকার কাছে দাবি জানাই শিক্ষাব্যস্থাকে উন্নত করার জন্য বিশে^র সাথে তাল মিলিয়ে এদেশের শিক্ষা, সংস্কৃতি গুরুত্ব দিয়ে শিক্ষাব্যবস্থা গড়তে হবে।

বক্তারা আরও বলেন , ১৯৭১ সালে এই দেশ স্বাধীন হবার ৫৪ বছরে যে সকরার কায়েম হয়েছে। প্রত্যেকটি সরকারে ধারা এই দেশের  মানুষের সাথে বৈষম্য শিকার হয়েছে। বিশেষ করে শিক্ষক সমাজ। শিক্ষকরা হচ্ছে জাতিগড়ার কারিগর। সেই শিক্ষকরা দাবি আদায়ের জন্য আন্দোলন ও কর্মসূচি পালন করতে হয়েছে। কিন্তু কাক্ষিত ফল শিক্ষকরা পায় নাই। 

এই মানববন্ধনে থেকে আমাদের দাবি হচ্ছে বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোকে জাতীয় করণ করা এবং সকারি ভাবে প্রতিষ্ঠান গুলো যেভাবে বদলি হতে পারে সে ব্যবস্থা করতে হবে। তার সাথে আরো দাবি জানাই অবসর ভাতা দ্রুত যাতে পেতে পারে তার দাবি জানাই। বৃত্তি পরীক্ষার আওতায় সকল ধর্মের ব্যবস্থা করতে হবে। 
 

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • বিভিন্ন দাবি নিয়ে জাতীয় শিক্ষক ফোরাম না’গঞ্জ মহানগরের মানববন্ধন